লেখক এখানেও ধারাক্রম রক্ষা করেননি। গরিব খবরে ওয়াহেদের একপ্রকার, তাই খবরে ওয়াহেদের অপর দু’প্রকার আযিয ও মাশহূরের সাথে এ প্রকার উল্লেখ করা শ্রেয় ছিল, যেমন অন্যান্য মুহাদ্দিস করেছেন। এ প্রকারের সম্পর্ক সনদ ও মতন উভয়ের সাথে।
غَريبٌ আরবি غربة শব্দ থেকে গৃহীত, অর্থ অপরিচিত, আগন্তুক ও বিদেশী। পরিবার ও স্বদেশ থেকে বিচ্ছিন্ন অপর দেশে অপরিচিত ব্যক্তিকে গরিব বলা হয়। অপরিচিত হওয়াকে গুরবত, আর ব্যক্তিকে গরিব বলা হয়।
‘গরিবে’র পারিভাষিক সংজ্ঞা প্রসঙ্গে লেখক রাহিমাহুল্লাহ্ বলেন: “যে হাদিস শুধু একজন রাবি বর্ণনা করেন তাই গরিব”
সনদে গুরবতের স্থান:
সনদের তিন জায়গায় গুরবত হয়। শেষে অর্থাৎ সাহাবির স্তরে, মাঝখানে ও শুরুতে। সনদের শেষে একজন রাবি হলে হাদিস গরিব, যেমন সাহাবি থেকে কোনো হাদিসের রাবি মাত্র একজন, যদিও তার থেকে রাবির সংখ্যা অনেক। এ হাদিস পরবর্তী স্তরে মুতাওয়াতির হলেও গুরবত দূর হবে না। যেমন «إنما الأعمال بالنيات...» হাদিস। সাহাবি ও তাবে‘ঈর স্তরে গরিব, কিন্তু পরবর্তী স্তরে ব্যাপক প্রচার পেয়েছে।
গুরবত কখনো হয় সনদের মাঝে, যেমন একাধিক রাবি থেকে বর্ণনাকারী একজন, তার থেকে বর্ণনাকারী একাধিক। গুরবত কখনো হয় সনদের শুরুতে, যেমন একাধিক রাবি থেকে একজন রাবি বর্ণনা করেন।
ইব্নুস সালাহ রাহিমাহুল্লাহ্ গরিবের সংজ্ঞা প্রসঙ্গে বলেন:
"بأنه الحديث الذي يتفرد به بعض الرواة، يوصف بالغريب، وكذلك الحديث الذي يتفرد فيه بعضهم بأمر لا يذكره فيه غيره، إما في متنه، وإما في إسناده" (مقدمة ابن الصلاح).
“গরিব সে হাদিসকে বলা হয়, কতক রাবি একলা যা বর্ণনা করেন, অনুরূপ কোনো রাবি যদি হাদিসের কোনো অংশ একলা বর্ণনা করেন যা কেউ বর্ণনা করেনি, হোক সনদের অংশ কিংবা মতনের অংশ সেটাও গরিব”।[1] এ থেকে স্পষ্ট যে, গরিব কখনো হাদিসের অংশ বিশেষ, কখনো সনদের অংশ বিশেষ হয়।
ইব্ন হাজার রাহিমাহুল্লাহ্ গরিবের সংজ্ঞায় বলেন:
"وهو: ما يتفرد بروايته شخص واحد، في أي موضع وقع التفرد به من السند"
“যে হাদিস একজন রাবি বর্ণনা করেন তাই গরিব, সনদের যে কোনো জায়গায় একজন রাবি থাকাই যথেষ্ট”।[2]
গরিব সাধারণত তিন প্রকার:
১. সনদ ও মতন উভয় গরিব, যেমন কোনো রাবির একলা বর্ণিত মতন।
২. সনদ গরিব কিন্তু মতন গরিব নয়, যেমন কোনো রাবি স্বীয় সনদে কোনো মতন বর্ণনা করলেন, তার সাথীদের কেউ যা বর্ণনা করেনি, তবে অপর সনদে তা বর্ণিত আছে। এখানে সনদ গবির, কিন্তু মতন গরিব নয়।
