দীনের স্বকীয়তা রক্ষার তৃতীয় গুরুত্বপূর্ণ বিষয় বিকৃতিহীন হাদিস বর্ণনা করা। এ ধাপ অতিক্রম করা খুব কঠিন, কারণ ভুল মানুষের স্বভাব। ভুল ও সন্দেহ থেকে নবী ব্যতীত কেউ নিরাপদ নয়। অতএব প্রত্যেক হাদিসে শব্দ ও অর্থের অক্ষুণ্নতা এবং রাবিদের সন্দেহ ও ভুল থেকে মুক্ত থাকার দাবি করা খুব কঠিন। তাহলে প্রশ্ন হয়, এ ক্ষেত্রে করণীয় কি?

এ ক্ষেত্রে প্রথম করণীয় বর্তায় রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের উপর। তিনি সাহাবিদেরকে হাদিস মুখস্থ করাবেন, তারা তার কথা ও কর্মগুলো যথাযথ সংরক্ষণ ও মুখস্থ করবেন। ভুল হলে শুধরানোর ব্যবস্থা করবেন এবং সন্দেহ কিংবা গাফলতি হলে দূর করার পন্থা অবলম্বন করবেন। এটাই এ ক্ষেত্রে করণীয়, এ ছাড়া বিকল্প কিছু নেই। তাই দেখি হাদিস সংরক্ষণ ও তাতে বিকৃতি ঠেকানোর জন্য নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম সম্ভাব্য সকল পন্থা অবলম্বন করেছেন, যেমন:

হাদিস শিক্ষা দেওয়ার বিভিন্ন পদ্ধতি:

১. রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম একটি কথা বারবার বলতেন, কখনো তিনবার, কখনো তার চেয়ে অধিক বলতেন, যেন শ্রোতারা তার কথা বুঝে ও মুখস্থ করতে সক্ষম হয়। ইমাম বুখারি প্রমুখ আনাস ও আবু উমামাহ রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুমা থেকে বর্ণনা করেন:

«أَنَّ رَسُولَ اللهِ صلى الله عليه وسلم كَانَ إِذَا تَكَلَّمَ بِكَلِمَةٍ أَعَادَهَا ثَلاَثاً حَتَّى تُفْهَمَ عَنْهُ، وَإِذَا أَتَى عَلَى قَوْمٍ فَسَلَّمَ عَلَيْهِمْ سَلَّمَ عَلَيْهِمْ ثَلاَثًا».

“রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন কোনো বিষয়ে কথা বলতেন, তিনবার পুনরাবৃত্তি করতেন, যেন তার কথা বুঝা যায়। যখন তিনি কোনো কওমের নিকট আসতেন, তাদেরকে সালাম করতেন, তিনবার সালাম করতেন”।[1]

২. রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম শব্দসমূহ পৃথক উচ্চারণ করতেন ও ধীরে কথা বলতেন, যেন শ্রোতারা মুখস্থ ও স্মরণ রাখতে সক্ষম হয়। আয়েশা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহা বলেন: “নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম কথা বলতেন, যদি কোনো গণনাকারী গণনা করতে চাইত অবশ্যই গণনা করতে সক্ষম হত”।[2] অপর বর্ণনায় তিনি বলেন: “নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম তোমাদের ন্যায় দ্রুত বলতেন না, তিনি পৃথক পৃথক বাক্য উচ্চারণ করতেন, যে তার কাছে বসত মুখস্থ করতে সক্ষম হত”।[3]

৩. রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম কথার সময় মধ্যম পন্থা অবলম্বন করতেন, যেন শ্রোতারা বিরক্ত না হয় এবং তাদের আলস্য না আসে। কখনো কয়েকটি শব্দে কথা শেষ করতেন, যেমন একদা তিনি বলেন: «النَّدَمُ تَوْبَةٌ» ‘লজ্জিত হওয়াই তওবা’।[4] অপর হাদিসে তিনি বলেন:

«الْجَمَاعَةُ رَحْمَةٌ، وَالْفُرْقَةُ عَذَابٌ»

“একতা রহমত ও বিচ্ছিন্নতা শাস্তি”।[5]

