বছরের বার মাসে ও বিভিন্ন মাসের বিভিন্ন দিনে বিভিন্ন আকৃতি ও প্রকৃতির সালাত ও সেগুলোর নামে আজগুবি ও উদ্ভট সব ফযীলতের বর্ণনা দিয়ে হাদীস বানিয়েছে জালিয়াতগণ। প্রচলিত ‘বার চাঁদের ফযীলত’ জাতীয় গ্রন্থগুলো এ সব বাতিল কথায় ভরা। পাঠকদের সুবিধার্থে আমি আরবী মাসগুলোর উল্লেখ করে, সে বিষয়ক সহীহ ও বানোয়াট সালাত, সিয়াম, অন্যান্য আমল ও ফযীলতের কথা উল্লেখ করব। আল্লাহর তাওফীক চাই।
১. মুহাররাম মাস
(ক) সহীহ হাদীসের আলোকে মুহার্রাম মাস
আরবী পঞ্জিকার প্রথম মাস মুহাররাম। সহীহ হাদীসের আলোকে আমরা এ মাসের ফযীলত সম্পর্কে নিম্নের বিষয়গুলো জানতে পারি:
(১) বৎসরের চারটি ‘হারাম’ মাস: মুহার্রাম, রজব, যিলকাদ ও যুলহাজ্জ মাস। এ মাসগুলো ইসলামী শরীয়তে বিশেষভাবে সম্মানিত। এগুলোতে ঝগড়াঝাটি বা যুদ্ধবিগ্রহ নিষিদ্ধ। আল্লাহ বলেছেন: ‘‘আকাশমন্ডলী ও পৃথিবীর সৃষ্টির দিন হতেই আল্লাহর বিধানে আল্লাহর নিকট মাস গণনায় মাস বারটি, তন্মধ্যে চারটি নিষিদ্ধ মাস। এটি সুপ্রতিষ্ঠিত বিধান। সুতরাং এ নিষিদ্ধ মাসগুলোর মধ্যে তোমরা নিজেদের প্রতি জুলুম করো না...।’’[1]
(২) এ মাসকে সহীহ হাদীসে ‘আল্লাহর মাস’ বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে এবং এ মাসের নফল সিয়াম সর্বোত্তম নফল সিয়াম বলে উল্লেখ করা হয়েছে। সহীহ মুসলিমে সংকলিত হাদীসে রাসুলুল্লাহ (ﷺ) বলেন:
أفْضَلُ الصِّيَامِ بَعْدَ رَمَضَانَ شَهْرُ اللهِ المُحَرَّمُ
‘‘রামাদানের পরে সর্বোত্তম সিয়াম হলো আল্লাহর মাস মুহার্রাম মাস।’’[2]
(৩) এ মাসের ১০ তারিখ ‘আশূরা’র দিনে সিয়াম পালনের বিশেষ ফযীলত রয়েছে। আশূরার সিয়াম সম্পর্কে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেন:
يُكَفِّرُ السَّنَةَ الْمَاضِيَةَ
‘‘এ দিনের সিয়াম গত এক বছরের পাপ মার্জনা করে।’’[3]
এ দিনে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) নিজে সিয়াম পালন করতেন, তাঁর উম্মাতকে সিয়াম পালনে উৎসাহ দিয়েছেন এবং ১০ তারিখের সাথে সাথে ৯ বা ১১ তারিখেও সিয়াম পালন করতে উৎসাহ দিয়েছেন।[4]
(৪) সহীহ হাদীস দ্বারা প্রমাণিত হয়েছে যে, এ দিনে মহান আল্লাহ তাঁর রাসূল মূসা (আঃ) ও তাঁর সঙ্গী বনী ইসরাঈলকে ফির্আউনের হাত থেকে উদ্ধার করেন এবং ফির‘আউন ও তার সঙ্গীদেরকে ডুবিয়ে মারেন।[5]
(খ) অত্যন্ত দুর্বল হাদীস ও সাহাবী-তাবিয়ীগণের বক্তব্য
সহীহ হাদীস থেকে মুহার্রাম মাস ও আশুরা সম্পর্কে শুধু এতটুকুই জানা যায়। পরবর্তীকালে অনেক বানোয়াট ও মিথ্যা কাহিনী এক্ষেত্রে প্রচলিত হয়েছে। এখানে দুটি বিষয় লক্ষণীয়:
প্রথম বিষয়: এ দিনটিকে ইহূদীগণ সম্মান করত। এ কারণে ইহূদীদের মধ্যে এ দিনটি সম্পর্কে অনেক ভিত্তিহীন কল্প-কাহিনী প্রচলিত ছিল। পরবর্তী যুগে ইসরাঈলী রেওয়ায়াত হিসাবে সেগুলো মুসলিম সমাজে প্রবেশ করেছে। প্রথম যুগে মুসলিমগণ এগুলো সত্য বা মিথ্যা বলে বিশ্বাস না করে ইসরাঈলী কাহিনী হিসাবেই বলেছেন। পরবর্তী যুগে তা ‘হাদীসে’ পরিণত হয়েছে।
দ্বিতীয় বিষয়: রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর ইন্তিকালের অর্ধ শতাব্দী পরে ৬১ হিজরীর মুহার্রাম মাসের ১০ তারিখে আশূরার দিনে তাঁর প্রিয়তম নাতি হুসাইন (রা) কারবালার প্রান্তরে শহীদ হন। এ ঘটনা মুসলিম উম্মাহর মধ্যে চিরস্থায়ী প্রভাব বিস্তার করে। হুসাইন (রা)-এর পক্ষের ও বিপক্ষের অনেক বিবেকহীন দুর্বল ঈমান মানুষ ‘আশূরার’ বিষয়ে অনেক ‘হাদীস’ বানিয়েছে। কেউ দিনটিকে ‘শোক দিবস’ হিসেবে এবং কেউ দিনটিকে ‘বিজয় দিবস’ হিসেবে পালনের জন্য নানা প্রকারের কথা বানিয়েছেন। তবে মুহাদ্দিসগণের নিরীক্ষা পদ্ধতিতে এ সকল জালিয়াতি ধরা খুবই সহজ ছিল।
মুহার্রাম ও আশূরা সম্পর্কে এজাতীয় প্রচলিত কথাবার্তাকে আমরা দু ভাগে ভাগ করতে পারি: (১) যে সকল ‘হাদীস’ কোনো কোনো মুহাদ্দিস জাল বা বানোয়াট বলে উল্লেখ করলেও, কেউ কেউ তা দুর্বল হিসাবে গ্রহণ করেছেন এবং যে সকল ‘হাদীস’ অত্যন্ত দুর্বল সনদে কোনো কোনো সাহাবী বা তাবিয়ী থেকে তাঁর নিজের বক্তব্য হিসেবে বর্ণিত হয়েছে। বাহ্যত ইসরাঈলী বর্ণনার ভিত্তিতে তাঁরা এগুলি বলেছেন। (২) সকল মুহাদ্দিস যে সকল হাদীসকে ‘জাল’ ও ভিত্তিহীন বলে একমত পোষণ করেছেন। এখানে আমরা প্রথম পর্যায়ের কিছু হাদীস ও মতামত উল্লেখ করছি:
- অত্যন্ত দুর্বল সূত্রে কোনো কোনো সাহাবী বা তাবিয়ী থেকে বর্ণিত হয়েছে যে, এ দিনে আল্লাহ তা’আলা আদম (আঃ)-এর তাওবা কবুল করেন।
- অনির্ভরযোগ্য সূত্রে বর্ণিত হয়েছে যে, এ দিনে নূহ (আঃ) এর নৌকা জূদী পর্বতের উপর থামে।
- অনির্ভরযোগ্য সূত্রে বর্ণিত হয়েছে, এ দিনে ঈসা (আঃ) জন্মগ্রহণ করেন।
- মুহার্রাম মাসে বা আশূরার দিনে দান-সাদকার বিষয়ে যা কিছু বলা হয় সবই বানোয়াট ও ভিত্তিহীন। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) থেকে এ বিষয়ে কিছুই বর্ণিত হয় নি। তবে অত্যন্ত দুর্বল ও অনির্ভরযোগ্য সূত্রে একজন সাহাবী (রা) থেকে বর্ণিত হয়েছে, তিনি বলেছেন, আশুরার দিনে সিয়াম পালন করলে যেহেতু এক বছরের সাওয়াব পাওয়া যায়, সেহেতু এ দিনে দান করলেও এক বছরের দানের সাওয়াব পাওয়া যেতে পারে। এ ছাড়া এ দিনে দানের বিষয়ে যা কিছু বলা হয় সবই বাতিল ও ভিত্তিহীন কথা।[6]
- আশুরার দিনে ভাল খাওয়া-পরা। একটি হাদীসে বলা হয়েছে:
مَنْ وَسَّعَ عَلَى عِيَالِهِ فِيْ يَوْمِ عَاشُوْرَاءَ، وَسَّعَ اللهُ عَلَيْهِ فِيْ سَنَتِهِ كُلِّهَا
‘‘যে ব্যক্তি আশূরার দিনে তার পরিবারের জন্য প্রশস্তভাবে খরচ করবে, আল্লাহ সারা বছরই সে ব্যক্তিকে প্রশস্ত রিয্ক প্রদান করবেন।’’
হাদীসটি কয়েকটি সনদে বর্ণিত হয়েছে। প্রত্যেকটি সনদই অত্যন্ত দুর্বল। বিভিন্ন সনদের কারণে বাইহাকী, ইরাকী, সুয়ূতী প্রমুখ মুহাদ্দিস এ হাদীসটিকে ‘জাল’ হিসেবে গণ্য না করে ‘দুর্বল’ বলে আখ্যায়িত করেছেন। ইবনু হাজার হাদীসটিকে ‘অত্যন্ত আপত্তিকর ও খুবই দুর্বল’ বলেছেন। অপরদিকে ইমাম আহমাদ ইবনু হাম্বাল, ইবনু তাইমিয়া প্রমুখ মুহাদ্দিস একে জাল ও বানোয়াট বলে গণ্য করেছেন। তাঁরা বলেন যে, প্রত্যেক সনদই অত্যন্ত দুর্বল হওয়ার ফলে একাধিক সনদে এর গ্রহণযোগ্যতা বৃদ্ধি পায় না। এছাড়া হাদীসটি সহীহ হাদীসের বিরোধী। সহীহ হাদীসে উল্লেখ করা হয়েছে যে, ইহূদীরা আশুররা দিনে উৎসব- আনন্দ করে- তোমরা তাদের বিরোধিতা করবে, এ দিনে সিয়াম পালন করবে এবং উৎসব বা আনন্দ করবে না।[7]
- আশূরার দিনে সুরমা ব্যবহার। একটি হাদীসে বলা হয়েছে:
مَنِ اكْتَحَلَ يَوْمَ عَاشُوْرَاءَ بِالإِثْمِدِ، لَمْ تَرْمُدْ عَيْنُهُ أَبَداً
‘‘যে ব্যক্তি আশূরার দিনে চোখে ‘ইসমিদ’ সুরমা ব্যবহার করবে কখনোই তার চোখ উঠবে না।’’
উপরের হাদীসটির মতই এ হাদীসটি একাধিক সনদে বর্ণিত হয়েছে। প্রত্যেক সনদেই অত্যন্ত দুর্বল বা মিথ্যাবাদী রাবী রয়েছে। কোনো কোনো মুহাদ্দিস একাধিক সনদের কারণে হাদীসটিকে ‘দুর্বল’ হিসাবে গণ্য করলেও অধিকাংশ মুহাদ্দিস হাদীসটিকে জাল ও বানোয়াট হিসাবে গণ্য করেছেন। তাঁরা বলেন, ইমাম হুসাইনের হত্যাকারীগণ আশুরার দিনে সুরমা মাখার বিদ‘আতটি চালু করেন। এ কথাটি তাদেরই বানানো। কোনো দুর্বল রাবী বেখেয়ালে তা বর্ণনা করেছেন।[8]
(গ) মুহাররাম মাস বিষয়ক মিথ্যা ও ভিত্তিহীন কথাবার্তা
উপরের কথাগুলো কোনো কোনো মুহাদ্দিস জাল বলে গণ্য করলেও কেউ কেউ তা ‘দুর্বল’ বলে গণ্য করেছেন। নিচের কথাগুলো সকল মুহাদ্দিস একবাক্যে জাল বলে স্বীকার করেছেন। এগুলোকে আমরা তিন ভাগে ভাগ করতে পারি: প্রথম, মুহার্রাম বা আশুরার সিয়ামের ফযীলতের বিষয়ে জাল কথা, দ্বিতীয়, আশুরার দিনের বা রাতের জন্য বা মুহার্রম মাসের জন্য বিশেষ সালাত ও তার ফযীলতের বিষয়ে জাল কথা এবং তৃতীয়, আশুরার দিনে অতীত ও ভবিষ্যতে অনেক বড় বড় ঘটনা ঘটেছে বা ঘটবে বলে জাল কথা।
