وَمُرْسَلٌ مِنْهُ الصَّحَابِيُّ سَقَطْ |وَقُلْ غَرِيبٌ مَا رَوَى رَاوٍ فَقَطْ
“আর মুরসাল: যার থেকে সাহাবি বাদ পড়েছে। আর বল গরিব: যা শুধু একজন রাবি বর্ণনা করেছে”। অত্র কবিতায় বর্ণিত ক্রমানুসারে হাদিসের ষোড়শ ও সপ্তদশ প্রকার মুরসাল ও গরিব।
مُرْسلٌ এর আভিধানিক অর্থ মুক্ত করা ও ছেড়ে দেওয়া, যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
﴿ أَلَمۡ تَرَ أَنَّآ أَرۡسَلۡنَا ٱلشَّيَٰطِينَ عَلَى ٱلۡكَٰفِرِينَ تَؤُزُّهُمۡ أَزّٗا ٨٣ ﴾ [مريم: ٨٣]
“তুমি কি লক্ষ্য করনি যে, আমি কাফেরদের জন্য শয়তানদের ছেড়ে দিয়েছি; ওরা তাদেরকে বিশেষভাবে প্ররোচিত করে”?[1]
‘মুরসাল’ হাদিস বর্ণনাকারী সনদকে মুক্ত ছেড়ে দেন, নির্দিষ্ট কোনো সাহাবির সাথে সম্পৃক্ত করেন না, তাই এ প্রকারকে মুরসাল বলা হয়।[2]
‘মুরসালে’র পারিভাষিক সংজ্ঞা প্রসঙ্গে লেখক রাহিমাহুল্লাহ্ বলেন: “যে সনদে সাহাবির উল্লেখ নেই তাই মুরসাল”। এ সংজ্ঞা সঠিক নয়, কারণ সাহাবির বাদ পড়া নিশ্চিত জানা গেলে কোনো সমস্যা নয়, যেহেতু সকল সাহাবি ‘আদিল ও বিশ্বস্ত। তাই সাহাবির বাদ পড়া সমস্যা নয়, বরং সাহাবির সাথে কোনো তাবে‘ঈর বাদ পড়া সমস্যা। কারণ তাবে‘ঈ কখনো এক বা একাধিক তাবে‘ঈ থেকে বর্ণনা করেন, যিনি বা যারা সাহাবি থেকে শ্রবণ করেছেন। তাই তাবে‘ঈর বর্ণিত হাদিসে সাহাবি উল্লেখ না থাকার অর্থ সাহাবি বাদ পড়েছেন নিশ্চিত নয়, দুর্বল তাবে‘ঈ বাদ পড়তে পারেন।
দ্বিতীয়ত লেখকের সংজ্ঞা প্রমাণ করে, সাহাবি ইরসাল করলে মুরসাল নয়, অথচ বিজ্ঞ আলেমগণ তাকেও মুরসাল বলেন। তাই শায়খ আব্দুস সাত্তার আবু গুদ্দাহ লেখকের সংজ্ঞা সংশোধন করে বলেন:
ومرسل من فوق تابع سقط = وقل غريب ما روى راو فقط
“আর মুরসাল: তাবে‘ঈর উপর থেকে যার রাবি বাদ পড়েছে। আর বল গরিব: যা শুধু একজন রাবি বর্ণনা করেছে”। এ সংজ্ঞানুসারে কোনো প্রশ্ন থাকে না, সাহাবির সাথে তাবে‘ঈ বাদ পড়ুক কিংবা সাহাবির সনদ থেকে সাহাবি বাদ পড়ুক, সকল প্রকার তার অন্তর্ভুক্ত।
অতএব নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে সরাসরি তাবে‘ঈর বর্ণিত হাদিস মুরসাল। হোক তা বাণী, কিংবা কর্ম কিংবা সমর্থন কিংবা কোনো বিশেষণ।
সাহাবির মুরসাল:
কোনো সাহাবি যদি নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে না শুনে সরাসরি বর্ণনা করেন, কেউ বলেছেন তার হাদিস গ্রহণযোগ্য নয়, তবে সাহাবির কারণে নয়, হতে পারে তিনি কোনো তাবে‘ঈ থেকে শ্রবণ করেছেন, যিনি অপর সাহাবি থেকে শ্রবণ করেছেন, যদিও তার দৃষ্টান্ত খুব কম।
হাফেয ইব্ন হাজার রাহিমাহুল্লাহ্ বলেন: “এ জাতীয় হাদিসগুলো চিহ্নিত করা হয়েছে, তাতে দেখা গেছে যে, কোনো সাহাবি আহকাম সংক্রান্ত কোনো হাদিস দুর্বল তাবে‘ঈ থেকে গ্রহণ করেননি”।[3]
কেউ বলেছেন: সাহাবির মুরসাল গ্রহণযোগ্য, কারণ সাহাবির ইরসাল অপর সাহাবি থেকে হওয়াই স্বাভাবিক, তাবে‘ঈ থেকে তাদের ইরসাল করা সচরাচর নয়। তাই নির্দিষ্ট আলামত ব্যতীত বলা যাবে না সাহাবি কোনো তাবে‘ঈ থেকে ইরসাল করেছেন। বিশেষ করে ইব্ন হাজার যখন বলেছেন: আহকাম অধ্যায়ে দুর্বল তাবে‘ঈ থেকে কোনো সাহাবি হাদিস গ্রহণ করেননি।
