وَكُلُّ ما عَنْ رُتْبَةِ الحُسْنِ قَصُرْ| فَهْوَ الضَّعيفُ وَهْوَ أقْساماً كَثُرْ
“আর যেসব হাদিস হাসানের স্তর থেকে নিচু মানের, তাই দুর্বল, তার অনেক প্রকার রয়েছে”। অত্র কবিতায় বর্ণিত ক্রমানুসারে দ্বা‘ঈফ তৃতীয় প্রকার। হাদিসের এ প্রকার সনদ ও মতন উভয়ের সাথে সম্পৃক্ত।
ضعيف এর আভিধানিক অর্থ দুর্বল।
‘দ্বা‘ঈফ’ এর পারিভাষিক সংজ্ঞা প্রসঙ্গে লেখক রাহিমাহুল্লাহ্ বলেন: “যেসব হাদিস হাসান হাদিসের স্তর থেকে নিচু তাই দ্বা‘ঈফ বা দুর্বল হাদিস, তার অনেক প্রকার রয়েছে”। লেখক রাহিমাহুল্লাহ্ এখানে দ্বা‘ঈফের সংজ্ঞা দিয়েছেন ও তার বিভিন্ন প্রকারের দিকে ইশারা করেছেন, কিন্তু কোনো প্রকার উল্লেখ করেননি, তবে পরবর্তীতে অনেক প্রকার উল্লেখ করেছেন। তিনি দ্বা‘ঈফের সুনির্দিষ্ট সংজ্ঞার পরিবর্তে ‘হাসানের স্তর থেকে নিচু হলে দ্বা‘ঈফ’ বলেছেন। দ্বা‘ঈফ যদি হাসান থেকে নিচু মানের হয়, তাহলে সহি থেকে নিচু মানের বলার অপেক্ষা রাখে না।
আমরা পূর্বে জেনেছি যে, সহি ও হাসান হাদিসে পার্থক্য শুধু একটি। সহি হাদিসের রাবি পরিপূর্ণ দ্বাবতের অধিকারী, হাসান হাদিসের রাবি দুর্বল দ্বাবতের অধিকারী, অন্যান্য শর্তের ক্ষেত্রে সহি ও হাসান উভয় সমান। সহি হাদিসের এক বা একাধিক শর্ত কোনো হাদিসে অনুপস্থিত থাকলে হাদিস দুর্বল।
লেখক রাহিমাহুল্লাহ্ এ সংজ্ঞায় দ্বা‘ঈফের সকল প্রকার অন্তর্ভুক্ত করেছেন। শায, মুনকার, মাতরুক ও মিথ্যার অপবাদে দুষ্ট রাবির হাদিস এ সংজ্ঞার অন্তর্ভুক্ত। সেসব হাসান হাদিসও অন্তর্ভুক্ত, যা অপর দ্বা‘ঈফ হাদিসের ফলে হাসানের মর্যাদায় উন্নীত হয়। অর্থাৎ এ সংজ্ঞায় দ্বা‘ঈফ ও হাসান লি-গায়রিহি উভয় শামিল। অতএব লেখক রাহিমাহুল্লাহ দ্বা‘ঈফের যথাযথ সংজ্ঞা পেশ করেননি। তাই অনেকে তার সমালোচনা করেছেন।
লেখক এ পর্যন্ত হাদিসের মৌলিক তিন প্রকার উল্লেখ করেছেন: ১. সহি, ২. হাসান ও ৩. দ্বা‘ঈফ বা দুর্বল।
এ তিন প্রকার পাঁচভাগে ভাগ হয়, যেমন ইব্ন হাজার ও অন্যান্য মুহাদ্দিসগণ করেছেন: ১. সহি লি-যাতিহি, ২. সহি লি-গায়রিহি, ৩. হাসান লি-যাতিহি, ৪. হাসান লি-গায়রিহি, ৫. দ্বা‘ঈফ বা দুর্বল।
১. সহি লি-যাতিহি: পূর্বে সহির যে সংজ্ঞা পেশ করা হয়েছে তাই সহি লি-যাতিহির সংজ্ঞা।
২. সহি লি-গায়রিহি: এ প্রকার হাদিস মূলত হাসান, তবে একাধিক সনদের বলে সহির মর্যাদায় উন্নীত হয়েছে। যেহেতু একাধিক সনদের কারণে সহির পর্যায়ে উন্নীত হয়েছে, তাই এ প্রকার হাদিসকে সহি লি-গায়রিহি বলা হয়।