১. মুহার্রাম বা আশূরার সিয়াম
আশুরার সিয়াম পূর্ববর্তী এক বছরের গোনাহের কাফ্ফারা হবে বলে সহীহ হাদীসে আমরা দেখতে পেয়েছি। জালিয়াতগণ আরো অনেক কথা এ সম্পর্কে বানিয়েছে। প্রচলিত একটি পুস্তক থেকে উদ্ধৃত করছি:
‘‘হাদীসে আছে- যে ব্যক্তি মহররমের মাসে রোযা রাখিবে, আল্লাহ তা‘আলা তাহাকে প্রত্যেক রোযার পরিবর্তে ৩০ দিন রোযা রাখার সমান ছওয়াব দিবেন। আরও হাদীছে আছে- যে ব্যক্তি আশুরার দিন একটি রোযা রাখিবে সে দশ হাজার ফেরেশতার, দশ হাজার শহীদের ও দশ হাজার হাজীর ছওয়াব পাইবে। আরও হাদীছে আছে- যে ব্যক্তি আশুরার তারিখে স্নেহ-পরবশ হইয়া কোন এতীমের মাথায় হাত ঘুরাইবে, আল্লাহতাআলা ঐ এতীমের মাথার প্রত্যেক চুলের পরিবর্তে তাহাকে বেহেশতের এক একটি ‘দরজা’ প্রদান করিবেন। আর যে ব্যক্তি উক্ত তারিখের সন্ধ্যায় রোযাদারকে খানা খাওয়াইবে বা ইফতার করাইবে, সে ব্যক্তি সমস্ত উম্মতে মোহাম্মদীকে খানা খাওয়াইবার ও ইফতার করাইবার ন্যায় ছওয়াব পাইবে।
হযরত (ﷺ) আরও বলিলেন, যে ব্যক্তি আশুরার তারিখে রোযা রাখিবে, সে ৬০ বৎসর রোযা নামায করার সমতুল্য ছওয়াব পাইবে। যে ব্যক্তি ঐ তারিখে বিমার পোরছী করিবে, সে সমস্ত আওলাদে আদমের বিমার-পোরছী করার সমতুল্য ছওয়াব পাইবে।... তাহার পরিবারের ফারাগতি অবস্থা হইবে। ৪০ বৎসরের গুনাহর কাফ্ফারা হইয়া যাইবে।... (হাদীস)’’[9]
অনুরূপ আরেকটি মিথ্যা কথা: ‘‘হযরত রাসূলুল্লাহ (ﷺ) এরশাদ করিয়াছেন, যে ব্যক্তি মহররম মাসের প্রথম ১০ দিন রোজা রাখিবে, সে ব্যক্তি যেন ১০ হাজার বৎসর যাবত দিনের বেলা রোজা রাখিল এবং রাত্রিবেলা ইবাদতে জাগরিত থাকিল। ... মহররম মাসে ইবাদতকারী ব্যক্তি যেন ক্বদরের রাত্রির ইবাদতের ফযীলত লাভ করিল।... তোমরা আল্লাহ তা‘আলার পছন্দনীয় মাস মহররমের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করিও। যেই ব্যক্তি মহররম মাসের সম্মান করিবে, আল্লাহ তাআলা তাহাকে জান্নাতের মধ্যে সম্মানিত করিবেন এবং জাহান্নামের আযাব হইতে বাঁচাইয়া রাখিবেন... মহররমের ১০ তারিখে রোজা রাখা আদম (আঃ) ও অন্যান্য নবীদের উপর ফরজ ছিল। এই দিবসে ২০০০ নবী জন্মগ্রহণ করিয়াছেন এবং ২০০০ নবীর দোয়া কবুল করা হইয়াছে ...।’’[10]
মুহাদ্দিসগণ একমত যে, এগুলো সবই বানোয়াট কথা ও জাল হাদীস।[11]
২. মুহার্রাম মাসের সালাত
মুহার্রাম মাসের কোনো দিবসে বা রাত্রে এবং আশুরার দিবসে বা রাত্রে কোনো বিশেষ সালাত আদায়ের কোনো প্রকার নির্দেশনা বা উৎসাহ কোনো হাদীসে বর্ণিত হয় নি। এ বিষয়ক সকল কথাই বানোয়াট। আমাদের দেশে প্রচলিত কোনো কোনো পুস্তকে মুহার্রাম মাসের ১ম তারিখে দুই রাক‘আত সালাত আদায় করে বিশেষ দোয়া পাঠের বিশেষ ফযীলতের বিবরণ দেয়া হয়েছে। এগুলো সবই বানোয়াট ও ভিত্তিহীন।[12]
৩. আশুরার দিনে বা রাতে বিশেষ সালাত
আশুরার সিয়ামের উৎসাহ দেয়া হলেও, হাদীসে আশুরার দিনে বা রাত্রে কোনো বিশেষ সালাত আদায়ের বিধান দেওয়া হয় নি। তবে জালিয়াতগণ অনেক কথা বানিয়েছে। যেমন, যে ব্যক্তি আশুরার দিবসে যোহর ও আসরের মধ্যবর্তী সময়ে ... অথবা আশুরার রাত্রিতে এত রাকআত সালাত অমুক অমুক সূরা এতবার পাঠ করে আদায় করবে ... সে এত পুরস্কার লাভ করবে। সরলপ্রাণ মুসলিমদের মন জয় করার জন্য জালিয়াতগণ এ সকল কথা বানিয়েছে, যা অনেক সময় সরলপ্রাণ আলিম ও বুযুর্গকেও ধোঁকা দিয়েছে।[13]
৪. আশুরায় অতীত ও ভবিষ্যত ঘটনাবলির বানোয়াট ফিরিস্তি
মিথ্যাবাদীরা রাসূলুল্লাহ (ﷺ) এর নামে জালিয়াতি করে বলেছে:
- আশুরার দিনে আল্লাহ আসমান ও যমিন সৃষ্টি করেছেন।
- এ দিনে তিনি পাহাড়, পর্বত, নদনদী.... সৃষ্টি করেছেন।
- এ দিনে তিনি কলম সৃষ্টি করেছেন।
- এ দিনে তিনি লাওহে মাহফূয সৃষ্টি করেছেন।
- এ দিনে তিনি আরশ সৃষ্টি করেছেন।
- এ দিনে তিনি আরশের উপরে সমাসীন হয়েছেন।
- এ দিনে তিনি কুরসী সৃষ্টি করেছেন।
- এ দিনে তিনি জান্নাত সৃষ্টি করেছেন।
- এ দিনে তিনি জিবরাঈলকে (আঃ) সৃষ্টি করেছেন।
- এ দিনে তিনি ফিরিশতাগণকে সৃষ্টি করেছেন।
- এ দিনে তিনি আদমকে (আঃ) সৃষ্টি করেছেন।
- এ দিনে তিনি আদমকে (আঃ) জান্নাতে প্রবেশ করিয়েছেন।
- এ দিনে তিনি ইদরীসকে (আঃ) আসমানে উঠিয়ে নেন।
- এ দিনে তিনি নূহ (আঃ)-কে নৌকা থেকে বের করেন।
- এ দিনে তিনি দায়ূদের (আঃ) তাওবা কবুল করেছেন।
- এ দিনে তিনি সুলাইমান (আঃ)-কে রাজত্ব প্রদান করেছেন।
- এ দিনে তিনি আইঊব (আঃ)-এর বিপদ-মসিবত দূর করেন।
- এ দিনে তিনি তাওরাত নাযিল করেন।
- এ দিনে ইবরাহীম (আঃ) জন্মগ্রহণ করেন... খলীল উপাধি লাভ করেন।
- এ দিনে ইবরাহীম (আঃ) নমরূদের অগ্নিকুন্ডু থেকে রক্ষা পান।
- এ দিনে ইসমাঈল (আঃ) কে কুরবানী করা হয়েছিল।
- এ দিনে ইউনূস (আঃ) মাছের পেট থেকে বাহির হন।
- এ দিনে আল্লাহ ইউসূফকে (আঃ) জেলখানা থেকে বের করেন।
- এ দিনে ইয়াকুব (আঃ) দৃষ্টি শক্তি ফিরে পান।
- এ দিনে ইয়াকূব (আঃ) ইউসূফের (আঃ) সাথে সম্মিলিত হন।
- এ দিনে মুহাম্মাদ (ﷺ) জন্মগ্রহণ করেছেন।
- এ দিনে কেয়ামত সংঘঠিত হবে....।
কেউ কেউ বানিয়েছে: মুহার্রামের ২ তারিখে নূহ (আঃ) প্লাবন হতে মুক্তি পেয়েছেন, ৩ তারিখে ইদরীসকে (আঃ) আসমানে উঠানো হয়েছে, ৪ তারিখে ইবরাহীমকে (আঃ) অগ্নিকুন্ডে নিক্ষেপ করা হয়েছে, ইত্যাদি ইত্যাদি।
এরূপ অগণিত ঘটনা এ মাসে বা এ দিনে ঘটেছে এবং ঘটবে বলে উল্লেখ করেছে জালিয়াতরা তাদের এ সকল কল্প কাহিনীতে। মোট কথা হলো, আশুরার দিনে মূসা (আঃ) ও তাঁর সাথীদের মুক্তি পাওয়া ছাড়া আর কোনো ঘটনা সহীহ হাদীস দ্বারা প্রমাণিত নয়। আদমের (আঃ) এর তাওবা কবুল, নূহ (আঃ) এর নৌকা জূদী পর্বতের উপর থামা ও ঈসা (আঃ) জন্মগ্রহণ করার কথা অনির্ভরযোগ্য সূত্রে কোনো কোনো সাহাবী-তাবিয়ী থেকে বর্ণিত। আশুরা বা মুহার্রাম সম্পর্কে আর যা কিছু বলা হয় সবই মিথ্যা ও বাতিল কথা। দুঃখজনক হলো, আমাদের সমাজে মুহার্রাম বা আশূরা বিষয়ক বই পুস্তকে, আলোচনা ও ওয়াযে এ সমস্ত ভিত্তিহীন কথাবার্তা উল্লেখ করা হয়।[14]
[2] মুসলিম, আস-সহীহ ২/৮২১।
[3] মুসলিম, আস-সহীহ ২/৮১৯।
[4] ইবনু রাজাব, লাতাইফ ১/৬৮-৭৬; আব্দুল হাই লাখনবী, আল-আসার, পৃ. ৯১-৯৪।
[5] বুখারী, আস-সহীহ ২/৭০৪, ৩/১২৪৪; মুসলিম, আস-সহীহ ২/৭৯৬।
[6] ইবনু রাজাব, লাতাইফ ১/৭৮; আব্দুল হাই লাখনবী, আল-আসার, পৃ. ৯৫-৯৬।
[7] ইবনু তাইমিয়া, আহাদীসুল কুস্সাস, পৃ. ৭৯, ইবনুল জাওযী, আল-মাওদূ‘আত ২/১১৩-১১৭; সুয়ূতী, আল-লাআলী ২/১০৯-২১৩; সাখাবী, আল-মাকাসিদ, পৃ. ৪২৭; আল-যারকশী, আত-তাযকিরা ৩৪, ১১৮; ইবনু আর্রাক, তানযীহ ২/১৫০-১৫৭; ইবনু রাজাব, লাতাইফ ১/৭৯; মোল্লা কারী, আল-আসরার, পৃ. ২৪৪-২৪৫; শাওকানী, আল-ফাওয়াইদ ১/১৩২-১৩৩; আব্দুল হাই লাখনবী, আল-আসার, পৃ. ১০০-১০২।
[8] ইবনুল জাওযী, আল-মাওদূ‘আত ২/১১৬; সুয়ূতী, আল-লাআলী ২/২১১; সাখাবী, আল-মাকাসিদ, পৃ. ৪০১; ইবনু আর্রাক, তানযীহ ২/১৫৭; ইবনু রাজাব, লাতাইফ ১/৭৯; মোল্লা কারী, আল-আসরার, পৃ. ২২২; মাসনূ, পৃ. ১৪১; শাওকানী, আল-ফাওয়াইদ ১/১৩১-১৩২; আব্দুল হাই লাখনবী, আল-আসার, পৃ. ১০০-১০২।
[9] মাও. গোলাম রহমান, মকছুদোল মো’মেনীন, পৃ. ৪৩০-৪৩১। পুনশ্চ: মুফতী হাবীব ছামদানী, বার চান্দের ফযীলত, পৃ. ১৩; অধ্যাপিকা কামরুন নেসা দুলাল, পৃ. ২৯৮-৩০০।
[10] মুফতী হাবীব ছামদানী, বার চান্দের ফযীলত, পৃ. ১৩।
[11] ইবনুল জাওযী, আল-মাওদূ‘আত ২/১১২-১১৭; সুয়ূতী, আল-লাআলী ২/১০৮-১০৯; ইবনু আর্রাক, তানযীহ ২/১৪৯-১৫১; মোল্লা কারী, আল-আসরার, পৃ. ২৯৪; শাওকানী, আল-ফাওয়াইদ ১/১২৯-১৩০; আব্দুল হাই লাখনবী, আল-আসার, পৃ. ৯৪-৯৫।
[12] মুফতী হাবীব ছামদানী, বার চান্দের ফযীলত, পৃ. ১১-১২; অধ্যাপিকা কামরুন নেসা দুলাল, নেক কানুন, পৃ. ২৯৮।
[13] ইবনুল জাওযী, মাওদূ‘আত ২/৪৫-৪৬; সুয়ূতী, লাআলী ২/৫৪; ইবন আর্রাক, তানযীহ ২/৮৯; শাওকানী, আল-ফাওয়াইদ ১/৭৩; আব্দুল হাই লাখনবী, আল-আসার, পৃ. ৯০, ১১০-১১১।