৪. নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম উপদেশের জন্য উপযুক্ত সময় অন্বেষণ করতেন, যেন শ্রোতারা গভীর আগ্রহে শ্রবণ করে ও মুখস্থের প্রতি যত্নশীল হয়। কখনো দু’টি উপদেশের মাঝে দীর্ঘ বিরতি নিতেন, যেন তাদের উদ্যমতা বৃদ্ধি পায় ও স্মৃতি শক্তি প্রখর হয়। আব্দুল্লাহ ইব্‌ন মাসউদ রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু বলেন:

«كَانَ النَّبِيُّ صلى الله عليه وسلم يَتَخَوَّلُنَا بِالْمَوْعِظَةِ فِي الْأَيَّامِ، كَرَاهَةَ السَّآمَةِ عَلَيْنَا»

“নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম ওয়াযের জন্য দিনসমূহে উপযুক্ত সময় অন্বেষণ করতেন, কারণ তিনি আমাদের বিরক্তিকে অপছন্দ করতেন”।[6]

৫. রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম কখনো উদাহরণ পেশ করতেন, কারণ উদাহরণ বুঝা সহজ, দ্রুত অন্তরে আছর কাটে এবং অর্থগত বস্তুকে সহজে ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য বস্তুতে পরিণত করা যায়। বিশেষ করে অলঙ্কার শাস্ত্রবিদদের নিকট উদাহরণের খুব মূল্য। তাই নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম অধিক উদাহরণ পেশ করতেন, আব্দুল্লাহ ইব্‌ন আমর ইব্‌ন আস রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু বলেন: “আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে এক হাজার উদাহরণ মুখস্থ করেছি”।[7]

এ ছাড়া তিনি আরো পদ্ধতি গ্রহণ করেছেন, যে কারণে সাহাবিগণ তার কথা, কর্ম, সমর্থন ও গুণগানগুলো সংরক্ষণ ও পরবর্তীদের নিকট পূর্ণরূপে পৌঁছাতে সক্ষম হয়েছেন।শ্রোতা হিসেবে সাহাবিরা নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের সামনে আদব ও মনোযোগসহ শ্রবণ করতেন, যেন কোনো বাণী তাদের থেকে বিচ্যুত না হয়, কোনো হাদিসে ভুল কিংবা সন্দেহ প্রবেশ না করে। নিম্নে তার কয়েকটি নমুনা পেশ করছি:

[1] বুখারি: (১/১৮৮), হাদিস নং: (৯৪,৯৫), আবু উমামার হাদিস তাবরানি ফিল কাবিরে দেখুন: (৮/২৮৫), হাদিস নং: (৮০৯৫), হায়সামি তার সনদকে হাসান বলেছেন। আল-মাজমা: (১/১২৯)

[2] আবু দাউদ: (৩/৩২০), হাদিস নং: (৩৬৫৪)

[3] তিরমিযি: (৫/৬০০), হাদিস নং: (৩৬৩৯), আহমদ: (৬/২৫৭)

[4] ইব্‌ন মাজাহ: (২/১৪২০), হাদিস নং: (৪২৫২), ইব্‌ন হিব্বান: (২/৩৭৭), হাদিস নং: (৬১২-৬১৪)

[5] মুসনাদুশ শিহাব: (১/৪৩), হাদিস নং: (১৫), আব্দুল্লাহ ইব্‌ন আহমদ: (৪/২৭৮), হাদিস নং: (১৮৪৪৯, ১৮৪৫০), বাজ্জার: (২/২২৬), হাদিস নং: (৩২৮২), হায়সামি ‘মাজমাউয যাওয়ায়েদ’: (৫/২১৮) গ্রন্থে বলেন: ‘এ হাদিসের রাবিগণ সেকাহ’ বা শক্তিশালী।

[6] বুখারি: (১/১৬২), হাদিস নং: (৬৮)

[7] ‘আল-আমসাল’ লি রামাহুরমুযী: (পৃ.২৯-৩০), ‘আস-সিয়ার’ লিয যাহাবি: (৩/৮৭), আল-হিলইয়াহ’ লি আবি নু‘আইম: (৫/১৬৯)