عَزِيزُ مَرْوِيْ اثْنَيْنِ أوْ ثَلاثَهْ |مَشْهُورُ مَرْوِيْ فَوْقَ ما ثَلاثَهْ
“আযিয”: দুই অথবা তিনজন রাবির বর্ণিত হাদিস। আর “মাশহূর” তিনের অধিক রাবির বর্ণিত হাদিস”। অত্র কবিতায় বর্ণিত ক্রমানুসারে হাদিসের নবম ও দশম প্রকার আযিয ও মাশহূর।
এখান থেকে লেখক রাবির সংখ্যা অনুসারে হাদিসকে ভাগ করছেন। রাবির সংখ্যা অনুসারে হাদিস দু’প্রকার: মুতাওয়াতির ও আহাদ বা খবরে ওয়াহেদ। খবরে ওয়াহেদ তিন প্রকার: ১. গরিব, ২. আযিয, ৩. মাশহূর বা মুস্তাফিধ। লেখক রাহিমাহুল্লাহ্ এখানেও বর্ণনার ধারাক্রম রক্ষা করেননি। ১৬-পঙক্তির দ্বিতীয়াংশে তিনি গরিব বর্ণনা করেছেন। মুতাওয়াতির হাদিস তিনি বর্ণনা করেননি। আমরা প্রথমে আযিয ও মাশহূর বর্ণনা করব অতঃপর সম্পূরক হিসেবে মুতাওয়াতির বর্ণনা করব।
عزيز শব্দ عز থেকে সংগৃহীত, আভিধানিক অর্থ শক্তিশালী। কেউ শক্তিশালী হলে বলা হয়: عَزَّ فُلانٌ একজন রাবির কোনো সংবাদ দেওয়ার পর দ্বিতীয় বা তৃতীয় রাবি একই সংবাদ দিলে সংবাদটি ‘আযিয’ বা শক্তিশালী হয়। সংবাদদাতার সংখ্যা বেশী হলে সংবাদের গ্রহণযোগ্যতা বৃদ্ধি পায়। এ থেকে দু’জন বা তিনজন রাবির বর্ণিত হাদিসকে ‘আযিয’ বলা হয়।
‘আযিয’-র পারিভাষিক সংজ্ঞা প্রসঙ্গে লেখক রাহিমাহুল্লাহ্ বলেন: ‘দু’জন অথবা তিনজন রাবির বর্ণিত হাদিস আযিয’। সনদের কোনো স্তরে যদি দু’জন অথবা তিনজন রাবি থাকে, অন্যান্য স্তরে রাবির সংখ্যা দুই বা দু’য়ের অধিক থাকলে হাদিস আযিয। রাবির সংখ্যা দু’জন শর্তারোপের ফলে গরিব থেকে পৃথক হল, কারণ ‘গরিব’-এ সর্বনিম্ন রাবির সংখ্যা একজন।
লেখক রাহিমাহুল্লাহ্ أوْ ثَلاثهْ বলে আযিযের দ্বিতীয় প্রকার বর্ণনা করেছেন। হাদিসের সনদে কোনো স্তরে রাবির সংখ্যা তিনজন হলে আযিয। কারণ দ্বিতীয় দু’টি সংবাদের ফলে প্রথম সংবাদ শক্তিশালী হয়, তাই আযিয বলা হয়, তবে অধিকাংশ আলেমের মতে তিনজন রাবির বর্ণিত হাদিস মাশহূর।
লেখক আযিযের সংজ্ঞার ক্ষেত্রে অধিকাংশ মুহাদ্দিসের খিলাফ করেছেন, তাদের নিকট সনদের কোনো স্তরে সর্বনিম্ন দু’জন রাবি হলে আযিয, আর তিনজন রাবি হলে মাশহূর।
হাফেয ইব্ন হাজার রাহিমাহুল্লাহ্ ‘নুখবায়’ বলেন: ‘দু’জন রাবির বর্ণিত হাদিস আযিয, তিনজন বা তার চেয়ে অধিক রাবির বর্ণিত হাদিস মাশহূর ও একজন রাবির বর্ণিত হাদিস গরিব’। এ সংজ্ঞা অধিকাংশ মুহাদ্দিসের নিকট পছন্দনীয়। ‘আযিযে’র উদাহরণ:
قال الإمام البخاري –رحمه الله- حَدَّثَنَا أَبُو الْيَمَانِ، قَالَ: أَخْبَرَنَا شُعَيْبٌ، قَالَ: حَدَّثَنَا أَبُو الزِّنَادِ، عَنِ الْأَعْرَجِ، عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُ، أَن رَسُولَ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَالَ: «فَوَالَّذِي نَفْسِي بِيَدِهِ، لَا يُؤْمِنُ أَحَدُكُمْ حَتَّى أَكُونَ أَحَبَّ إِلَيْهِ مِنْ وَالِدِهِ وَوَلَدِهِ»