[14] ইবনুল জাওযী, আল-মাউদূ‘আত ২/১১২-১১৭; ইবনুল কাইয়িম, আল-মানার, পৃ. ৫২; যাহাবী, মীযানুল ই’তিদাল ২/১৯০; ইবনু হাজার, লিসানুল মীযান ২/১৬৯; সুয়ূতী, আল-লাআলী ২/১০৮-১০৯; ইবনু আর্রাক, তানযীহ ২/১৪৯; মোল্লা কারী, আল-আসরার, পৃ. ৩০০; আব্দুল হাই লাখনবী, আল-আসার, পৃ. ৯৪-৯৭; দরবেশ হূত, আসনাল মাতালিব, পৃ. ২৭৭-২৭৮; আজলূনী, কাশফুল খাফা ২/৫৫৭।
উপরের আলোচনা থেকে আমরা দেখেছি যে, মুহার্রাম মাসের জন্য কোনো বিশেষ সালাত নেই, তবে এ মাসে বিশেষ সিয়ামের কথা হাদীস শরীফে বর্ণিত হয়েছে এবং এ জন্য বিশেষ সাওয়াব ও ফযীলত রয়েছে। পক্ষান্তরে সফর মাসের জন্য কোনো বিশেষ সালাতও নেই, সিয়ামও নেই। এ মাসের কোনো দিবসে বা রাত্রে কোনো প্রকারের সালাত আদায়ের বিশেষ সাওয়াব বা ফযীলতে কোনো হাদীস বর্ণিত হয় নি। অনুরূপভাবে এ মাসের কোনো দিনে সিয়াম পালনেরও কোনো বিশেষ ফযীলত কোনো হাদীসে বর্ণিত হয় নি। এ বিষয়ে যা কিছু বলা হয় সবই বানোয়াট ও ভিত্তিহীন কথা।
এ মাসকে কেন্দ্র করেও অনেক মিথ্যা ও ভিত্তিহীন কথা মুসলিম সমাজে প্রচলিত হয়েছে। এগুলোকে আমরা তিন ভাগে বিভক্ত করতে পারি। প্রথম, সফর মাসের ‘অশুভত্ব’ ও ‘বালা-মুসিবত’ বিষয়ক, দ্বিতীয়, সফর মাসের প্রথম তারিখে বা অন্য সময়ে বিশেষ সালাত ও তৃতীয়, আখেরী চাহার শোম্বা বা সফর মাসের শেষ বুধবার বিষয়ক।
(ক) সফর মাসের অশুভত্ব ও এ মাসের বালা-মুসিবত
কোনো স্থান, সময়, বস্ত্ত বা কর্মকে অশুভ, অযাত্রা বা অমঙ্গলময় বলে মনে করা ইসলামী বিশ্বাসের ঘোর পরিপন্থী একটি কুসংস্কার। এ বিষয়ে আমরা পরবর্তীকালে আলোচনা করব, ইনশা আল্লাহ। এখানে লক্ষণীয় যে, আরবের মানুষেরা জাহেলী যুগ থেকে ‘সফর’ মাসকে অশুভ ও বিপদাপদের মাস বলে বিশ্বাস করত। রাসূলুল্লাহ ﷺ তাদের এ কুসংস্কারের প্রতিবাদ করে বলেন:
لاَ طِيَرَةَ ، وَلاَ هَامَةَ وَلاَ صَفَرَ
‘‘...কোনো অশুভ-অযাত্রা নেই, কোনো ভুত-প্রেত বা অতৃপ্ত আত্মা নেই এবং সফর মাসের অশুভত্বের কোনো অস্তিত্ব নেই।...’’[1]
অথচ এর পরেও মুসলিম সমাজে অনেকের মধ্যে পূর্ববর্তী যুগের এ সকল কুসংস্কার থেকে যায়। এ সকল কুসংস্কারকে উস্কে দেয়ার জন্য অনেক বানোয়াট কথা হাদীসের নামে বানিয়ে সমাজে প্রচার করেছে জালিয়াতগণ। এ সকল জাল কথার মধ্যে রয়েছে: এ মাস বালা মুসিবতরে মাস। এ মাসে এত লক্ষ এত হাজার... বালা নাযিল হয়।.. এ মাসেই আদম ফল খেয়েছিলেন। এমাসেই হাবীল নিহত হন। এ মাসেই নূহের কাওম ধ্বংস হয়। এ মাসেই ইবরাহীমকে (আঃ) আগুনে ফেলা হয়। .... এ মাসের আগমনে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) ব্যথিত হতেন। এ মাস চলে গেলে খুশি হতেন....। তিনি বলতেন:
مَنْ بَشَّرَنِيْ بِخُرُوْجِ صَفَرٍ بَشَّرْتُهُ بِالْجَنَّةِ (بِدُخُوْلِ الْجَنَّةِ)
‘‘যে ব্যক্তি আমাকে সফর মাস অতিক্রান্ত হওয়ার সুসংবাদ প্রদান করবে, আমি তাকে জান্নাতে প্রবেশ করার সুসংবাদ প্রদান করব।’’ .... ইত্যাদি অনেক কথা তারা বানিয়েছে। আর অনেক সরলপ্রাণ বুযুর্গও তাদের এ সকল জালিয়াতি বিশ্বাস করে ফেলেছেন। মুহাদ্দিসগণ একমত যে, সফর মাসের অশুভত্ব ও বালা-মুসিবত বিষয়ক সকল কথাই ভিত্তিহীন মিথ্যা।[2]
(খ) সফর মাসের ১ম রাতের সালাত
উপরের মিথ্যা কথাগুলোর ভিত্তিতেই একটি ভিত্তিহীন ‘সালাতের’ উদ্ভাবন করা হয়েছে। বলা হয়েছে, কেউ যদি সফর মাসের ১ম রাত্রিতে মাগরিবের পরে ... বা ইশার পরে.. চার রাক‘আত সালাত আদায় করে, অমুক অমুক সূরা বা আয়াত এতবার পাঠ করে .... তবে সে বিপদ থেকে রক্ষা পাবে, এত পুরস্কার পাবে... ইত্যাদি। এগুলো সবই ভিত্তিহীন বানোয়াট কথা, যদিও অনেক সরলপ্রাণ আলিম ও বুযুর্গ এগুলো বিশ্বাস করেছেন বা তাদের বইয়ে বা ওয়াযে উল্লেখ করেছেন।[3]
(গ) সফর মাসের শেষ বুধবার
বিভিন্ন জাল হাদীসে বলা হয়েছে, বুধবার অশুভ এবং যে কোনো মাসের শেষ বুধবার সবচেয়ে অশুভ দিন। আর সফর মাস যেহেতু অশুভ, সেহেতু সফর মাসের শেষ বুধবার বছরের সবচেয়ে বেশি অশুভ দিন এবং এ দিনে সবচেয়ে বেশি বালা মুসিবত নাযিল হয়। এ সব ভিত্তিহীন কথাবার্তা অনেক সরলপ্রাণ বুযুর্গ বিশ্বাস করেছেন। যেমন: ‘‘সফর মাসে একলাখ বিশ হাজার ‘বালা’ নাজিল হয় এবং সবদিনের চেয়ে ‘আখেরী চাহার শুম্বা-’তে (সফর মাসে শেষ বুধবার) নাজিল হয় সবচেয়ে বেশী। সুতরাং ঐ দিনে যে ব্যক্তি নিম্নোক্ত নিয়মে চার রাকাত নামাজ পাঠ করবে আল্লাহ তায়ালা তাকে ঐ বালা থেকে রক্ষা করবেন এবং পরবর্তী বছর পর্যন্ত তাকে হেফাজতে রাখবেন...।’’[4]
এগুলো সবই ভিত্তিহীন কথা। তবে আমাদের দেশে ‘আখেরী চাহার শুম্বা’-র প্রসিদ্ধি এ কারণে নয়, অন্য কারণে। প্রসিদ্ধ আছে যে, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) সফর মাসের শেষ দিকে অসুস্থ হয়ে পড়েন। তিনি সফর মাসের শেষ বুধবারে কিছুটা সুস্থ হন এবং গোসল করেন। এরপর তিনি পুনরায় অসুস্থ হয়ে পড়েন এবং এ অসুস্থতাতেই তিনি পরের মাসে ইন্তিকাল করেন। এজন্য মুসলিমগণ এ দিনে তাঁর সর্বশেষ সুস্থতা ও গোসলের স্মৃতি উদযাপন করেন।
এ বিষয়ক প্রচলিত কাহিনীর সার-সংক্ষেপ প্রচলিত একটি পুস্তক থেকে উদ্ধৃত করছি: ‘‘হযরত নবী করীম (ﷺ) দুনিয়া হইতে বিদায় নিবার পূর্ববর্তী সফর মাসের শেষ সপ্তাহে ভীষণভাবে রোগে আক্রান্ত হইয়া ছিলেন। অতঃপর তিনি এই মাসের শেষ বুধবার দিন সুস্থ হইয়া গোসল করতঃ কিছু খানা খাইয়া মসজিদে নববীতে হাযির হইয়া নামাযের ইমামতী করিয়াছিলেন। ইহাতে উপস্থিত সাহাবীগণ অত্যধিক আনন্দিত হইয়াছিলেন। আর খুশীর কারণে অনেকে অনেক দান খয়রাত করিয়াছিলেন। বর্ণিত আছে, হযরত আবু বকর (রা) খুশীতে ৭ সহস্র দীনার এবং হযরত ওমর ইবনে খাত্তাব (রা) ৫ সহস্র দীনার, হযরত ওসমান (রা) ১০ সহস্র দীনার, হযরত আলী (রা) ৩ সহস্র দীনার এবং হযরত আব্দুর রহমান ইবনে আওফ (রা) ১০০ উট ও ১০০ ঘোড়া আল্লাহর ওয়াস্তে দান করিয়াছিলেন। তৎপর হইতে মুসলমানগণ সাহাবীগণের নীতি অনুকরণ ও অনুসরণ করিয়া আসিতেছে। হযরত নবী করীম (ﷺ) এর এই দিনের গোসলই জীবনের শেষ গোসল ছিল। ইহার পর আর তিনি জীবিতকালে গোসল করেন নাই। তাই সকল মুসলমানের জন্য এই দিবসে ওজু-গোসল করতঃ ইবাদৎ বান্দেগী করা উচিৎ এবং হযরত নবী করীম (ﷺ) এর প্রতি দরূদ শরীফ পাঠ করতঃ সাওয়াব রেছানী করা কর্তব্য...।’’[5]
উপরের এ কাহিনীটিই কমবেশি সমাজে প্রচলিত ও বিভিন্ন গ্রন্থে লেখা রয়েছে। আমি আমার সাধ্যমত চেষ্টা করেও কোনো সহীহ বা যয়ীফ হাদীসে এ ঘটনার কোনো প্রকারের উল্লেখ পাই নি। হাদীস তো দূরের কথা কোনো ইতিহাস বা জীবনী গ্রন্থেও আমি এ ঘটনার কোনো উল্লেখ পাই নি। ভারতীয় উপমহাদেশ ছাড়া অন্য কোনো মুসলিম সমাজে ‘সফর মাসের শেষ বুধবার’ পালনের রেওয়াজ বা এ কাহিনী প্রচলিত আছে বলে আমার জানা নেই।
১. রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর সর্বশেষ অসুস্থতা
রাসূলুল্লাহ (ﷺ) সফর বা রবিউল আউয়াল মাসের কত তারিখ থেকে অসুস্থ হয়ে পড়েন এবং কত তারিখে ইন্তিকাল করেন সে বিষয়ে হাদীস শরীফে কোনোরূপ উল্লেখ বা ইঙ্গিত নেই। অগণিত হাদীসে তাঁর অসুস্থতা, অসুস্থতা- কালীন অবস্থা, কর্ম, উপদেশ, তাঁর ইন্তিকাল ইত্যাদির ঘটনা বিস্তারিত বর্ণিত হয়েছে। কিন্তু কোথাও কোনো ভাবে কোনো দিন-তারিখ বলা হয় নি।
২য় হিজরী শতক থেকে আলিমগণ রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর জীবনের ঘটনাবলি ঐতিহাসিক দিন-তারিখ সহকারে সাজাতে চেষ্টা করেন। তাঁর অসুস্থতার শুরু সম্পর্কে অনেক মত রয়েছে। এ প্রসঙ্গে দ্বিতীয় হিজরী শতকের প্রখ্যাত তাবিয়ী ঐতিহাসিক ইবনু ইসহাক (১৫১ হি/৭৬৮ খৃ) বলেন:
اُبْتُدِئَ رَسُوْلُ اللهِ ﷺ بِشَكْوَاهُ الَّذِيْ قَبَضَهُ اللهُ فِيْهِ ... فِيْ لَيَالٍ بَقِيْنَ مِنْ صَفَرٍ، أَوْ فِيْ أَوَّلِ شَهْرِ رَبِيْعِ الأَوَّلِ.
