مُتَّفِقٌ لَفْظًا وَخَطّاً مُتَّفِقْ | وَضِدُّهُ فِيْمَا ذَكَرْنَا الْمُفْتَرِقْ
“লিখায় ও উচ্চারণে অভিন্ন নাম মুত্তাফিক, আর আমরা যা উল্লেখ করেছি তার বিপরীত মুখতালিফ।” অত্র কবিতায় বর্ণিত ক্রমানুসারে হাদিসের অষ্টাবিংশ প্রকার মুত্তাফিক ও মুফতারিক। লেখকের বর্ণনা পদ্ধতি থেকে মুত্তাফিক ও মুফতারিক দু’প্রকার বুঝে আসে, বস্তুত ‘মুত্তাফিক ও মুফতারিক’ এক প্রকার। এ প্রকারের সম্পর্ক সনদের সাথে।
‘মুত্তাফিক ও মুফতারিক’ আভিধানিকভাবে এমন দু’টি বস্তুকে বলা হয়, যাদের মাঝে কোনো বিষয়ে মিল ও কোনো বিষয়ে অমিল রয়েছে, যেমন বলা হয়: قوم متفق ومفترق অর্থ ‘এমন জাতি, যাদের দীন এক, তবে মত বিভিন্ন’। দীন এক হওয়ার কারণে তারা মুত্তাফিক, মতামত বিভিন্ন কারণে তারা মুফতারিক।
متفق ومفترق এর পারিভাষিক সংজ্ঞা প্রসঙ্গে লেখক বলেন: ‘যে রাবিদের নাম লেখায় ও উচ্চারণ এক কিন্তু তাদের ব্যক্তি সত্ত্বা ভিন্ন তাই ‘মুত্তাফিক ও মুফতারিক’।
রাবিদের নামেই লিখায় ও উচ্চারণে মিল সীমাবদ্ধ থাকে না, কখনো তার পরিধি আরো বর্ধিত হয়, যেমন রাবিদের নাম ও তাদের পিতার নাম এক। কখনো রাবিদের নাম, পিতার নাম ও দাদার নাম পর্যন্ত এক হয়, তাদের বংশ এক হলে মিলের পরিসর আরো বর্ধিত হয়। রাবিদের নাম, কিংবা উপনাম, কিংবা বংশ এক হলে শব্দের বিচারে ‘মুত্তাফিক’ বলা হয়, ব্যক্তি সত্ত্বার বিচারে ‘মুফতারিক’ বলা হয়। উদাহরণত সনদে কোনো রাবির নাম আব্দুল্লাহ, আব্দুল্লাহ নামে সেকাহ ও গায়রে সেকাহ একস্তরে দু’জন রাবি রয়েছে। তাদের দু’জন থেকে খালিদ নামক রাবি হাদিস শ্রবণ করেছেন। খালিদ যখন বললেন: আমাকে আব্দুল্লাহ বলেছেন। আমরা তার হাদিস সম্পর্কে সহি বা দ্বা‘ঈফ ফয়সালা করব না, যতক্ষণ না আমাদের নিকট স্পষ্ট হয় তার উস্তাদ কোন্ আব্দুল্লাহ? সেকাহ আব্দুল্লাহ হলে হাদিস সহি, দুর্বল আব্দুল্লাহ হলে হাদিস দ্বা‘ঈফ। তারা উভয়ে সেকাহ হলে যাচাই ব্যতীত সহি বলা যেত। এ প্রকার হাদিস মুত্তাফিক ও মুফতারিক নামে পরিচিত।
‘ইত্তিফাক ও ইফতিরাক’ কখনো শুধু রাবির নামে হয়; কখনো রাবি ও তার পিতার নামে হয়; কখনো রাবি, রাবির পিতা ও দাদার নামে হয়। ‘ইত্তিফাক ও ইফতিরাক’কে উসুলে হাদিসের কিতাবে আট প্রকারে ভাগ করা হয়েছে:
১. একাধিক রাবির নাম ও পিতার নাম এক, যেমন: খলিল ইব্ন আহমদ নামে ছয়জন ব্যক্তি রয়েছে, যথা:
ক. আবু আব্দুর রহমান খলিল ইব্ন আহমদ নাহবি। তিনি আরবি ভাষাবিদ ‘সিবওয়েহ’-এর উস্তাদ। মুসলিম উম্মায় তাদের নবীর নামানুসারে খলিলের পিতার নাম সর্বপ্রথম আহমদ রাখা হয়।
খ. আবু বশির খলিল ইব্ন আহমদ মুযানি।
গ. খলিল ইব্ন আহমদ ইস্পাহানী।
ঘ. আবু সায়িদ খলিল ইব্ন আহমদ সাজাজি, হানাফি।
ঙ. আবু সায়িদ খলিল ইব্ন আহমদ বুসতি।
চ. আবু সায়িদ খলিল ইব্ন আহমদ বুসতি, শাফেয়ি।
২. রাবিদের নাম, পিতার নাম ও দাদার নাম এক, যেমন: আহমদ ইব্ন জাফর ইব্ন হামদান নামে একস্তরে চারজন রাবি আছেন, তাদের সবার শায়খ আব্দুল্লাহ।
ক. আবু বকর আহমদ ইব্ন জাফর ইব্ন হামদান ইব্ন মালিক ইব্ন শাবিব ইব্ন আব্দুল্লাহ আল-কাতিয়ি।
খ. আবু বকর আহমদ ইব্ন জাফর ইব্ন হামদান সাকতি।
গ. আহমদ ইব্ন জাফর ইব্ন হামদান দিনুরি।
ঘ. আহমদ ইব্ন জাফর ইব্ন হামদান তারতুসি।
৩. রাবিদের বংশ ও উপনাম এক, যেমন আবু ইমরান আল-জুনি নামে দু’জন রাবি রয়েছে:
ক. আবু ইমরান আব্দুল মালিক আল-জুনি তাবে‘ঈ,
খ. আবু ইমরান মুসা ইব্ন সাহাল আল-বুসাইরি আল-জুনি।
৪. রাবির নাম, পিতার নাম ও বংশ মুত্তাফিক। কাছাকাছি তবকার এরূপ দু’জন রাবি আছেন, দু’জনই আনসারি, যেমন: মুহাম্মদ ইব্ন আব্দুল্লাহ আল-আনসারি।
ক. কাদি আবু আব্দুল্লাহ মুহাম্মদ ইব্ন আব্দুল্লাহ ইব্নুল মুসান্না ইব্ন আব্দুল্লাহ ইব্ন আনাস ইব্ন মালিক আল-আনসারি আল-বসরি।
খ. আবু সালামাহ মুহাম্মদ ইব্ন আব্দুল্লাহ ইব্ন যিয়াদ আল-আনসারি আল-বসরি।
তাদের উভয়ের উস্তাদ: ১. হুমাইদ আত-তাওয়িল, ২. সুলাইমান আত-তাইমি, ৩. মালিক ইব্ন দিনার, ও ৪. কুররাহ ইব্ন খালিদ।
৫. উপনাম ও পিতার নাম মুত্তাফিক, যেমন আবু বকর ইব্ন ‘আইয়াশ, এরূপ তিনজন রাবি রয়েছেন।
ক. আবু বকর ইব্ন ‘আইয়াশ সালেম আল-আসাদি আল-কুফি, তিনি কারি ‘আসেম’ এর কিরাতের রাবি।
খ. আবু বকর ইব্ন ‘আইয়াশ হিমসি।
গ. আবু বকর ইব্ন ‘আইয়াশ সুলামি।
৬. রাবির নাম ও পিতার উপনাম মুত্তাফিক। এ প্রকার পঞ্চম প্রকারের বিপরীত, যেমন সালেহ ইব্ন আবু সালেহ নামে চারজন আছেন।
ক. সালেহ ইব্ন আবু সালেহ আল-মাদানি। তিনি আবু হুরায়রা, ইব্ন আব্বাস প্রমুখ সাহাবিদের থেকে বর্ণনা করেন।