وقال الإمام البخاري –رحمه الله- حَدَّثَنَا يَعْقُوبُ بْنُ إِبْرَاهِيمَ، قَالَ: حَدَّثَنَا ابْنُ عُلَيَّةَ، عَنْ عَبْدِ الْعَزِيزِ بْنِ صُهَيْبٍ، عَنْ أَنَسٍ، عَنِ النَّبِيِّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ وحَدَّثَنَا آدَمُ، قَالَ: حَدَّثَنَا شُعْبَةُ، عَنْ قَتَادَةَ، عَنْ أَنَسٍ، قَالَ: قَالَ النَّبِيُّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: «لَا يُؤْمِنُ أَحَدُكُمْ حَتَّى أَكُونَ أَحَبَّ إِلَيْهِ وَالِدِهِ وَوَلَدِهِ وَالنَّاسِ أَجْمَعِينَ»
ইমাম বুখারি উক্ত হাদিস দু’জন সাহাবি: আবু হুরায়রা ও আনাস ইব্ন মালিক থেকে দু’টি সনদে বর্ণনা করেন। তাই এতে সাহাবির স্তরে দু’জন রাবি বিদ্যমান।[1] অতঃপর আনাস রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে দু’জন তাবে‘ঈ বর্ণনা করেন: কাতাদাহ ও আব্দুল আযিয ইব্ন সুহাইব। অতএব তাবে‘ঈর স্তরে দু’জন রাবি বিদ্যমান। অতঃপর কাতাদাহ থেকে দু’জন রাবি বর্ণনা করেন: শু‘বা ও সায়িদ ইব্ন আবি ‘আরুবাহ। আবার আব্দুল আযিয থেকে দু’জন রাবি বর্ণনা করেন: ইসমাইল ইব্ন ‘উলাইয়্যাহ ও আব্দুল ওয়ারেস ইব্ন সায়িদ। অতঃপর তাদের প্রত্যেকের থেকে একদল রাবি বর্ণনা করেন।
যাকারিয়া আনসারি রাহিমাহুল্লাহ্ বলেন: ‘একটি হাদিস একসাথে আযিয ও মাশহূর উভয় হতে পারে, যেমন:
«نَحْنُ الْآخِرُونَ السَّابِقُونَ يَوْمَ الْقِيَامَةِ»
“আমরা পরবর্তী কিন্তু কিয়ামতের দিন অগ্রবর্তী”।[2] এ হাদিস নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে দু’জন সাহাবি: হুযায়ফা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু ও আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু বর্ণনা করেন”।[3] অতএব সাহাবিদের স্তরে এ হাদিস আযিয, অবশ্য পরবর্তীতে মাশহূর হয়েছে[4]।
বাইকুনির ব্যাখ্যাকার আবুল হাসান সুলাইমানি রাহিমাহুল্লাহ্ বলেন: “আমার নিকট আযিয হওয়ার জন্য সাহাবির স্তরেও দু’জন থাকা জরুরি। কেউ বলতে পারেন: সকল সাহাবি আদিল, অতএব তাদের ক্ষেত্রে সংখ্যার হিসেবে কেন? এ প্রশ্নের উত্তর: এ শর্ত হাদিস গ্রহণ কিংবা বর্জন করা হিসেবে নয়, বরং আমাদের নিকট হাদিস পৌঁছার সনদের হিসেবে, কোন সনদে পৌঁছল, রাবির সংখ্যা কত ও কিভাবে পৌঁছল ইত্যাদি। তাই এ প্রকার কখনো সহি ও কখনো দুর্বল হয়। সাহাবিদের পরবর্তী স্তরে রাবিদের সংখ্যা হাদিসের বিশুদ্ধতা যাচাইয়ের জন্য দেখা হয় না, কারণ একটি হাদিস কখনো দু’জন সেকাহ রাবি বর্ণনা করেন, কখনো দু’জন দুর্বল রাবি বর্ণনা করেন, আবার কখনো দু’জন মাতরুক রাবি বর্ণনা করেন। সংখ্যার দৃষ্টিকোন থেকে বর্ণনাকারী দু’জন হলেই আযিয। এটা শুধু পরিভাষা।[5]