‘‘রাসূলুল্লাহ (ﷺ) যে অসুস্থতায় ইন্তিকাল করেন, সে অসুস্থতার শুরু হয়েছিল সফর মাসের শেষে কয়েক রাত থাকতে, অথবা রবিউল আউয়াল মাসের শুরু থেকে।’’[6]
কি বার থেকে তাঁর অসুস্থতার শুরু হয়েছিল, সে বিষয়েও মতভেদ রয়েছে। কেউ বলেছেন শনিবার, কেউ বলেছেন বুধবার এবং কেউ বলেছেন সোমবার তার অসুস্থতার শুরু হয়।[7] কয়দিনের অসুস্থতার পরে তিনি ইন্তিকাল করেন, সে বিষয়ে মতভেদ রয়েছে। কেউ বলেছেন, ১০ দিন, কেউ বলেছেন, ১২ দিন, কেউ বলেছেন ১৩ দিন, কেউ বলেছেন, ১৪ দিন অসুস্থ থাকার পরে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইন্তিকাল করেন।[8]
পরবর্তী আলোচনা থেকে আমরা দেখতে পাব যে, তিনি কোন তারিখে ইন্তিকাল করেছিলেন, সে বিষয়েও মতভেদ রয়েছে। কেউ বলেছেন ১লা রবিউল আউয়াল, কেউ বলেছেন, ২রা রবিউল আউয়াল এবং কেউ বলেছেন, ১২ই রবিউল আউয়াল তিনি ইন্তিকাল করেন।
সর্বাবস্থায়, কেউ কোনোভাবে বলছেন না যে, অসুস্থতা শুরু হওয়ার পরে মাঝে কোনো দিন তিনি সুস্থ হয়েছিলেন। অসুস্থ অবস্থাতেই, ইন্তিকালের কয়েকদিন আগে তিনি গোসল করেছিলেন বলে সহীহ হাদীসে বর্ণিত হয়েছে। বুখারী সংকলিত হাদীসে আয়েশা (রা) বলেন:
إِنَّ رَسُولَ اللَّهِ ﷺ لَمَّا دَخَلَ بَيْتِي وَاشْتَدَّ بِهِ وَجَعُهُ قَالَ هَرِيقُوا عَلَيَّ مِنْ سَبْعِ قِرَبٍ ... لَعَلِّي أَعْهَدُ إِلَى النَّاسِ (لَعَلِّى أَسْتَرِيحُ فَأَعْهَدُ إِلَى النَّاسِ) ... ثُمَّ خَرَجَ إِلَى النَّاسِ ، فَصَلَّى لَهُمْ وَخَطَبَهُمْ
‘‘রাসূলুল্লাহ (ﷺ) যখন আমার ঘরে প্রবেশ করলেন এবং তাঁর অসুস্থতা বৃদ্ধি পেল, তখন তিনি বললেন, তোমরা আমার উপরে ৭ মশক পানি ঢাল...; যেন আমি আরাম বোধ করে লোকদের নির্দেশনা দিতে পারি। তখন আমরা এভাবে তাঁর দেহে পানি ঢাললাম...। এরপর তিনি মানুষদের কাছে বেরিয়ে যেয়ে তাদেরকে নিয়ে সালাত আদায় করলেন এবং তাদেরকে খুতবা প্রদান করলেন বা ওয়ায করলেন।’’[9]
এখানে সুস্পষ্ট যে, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) তাঁর অসুস্থতার মধ্যেই অসুস্থতা ও জ্বরের প্রকোপ কমানোর জন্য এভাবে গোসল করেন, যেন কিছুটা আরাম বোধ করেন এবং মসজিদে যেয়ে সবাইকে প্রয়োজনীয় নসীহত করতে পারেন।
এ গোসল করার ঘটনাটি কত তারিখে বা কী বারে ঘটেছিল তা হাদীসের কোনো বর্ণনায় সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ করা হয় নি। তবে আল্লামা ইবনু হাজার আসকালানী সহীহ বুখারী ও সহীহ মুসলিমের অন্যান্য হাদীসের সাথে এ হাদীসের সমন্বয় করে উল্লেখ করেছেন যে, এ গোসলের ঘটনাটি ঘটেছিল ইন্তিকালের আগের বৃহস্পতিবার, অর্থাৎ ইন্তেকালের ৫ দিন আগে।[10] ১২ই রবিউল আউয়াল ইন্তিকাল হলে তা ঘটেছিল ৮ই রবিউল আউয়াল।
উপরের আলোচনা থেকে আমাদের কাছে প্রতীয়মান হয় যে, সফর মাসের শেষ বুধবারে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) এর সুস্থ হওয়া, গোসল করা এবং এজন্য সাহাবীগণের আনন্দিত হওয়া ও দান-সাদকা করার এ সকল কাহিনীর কোনোরূপ ভিত্তি নেই। আল্লাহই ভাল জানেন।
যেহেতু মূল ঘটনাটিই প্রমাণিত নয়, সেহেতু সে ঘটনা উদযাপন করা বা পালন করার প্রশ্ন ওঠে না। এরপরেও আমাদের বুঝতে হবে যে, কোনো আনন্দের বা দুঃখের ঘটনায় আনন্দিত বা দুঃখিত হওয়া এক কথা, আর প্রতি বছর সে দিনে আনন্দ বা দুঃখ প্রকাশ করা বা ‘আনন্দ দিবস’ বা ‘শোক দিবস’ উদযাপন করা সম্পূর্ণ অন্য কথা। উভয়ের মধ্যে আসমান-যমীনের পার্থক্য।
রাসূলুল্লাহর (ﷺ) জীবনে অনেক আনন্দের দিন বা মুহূর্ত এসেছে, যখন তিনি অত্যন্ত আনন্দিত হয়েছেন, শুকরিয়া জ্ঞাপনের জন্য আল্লাহর দরবারে সাজদা করেছেন। কোনো কোনো ঘটনায় তাঁর পরিবারবর্গ ও সাহাবীগণও আনন্দিত হয়েছেন ও বিভিন্নভাবে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেছেন। কিন্তু পরের বছর বা পরবর্তী কোনো সময়ে সে দিন বা মুহূর্তকে তারা বাৎসরিক ‘আনন্দ দিবস’ হিসেবে উদযাপন করেন নি। এজন্য রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর নির্দেশ বা সাহাবীদের কর্ম ছাড়া এরূপ কোনো দিন বা মুহুর্ত পালন করা বা এগুলোতে বিশেষ ইবাদত বিশেষ সাওয়াবের কারণ বলে মনে করার সুযোগ নেই।
২. আখেরী চাহার শোম্বার নামায
উপরের আলোচনা থেকে আমার জানতে পেরেছি যে, সফর মাসের শেষ বুধবারের কোনো প্রকার বিশেষত্ব হাদীস দ্বারা প্রমাণিত নয়। এ দিনে কোনোরূপ ইবাদত, সালাত, সিয়াম, যিকির, দোয়া, দান, সদকা ইত্যাদি পালন করলে অন্য কোনো দিনের চেযে বেশি বা বিশেষ কোনো সাওয়াব বা বরকত লাভ করা যাবে বলে ধারণা করা ভিত্তিহীন ও বানোয়াট কথা। এজন্য আল্লামা আব্দুল হাই লাখনবী লিখেছেন যে, সফর মাসের শেষ বুধবারে যে বিশেষ নফল সালাত বিশেষ কিছু সুরা, আয়াত ও দোয়া পাঠের মাধ্যমে আদায় করা হয়, তা বানোয়াট ও ভিত্তিহীন।[11]
[2] সাগানী, আল-মাউদূ‘আত, পৃ. ৬১; মোল্লা কারী, আল-আসরার, পৃ. ২২৫; তাহির পাটনী, তাযকিরা, পৃ. ১১৬; আজলূনী, কাশফুল খাফা ২/৩০৯; শাওকানী, আল-ফাওয়াইদ ২/৫৩৯; নিযামুদ্দীন আউলিয়া, রাহাতুল মুহিববীন, পৃ. ১০১; রাহাতুল কুলুব, পৃ. ১৩৮।
[3] খাজা নিযামুদ্দীন আউলিয়া, রাহাতুল কুলুব, পৃ. ১৩৮-১৩৯; মুফতী হাবীব ছামদানী, বার চান্দের ফযীলত, পৃ. ১৪।
[4] খাজা নিযামুদ্দীন আউলিয়া, রাহাতিল কুলুব, পৃ. ১৩৯।
[5] মুফতী হাবীব ছামদানী, বার চান্দের ফযীলত, পৃ. ১৫।
[6] ইবনু হিশাম, আস-সীরাহ আন-নববিয়্যাহ ৪/২৮৯।
[7] কাসতালানী, আহমাদ ইবনু মুহাম্মাদ, আল-মাওয়াহিব আল-লাদুন্নিয়া ৩/৩৭৩; যারকানী, শারহুল মাওয়াহিব ১২/৮৩।
[8] কাসতালানী, আহমাদ ইবনু মুহাম্মাদ, আল-মাওয়াহিব আল-লাদুন্নিয়া ৩/৩৭৩; যারকানী, শারহুল মাওয়াহিব ১২/৮৩।
[9] বুখারী, আস-সহীহ ১/৮৩, ৪/১৬১৪, ৫/২১৬০; হাকিম, আল-মুসতাদরাক ১/২৪৩; ইবনু হিববান, আস-সহীহ ১৪/৫৬৬।
[10] ইবনু হাজার, ফাতহুল বারী ৮/১৪২।
[11] আব্দুল হাই লাখনবী, আল-আসার, পৃ. ১১১।
মহানবী মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের জন্ম ও ওফাতের মাস হিসাবে রবিউল আউয়াল মাস মুসলিম মানসে বিশেষ মর্যাদার আসনে অধিষ্ঠিত। এ মাসের ফযীলত, ও আমল বিষয়ক হাদীস আলোচনা করার আগে আমরা রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর জন্ম ও ইন্তিকাল সম্পর্কে হাদীস ও ইতিহাসের আলোকে আলোচনা করব। মহান আল্লাহর তাওফীক চাই।
(ক) রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর জন্ম দিবস
রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর জন্ম বার, জন্ম দিন, জন্ম মাস ও জন্ম তারিখ বিষয়ক হাদীস ও ঐতিহাসিক তথ্যাদি বিস্তারিত আলোচনা করেছি ‘এহইয়াউস সুনান’ গ্রন্থে। এখানে সংক্ষেপে কিছু বিষয় আলোচনা করছি।
সহীহ হাদীস থেকে সুস্পষ্টরূপে জানা যায় যে, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) সোমবার জন্মগ্রহণ করেছেন।[1] হাদীসে নাবাবী থেকে তাঁর জন্মমাস ও জন্মতারিখ সম্পর্কে কোনো তথ্য পাওয়া যায় না। সাহাবীগণের মাঝেও এ বিষয়ে কোনো সুনির্দিষ্ট মত প্রচলিত ছিল না। পরবর্তী যুগের আলিম ও ঐতিহাসিকগণ তাঁর জন্মতারিখ সম্পর্কে অনেক মতভেদ করেছেন। এ বিষয়ে ১২টিরও বেশি মত রয়েছে। ইবন হিশাম, ইবন সা’দ, ইবন কাসীর, কাসতালানী ও অন্যান্য ঐতিহাসিক এ বিষয়ে নিম্নলিখিত মতামত উল্লেখ করেছেন :
(১). কারো মতে তাঁর জন্মতারিখ অজ্ঞাত, তা জানা যায় নি এবং জানা সম্ভব নয়। তিনি সোমবারে জন্মগ্রহণ করেছেন এটুকুই শুধু জানা যায়, জন্ম মাস বা তারিখ জানা যায় না। এ বিষয়ে আলোচনা তারা অবান্তর মনে করেন।
(২). কারো কারো মতে তিনি মুহাররাম মাসে জন্মগ্রহণ করেছেন।
(৩). অন্য মতে তিনি সফর মাসে জন্মগ্রহণ করেছেন।
(৪). কারো মতে তিনি রবিউল আউআল মাসের ২ তারিখে জন্মগ্রহণ করেন। দ্বিতীয় হিজরী শতকের অন্যতম ঐতিহাসিক মুহাদ্দিস আবু মা’শার নাজীহ বিন আব্দুর রাহমান আস-সিনদী (১৭০হি) এ মতটি গ্রহণ করেছেন।
(৫). অন্য মতে তাঁর জন্মতারিখ রবিউল আউয়াল মাসের ৮ তারিখ। আল্লামা কাসতালানী ও যারকানীর বর্ণনায় এ মতটিই অধিকাংশ মুহাদ্দিস গ্রহণ করেছেন। এ মতটি দু’জন সাহাবী ইবনু আববাস ও জুবাইর বিন মুতয়িম (রা) থেকে বর্ণিত। অধিকাংশ ঐতিহাসিক ও সীরাত বিশেষজ্ঞ এ মতটি গ্রহণ করেছেন বলে তারা উল্লেখ করেছেন। প্রখ্যাত তাবিয়ী ইমাম মুহাম্মাদ ইবন মুসলিম ইবন শিহাব আয-যুহরী (১২৫ হি.) তাঁর উস্তাদ প্রথম শতাব্দীর প্রখ্যাত মুহাদ্দিস ও নসববিদ ঐতিহাসিক তাবিয়ী মুহাম্মাদ ইবন জুবাইর ইবন মুতয়িম (১০০ হি.) থেকে এই মতটি বর্ণনা করেছেন। কাসতালানী বলেন : ‘‘মুহাম্মাদ ইবন জুবাইর আরবদের বংশ পরিচিতি ও আরবদের ইতিহাস সম্পর্কে অভিজ্ঞ ছিলেন। রাসূলুল্লাহ ﷺ -এর জন্মতারিখ সম্পর্কিত এ মতটি তিনি তাঁর পিতা সাহাবী জুবাইর বিন মুতয়িম থেকে গ্রহণ করেছেন। স্পেনের প্রখ্যাত মুহাদ্দিস ও ফকীহ আলী ইবন আহমাদ ইবন হাযম (৪৫৬ হি) ও মুহাম্মাদ ইবন ফাতুহ আল-হুমাইদী (৪৮৮ হি) এ মতটিকে গ্রহণযোগ্য বলে মনে করেছেন। স্পেনের মুহাদ্দিস আল্লামা ইউসূফ ইবন আব্দুল্লাহ ইবন আব্দুল বার (৪৬৩ হি) উল্লেখ করেছেন যে, ঐতিহাসিকগণ এ মতটিই সঠিক বলে মনে করেন। মীলাদের উপর প্রথম গ্রন্থ রচনাকারী আল্লামা আবুল খাত্তাব ইবন দেহিয়া (৬৩৩ হি) ঈদে মীলাদুন্নবীর উপর লিখিত সর্বপ্রথম গ্রন্থ ‘‘আত-তানবীর ফী মাওলিদিল বাশির আন নাযীর’’ -এ এ মতটিকেই গ্রহণ করেছেন।
