১। কান কাটা বা শিং ভাঙ্গা। এর দ্বারা কুরবানী মকরূহ। তবে সিদ্ধ হয়ে যাবে। কারণ, এতে মাংসের কোন ক্ষতি বা কমি হয় না এবং সাধারণতঃ এমন ত্রুটি পশুর মধ্যে বেশী পরিলক্ষিত হয়ে থাকে। কিন্তু যে পশুর জন্ম থেকেই শিং বা কান নেই তার দ্বারা কুরবানী মকরূহ নয়। যেহেতু ভাঙ্গা বা কাটাতে পশু রক্তাক্ত ও ক্লিষ্ট হয়; যা এক রোগের মত। কিন্তু জন্ম থেকে না থাকাটা এ ধরনের কোন রোগ নয়। অবশ্য পূর্ণাঙ্গ পশুই আফযল।
২। লেজ কাটা - যার পূর্ণ অথবা কিছু অংশ লেজ কাটা গেছে তার কুরবানী মকরূহ। ভেড়ার পুচ্ছে মাংসপিন্ড কাটা থাকলে তার কুরবানী সিদ্ধ নয়। যেহেতু তা এক স্পষ্ট কমি এবং ইস্ফিত অংশ। অবশ্য এমন জাতের ভেঁড়া যার পশ্চাতে মাংস পিন্ড হয় না তার দ্বারা কুরবানী শুদ্ধ।
৩। কান চিরা, দৈর্ঘ্যে চিরা, পশ্চাৎ থেকে চিরা, সম্মুখ থেকে প্রস্থে চিরা, কান ফাটা ইত্যাদি।
৪। লিঙ্গ কাটা। অবশ্য মুষ্ক কাটা মকরূহ নয়। যেহেতু খাসীর দেহ হূষ্টপুষ্ট ও মাংস উৎকৃষ্ট হয়।
৫। দাঁত ভাঙ্গা ও চামড়ার কোন অংশ অগভীর কাটা বা চিরা ইত্যাদি।
কুরবানী সিদ্ধ হওয়ার তৃতীয় শর্ত হল মালিকানা। অর্থাৎ, কুরবানীদাতা যেন বৈধভাবে ঐ পশুর মালিক হয়। সুতরাং চুরিকৃত, আত্মসাৎকৃত অথবা অবৈধ ক্রয়-বিক্রয়ে ক্রীত পশুর কুরবানী সিদ্ধ নয়। তদনুরূপ অবৈধ মূল্য (যেমন সূদ, ঘুস, প্রবঞ্চনা প্রভৃতির অর্থ) দ্বারা ক্রীত পশুর কুরবানীও জায়েয নয়। যেহেতু কুরবানী এক ইবাদত যার দ্বারা আল্লাহর নৈকট্য লাভ করা হয়। আর কুরবানীর পশুর মালিক হওয়ার ঐ সমস্ত পদ্ধতি হল পাপময়। আর পাপ দ্বারা কোন প্রকার নৈকট্য লাভ সম্ভব নয়। বরং তাতে দূরতক্ষ সৃষ্টি হয়। রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘‘আল্লাহ পবিত্র, তিনি পবিত্র ব্যতীত কিছু গ্রহণ করেন না।[1]
কুরবানীর পশু নির্ধারণে মুসলিমকে সবিশেষ যত্নবান হওয়া উচিত, যাতে পশু সর্বগুণে সম্পূর্ণ হয়। যেহেতু এটা আল্লাহর নিদর্শন ও তা’যীমযোগ্য দ্বীনী প্রতীকসমূহের অন্যতম। যা আত্মসংযম ও তাকওয়ার পরিচায়ক। আল্লাহ তাআলা বলেন,
(ذلِكَ وَمَنْ يُعَظِّمْ شَعَائِرَ اللهِ فَإِنَّهَا مَنْ تَقْوَى الْقُلُوْبِ)
অর্থাৎ, এটিই আল্লাহর বিধান এবং কেউ আল্লাহর নিদর্শনাবলীর সম্মান করলে এতো তার হূদয়ের তাকওয়া (ধর্মনিষ্ঠা)। (সূরা হজ্জ্ ৩২ আয়াত)
এ তো সাধারণ দ্বীনী প্রতীকসমূহের কথা। নির্দিষ্টভাবে কুরবানীর পশু যে এক দ্বীনী প্রতীক এবং তার যত্ন করা যে আল্লাহর সম্মান ও তা’যীম করার শামিল, সে কথা অন্য এক আয়াত আমাদেরকে নির্দেশ করে। মহান আল্লাহ বলেন,
(وَالبُدْنَ جَعَلْنَاهَا لَكُمْ مِنْ شَعَائِرِ الله)
অর্থাৎ, (কুরবানীর) উঁটকে তোমাদের জন্য আল্লাহর নিদর্শনাবলীর অন্যতম করেছি। (সূরা হজ্জ ৩৬ আয়াত)