খ. সালেহ ইব্ন আবু সালেহ যাকওয়ান আস-সুমান, তিনি আনাস রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণনা করেন।
৭. রাবির নাম, অথবা উপনাম, অথবা বংশ মুত্তাফিক, যেমন হাম্মাদ নামে দু’জন ও আব্দুল্লাহ নামে একাধিক রাবি আছেন।
ক. হাম্মাদ ইব্ন যায়েদ,
খ. হাম্মাদ ইব্ন সালামাহ।
আব্দুল্লাহ নামে অনেক রাবি আছেন। সালামাহ ইব্ন সুলাইমান বলেছেন: যদি মক্কায় আব্দুল্লাহ বলা হয়, তার অর্থ আব্দুল্লাহ ইব্ন জুবাইর; যদি মদিনায় আব্দুল্লাহ বলা হয়, তার অর্থ আব্দুল্লাহ ইব্ন ওমর; যদি কুফায় আব্দুল্লাহ বলা হয়, তার অর্থ আব্দুল্লাহ ইব্ন মাসউদ; যদি বসরায় আব্দুল্লাহ বলা হয়, তার অর্থ আব্দুল্লাহ ইব্ন আব্বাস; যদি খোরাসানে আব্দুল্লাহ বলা হয়, তার অর্থ আব্দুল্লাহ ইব্নুল মুবারক; যদি শামে আব্দুল্লাহ বলা হয়, তার অর্থ আব্দুল্লাহ ইব্ন আমর ইব্নুল আস। তারা সবাই সত্ত্বার বিবেচনায় মুফতারিক, তবে নামের বিবেচনায় মুত্তাফিক।
৮. রাবিদের বংশের নাম মুত্তাফিক, তবে বাস্তবের বিবেচনায় মুফতারিক, যেমন হানাফি দ্বারা বনু হানাফিয়া ও মাযহাবে হানাফি উভয় বুঝায়। বনু হানিফা বংশের রাবি:
ক. আবু বকর আব্দুল কাবির ইব্ন আব্দুল মাজিদ আল-হানাফি এবং তার ভাই উবাইদুল্লাহ হানাফি থেকে ইমাম বুখারি ও ইমাম মুসলিম হাদিস বর্ণনা করেছেন।
জ্ঞাতব্য: ‘মুত্তাফিক ও মুফতারিকে’র জন্য দুই বা ততোধিক রাবির এক যুগের মুহাদ্দিস, কিংবা এক উস্তাদের ছাত্র, কিংবা উভয় থেকে কোনো রাবি বর্ণনা করেছেন এরূপ হওয়া জরুরি, যেন তাদের নির্ণয়ে জটিলতা সৃষ্টি হয়, তাহলে মুত্তাফিক ও মুফতারিক হবে। যদি তাদের নির্ণয়ে জটিলতা সৃষ্টি না হয়, তাহলে ‘মুত্তাফিক ও মুফতারিক’ হবে না, যেমন তাদের যুগ এক নয়, কিংবা তাদের উস্তাদ এক নয়, কিংবা তাদের ছাত্র এক নয়, তাই এসব ক্ষেত্রে ‘মুত্তাফিক ও মুফতারিক’ হবে না।
মুহমাল:
দু’জন রাবির নাম এক, কিন্তু কাউকে পৃথক করে বর্ণনা করা হয়নি, ফলে তাদের চিহ্নিত করা দুষ্কর। এরূপ রাবিদের মুহমাল বলা হয়, যেমন বুখারিতে আহমদ নামে একজন রাবি আছেন, তার ছাত্র ইব্ন ওহাব নির্দিষ্ট করে বলেননি আহমদকে: আহমদ ইব্ন সালেহ, না আহমদ ইব্ন ঈসা। তাই আহমদ মুহমাল।