(৬). অন্য মতে তাঁর জন্মতারিখ ১০ রবিউল আউয়াল। এ মতটি ইমাম হুসাইনের পৌত্র মুহাম্মাদ ইবন আলী আল বাকির (১১৪ হি) থেকে বর্ণিত। ১ম-২য় শতাব্দীর প্রখ্যাত মুহাদ্দিস আমির ইবন শারাহিল শাবী (১০৪ হি.) থেকেও মতটি বর্ণিত। ঐতিহাসিক মুহাম্মাদ ইবন উমর আল-ওয়াকিদী (২০৭ হি) এ মত গ্রহণ করেছেন। ইবন সা’দ তার বিখ্যাত ‘‘আত-তাবাকাতুল কুবরা’’-য় শুধু দু’টি মত উল্লেখ করেছেন, ২ তারিখ ও ১০ তারিখ।[2]
(৭). কারো মতে রাসূলুল্লাহ ﷺ -এর জন্মতারিখ ১২ রবিউল আউয়াল। এ মতটি দ্বিতীয় হিজরী শতাব্দীর প্রখ্যাত ঐতিহাসিক মুহাম্মাদ ইবন ইসহাক (১৫১ হি) গ্রহণ করেছেন। তিনি বলেছেন : ‘‘রাসূলুল্লাহ ﷺ হাতির বছরে রবিউল আউয়াল মাসের ১২ তারিখে জন্মগ্রহণ করেন।’’[3] এখানে লক্ষণীয় যে, ইবন ইসহাক সীরাতুন্নবীর সকল তথ্য সাধারণত সনদসহ বর্ণনা করেছেন, কিন্তু এ তথ্যটির জন্য কোনো সনদ উল্লেখ করেন নি। কোথা থেকে তিনি এ তথ্যটি গ্রহণ করেছেন তাও জানান নি বা সনদসহ প্রথম শতাব্দীর কোনো সাহাবী বা তাবিয়ী থেকে মতটি বর্ণনা করেন নি। এ জন্য অনেক গবেষক এ মতটিকে দুর্বল বলে উল্লেখ করেছেন[4]। তা সত্ত্বেও পরবর্তী যুগে এ মতটিই প্রসিদ্ধি লাভ করেছে। ইবন কাসীর উল্লেখ করেছেন যে ২ জন সাহাবী জাবির ইবন আব্দুল্লাহ (রা) ও আব্দুল্লাহ ইবন আববাস (রা) থেকে এ মতটি বর্ণিত।
(৮). অন্য মতে রাসূলুল্লাহর ﷺ জন্ম তারিখ ১৭-ই রবিউল আউয়াল।
(৯). অন্য মতে তাঁর জন্ম তারিখ ২২-শে রবিউল আউয়াল।
(১০). অন্য মতে তিনি রবিউস সানী মাসে জন্মগ্রহণ করেছেন।
(১১). অন্য মতে তিনি রজব মাসে জন্মগ্রহণ করেছেন। ।
(১২). অন্য মতে তিনি রমযান মাসে জন্মগ্রহণ করেছেন। ৩য় হিজরী শতকের প্রখ্যাত ঐতিহাসিক যুবাইর ইবন বাক্কার (২৫৬ হি.) থেকে এ মতটি বর্ণিত। তাঁর মতের পক্ষে যুক্তি হলো যে, রাসূলুল্লাহ ﷺ সর্বসম্মতভাবে রমযান মাসে নুবুওয়াত পেয়েছেন। তিনি ৪০ বছর পূর্তিতে নবুয়্যত পেয়েছেন। তাহলে তাঁর জন্ম অবশ্যই রমযানে হবে। এছাড়া কোনো কোনো হাদীসে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ ﷺ হজ্জের পবিত্র দিনগুলোতে মাতৃগর্ভে আসেন। সেক্ষেত্রেও তাঁর জন্ম রমযানেই হওয়া উচিত। এ মতের সমর্থনে আব্দুল্লাহ বিন উমার (রা) থেকে একটি বর্ণনা আছে বলে কেউ কেউ উল্লেখ করেছেন।[5]
(খ) রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর ওফাত দিবস
বিভিন্ন সহীহ হাদীস থেকে জানা যায় যে, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) সোমবার ইন্তিকাল করেন।[6] কিন্তু এ সোমবারটি কোন্ মাসের কোন্ তারিখ ছিল তা কোনো হাদীসে বলা হয় নি। আব্দুল্লাহ ইবনু মাসঊদ (রা) থেকে বর্ণিত হয়েছে যে, রামাদান মাসের ১১ তারিখে ইন্তিকাল করেন।[7] এ একক বর্ণনাটি ছাড়া মুসলিম উম্মাহর সকল ঐতিহাসিক ও মুহাদ্দিস একমত যে, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) রবিউল আউয়াল মাসে ইন্তিকাল করেন। কিন্তু কোন্ তারিখে তিনি ইন্তিকাল করেছেন তা নিয়ে মতভেদ রয়েছে।
বুখারী-মুসলিম সংকলিত হাদীসে বলা হয়েছে যে, রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর বিদায় হজ্জে ৯ই যুলহাজ্জ ছিল শুক্রবার।[8] এ থেকে আমরা জানতে পারি যে, সে বছর যুলহাজ্জ মাসের ১ তারিখ ছিল বৃহস্পতিবার। আমরা জানি যে, বিদায় হজ্জ থেকে ফিরে তিনি যুলহাজ্জ মাসের বাকি দিনগুলি এবং মুহার্রাম ও সফর মাস মদীনায় অবস্থান করেন এবং রবিউল আউয়াল মাসে তিনি ইন্তিকাল করেন। কোনো কোনো ঐতিহাসিক উলেলখ করেছেন যে, তিনি বিদায় হজ্জের এ দিনের পরে ৮০ বা ৮১ দিন জীবিত ছিলেন। এরপর রবিউল আউয়াল মাসের শুরুতে তিনি ইন্তিকাল করেন।[9]
ওফাতের তারিখ সম্পর্কে দ্বিতীয় হিজরীর তাবিয়ী ঐতিহাসিকগণ এবং পরবর্তী ঐতিহাসিকগণের ৪টি মত রয়েছে: ১ রবিউল আউয়াল, ২ রবিউল আউয়াল, ১২ রবিউল আউয়াল ও ১৩ রাবিউল আউয়াল।[10]
সাধারণভাবে পরবর্তী কালে ১২ তারিখের মতটিই প্রসিদ্ধি লাভ করেছে। কিন্তু এখানে একটি কঠিন সমস্যা রয়েছে। আমরা জানি যে, আরবী মাস ৩০ বা ২৯ দিন হয় এবং সাধারণত কখনোই পরপর তিনটি মাস ৩০ বা ২৯ দিনের হয় না। উপরের হাদীস থেকে আমরা জেনেছি যে, যুলহাজ্জ মাস শুরু হয়েছিল বৃহস্পতিবার। আর বৃহস্পতিবার ১ যুলহাজ্জ হলে রবিউল আউয়াল মাসের ১২ তারিখ কোনোভাবেই সোমবার হতে পারে না।
যুলহাজ্জ, মুহার্রাম ও সফর তিনটি মাসই ৩০ দিনে ধরলে ১ রবিউল আউয়াল হয় বুধবার। দু’টি ৩০ ও একটি ২৯ ধরলে ১ রবিউল আউয়াল হয় মঙ্গলবার। দু’টি ২৯ ও একটি ৩০ ধরলে হয় ১ রবিউল আউয়াল হয় সোমবার। আর তিনটি মাসই ২৯ দিন ধরলে ১ রবিউল আউয়াল হয় রবিবার। আর কোনো হিসাবেই ১২ তারিখ সোমবার হয় না।
এ সমস্যা থেকে বের হওয়ার জন্য কেউ কেউ ১৩ তারিখের কথা বলেছেন। কেউ কেউ বলেছেন যে, তিনটি মাসই ৩০ দিনের ছিল এবং মদীনায় একদিন পরে চাঁদ দেখা গিয়েছিল। দুটি ব্যখ্যাই দূরবর্তী।[11]
দ্বিতীয় হিজরী শতকের প্রখ্যাত তাবিয়ী মুহাদ্দিস ও ঐতিহাসিক আল্লামা সুলাইমান ইবনু তারখান আত-তাইমী (৪৬-১৪৩ হি) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) এর অসুস্থতার শুরু হয় ২২ সফর শনিবার। ১০ দিন অসুস্থতার পর ২ রবিউল আউয়াল সোমবার তিনি ইন্তিকাল করেন।’’[12]
তাঁর এ মতঅনুসারে সে বছরে যুলহাজ্জ, মুহার্রাম ও সফর তিনটি মাসই ২৯ দিন ছিল, যা সাধারণত খুবই কম ঘটে। এ জন্য কোনো কোনো মুহাদ্দিস, ঐতিহাসিক ও গবেষক ১লা রবিউল আউয়ালের মতটিকেই প্রাধান্য দিয়েছেন। তবে আল্লামা সুহাইলী, ইবনু হাজার প্রমুখ গবেষক মুহাদ্দিস ও ঐতিহাসিক ২ তারিখের মতটিকেই গ্রহণ করেছেন। তিনটি কারণে তাঁরা এ মতটি গ্রহণ করেছেন। প্রথম, তাবিয়ীগণের যুগ থেকে সহীহ সনদে কথাটি পাওয়া যাচ্ছে। দ্বিতীয়, এ মতটি বিদায় হজ্জের পরে তাঁর ৮০ বা ৮১ দিন জীবিত থাকার বর্ণনাটির সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ। তৃতীয়, যারা ১২ বলেছেন তাদের কথার একটি দূরবর্তী ব্যাখ্যা দেওয়া যায় যে, আরবীতে (ثاني شهر) কে (ثاني عشر) বা ‘মাসের দুই’-কে ‘দশের দুই’ (১২) পড়ার একটি সম্ভাবনা থাকে। কেউ হয়ত ২-কে ১২ পড়েছিলেন ও লিখেছিলেন এবং অন্যরা তার অনুসরণ করেছেন।[13]
(গ) রবিউল আউয়াল বিষয়ক ভিত্তিহীন কথাবার্তা
উপরের আলোচনা থেকে আমরা জানতে পারছি যে, রাসূলুল্লাহ (ﷺ)- এর জন্ম বা ওফাতের মাস হিসাবে রবিউল আউয়াল মাসের কোনো উল্লেখ হাদীস শরীফে নেই। এ মাসের কোনো বিশেষ ফযীলত বা বিশেষ আমল কোনো কিছুই হাদীসে বর্ণিত হয় নি।
এ বিষয়ক মিথ্যা গল্প কাহিনীর মধ্যে রয়েছে: ‘‘এ মাসের ১২ তারিখে বুজুর্গ তাবিয়ী’গণ হযরত রাসূলে কারীম (ﷺ) এর রূহের মাগফিরাতের জন্য ২০ রাকয়া’ত নফল নামায পড়িতেন। এ নামায দুই দুই রাকয়া’তের নিয়তে আদায় করিতেন এবং প্রত্যেক রাকয়া’তে সূরা ফাতিহার পরে ১১ বার করিয়া সূরা ইখলাছ পড়িতেন। নামায শেষে আল্লাহর হাবীবের প্রতি সাওয়াব রেছানী করিতেন। তাহারা ইহার বরকতে খাবের মাধ্যমে হযরত রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-কে দর্শন লাভ করিতেন এবং দোজাহানের খায়ের ও বরকত লাভ করিতেন। অন্য রেওয়ায়েতে বর্ণিত আছে যে, কোন মু’মিন ব্যক্তি নিম্নের দরূদ শরীফ এ মাসের যে কোন তারিখে এশার নামাযের পরে ১১২৫ বার পাঠ করিলে আল্লাহর রহমতে সে ব্যক্তি হযরত নবী করীম (ﷺ) কে স্বপ্নে দর্শন লাভ করিবে।...’’[14]
এরূপ আরো অনেক ভিত্তিহীন বানোয়াট কথা প্রচলিত বিভিন্ন পুস্তকে দেখা যায়।[15] এগুলো সবই বানোয়াট কথা। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) এর ইন্তিকালের পরবর্তী তিন যুগ, সাহাবী, তাবিয়ী ও তাবি-তাবিয়ীগণের মধ্যে এ মাসটির কোনো পরিচিতিই ছিল না। এ মাসটি যে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) এর জন্ম মাস সে কথাটিই তখনো প্রসিদ্ধি লাভ করে নি।
৪০০ হিজরীর দিকে সর্বপ্রথম মিসরের ফাতেমীয় শিয়া শাসকগণ এ মাসে ‘মীলাদ’ বা রাসূলুল্লাহ (ﷺ) এর জন্ম দিবস পালনের প্রচলন করে। ৬০০ হিজরীতে ইরাকের ইরবিল শহরে ৮ ও ১২ রবিউল আউয়াল ‘মীলাদ’ বা ‘ঈদ মীলাদুন্নবী’ নামে রাসূলুল্লাহ ﷺ-এর জন্ম উদযাপন শুরু হয়। অপরদিকে ভারত ও অন্যান্য দেশে ১২ রবিউল আউয়ালে রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর ওফাত উপলক্ষ্যে ‘ফাতেহা’ বা ‘ফাতেহায়ে দোয়াজদহম’ উদযাপন শুরু হয়। এ বিষয়ক সকল তথ্য বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে ‘এহইয়াউস সুনান’ গ্রন্থে।