এখানে কুরবানী পশুর তা’যীম হবে তা উত্তম নির্বাচনের মাধ্যমে। ইবনে আববাস (রা.) প্রথম আয়াতের ব্যাখ্যায় বলেন, ‘কুরবানী পশুর সম্মান করার অর্থ হল, পুষ্ট মাংসবহুল, সুন্দর ও বড় পশু নির্বাচন করা।’[2]
রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর যুগে মুসলিমগণ দামী পশু কুরবানীর জন্য ক্রয় করতেন, মোটা-তাজা এবং উত্তম পশু বাছাই করতেন; যার দ্বারা আল্লাহর নিদর্শনাবলীর তা’যীম ঘোষণা করতেন। যা একমাত্র তাঁদের তাক্বওয়া, আল্লাহর প্রতি ভীতি ও ভালবাসা থেকে উদ্গত হত।[3]
অবশ্য মুসলিমকে এই স্থানে খেয়াল রাখা উচিত যে, মোটা-তাজা পশু কুরবানী করার উদ্দেশ্য কেবল উত্তম মাংস খাওয়া এবং আপোসে প্রতিযোগিতা করা না হয়। বরং উদ্দেশ্য আল্লাহর নিদর্শন ও ধর্মীয় এক প্রতীকের তা’যীম এবং তার মাধ্যমে আল্লাহর সামীপ্যলাভ হয়।
কালো রঙ অপেক্ষা ধূসর রঙের পশু কুরবানীর জন্য উত্তম। মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘‘কালো রঙের দুটি কুরবানী অপেক্ষা ধূসর রঙের একটি কুরবানী আল্লাহর নিকট অধিক পছন্দনীয়।’’[4]
এ পশু ক্রয়ের সময় ত্রুটিমুক্ত দেখা ও তার বয়সের খেয়াল রাখা উচিত। যেহেতু পশু যত নিখুঁত হবে তত আল্লাহর নিকট প্রিয় হবে, সওয়াবেও খুব বড় হবে এবং কুরবানীদাতার আন্তরিক তাক্বওয়ার পরিচায়ক হবে। কারণ, ‘‘আল্লাহর কাছে ওদের (কুরবানীর পশুর) মাংস এবং রক্ত পৌঁছে না, বরং তোমাদের তাক্বওয়া (পরহেযগারী) পৌঁছে থাকে। এভাবে তিনি এদেরকে তোমাদের অধীন করে দিয়েছেন, যাতে তোমরা আল্লাহর শ্রেষ্ঠত্ব ঘোষণা কর; এ জন্য যে তিনি তোমাদেরকে পথপ্রদর্শন করেছেন। সুতরাং (হে নবী!) তুমি সৎকর্মপরায়ণদেরকে সুসংবাদ দাও।’’ (সূরা হজ্জ ৩৭ আয়াত)
কুরবানীদাতা কুরবানীর পশু ক্রয়ের পর তাকে কথা দ্বারা (মুখে বলে) কুরবানীর জন্য নির্দিষ্ট করবে এবং কুরবানীর দিন তাকে কুরবানীর নিয়তে যবেহ করবে।
যখন কোন পশু কুরবানীর বলে নির্ণীত হয়ে যাবে, তখন তার জন্য কতক আহকাম বিষয়ীভূত হবে। যেমনঃ-
১। ঐ পশুর সবতক্ষ কুরবানীদাতার হাতছাড়া হবে। ফলে তা বিক্রয় করা, হেবা করা, উৎকৃষ্টতর বিনিময়ে ছাড়া পরিবর্তন করা বৈধ হবে না। যেহেতু যা আল্লাহর জন্য নির্দিষ্ট হয়েছে তার ক্রয়-বিক্রয় বৈধ নয়। তবে যেহেতু ওর চেয়ে উৎকৃষ্টতর পশুর বিনিময়ে পরিবর্তন করাতে কুরবানীর মান অধিক বর্ধিত হয়, তাই তা বৈধ। আর ওর চেয়ে মন্দতর পশু দ্বারা পরিবর্তন অবৈধ। কারণ, তাতে কুরবানীর আংশিক পরিমাণ হাতছাড়া হয়।
কুরবানীর পশু নির্দিষ্টকারী ব্যক্তি যদি মারা যায় তাহলেও তা বিক্রয় করা বৈধ নয়। বরং তার উত্তরাধিকারীগণ তা যবেহ করে ভক্ষণ করবে, দান করবে ও উপঢৌকন দিবে।