৩. হাসান লি-যাতিহি: পূর্বে হাসানের যে সংজ্ঞা পেশ করা হয়েছে তাই হাসান লি-যাতিহির সংজ্ঞা।
৪. হাসান লি-গায়রিহি: “যে হাদিসে সামান্য দুর্বলতা রয়েছে, যা অনুরূপ দুর্বলতা সম্পন্ন হাদিস দ্বারা দূরীভূত হয়, তাই হাসান লি-গায়রিহি”। দুর্বলতা দ্বারা উদ্দেশ্য আদালত, দ্বাবত ও ইত্তেসালের দুর্বলতা। এ তিনটি দোষের কারণে দুর্বল হাদিস অনুরূপ দুর্বল হাদিস দ্বারা হাসান লি-গায়রিহি প্রকারে উন্নীত হয়। তবে দুর্বল হাদিসে দুর্বলতা দূরকারী শক্তি থাকা জরুরি, শায ও ইল্লতের কারণে দুর্বল হাদিস অপর হাদিসের দুর্বলতা দূর করার ক্ষমতা রাখে না। আবার কঠিন দুর্বল হাদিস অনুরূপ কঠিন দুর্বল হাদিস দ্বারা হাসান লি-গায়রিহি মর্যাদায় উন্নীত হয় না।
জ্ঞাতব্য, দুর্বল হাদিসের দুর্বলতা দূরীকরণে অনুরূপ দুর্বল হাদিস হওয়া জরুরি, যদি মকবুল হাদিসের দুর্বলতা দূর হয়, তাহলে সে হাদিস সহি কিংবা হাসান, হাসান লি-গায়রিহি নয়।
৫. দ্বা‘ঈফ: সহি ও হাসানের বাইরে হাদিসের সকল প্রকার দ্বা‘ঈফ। দ্বা‘ঈফ বা দুর্বল হাদিস গ্রহণযোগ্য নয়। অতএব দ্বা‘ঈফ প্রচার করা, শিক্ষা দেওয়া ও তার উপর আমল করা দুরস্ত নয়। তবে প্রয়োজন হলে দুর্বলতা প্রকাশ করে দ্বা‘ঈফ বলা বৈধ, কারণ দুর্বলতা প্রকাশ করা ব্যতীত দ্বা‘ঈফ বলা নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের উপর মিথ্যারোপ করার শামিল। মুসলিম সহি গ্রন্থে বর্ণনা করেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন:
«مَنْ حَدَّثَ عَنِّى، بِحَدِيثٍ يُرَى أَنَّهُ كَذِبٌ فَهُوَ أَحَدُ الْكَاذِبِينَ»
“যে আমার থেকে কোন হাদিস বর্ণনা করল, অথচ দেখা যাচ্ছে তা মিথ্যা, তাহলে সেও মিথ্যাবাদীদের একজন”।[1] অপর হাদিসে তিনি ইরশাদ করেন:
«وَمَنْ كَذَبَ عَلَيَّ مُتَعَمِّدًا فَلْيَتَبَوَّأْ مَقْعَدَهُ مِنَ النَّارِ»
“আর আমার উপর যে ইচ্ছাকৃত মিথ্যা বলল, সে যেন তার ঠিকানা জাহান্নাম বানিয়ে নেয়”।[2]
দ্বা‘ঈফ বর্ণনার পদ্ধতি: ‘নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে বর্ণনা করা হয়’, অথবা ‘নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাথে সম্পৃক্ত করা হয়’। দৃঢ়ভাবে বলা যাবে না ‘নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন’।