[2] ইবন সা’দ, আত-তাবাকাতুল কুবরা ১/৮০-৮১।
[3] ইবন হিশাম, আস-সীরাতুন নাবাবিয়্যাহ ১/১৮৩।
[4] মাহদী রেজকুল্লাহ আহমাদ, আস-সীরাতুন নাবাবিয়াহ, ১০৯ পৃ।
[5] ইবন সা’দ, আত-তাবাকাতুল কুবরা ১/১০০-১০১, ইবন কাসীর, আল-বিদায়া ওয়ান নিহায়া ২/২১৫, আল-কাসতালানী, আহমাদ বিন মুহাম্মাদ, আল-মাওয়াহিবুল লাদুন্নিয়্যা ১/৭৪-৭৫, আল-যারকানী, শরহুল মাওয়াহিব আল-লাদুন্নিয়্যা ১/২৪৫-২৪৮, ইবন রাজাব, লাতায়িফুল মায়ারিফ ১/১৫০।
[6] বুখারী, আস-সহীহ ১/২৬২, ৪/১৬১৬; মুসলিম, আস-সহীহ ১/৩১৫; আবূ নুআইম ইসপাহানী, আল-মুসনাদ আল-মুসতাখরাজ আলা সহীহ মুসলিম ২/৪৩-৪৪।
[7] ইবনু হাজার, ফাতহুল বারী ৮/১২৯।
[8] বুখারী, সহীহ ১/২৫, ৪/১৬০০, ১৬৮৩, ৬/২৬৫৩; মুসলিম, সহীহ ৪/২৩১২-২৩১৩।
[9] ইবনু হাজার, ফাতহুল বারী ৮/১৩০।
[10] প্রাগুক্ত ৮/১২৯।
[11] ইবনু হাজার আসকালানী, ফাতহুল বারী ৮/১২৯-১৩০।
[12] প্রাগুক্ত ৮/১২৯।
[13] প্রাগুক্ত ৮/১২৯-১৩০।
[14] মুফতী হাবীব ছামদানী, বার চান্দের ফযীলত, পৃ. ১৬-১৭।
[15] অধ্যাপিকা কামরুন নেসা দুলাল, পৃ. ৩০১-৩০২।
রবিউস সানী বা রবিউল আখির মাসের কোনোরূপ বৈশিষ্ট্য, ফযীলত বা এ মাসের কোনো বিশেষ সালাত, সিয়াম, দোয়া, যিক্র বা বিশেষ কোনো আমল হাদীস শরীফে বর্ণিত হয় নি।
রাসূলুল্লাহ (ﷺ) এর ইন্তিকালের প্রায় সাড়ে পাঁচশত বছর পরে, ৫৬১ হিজরী সালের রবিউস সানী মাসের ১০ তারিখে আব্দুল কাদির জীলানী (রাহ) ইন্তিকাল করেন। আমাদের দেশে অনেকে এ উপলক্ষ্যে ১১ রবিউস সানী গেয়ারভী শরীফ বা ফাতেহায়ে ইয়াযদহম উদযাপন করেন।
স্বভাবতই এর সাথে হাদীসের কোনোরূপ সম্পর্ক নেই। এমনকি জন্ম বা মৃত্যু উদযাপন করা বা জন্ম তারিখ বা মৃত্যু তারিখ উপলক্ষ্যে দোয়া খায়ের বা সাওয়াব রেসানী করার কোনো নির্দেশনা, প্রচলন বা উৎসাহ কোনো হাদীসে নেই। রাসুলুল্লাহ (ﷺ) এর জীবদ্দশায় তাঁর ছেলে, মেয়ে, স্ত্রী অনেক আত্মীয় ও অনেক সাহাবী ইন্তেকাল করেছেন, যারা সকলেই আল্লাহর শ্রেষ্ঠতম ওলীদের অন্তর্ভুক্ত ছিলেন। তিনি কখনো কারো মৃত্যুর পরের বছরে, বা পরবর্তী কোনো সময়ে মৃত্যুর দিনে বা অন্য কোনো সময়ে কোনো ফাতেহা বা কোনো অনুষ্ঠানের ব্যবস্থা করেন নি। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) এর ওফাতের পরে তাঁর কন্যা ফাতিমা, জামাতা আলী, দৌহিত্র হাসান-হুসাইন, উম্মুল মুমিনীনগণ, খলীফায়ে রাশিদগণ, অন্যান্য সাহাবীগণ, তাবিয়ী-তাবি-তাবিয়ীগণ কেউ কখনো তাঁর ওফাতের দিনে বা অন্য কোনো সময়ে কোনোরূপ ফাতেহা, দোয়া বা কোনো অনুষ্ঠান করেন নি। অনুরূপভাবে কোনো সাহাবী, তাবিয়ী, তাবি-তাবিয়ী, চার ইমাম, তাদের ছাত্রগণ কেউ কখনো এরূপ ফাতিহা বা অনুষ্ঠান করেন নি।
রবিউস সানী মাসের ফযীলত, আমল ইত্যাদি নামে যা কিছু প্রচলিত রয়েছে সবই বানোয়াট ও ভিত্তিহীন। যেমন ‘‘রবিউস-সানী মাসের প্রথম তারিখে রাত্রিবেলা চার রাকয়া’ত নফল নামায আদায় করিতে হয়। উহার প্রতি রাকয়াতে সূরা ফাতিহার পরে সূরা ইখলাছ পড়িতে হয়। এই নামায আদায়কারীর আমল নামায় ৯০ হাজার বৎসরের সাওয়াব লিখা হইবে এবং ৯০ হাজার বৎসরের গুনাহ মাফ করিয়া দেওয়া হইবে।’’[1] এরূপ আরো অনেক আজগুবি মিথ্যা কথা প্রচলিত বিভিন্ন পুস্তকে দেখা যায়।[2]
[2] মুফতী ছামদানী, বার চান্দের ফযীলত,পৃ. ১৭-১৮; অধ্যাপিকা দুলাল, নেক কানুন, পৃ.৩০২।
জমাদিউল আউয়াল (জুমাদা আল-উলা) মাসের কোনোরূপ বৈশিষ্ট্য, ফযীলত বা এ মাসের কোনো বিশেষ সালাত, সিয়াম, দোয়া, যিক্র বা বিশেষ কোনো আমল হাদীস শরীফে বর্ণিত হয় নি। এ বিষয়ে যা কিছু বলা হয় সবই বানোয়াট ও ভিত্তিহীন। যেমন: ‘‘রাসূলে করীম (ﷺ) এর সাহাবীগণ এ মাসের প্রথম তারিখে দুই রাকয়াতের নিয়তে মোট ২০ রাকয়া’ত নামায আদায় করিতেন এবং ইহার প্রত্যেক রাকয়া'তে সূরা ফাতিহার পরে একবার করিয়া সূরা ইখলাছ পাঠ করিতেন। নামাযের পরে নিম্নের দরূদ শরীফ ১০০ বার পাঠ করিতেন। এই নামাযীর আমল নামায় অসংখ্য নেকী লিখা হইবে এবং তাহার সমস্ত নেক নিয়ত পূর্ণ করা হইবে। ...কোন ব্যক্তি এই মাসের প্রথম তারিখে দিনের বেলা দুই রাকয়া'তের নিয়তে মোট ৮ রাকয়া’ত নামায আদায় করিলে এবং উহার প্রত্যেক রাকয়া'তে ১১ বার করিয়া সূরা ইখলাস পাঠ করিলে..।’’[1] এ জাতীয় অনেক আজগুবি, ভিত্তিহীন ও বানোয়াট কথা আমাদের দেশে প্রচলিত ‘বার চাঁদের ফযীলত’ ও এই ধরনের পুস্তকাদিতে পাওয়া যায়।
জমাদিউস সানী বা জমাদিউল আখির (জুমাদা আল-আখেরা) মাসের কোনোরূপ বৈশিষ্ট্য, ফযীলত বা এই মাসের কোনো বিশেষ সালাত, সিয়াম, দোয়া, যিক্র বা বিশেষ কোনো আমল হাদীস শরীফে বর্ণিত হয় নি। এ বিষয়ে যা কিছু বলা হয় সবই বানোয়াট ও ভিত্তিহীন। যেমন, ‘‘জমাদিউস সানী মাসের পহেলা তারিখে হযরত আবু বকর সিদ্দীক (রা) এবং অন্যান্য সাহাবীগণ দুই রাকয়াতের নিয়তে মোট ১২ রাকয়া’ত নামায আদায় করিতেন। ইহার প্রত্যেক রাকয়া'তে সূরা ফাতিহার পরে ১১ বার করিয়া সুরা ইখলাছ পড়িতেন। আবার কেহ কেহ সূরা ইখলাছের পরে ৩ বার আয়াতুল কুরসী পাঠ করিতেন। এই নামাযে অসংখ্য নেকী লাভ হয়।...’’[1]
এ সবই ভিত্তিহীন ও বানোয়াট কথা।
রজব মাসকে নিয়ে যত বেশি মিথ্যা হাদীস তৈরি করা হয়েছে, তত বেশি আর কোনো মাসকে নিয়ে করা হয় নি। সফর, রবিউল আউয়াল, রবিউস সানী, জমাদিউল আউয়াল ও জমাদিউস সানী এ ৫ মাসের ফযীলত বা খাস ইবাদত বিষয়ক যা কিছু বানোয়াট কথাবার্তা তা মূলত গত কয়েক শত বছর যাবত ভারতীয় উপমহাদেশেই প্রচলিত হয়েছে। ৫ম/৬ষ্ঠ হিজরী শতাব্দী পর্যন্ত মাউযূ হাদীস বা ফযীলতের বইগুলোতেও এ সকল মাসের উল্লেখ পাওয়া যায় না। এ সকল যুগে যে সকল নেককার সরলপ্রাণ বুযুর্গ ফযীলত ও আমলের বিষয়ে সত্য-মিথ্যা সকল কথাই জমা করে লিখতেন তাদের বই-পুস্তকেও এ মাসগুলোর কোনো প্রকারের উল্লেখ নেই। তাঁরা মূলত রজব মাস দিয়েই তাদের আলোচনা শুরু করতেন এবং মুহার্রাম মাস দিয়ে শেষ করতেন।
আমরা ইতোপূর্বে দেখেছি যে, রজব মাস ইসলামী শরীয়তের ‘হারাম’ অর্থাৎ ‘নিষিদ্ধ’ বা ‘সম্মানিত’ মাসগুলির অন্যতম। জাহিলী যুগ থেকেই আরবরা ‘ইবরাহীম (আঃ)-এর শরীয়ত’ অনুসারে এ মাসগুলোর সম্মান করত। তবে ক্রমান্বয়ে তাদের মধ্যে অনেক কুসংস্কার ও রসম-রেওয়াজ প্রবেশ করে। জাহিলী যুগে আরবরা এ মাসকে বিশেষ ভাবে সম্মান করত। এ মাসে তারা ‘আতীরাহ’ নামে এক প্রকারের ‘কুরবানী’ করত এবং উৎসব করত। হাদীস শরীফে তা নিষেধ করা হয়েছে।[1]
‘হারাম’ মাস হিসাবে সাধারণ মর্যাদা ছাড়া ‘রজব’ মাসের মর্যাদায় কোনো সহীহ হাদীসে কোনো কিছু উল্লেখ করা হয় নি। এ মাসের কোনোরূপ মর্যাদা, এ মাসের কোনা দিনে বা রাতে কোনো বিশেষ সালাত, সিয়াম, যিক্র, দোয়া, তিলাওয়াত বা কোনো বিশেষ ইবাদতের বিশেষ কোনো ফযীলত আছে এ মর্মে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) থেকে কোনোরূপ কোনো হাদীস সহীহ বা গ্রহণযোগ্য সনদে বর্ণিত হয় নি। পরবর্তী যুগের তাবিয়ী, তাবি-তাবিয়ীগণ থেকে সামান্য কিছু কথা পাওয়া যায়। কিন্তু এ বিষয়ে অনেক জাল কথা প্রচলিত। যেহেতু আমাদের দেশে সাধারণভাবে ২৭ রজব ছাড়া অন্য কোনো দিবস বা রাত্রি কেন্দ্রিক জাল হাদীসগুলো তেমন প্রসিদ্ধ নয়, সেহেতু ২৭ রজবের বিষয়ে কিছু বিস্তারিত আলোচনা ও বাকি বিষয়গুলো সংক্ষেপে আলোচনার ইচ্ছা করছি। মহান আল্লাহর দরবারে তাওফীক প্রার্থনা করছি।
(ক) সাধারণভাবে রজব মাসের মর্যাদা
সাধারণভাবে ‘রজব’ মাসের মর্যাদা, এ মাসে কী কী গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ঘটেছে এবং এ মাসের প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত যে কোনো সময়ে বা বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন প্রকারের সালাত, সিয়াম, দান, দোয়া ইত্যাদি ইবাদত করলে কী অকল্পনীয় পরিমাণে সাওয়াব বা পুরস্কার পাওয়া যাবে তার বর্ণনায় অনেক জাল হাদীস বানানো হয়েছে। আমাদের দেশের প্রচলিত ‘বার চাঁদের ফযীলত’ ও আমল-ওযীফা বিষয়ক বইগুলোতে এগুলোর সমাবেশ দেখতে পাওয়া যায়।
যেমন, অন্য মাসের উপর রজবের মর্যাদা তেমনি, যেমন সাধারণ মানুষের কথার উপরে কুরআনের মর্যাদা...। এ মাসে নূহ (আঃ) ও তাঁর সহযাত্রীগণ নৌকায় আরোহণ করেন...। এ মাসেই নৌকা পানিতে ভেসেছিল ...। এ মাসেই রক্ষা পেয়েছিল। এ মাসেই আদমের তাওবা কবুল হয়। ইউনূস (আঃ)-এর জাতির তাওবা কবুল করা হয়। এ মাসেই ইবরাহীম (আঃ) ও ঈসা (আঃ) এর জন্ম। এ মাসেই মূসার জন্য সমুদ্র দ্বিখন্ডিত হয়। ....
