مِثْلُ أما وَاللهِ أنْباني الفَتى |
مُسَلْسَلٌ قُلْ ما على وَصْفٍ أتى |
أوْ بَعْدَ أنْ حَدَّثَني تَبَسَّما |
كَذَاكَ قَدْ حَدَّثَنِيهِ قائما |
‘মুসালসাল’ বল সে হাদিসকে, যে হাদিস একই বিশেষণে এসেছে, যেমন আল্লাহর শপথ আমাকে শায়খ বলেছেন। অনুরূপ তিনি আমাকে দাঁড়িয়ে বলেছেন, অথবা আমাকে বর্ণনার পর তিনি হেসেছেন’।
অত্র কবিতায় বর্ণিত ক্রমানুসারে হাদিসের অষ্টম প্রকার মুসালসাল। মুসালসালের সম্পর্ক সনদ ও মতন উভয়ের সাথে।
مُسَلْسَلٌ এর আভিধানিক অর্থ পরম্পরাযুক্ত। বলা হয়: فُلَانٌ سَلْسَلَ الأَشْيَاءَ ‘অমুক ব্যক্তি বস্তুসমূহকে একটির সাথে অপরটি সংযুক্ত করেছে বা ক্রমানুসারে শিকলে গেঁথেছে’। এ থেকে একাধিক রাবি হাদিসের সনদ বা মতনে ক্রমান্বয়ে একই পদ্ধতি অনুসরণ করলে মুসালসাল বলা হয়।
‘মুসালসালে’র পারিভাষিক সংজ্ঞা প্রসঙ্গে লেখক বলেন: ‘যে হাদিসের সনদ বা মতন এক স্তরের সকল রাবি অভিন্ন শব্দ বা অভিন্ন হালতে বর্ণনা করে তাই মুসালসাল’। যেমন কোনো সনদে এক স্তরের সকল রাবি বললেন: أنْبأنِي فُلَانٌ (প্রথম শায়খ), তিনি বললেন: أنْبأنِي فُلَانٌ (দ্বিতীয় শায়খ), এভাবে (তৃতীয় শায়খ) বললেন। এখানে সনদটি أنْبأنِي দ্বারা মুসালসাল হয়েছে।[1]
কখনো রাবিদের অবস্থা মুসালসাল হয়, যেমন সনদের প্রথম রাবি বলল: حدثني فلان قائماً ‘অমুক শায়খ আমাকে দাঁড়িয়ে বলেছে, দ্বিতীয় রাবি বলল: حدثني فلان قائماً এভাবে তৃতীয়, চতুর্থ ও সর্বশেষ রাবি বলল, কারণ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম দাঁড়িয়ে বলেছেন।
অথবা প্রত্যেক রাবি বললেন, হাদিস বর্ণনা শেষে আমার শায়খ হেসেছেন। যেমন, আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত, নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম রমযানে সহবাসকারী ব্যক্তিকে কাফফারা আদায়ের জন্য সদকা দিলেন, অতঃপর লোকটি বলল:
«أَعَلَى أَفْقَرَ مِنِّي يَا رَسُولَ اللَّهِ، فَوَاللَّهِ مَا بَيْنَ لَابَتَيْهَا يُرِيدُ الْحَرَّتَيْنِ أَهْلُ بَيْتٍ أَفْقَرُ مِنْ أَهْلِ بَيْتِي، فَضَحِكَ النَّبِيُّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ حَتَّى بَدَتْ أَنْيَابُهُ، ثُمَّ قَالَ: أَطْعِمْهُ أَهْلَكَ»