কতক আলেম বলেন: ইবাদতের প্রতি আগ্রহ ও জাহান্নাম থেকে সতর্ক করার নিমিত্তে চারটি শর্তে দ্বা‘ঈফ হাদিস বলা বৈধ: ১. দ্বা‘ঈফ হাদিস ইবাদতের প্রতি আগ্রহ ও পাপ থেকে সতর্ককারী সম্পর্কিত হওয়া। ২. কঠিন দ্বা‘ঈফ না হওয়া। ৩. দ্বা‘ঈফ হাদিসের মূল বিষয় কুরআন বা সুন্নায় মওজুদ থাকা। ৪. রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন দ্বা‘ঈফ হাদিসের ক্ষেত্রে বিশ্বাস না করা। এ চারটি শর্তে দ্বা‘ঈফ হাদিসের উপর আমল করা বৈধ।
কতক আলেম বলেন: দ্বা‘ঈফ হাদিসের উপর কোনো অবস্থায় আমল করা বৈধ নয়, কারণ:
১. দ্বা‘ঈফ হাদিসের উপর আমল করার অর্থ সন্দেহ বা ধারণার উপর আমল করা, যা নিন্দনীয়।
২. দ্বা‘ঈফ হাদিস দ্বারা মোস্তাহাব বা মাকরুহ প্রমাণিত হয় না, অতএব তার দ্বারা কিভাবে ফযিলত প্রমাণিত হয়।
৩. সমাজে দ্বা‘ঈফ হাদিসের কু-প্রভাব বন্ধের নিমিত্তে তার উপর আমল নিষিদ্ধ করা জরুরি। ফযিলত অধ্যায়ে দুর্বল হাদিস বলার অজুহাতে অনেক খতিব ও বক্তা নিয়ম-নীতির তোয়াক্কা না করে জাল হাদিস পর্যন্ত বর্ণনা করেন, যা পরিহার করা জরুরি।
৪. দ্বা‘ঈফ হাদিসের উপর আমল করা হলে সহি হাদিস সুরক্ষায় মুহাদ্দিসদের প্রচেষ্টাকে অবজ্ঞা করা হয়।
৫. প্রত্যেক প্রকার সহি ও হাসানের উপর আমল করতে পারিনি, তবু কেন দুর্বল হাদিসের উপর আমল করব।
শায়খ উসাইমিন রাহিমাহুল্লাহ্ বলেন: “আমার নিকট দুর্বলতা প্রকাশ করা ব্যতীত দুর্বল হাদিস বলা বৈধ নয়, বিশেষ করে জনগণের সামনে। কারণ তাদের সামনে যখন হাদিস বলা হয়, তারা সেটাকে নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের বাণী হিসেবে বিশ্বাস করে। তারা মনে করেন খতিব যা বলেন তাই ঠিক। বিশেষ করে আগ্রহ সৃষ্টি ও সতর্ককারী হাদিসগুলো। কুরআন ও সহি সুন্নায় যা রয়েছে, দুর্বল হাদিস অপেক্ষা তাই আমাদের জন্য যথেষ্ট।
কতক লোক সুন্নতের প্রতি উদ্বুদ্ধ করার জন্য হাদিস রচনা করে। তারা বলে: আমরা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের বিপক্ষে মিথ্যা রচনা করি না, বরং তার স্বার্থে মিথ্যা রচনা করি। তারা হাদিসের অপব্যাখ্যা করে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন:
«وَمَنْ كَذَبَ عَلَيَّ مُتَعَمِّدًا فَلْيَتَبَوَّأْ مَقْعَدَهُ مِنَ النَّارِ»
“আর যে আমার উপর মিথ্যা রচনা করল, সে যেন তার ঠিকানা জাহান্নাম বানিয়ে নেয়”। আপনি যখন কোনো কথা বললেন, যা তিনি বলেননি, আপনি তার উপর মিথ্যা রচনা করলেন”।[3]
[2] বুখারি: (১০৮)
[3] শারহুল মানযুমাহ লি ইব্ন উসাইমিন।