এ মাসের প্রথম তারিখে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) জন্মগ্রহণ করেন। এ মাসের ২৭ তারিখে তিনি নবুয়ত প্রাপ্ত হন।... এ মাসের ২৭ তারিখে তিনি মি’রাজে গমন করেন। ... এ মাসে সালাত, সিয়াম, দান-সাদকা, যিক্র, দরুদ, দোয়া ইত্যাদি নেক আমল করলে তার সাওয়াব বৃদ্ধি পায় বা বহুগুণ বেড়ে যায়...। ইত্যাদি সবই ভিত্তিহীন মিথ্যা কথা ও জাল হাদীস।[2]
পূর্ববর্তী অনেক বুযুর্গের আমল ও ফাযাইল বিষয়ক গ্রন্থে এগুলোর সমাবেশ রয়েছে। তবে আমাদের সমাজের সাধারণ ধার্মিক মুসলিমদের মধ্যে এগুলোর প্রচলন কম। এজন্য এগুলোর বিস্তারিত আলোচনা বর্জন করছি।
(খ) রজব মাসের সালাত
রজব মাসে সাধারণভাবে এবং রজব মাসের ১ তারিখ, ১ম শুক্রবার, ৩, ৪, ৫ তারিখ, ১৫ তারিখ, ২৭ তারিখ, শেষ দিন ও অন্যান্য বিশেষ দিনে বা রাতে বিশেষ সালাত আদায়ের বিশেষ পদ্ধতি ও সেগুলোর অভাবনীয় পুরস্কারের ফিরিস্তি দিয়ে অনেক জাল হাদীস প্রচারিত হয়েছে। পূর্ববর্তী যুগের আমল, ওযীফা ও ফাযাইল বিষয়ক পুস্তকাদিতে এবং আমাদের দেশের বার চান্দের ফযীলত, আমল-ওযীফা ও অন্যান্য পুস্তকে এগুলোর কিছু কথা পাওয়া যায়। তবে সাধারণ মানুষের মধ্যে এগুলোর প্রচলন কম। এজন্য এগুলোর বিস্তারিত আলোচনা করছি না। মুহাদ্দিসগণ এক্ষেত্রে যে মূলনীতি উল্লেখ করেছেন তা বলেই শেষ করছি। আল্লামা ইবনু রাজাব, ইবনু হাজার, সুয়ূতী, মোল্লা আলী কারী ও অন্যান্য মুহাদ্দিস একবাক্যে বলেছেন, রজব মাসে বিশেষ কোনো সালাত বা রজব মাসের কোনো দিনে বা রাতে কোনো সময়ে কোনো সালাত আদায় করলে বিশেষ সাওয়াব পাওয়া যাবে এ মর্মে একটি হাদীসও গ্রহণযোগ্য সনদে বর্ণিত হয় নি। এ বিষয়ে যা কিছু বলা হয় সবই বাতিল ও বানোয়াট।[3]
(গ) রজব মাসের দান, যিকর ইত্যাদি
রজব মাসের দান, যিক্র, দরূদ, দোয়া ইত্যাদি নেক আমলের বিশেষ কোনো সাওয়াব হবে বা সাধারণ সাওয়াব বৃদ্ধি পাবে এ মর্মে যা কিছু বর্ণিত ও প্রচলিত হয়েছে সবই বাতিল ও ভিত্তিহীন।[4]
(ঘ) রজব মাসের সিয়াম
সবচেয়ে বেশি জাল হাদীস প্রচলিত হয়েছে রজব মাসের সিয়াম পালনের বিষয়ে। বিভিন্নভাবে এ মাসে সিয়াম পালনের উৎসাহ দিয়ে জালিয়াতগণ হাদীস জাল করেছে। কোনো কোনো জাল হাদীসে সাধারণভাবে রজব মাসে সিয়াম পালন করলে কত অভাবনীয় সাওয়াব তা বলা হয়েছে। কোনোটিতে রজব মাসের নির্ধারিত কিছু দিনের সিয়াম পালনের বিভিন্ন বানোয়াট সাওয়াবের কথা বলা হয়েছে। কোনোটিতে রজব মাসে ১ টি সিয়ামের কি সাওয়াব, ২টি সিয়ামের কি সাওয়াব, ৩টির কি সাওয়াব.... ৩০টি সিয়ামের কত সাওয়াব ইত্যাদি কথা বলা হয়েছে। মুহাদ্দিসগণ উল্লেখ করেছেন যে, রজব মাসের সিয়ামের বিশেষ সাওয়াব বা রজব মাসের বিশেষ কোনো দিনে সিয়াম পালনের উৎসাহ জ্ঞাপক সকল হাদীসই ভিত্তিহীন ও বানোয়াট। এ বিষয়ে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) থেকে কোনো কথাই নির্ভরযোগ্য সনদে বর্ণিত হয় নি।[5]
(ঙ) লাইলাতুর রাগাইব
রজব মাস বিষয়ক জাল হাদীসের মধ্যে অন্যতম হলো ‘লাইলাতুর রাগাইব’ ও সে রাত্রির বিশেষ সালাত বিষয়ক জাল হাদীস। মুহাদ্দিসগণ একমত যে এ রাত্রির নামকরণ, ফযীলত, এ রাত্রির সালাতের ফযীলত, রাক‘আত সংখ্যা, সূরা কিরাআত, পদ্ধতি সব কিছুই বানোয়াট ও ভিত্তিহীন মিথ্যা কথা। কিন্তু বিষয়টি অনেক মুসলিম দেশে ব্যাপক প্রচার লাভ করেছে।
প্রথমে কিছু জালিয়াত এ রাত্রিটির নামকরণ ও এ বিষয়ক কিছু আজগুবি গল্প বানায়। ক্রমান্বয়ে বিষয়টি আকর্ষণীয় ওয়াযে পরিণত হয়। জাল হাদীসের একটি বৈশিষ্ট্য, তা সাধারণ মানুষের চিত্তাকর্ষক হয় এবং কোনো একটি জাল হাদীস একবার ‘বাজার পেলে’ তখন অন্যান্য জালিয়াতও বিভিন্ন সনদ বানিয়ে তা বলতে থাকে। এভাবে অনেক জাল হাদীস সমাজে বিশেষ প্রভাব বিস্তার করেছে। সালাতুর রাগাইব বিষয়ক হাদীসগুলোও সেরূপ। হিজরী চতুর্থ শতাব্দীর পরে এই জাল হাদীসগুলো প্রচারিত ও প্রসিদ্ধি লাভ করলে সাধারণ মুসল্লীগণ অনেক দেশে উৎসাহ উদ্দীপনার সাথে ঘটা করে সালাতুর রাগাইব পালন করতে শুরু করেন। এ সকল সমাজে ‘লাইলাতুর রাগাইব’ আমাদের দেশের ‘লাইলাতুল বারাত’-এর মতই উৎসাহ উদ্দীপনার মধ্য দিয়ে পালিত হয়।
এ বানোয়াট সালাতটি আমাদের দেশে তেমন প্রসিদ্ধি লাভ করে নি। এজন্য এ বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা করছি না। এর সার সংক্ষেপ হলো, রজব মাসের প্রথম শুক্রবারের রাত্রি হলো ‘লাইলাতুর রাগাইব’ বা ‘আশা-আকাঙক্ষা পূরণের রাত’। রজবের প্রথম বৃহস্পতিবারে সিয়াম পালন করে, বৃহস্পতিবার দিবাগত শুক্রবারের রাত্রিতে মাগরিব ও ইশার মধ্যবর্তী সময়ে ১২ রাক‘আত সালাত নির্ধারিত সূরা, আয়াত ও দোয়া-দরূদ দিয়ে আদায় করবে। .... তাহলে এ ব্যক্তি এত এত.... পুরস্কার লাভ করবে।... এর সাথে আরো অনেক কল্প কাহিনী উল্লেখ করা হয়েছে এ সকল জাল হাদীসে।
এ সকল হাদীসের প্রচলন শুরু হওয়ার পর থেকে মুহাদ্দিসগণ সেগুলির সূত্র ও উৎস নিরীক্ষা করে এর জালিয়াতির বিষয়ে নিশ্চিত হয়েছে। মুসলিম উম্মাহর সকল মুহাদ্দিস একমত যে, ‘লাইলাতুর রাগাইব’ ও ‘সালাতুর রাগাইব’ বিষয়ক সকল কথা মিথ্যা, জাল ও বানোয়াট।[6]
(চ) রজব মাসের ২৭ তারিখ
বর্তমানে আমাদের সমাজে ২৭শে রজব মি’রাজ-এর রাত বলেই প্রসিদ্ধ। সে হিসেবেই্আমাদের দেশের মুসলিমগণ এ দিনটি উদযাপন করে থাকেন। কিন্তু এ প্রসিদ্ধির আগেও রজব মাসের ২৭ তারিখ বিষয়ক আরো অনেক কথা প্রচলিত হয়েছিল এবং এই তারিখের দিবসে ও রাতে ইবাদত বন্দেগির বিষয়ে অনেক জাল কথা প্রচলিত হয়েছিল। প্রথমে আমরা ‘লাইলাতুল মি’রাজ’ সম্পর্কে আলোচনা করতে চাই। এরপর এ দিন সম্পর্কে প্রচলিত বানোয়াট ও জাল হাদীসগুলো আলোচনা করব, ইনশা আল্লাহ।
১. লাইলাতুল মি’রাজ
ইসরা ও মি’রাজের ঘটনা বিভিন্নভাবে কুরআন কারীমে ও অনেক হাদীসে বর্ণিত হয়েছে। বিভিন্ন হাদীস গ্রন্থে প্রায় অর্ধশত সাহাবী থেকে মি’রাজের ঘটনার বিভিন্ন দিক ছোট বা বড় আকারে বর্ণিত হয়েছে। কিন্তু কোনো হাদীসে রাসূলুল্লাহ ﷺ থেকে মি’রাজের তারিখ সম্পর্কে একটি কথাও বর্ণিত হয় নি। সাহাবীগণ কখনো তাঁকে তারিখ সম্পর্কে প্রশ্নও করেছেন বলে জানা যায় না। পরবর্তী যুগের তাবিয়ীদেরও একই অবস্থা ; তাঁরা এ সকল হাদীস সাহাবীদের থেকে শিখছেন, কিন্তু তাঁরা তারিখ নিয়ে কোনো জিজ্ঞাসাবাদ করছেন না। কারণ, তাঁদের কাছে তারিখের বিষয়টির কোনো মূল্য ছিল না, এসকল হাদীসের শিক্ষা গ্রহণই তাঁদের উদ্দেশ্য ছিল। ফলে তারিখের বিষয়ে পরবর্তী যুগের মুহাদ্দিস ও ঐতিহাসিকদের মধ্যে মতবিরোধ দেখা দেয়। মি’রাজ একবার না একাধিকবার সংঘঠিত হয়েছে, কোন্ বছর হয়েছে, কোন্ মাসে হয়েছে, কোন্ তারিখে হয়েছে ইত্যাদি বিষয়ে অনেক মতবিরোধ রয়েছে এবং প্রায় ২০টি মত রয়েছে। মাসের ক্ষেত্রে অনেকেই বলেছেন রবিউল আউয়াল মাসের ২৭ তারিখ। কেউ বলেছেন রবিউস সানী মাসে, কেউ বলেছেন রজব মাসে, কেউ বলেছেন, রমযান মাসে, কেউ বলেছেন শাওয়াল মাসে, কেউ বলেছেন যিলকাদ মাসে এবং কেউ বলেছেন, যুলহাজ্জ মাসে। তারিখের বিষয়ে আরো অনেক মতবিরোধ আছে।