২। যদি তার কোন ত্রুটি দেখা দেয়, তাহলে ঐ ত্রুটি বড় না হলে (যাতে কুরবানী মকরূহ হলেও সিদ্ধ হবে। যেমন, কান কাটা, শিং ভাঙ্গা ইত্যাদি) তাই কুরবানী করবে। কিন্তু ত্রুটি বড় হলে (যাতে কুরবানী সিদ্ধ হয় না, যেমন স্পষ্ট খঞ্জতা ইত্যাদি) যদি তা নিজ কর্মদোষে হয়, তাহলে তার পরিবর্তে ত্রুটিহীন পশু কুরবানী করা জরুরী হবে। আর ঐ ত্রুটিযুক্ত পশুটি তার অধিকারভুক্ত হবে। তবে ঐ ত্রুটি যদি কুরবানীদাতার কর্মদোষে বা অবহেলায় না হয়, তাহলে ওটাই কুরবানী করা তার জন্য সিদ্ধ হবে।
কিন্তু নির্ণয়ের পূর্বে যদি কুরবানী তার উপর ওয়াজেব থাকে, যেমন কেউ কুরবানীর নযর মেনে থাকে এবং তারপর কোন ছাগল তার জন্য নির্ণীত করে এবং তারপর তার নিজ দোষে তা ত্রুটিযুক্ত না হয়ে অন্য কারণে হয়ে থাকে, তা হলেও ত্রুটিহীন পশু দ্বারা তার পরিবর্তন জরুরী হবে।
৩। কুরবানীর পশু হারিয়ে বা চুরি হয়ে গেলে, যদি তা কুরবানী দাতার অবহেলার ফলে না হয়, তাহলে তার পক্ষে অন্য কুরবানী জরুরী নয়। কারণ, তা তার হাতে এক প্রকার আমানত, যা যত্ন সত্ত্বেও বিনষ্ট হলে তার যামানত নেই। তবে ভবিষ্যতে ঐ পশু যদি ফিরে পায়, তবে কুরবানীর সময় পার হয়ে গেলেও ঐ সময়েই তা যবেহ করবে। কিন্তু যদি কুরবানী দাতার অবহেলা ও অযত্নের কারণে রক্ষা না করার ফলে হারিয়ে বা চুরি হয়ে যায়, তাহলে তার পরিবর্তে অন্য একটি পশু কুরবানী করা জরুরী হবে।
৪। কুরবানীর পশুর কোন অংশ (মাংস, চর্বি, চামড়া, দড়ি ইত্যাদি) বিক্রয় করা বৈধ হবে না। কারণ, তা আল্লাহর উদ্দেশ্যে উৎসর্গীকৃত বস্তু, তাই কোনও প্রকারে পুনরায় তা নিজের ব্যবহারে ফিরিয়ে আনা বৈধ নয়। তদনুরূপ ওর কোনও অংশ দ্বারা কসাইকে পারিশ্রমিক দেওয়া বৈধ নয়। যেহেতু সেটাও এক প্রকার বিনিময় যা ক্রয়-বিক্রয়ের মত[5]
অবশ্য কসাই গরীব হলে দান সবরূপ অথবা গরীব না হলে হাদিয়া সবরূপ তাকে কুরবানীর মাংস ইত্যাদি দেওয়া দূষণীয় নয়। যেহেতু তখন তাকে অন্যান্য হকদারদের শামিল মনে করা হবে; বরং সেই অধিক হকদার হবে। কারণ সে ঐ কুরবানীতে কর্মযোগে শরীক হয়েছে এবং তার মন ওর প্রতি আশানিক্ষত হয়েছে। তবে উত্তম এই যে, তার মজুরী আগে মিটিয়ে দেবে এবং পরে কিছু দান বা হাদিয়া দেবে। যাতে কোন সন্দেহ ও গোলযোগই অবশিষ্ট না থাকে।[6]
৫। পশু ক্রয় করার পর যদি তার বাচ্চা হয়, তাহলে মায়ের সাথে তাকেও কুরবানী করতে হবে।[7] এর পূর্বে ঐ পশুর দুধ খাওয়া যাবে; তবে শর্ত হল, যেন ঐ বাচ্চা ক্ষতিগ্রস্ত না হয় এবং তার প্রয়োজনের অতিরিক্ত হয়[8]
[2] (তফসীর ইবনে কাষীর ৩/২২৯)
[3] (ফাতহুল বারী ১০/৯)
[4] (আহমাদ, হাকেম, প্রমুখ, সিলসিলাহ সহীহাহ ১৮৬১নং)
[5] (বুখারী ১৬৩০, মুসলিম ১৩১৭নং)
[6] (ফাতহুল বারী ৩/৫৫৬)
[7] (তিঃ ১৫০৩নং)
[8] (বাইহাকী ৯/২৮৮, আল-মুমতে ৭/৫১০)