জ্ঞাতব্য: যারা বুঝের বয়সে উপনীত হয়ে নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে শ্রবণ করেছেন, তাদের হাদিস গ্রহণযোগ্য। যারা শুধু তাকে দেখার সৌভাগ্যে সাহাবি, কিন্তু তাকে দেখার সময় ভালমন্দ জ্ঞানের অধিকারী ছিল না, অথবা তিনি যেসব শিশুদের দেখেছেন, তাদের বর্ণনা তাবে‘ঈদের মুরসাল হিসেবে গণ্য।
মুরসাল বর্ণনার কয়েকটি কারণ:
১. কখনো রাবি একাধিক মুহাদ্দিস থেকে হাদিস শ্রবণ করেন, যাদের আদালত ও দ্বাবত সম্পর্কে তিনি নিশ্চিত, এরূপ অবস্থায় তিনি শায়খদের উপর নির্ভর করে মুরসাল বর্ণনা করেন। যেমন ইবরাহিম নাখ‘ঈ রহ. ইব্ন মাসউদ রা. থেকে এভাবে বর্ণনা করতেন।
২. কখনো রাবি নিজ শায়খের নাম ভুলে যান, কিন্তু হাদিস স্মরণ থাকে, ফলে তিনি মুরসাল বর্ণনা করেন।
৩. কখনো রাবি উপদেশ হিসেবে, বা বিতর্কের সময় বা ফতোয়ার ক্ষেত্রে বা ওয়াজের মজলিসে হাদিস বর্ণনা করেন, তাই সনদের প্রতি বিশেষ নজর দেন না, মতন স্পষ্ট বলেন, বিশেষ করে শ্রোতাদের সামনে বক্তার শায়খ নির্দিষ্ট থাকলে এরূপ করা হয়।
৪. কখনো দুর্বল রাবির কারণে মুরসাল বর্ণনা করা হয়।
৫. ক্ষতির আশঙ্কা কিংবা হাদিস গ্রহণ করা হবে না ভেবে মুরসাল বর্ণনা করা হয়।
৬. কখনো রাবির সন্দেহ হয় যে, হাদিসটি মুসনাদ না মুরসাল, এমতাবস্থায় মুসনাদ হলেও তিনি মুরসাল বলেন, যেমন ইমাম মালিক প্রমুখ থেকে এরূপ শ্রুতি রয়েছে।
৭. ইমাম মুসলিম বলেন: কখনো রাবি নিজের মধ্যে আগ্রহের অভাবে সনদবিহীন মতন উল্লেখ করেন, আবার যখন উদ্যমতা ফিরে পান শায়খকে স্পষ্ট বলে দেন।
মুরসাল হাদিসের হুকুম:
ইমাম মুসলিম রহ. বলেন: “আমাদের ও আহলে ইলমদের দৃষ্টিতে মুরসাল দলিল নয়”।[4]
ইমাম শাফেয়ী[5] রহ. কয়েকটি শর্তে মুরসাল গ্রহণ করেছেন, তন্মধ্যে কতক রাবি ও কতক মতনের সাথে সম্পৃক্ত। রাবির সাথে সম্পৃক্ত তিনটি শর্ত:
১. ইরসালকারী রাবির সেকাহ হওয়া।
২. রাবির বড় তাবে‘ঈ থেকে বর্ণনা করা।
৩. ইরসালকারী রাবির সেকাহ শায়খ থেকে গ্রহণ করা।
মতনের সাথে সম্পৃক্ত চারটি শর্ত:
১. মুরসাল মতন অপর কোনো সহি সনদে বর্ণিত হওয়া।
২. মুরসাল মতন অপর তাবে‘ঈ থেকে মুরসাল বর্ণিত হওয়া।
৩. মুরসাল মতনের স্বপক্ষে কোনো সাহাবির বাণী থাকা।
৪. সাধারণ আলেমের ফতোয়া মুরসাল মোতাবেক হওয়া।
[2] কেউ বলেন: আরবদের প্রবাদ فلان أرسل الناقة في المرعى ‘অমুক ব্যক্তি চারণভূমিতে উট ছেড়ে দিয়েছে’ থেকে তার নামকরণ করা হয়েছে, অথবা ناقة مِرسَال থেকেও তার উৎপত্তি হতে পারে, যার অর্থ ‘দ্রুতগামী উট’। মুরসাল হাদিসে রাবি সাহাবিকে ত্যাগ করে দ্রুত মতনের দিকে ছুটে যেতে চায়, তাই এ প্রকারকে মুরসাল বলা হয়।
[3] জাওয়াহিরুস সুলাইমানিয়াহ: (২১৯)
[4] ইমাম নববির ব্যাখ্যা সম্বলিত মুসলিম: (১/১৩২)
[5] আর-রিসালাহ: (৪৬১-৪৭০), জাওয়াহিরুস সুলাইমানিয়া থেকে সংগৃহীত: (২২৩)