“হে আল্লাহর রাসূল, আমার চেয়ে গরিব কাউকে কাফফারা দিব? আল্লাহর কসম মদিনার দু’প্রান্তের মাঝে আমার চেয়ে গরিব কেউ নেই, ফলে নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম হেসে দিলেন যে, তার মাড়ির দাঁত পর্যন্ত বেড়িয়েছিল। অতঃপর তিনি বলেন: তোমার পরিবারকে তা খেতে দাও”।[2] সেই থেকে প্রত্যেক রাবি এ হাদিস বর্ণনা শেষে হাসেন। এটা রাবির অবস্থার মুসালসাল।
লেখক মুসালসালের তিনটি উদাহরণ দিয়েছেন, একটি সনদের মুসালসাল, দু’টি রাবির অবস্থার মুসালসাল। তিনি মতনের মুসালসাল উল্লেখ করেননি। সম্পূরক হিসেবে আমরা মতনের মুসালসাল উল্লেখ করছি। নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম মু‘আয ইব্ন জাবাল রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুকে বলেন:
«يَا مُعَاذُ، وَاللَّهِ إِنِّي لَأُحِبُّكَ، وَاللَّهِ إِنِّي لَأُحِبُّكَ، فَقَالَ: أُوصِيكَ يَا مُعَاذُ لَا تَدَعَنَّ فِي دُبُرِ كُلِّ صَلَاةٍ تَقُولُ: اللَّهُمَّ أَعِنِّي عَلَى ذِكْرِكَ وَشُكْرِكَ وَحُسْنِ عِبَادَتِكَ»
“হে মু‘আয, আল্লাহর শপথ আমি তোমাকে মহব্বত করি, আল্লাহর শপথ আমি তোমাকে মহব্বত করি, অতঃপর তিনি বলেন: হে মু‘আয আমি তোমাকে উপদেশ দিচ্ছি, তুমি প্রত্যেক সালাতের পর কখনো বলা ত্যাগ করবে না:
«اللَّهُمَّ أَعِنِّي عَلَى ذِكْرِكَ وَشُكْرِكَ وَحُسْنِ عِبَادَتِكَ»
‘হে আল্লাহ তুমি আমাকে সাহায্য কর তোমার যিকিরের উপর [মৌখিক ইবাদত], তোমার শুকুরের উপর [শারীরিক ইবাদত] এবং ইহসানের সাথে তোমার [ফরয] ইবাদত আদায়ের উপর”।[3] মু‘আয স্বীয় ছাত্র সুনাবিহিকে রাসূলের ন্যায় অসিয়ত করেন, তিনি স্বীয় ছাত্র আবু আব্দুর রহমানকে মু‘আযের ন্যায় অসিয়ত করেছেন। এখানে হাদিসের মতনে মুসালসাল হয়েছে, কারণ প্রত্যেক শায়খ স্বীয় ছাত্রকে বলেছেন:وأنا أحبُّك আমিও তোমাকে মহব্বত করি।
উপরোক্ত আলোচনা থেকে স্পষ্ট হল যে, মুসালসাল প্রথমত দু’প্রকার: ১. রাবির অবস্থার মুসালসাল, ও ২. বর্ণনা পদ্ধতির মুসালসাল। বর্ণনা পদ্ধতির মুসালসাল কখনো হয় সনদে, কখনো হয় মতনে।
ইমাম নববি রাহিমাহুল্লাহ্ মুসালসালের সংজ্ঞা প্রসঙ্গে বলেন:
"هو ما تتابع رجال إسناده على صفة أو حالة للرواة تارة، وللرواية تارة أخرى"
“যে হাদিসের সনদের রাবিগণ কোনো বিশেষণ অথবা রাবিদের বিশেষ অবস্থা কিংবা বর্ণনার বিশেষ পদ্ধতি ক্রমান্বয়ে বজায় রাখেন তাই মুসালসাল”।[4] ইমাম নববির সংজ্ঞা থেকে স্পষ্ট যে, মুসালসাল হাদিসের রাবিগণ বিশেষ বিশেষণ অথবা রাবিদের বিশেষ অবস্থা অথবা বর্ণনার বিশেষ পদ্ধতি সকল স্তরে রক্ষা করবেন, তবে কতক মুসালসাল রয়েছে, যার সকল স্তরে পরম্পরা রক্ষা হয়নি। তাই ইব্নু দাকিকিল ‘ঈদ রাহিমাহুল্লাহ্ বলেন:
"وهو ماكان إسناده على صفة واحدة في طبقاته، فتارة يكون في جميعها، كما إذا كان كله بصيغة: سمعت فلانا يقول، إلى آخره، وتارة يكون في أكثره، مثل الحديث المسلسل بقولهم: (وهو أول حديث سمعته منه ..." الاقتراح: (صـ214)
“যে হাদিসের সনদ একাধিক স্তরে বিশেষ পদ্ধতিতে বর্ণিত হয়, কখনো বিশেষ পদ্ধতি বহাল থাকে সকল স্তরে, যেমন সনদের প্রত্যেক রাবি বলল: سمعت فلانا يقول কখনো বহাল থাকে অধিকাংশ স্তরে, যেমন وهو أول حديث سمعته منه পদ্ধতিতে বর্ণিত হাদিস। ইমাম সুয়ূতি جياد المسلسلات গ্রন্থে বর্ণনা করেন:
حَدَّثَنِي بِهِ أَبُو هُرَيْرَةَ بْنُ الْمُلَقِّنِ، مِنْ لَفْظِهِ، وَهُوَ أَوَّلُ حَدِيثٍ سَمِعْتُهُ مِنْهُ. قَالَ: حَدَّثَنَا جَدِّي، وَهُوَ أَوَّلُ حَدِيثٍ سَمِعْتُهُ مِنْهُ. قَالَ: حَدَّثَنَا أَبُو الْفَتْح الْمَيْدُومِيُّ، وَهُوَ أَوَّلُ حَدِيثٍ سَمِعْتُهُ مِنْهُ. قَالَ: حَدَّثَنَا أَبُو الْفَرَجِ الْحَرَّانِيُّ، وَهُوَ أَوَّلُ حَدِيثٍ سَمِعْتُهُ مِنْهُ. قَالَ: حَدَّثَنَا أَبُو الْفَرَجِ بْنُ الْجَوْزِيِّ وَهُوَ أَوَّلُ حَدِيثٍ سَمِعْتُهُ مِنْهُ. قَالَ: حَدَّثَنَا أَبُو سَعْدٍ إِسْمَاعِيلُ بْنُ أَبِي صَالِحٍ النَّيْسَابُورِيُّ، وَهُوَ أَوَّلُ حَدِيثٍ سَمِعْتُهُ مِنْهُ. قَالَ: حَدَّثَنِي وَالِدِي، وَهُوَ أَوَّلُ حَدِيثٍ سَمِعْتُهُ مِنْهُ. قَالَ: حَدَّثَنَا أَبُو طَاهِرِ بْنُ مُحَمَّدِ بْنِ مَحْمِشٍ الزِّيَادِيُّ، وَهُوَ أَوَّلُ حَدِيثٍ سَمِعْتُهُ مِنْهُ. قَالَ: حَدَّثَنَا أَبُو حَامِدِ بْنُ مُحَمَّدِ بْنِ يَحْيَى بْنِ بِلَالٍ البَزَّازُ، وَهُوَ أَوَّلُ حَدِيثٍ سَمِعْتُهُ مِنْهُ. قَالَ: حَدَّثَنَا عَبْدُ الرَّحْمَنِ بْنُ بِشْرٍ بن الْحَكَم وَهُوَ أَوَّلُ حَدِيثٍ سَمِعْتُهُ مِنْهُ. قَالَ: حَدَّثَنَا سُفْيَانُ بْنُ عُيَيْنَةَ، وهو أَوَّلُ حَدِيثٍ سَمِعْتُهُ مِنْ سُفْيَانَ. عَنْ عَمْرِو بْنِ دِينَارٍ، عَنْ أَبِي قَابُوسٍ، مَوْلَى عَبْدِ اللَّهِ بْنِ عَمْرِو بْنِ الْعَاصِ، عَنْ عَبْدِ اللَّهِ بْنِ عَمْرِو بْنِ الْعَاصِ، أَنّ رَسُولَ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَالَ: «الرَّاحِمُونَ يَرْحَمُهُمُ الرَّحْمَنُ، ارْحَمُوا مَنْ فِي الأَرْضِ يَرْحَمُكُمْ مَنْ فِي السَّمَاءِ».