লেখক রাহিমাহুল্লাহ্ আযিযের জন্য মারফূ‘ হওয়া শর্তারোপ করেননি, শুধু দু’জন রাবি হওয়া শর্তারোপ করেছেন, তাই মারফূ‘, মাওকুফ ও মাকতু‘ সবগুলোতেই আযিয হতে পারে।
কেউ বলেন: সহি হাদিসের জন্য দু’জন রাবি কর্তৃক বর্ণিত তথা আযিয হওয়া জরুরি, কারণ সাক্ষীর ন্যূনতম সংখ্যা দু’জন। নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের বাণী সাক্ষীর চেয়ে কম মর্যাদার নয়, তাই তাতেও দু’জন সাক্ষী প্রয়োজন।
এ কথা সঠিক নয়, কারণ সাক্ষীর সাথে হাদিসের তুলনা খাটে না। হাদিস বলা ও সাক্ষ্য দেওয়া এক নয়। হাদিস দীনি বিষয়, তার জন্য একজন রাবিই যথেষ্ট, যেমন একজন মুয়াজ্জিনের উপর নির্ভর করে মুসলিমগণ ইফতার করে। অতএব দীনি বিষয়ে নির্ভরযোগ্য একজন রাবি যথেষ্ট। তার প্রমাণ নিয়তের হাদিস:
«إِنَّمَا الْأَعْمَالُ بِالنِّيَّاتِ، وَإِنَّمَا لِكُلِّ امْرِئٍ مَا نَوَى، فَمَنْ كَانَتْ هِجْرَتُهُ إِلَى دُنْيَا يُصِيبُهَا أَوْ إِلَى امْرَأَةٍ يَنْكِحُهَا، فَهِجْرَتُهُ إِلَى مَا هَاجَرَ إِلَيْهِ»
“সকল আমল নিয়তের সাথে গ্রহণযোগ্য, প্রত্যেক ব্যক্তির জন্য তাই রয়েছে যা সে নিয়ত করেছে। অতএব যার হিজরত দুনিয়ার প্রতি, যা সে উপার্জন করবে, অথবা নারীর প্রতি, যাকে সে বিয়ে করবে, তাহলে তার হিজরত সে জন্য হবে, যার প্রতি সে হিজরত করেছে”।[6]
সকল আলেম এ হাদিস গ্রহণ করেছেন, অথচ সাহাবি থেকে পরবর্তী তিনস্তর পর্যন্ত একজন করে রাবি, তবে সবাই সেকাহ। অতএব সহি হওয়ার জন্য আযিয হওয়া জরুরি নয়।
আযিযের হুকুম: সহি, হাসান ও দুর্বল সকল প্রকার হতে পারে।
[2] বুখারি: (৮৩২), মুসলিম: (১৪১৮)
[3] ফাতহুল বারি: (পৃ.৪৯০), দেখুন: আল-জাওয়াহিরুস সুলাইমানিয়াহ: (পৃ.১৬৩)
[4] এখানে মতভেদটি হচ্ছে, সাহাবীর স্তরে একাধিক বর্ণনাকারী হওয়ার বিষয়টি ধর্তব্য কি না? যদি ধর্তব্য হয়, তবে এ হাদিসটি অবশ্যই আযিয হিসেবেই গণ্য হবে, পরবর্তীতে যতই এর বর্ণনাকারীর সংখ্যা বেশি হোক না কেন। আর যদি সাহাবীকে বর্ণনাকারীর সংখ্যা থেকে বাদ দেওয়া হয় এ ভিত্তিতে যে তাঁরা সবাই আদিল, তাদের একজন অন্যদের বহু জনের মত, তখন সেখানে হাদীসটি সাহাবী পরবর্তী অবস্থার দিকে তাকিয়ে আযিয কিংবা মাশহূর এমনকি মুতাওয়াতির হিসেবে গণ্য হতে পারে। কিন্তু মুহাদ্দিসদের আলোচনাদৃষ্টে প্রতীয়মাণ হয় যে, তাঁরা সাহাবীসহ সর্বস্তরের সংখ্যাকেই হিসেবে নিয়ে আসেন। সে হিসেবে উপরোক্ত হাদীসটি আযিয হিসেবেই গণ্য হবে মাশহূর নয়। কারণ, এ শাস্ত্রের নিয়ম হচ্ছে, সংখ্যাস্বল্পতা সংখ্যধিক্যের উপর প্রাধান্য পায়। কোথাও কোনো এক স্তরে সংখ্যা কম হলে সেটাই ধর্তব্য হবে, বেশির অংশ নয়। [সম্পাদক]
[5] আল-জাওয়াহিরুস সুলাইমানিয়াহ: (পৃ.১৬৩)
[6] বুখারি: (১), মুসলিম: (১৯১০)