৩. মতন গরিব কিন্তু সনদ গরিব নয়, এরূপ হতে পারে না। কেউ এরূপ কল্পনা করেছেন, যা সঠিক নয়, যেমন তারা নিয়তের হাদিসের সনদকে দু’ভাগ করেন: গরিব ও মাশহূর। কারণ ১-ওমর ইব্নুল খাত্তাব, ২-আলকামাহ, ৩-মুহাম্মদ ইব্ন ইবরাহিম, ৪-ইয়াহইয়া ইব্ন সায়িদ পর্যন্ত সনদ গরিব, ইয়াহইয়াহ ইব্ন সায়িদ থেকে সনদ ও মতন উভয় মাশহূর। সনদের দ্বিতীয়াংশ ইয়াহইয়া ইব্ন সায়িদ থেকে গ্রন্থকার[3] পর্যন্ত মাশহূর। তারা সনদের প্রথমাংশের বিবেচনায় মতন গরিব ও সনদের দ্বিতীয়াংশের বিবেচনায় সনদ মাশহূর বলেন। এরূপ বলা যথাযথ নয়, কারণ মতন যখন গরিব ছিল, সনদও তখন গরিব ছিল; মতন যখন প্রসিদ্ধ সনদও তখন প্রসিদ্ধ।
গরিব হাদিসের হুকুম:
১. সহি, ২. হাসান ও ৩. দ্বা‘ঈফ সবপ্রকার হতে পারে।
দুর্বল হওয়া গরিব হাদিসের প্রকৃতি। তাই মুহাদ্দিসগণ গরিব হাদিসের প্রতি তেমন ভ্রুক্ষেপ করেন না। ইমাম মালিক গরিব সম্পর্কে বলেন: “সবচেয়ে খারাপ ইলম গরিব, আর সবচেয়ে উত্তম ইলম প্রকাশ্য ইলম, যা একাধিক রাবি বর্ণনা করে”। আব্দুর রায্যাক বলেন: আমরা মনে করতাম গরিব ইলম ভালো, কিন্তু পরবর্তীতে প্রমাণিত হল নিরেট খারাপ”। ইমাম আহমদ ইব্ন হাম্বল বলেন: “তোমরা এসব গরিব লিপিবদ্ধ কর না, কারণ এগুলো মুনকার, তার অধিকাংশ দুর্বল রাবিদের থেকে বর্ণিত”। তিনি আরো বলেন: “সবচেয়ে খারাপ ইলম গরিব, তার উপর আমল ও ভরসা করা যায় না”।
গরিব ও ফার্দের পার্থক্য:
হাফেয ইব্ন হাজার বলেন: “গরিব ও ফার্দ আভিধানিক ও পারিভাষিক দিক থেকে একে অপরের সামর্থবোধক, তবে অধিক ব্যবহার ও কম ব্যবহারের বিবেচনায় পার্থক্য রয়েছে। ফার্দের ব্যবহার অধিকাংশ ক্ষেত্রে ফার্দে মুতলাকের উপর হয়। আর গুরবতের ব্যবহার অধিকাংশ ক্ষেত্রে ফার্দে নিসবির উপর হয়, তবে ব্যবহারের ক্ষেত্রে একটির জায়গায় অপরটি ব্যবহার হয়”।[4]
হাদিসুল গরিব ও গরিবুল হাদিস:
হাদিস শাস্ত্রের দু’টি পরিভাষা: ‘আল-হাদিসুল গারিব” ও ‘গারিবুল হাদিস’।الحديث الغريب যার আলোচনা আমরা এ যাবৎ করলাম। আর غريب الحديث অর্থ হাদিসের মতনে বিদ্যমান দুর্বোধ্য শব্দ। গরিবের ন্যায় অপরিচিত হওয়ার কারণে অভিধান ব্যতীত যার অর্থ জানা যায় না। ‘গারিবুল হাদিসে’র উপর লিখিত কয়েকটি গ্রন্থ:
১. গারিবুল হাদিস, লিল হারাওয়ী।
২. গারিবুল হাদিস, লিল-হারবি।৩. নিহায়াহ, লি ইব্ন আসির।
[2] আন-নুযহাহ: (পৃ.৭০)
[3] নিয়তের হাদিস বর্ণনাকারী গ্রন্থকারগণ, যেমন বুখারি ও মুসলিম প্রমুখ।
[4] আন-নুযহাহ: (পৃ.৮১)