ইমাম বায়হাকি রাহিমাহুল্লাহর বর্ণনায় এ হাদিস মুসালসাল নয়:
أَخْبَرَنَا أَبُو طَاهِرٍ الْفَقِيهُ، أنبأ أَبُو حَامِدِ بْنُ بِلالٍ، ثنا عَبْدُ الرَّحْمَنِ بْنُ بِشْرِ بْنِ الْحَكَمِ بْنِ حَبِيبِ بْنِ مِهْرَانَ الْعَبْدِيُّ، ثنا سُفْيَانُ بْنُ عُيَيْنَةَ، عَنْ عَمْرِو بْنِ دِينَارٍ، عَنْ أَبِي قَابُوسَ، مَوْلًى لِعَبْدِ اللَّهِ بْنِ عَمْرِو بْنِ الْعَاصِ، عَنْ عَبْدِ اللَّهِ بْنِ عَمْرِو بْنِ الْعَاصِ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُمَا، أَنّ رَسُولَ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَالَ: «الرَّاحِمُونَ يَرْحَمُهُمُ الرَّحْمَنُ، ارْحَمُوا مَنْ فِي الأَرْضِ يَرْحَمْكُمْ مَنْ فِي السَّمَاءِ»
“রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন: দয়াশলীদের উপর রহমান দয়া করেন। জমিনে যে আছে তাকে তোমরা রহম কর, আসমানে যিনি আছেন তিনি তোমাদেরকে রহম করবেন”।[5]
[2] বুখারি: (১৮০৯)
[3] আবু দাউদ: (১৩০৪), আহমদ: (২১৫৪৬)
[4] আত-তাদরিব: (২১৮৭)
[5] সুনানুল কুবরা লিল বায়হাকি: (৯/৪০), হাদিস নং: (১৬৪৬২), তিরমিযি: (১৯২৪), আবু দাউদ: (৪৯৪১)
১. মুসালসাল হাদিস রাবির অধিক দ্বাবত ও স্মৃতি শক্তির প্রমাণ বহন করে, কারণ শায়খের অবস্থা, বর্ণনা পদ্ধতি ও সংশ্লিষ্ট ঘটনার সংবাদ দেওয়া প্রমাণ করে রাবি শায়খকে যথাযথ অনুসরণ করেছেন।
২. কতক মুসালসাল প্রমাণ করে সনদে ইনকিতা‘ ও তাদলিস নেই, যা উসুলে হাদিসের প্রধান উদ্দেশ্য, যেমন "حدثني وأخبرني"দ্বারা মুসালসাল সনদ ইনকিতা‘ ও তাদলিসের সম্ভাবনামুক্ত, যদি অন্যান্য দোষ তাতে না থাকে।
৩. হাফেয ইব্ন হাজার রাহিমাহুল্লাহ্ বলেন: “হাফেযে হাদিস ও হাদিসের ইমামদের দ্বারা বর্ণিত মুসালসাল অপর হাদিস অপেক্ষা অধিক শক্তিশালী”।[1]
৪. মুসালসাল হাদিসে নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের অবস্থা ও কথার অনুসরণ থাকে, যা অন্যান্য হাদিসে থাকে না।
জ্ঞাতব্য: মুসালসাল হলে হাদিস সহি হওয়া জরুরি নয়। মুসালসাল সহি, হাসান ও দুর্বল সকল প্রকার হতে পারে, বরং আহলে ইলম বলেছেন অধিকাংশ মুসালসাল দুর্বল। হাফেয যাহাবি রাহিমাহুল্লাহ্ বলেছেন: “প্রায় সকল মুসালসাল বানোয়াট, রাবিদের মিথ্যাচারের কারণে অধিকাংশ মুসালসাল বাতিল। তবে সূরা সাফ পাঠ করার মুসালসাল, দামেস্কি রাবিদের মুসালসাল, মিসরি রাবিদের মুসালসাল ও মুহাম্মদ নামক রাবিদের মুসালসাল অধিক শক্তিশালী”।[2]
ইব্নুস সালাহ রাহিমাহুল্লাহ্ বলেন: “দুর্বল অর্থ মুসালসাল হাদিসের মতন দুর্বল নয়, বরং মুসালসাল পদ্ধতি দুর্বল। মতন সহি ও দুর্বল উভয় হতে পারে”।[3]
মুসালসাল হাদিসে শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত সকল রাবির পরম্পরা জরুরি নয়, কোনো এক স্তরে একাধিক রাবির পরম্পরাকে মুসালসাল বলা হয়, তবে মুসালসাল হাদিসে শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত পরম্পরা থাকা স্বাভাবিক। ইতোপূর্বে ইব্ন তাকিকুল ঈদ রাহিমাহুল্লাহর সংজ্ঞা থেকে জেনেছি, পরম্পরা কখনো হয় সকল স্তরে, কখনো হয় কতক স্তরে।
[2] আল-মুকেজাহ: (পৃ.৪৪), আল-জাওয়াহির:
[3] মুকাদ্দামাহ ইব্ন সালাহ: (পৃ.২৭৭)