দ্বিতীয় হিজরী শতক থেকে তাবিয়ী ঐতিহাসিকগণ মি’রাজের ঘটনা ঐতিহাসিকভাবে আলোচনা করেছেন। কিন্তু তাঁরা কোনো সুনির্দিষ্ট তারিখ নির্ধারণ করতে পারেন নি। পরবর্তী যুগের মুহাদ্দিস ও ঐতিহাসিকগণ মি’রাজের তারিখ বিষয়ক মতভেদ বিস্তারিত আলোচনা করেছেন। ইবনু কাসীর (৭৭৪ হি.), ইবনু হাজার আসকালানী (৮৫২ হি.), আহমাদ বিন মুহাম্মাদ কাসতালানী (৯২৩হি.), মুহাম্মাদ বিন ইউসূফ শামী (৯৪২ হি.), আব্দুল হাই লাখনবী (১৩০৪হি) ও অন্যান্যরা এ বিষয়ে বিস্তারিত লিখেছেন।[7]
এত মতবিরোধের কারণ হাদীস শরীফে এ বিষয়ে কিছুই বলা হয় নি এবং সাহাবীগণও কিছু বলেন নি। তাবি-তাবিয়ীদের যুগে তারিখ নিয়ে কথা শুরু হয়, কিন্তু কেউই সঠিক সমাধান না দিতে পারায় তাঁদের যুগ ও পরবর্তী যুগে এত মতবিরোধ হয়। এ মতবিরোধ থেকে আমরা বুঝতে পারি যে, কয়েক শতক আগেও ‘শবে মি’রাজ’ বলতে নির্দিষ্ট কোনো রাত নির্দিষ্ট ছিল না।
এভাবে আমরা দেখছি যে, রজব মাসের ২৭ তারিখে মি’রাজ হয়েছিল, বা এ তারিখটি ‘লাইলাতুল মি’রাজ’, এই কথাটি তাবিয়ী ও পরবর্তী যুগের ঐতিহাসিকগণের অনেক মতের একটি মত মাত্র। এ কথাটি হাদীস দ্বারা প্রমাণিত নয়। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) থেকে এ তারিখে মি’রাজ হওয়া সম্পর্কে কোনো কিছুই সহীহ বা যয়ীফ সনদে বর্ণিত হয় নি। এ বিষয়ে যা কিছু বলা হয় সবই ঐতিহাসিকগণের মতামত অথবা বানোয়াট কথাবার্তা।
আমরা ইতোপূর্বে উল্লেখ করেছি যে, কোনো কোনো জাল হাদীসে উল্লেখ করা হয়েছে, রজব মাসের ২৭ তারিখে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) জন্মগ্রহণ করেন, নবুয়ত লাভ করেন ... ইত্যাদি। এগুলোও বাতিল ও মিথ্যা কথা।
২. ২৭ রজবের ইবাদত
মি’রাজের রাত্রিতে ইবাদত বন্দেগি করলে বিশেষ কোনো সাওয়াব হবে এ বিষয়ে একটিও সহীহ বা যয়ীফ হাদীস নেই। মি’রাজের রাত কোন্টি তাই হাদীসে বলা হয়নি, সেখানে রাত পালনের কথা কী-ভাবে আসে। তবে ২৭ রজবের দিনে এবং রাতে ইবাদত বন্দেগির ফযীলতের বিষয়ে কিছু জাল হাদীস প্রচলিত আছে। এ সকল জাল হাদীসে মি’রাজের রাত হিসেবে নয়, বরং রাসূলুল্লাহ (ﷺ) এর নবুয়ত প্রাপ্তির দিবস হিসেবে বা একটি ফযীলতের দিন হিসেবে ‘২৭ রজব’-কে বিশেষ মর্যাদাময় বলে উল্লেখ করা হয়েছে।
এরূপ একটি জাল হাদীসে বলা হয়েছে:
إِنَّ فِيْ رَجَبٍ يَوْماً وَلَيْلَةً مَنْ صَامَ ذَلِكَ الْيَوْمَ وَقَامَ تِلْكَ اللَّيْلَةَ كَانَ لَهُ مِنَ الأَجْرِ كَمَنْ صَامَ مِائَةَ سَنَةٍ وَقَامَ لَيَالِيَهَا وَهِيَ لِثَلاَثَةٍ بَقِيْنَ مِنْ رَجَبٍ وَهُوَ الْيَوْمُ الَّذِيْ بُعِثَ فِيْهِ مُحَمَّدٌﷺ، وَهُوَ أَوَّلُ يَوْمٍ نَزَلَ فِيْهِ جِبْرِيْلُ عَلَى مُحَمَّدٍﷺ.
‘‘রজব মাসের মধ্যে একটি দিন আছে, কেউ যদি সে দিনে সিয়াম পালন করে এবং সে দিনের রাত দাঁড়িয়ে (সালাতে) থাকে তাহলে সে ১০০ বছর সিয়াম পালন করার ও রাত জেগে সালাত আদায়ের সাওয়াব লাভ করবে। সে দিনটি রজব মাসের ২৭ তারিখ। এ দিনেই মুহাম্মাদ (ﷺ) নবুয়ত লাভ করেন, এ দিনেই সর্বপ্রথম জিবরাঈল মুহাম্মাদ (ﷺ) উপর অবতরণ করেন।’’[8]
অন্য একটি জাল হাদীস নিম্নরূপ:
مَنْ صَلَّى لَيْلَةَ سَبْعٍ وَعِشْرِيْنَ مِنْ رَجَبٍ اثْنَتَيْ عَشْرَةَ رَكْعَةً يَقْرَأُ فِيْ كُلِّ رَكْعَةٍ بِفَاتِحَةِ الْكِتَابِ وَسُوْرَةٍ، فَإِذَا فَرَغَ مِنْ صَلاَتِهِ قَرَأَ فَاتِحَةَ الْكِتَابِ سَبْعَ مَرَّاتٍ وَهُوَ جَالِسٌ ثُمَّ يَقُوْلُ سُبْحَانَ اللهِ وَالْحَمْدُ للهِ وَلاَ إِلهَ إِلاَّ اللهُ وَلاَ حَوْلَ وَلاَ قُوَّةَ إِلاَّ بِاللهِ الْعَلِيِّ الْعَظِيْمِ أَرْبَعَ مَرَّاتٍ، ثُمَّ أَصْبَحَ صَائِماً حَطَّ اللهُ عَنْهُ ذُنُوْبَ سِتِّيْنَ سَنَةً وَهِيَ اللَّيْلَةُ الَّتِيْ بُعِثَ فِيْهَا مُحَمَّدٌ ﷺ.
‘‘যদি কেউ রজব মাসের ২৭ তারিখে রাত্রিতে ১২ রাক‘আত সালাত আদায় করে, প্রত্যেক রাক‘আতে সূরা ফাতিহা ও অন্য একটি সূরা পাঠ করে, সালাত শেষ হলে সে বসা অবস্থাতেই ৭ বার সূরা ফাতিহা পাঠ করে এবং এরপর ৪ বার ‘সুবহানাল্লাহ, ওয়ালহামদুলিল্লাহ, ওয়া লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু, ওয়াল্লাহু আকবার, ওয়া লা হাওলা ওয়ালা কুওয়াতা ইল্লা বিল্লাহিল আলিয়্যিল আযীম’ বলে, অতঃপর সকালে সিয়াম শুরু করে, তবে আল্লাহ তার ৬০ বছরের পাপরাশি ক্ষমা করবেন। এ রাতেই মুহাম্মাদ (ﷺ) নবুয়ত পেয়েছিলেন।’’[9]
অন্য একটি জাল হাদীসের ভাষা নিম্নরূপ:
بُعِثْتُ نَبِيًّا فِيْ السَّابِعِ وَالْعِشْرِيْنَ مِنْ رَجَبٍ فَمَنْ صَامَ ذَلِكَ الْيَوْمَ كَانَ كَفَّارَةَ سِتِّيْنَ شَهْراً
‘‘রজব মাসের ২৭ তারিখে আমি নবুয়ত পেয়েছি। কাজেই যে ব্যক্তি এই দিনে সিয়াম পালন করবে তার ৬০ মাসের গোনাহের কাফফারা হবে।’’[10]
আরেকটি জাল হাদীসে বলা হয়েছে, ‘‘ইবনু আববাস (রা) ২৭শে রজবের সকাল থেকে ইতিকাফ শুরু করতেন। যোহর পর্যন্ত সালাতে রত থাকতেন। যোহরের পরে অমুক অমুক সূরা দিয়ে চার রাক‘আত সালাত আদায় করতেন... এবং আসর পর্যন্ত দোয়ায় রত থাকতেন...। তিনি বলতেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) এরূপ করতেন।’’[11] এগুলো সবই জঘন্য মিথ্যা কথা।
২৭ রজবের ফযীলতে এবং এ দিনে ও রাতে সালাত, সিয়াম, দোয়া ইত্যাদি ইবাদতের ফযীলতে অনুরূপ আরো অনেক মিথ্যা কথা জালিয়াতগণ প্রচার করেছে। মুহাদ্দিসগণ একমত যে, ২৭ রজব সম্পর্কে হাদীস নামে যা কিছু প্রচলিত সবই ভিত্তিহীন, বাতিল ও জাল। রজব মাস এবং এ মাসের কোনো দিন বা রাতের বিশেষ ফযীলতের বিষয়ে বর্ণিত সকল হাদীসই ভিত্তিহীন। ২৭ রজব বিষয়ক হাদীসগুলোও এ সকল বাতিলের অন্তর্ভুক্ত। ইবনু হাজার আসকালানী, মোল্লা আলী কারী, মুহাম্মাদ ইবনু ইসমাঈল আজলূনী, আব্দুল হাই লাখনবী, দরবেশ হূত প্রমুখ মুহাদ্দিস বিশেষভাবে উল্লেখ করেছেন যে, ২৭ রজবের ফযীলত, এ তারিখের রাত্রে ইবাদত বা দিনের সিয়াম পালনের বিষয়ে বর্ণিত সকল কথাই বানোয়াট, জাল ও ভিত্তিহীন।[12]
[2] ইবনু রাজাব, লাতাইফ ১/১৯৯; ইবনু হাজার, তাবয়ীনুল আজাব, পৃ. ৯-৮০; মোল্লা কারী, আল-আসরার, পৃ. ১৬৬; আল-মাসনূ, পৃ. ৯৭; লাখনবী, আল-আসার, পৃ. ৫৮-৯০।
[3] ইবনু রাজাব, লাতাইফ ১/১৯৪; ইবনু হাজার আসকালানী, তাবয়ীনুল আজাব, পৃ. ৯-৮০; মোল্লা কারী, আল-আসরার, পৃ. ২৩৮; আল-মাসনূ, পৃ. ২০৮; আব্দুল হাই লাখনবী, আল-আসার, পৃ. ৫৮-৯০, ১১১-১১৩।
[4] ইবনু রাজাব, লাতাইফ ১/১৯৭; ইবনু হাজার আসকালানী, তাবয়ীনুল আজাব, পৃ. ৯-৮০; আব্দুল হাই লাখনবী, আল-আসার, পৃ. ৫৮-৯০।
[5] ইবনুল কাইয়িম, আল-মানার, পৃ. ৯৬; ইবনু রাজাব, লাতাইফ ১/১৯৫-১৯৭; মোল্লা আলী কারী, আল-আসরার, পৃ. ৩৯২-৩৩০; আব্দুল হাই লাখনবী, আল-আসার, ৫৮-৭৯; শাওকানী, আল-ফাওয়াইদ ২/৫৩৯-৫৪১; আজলূনী, কাশফুল খাফা ২/৫৬৭।
[6] ইবনুল জাওযী, আল-মাওদূ‘আত ২/৪৬-৪৮; ইবনু রাজাব, লাতাইফ ১/১৯৪-১৯৫; ইবনু হাজার, তাবয়ীনুল আজাব, পৃ. ৫৪; সুয়ূতী, আল-লাআলী ২/৫৫-৫৬; ইবনু আর্রাক, তানযীহ ১/৩০৩, ৩০৬, ২/৯০-৯১; মোল্লা কারী, আল-আসরার, পৃ. ৩২৮; আল-মাসনূ, পৃ. ২০৮; শাওকানী, আল-ফাওয়াইদ ২/৫৩৯-৫৪১; আব্দুল হাই লাখনবী, আল-আসার, পৃ. ৬২-৭৭।
[7] দেখুন: ইবন কাসীর, আল-বিদায়া ওয়ান নিহায়া ২/৪৭০-৪৮০, শামী, সুবুলুল হুদা (সিরাহ শামিয়া), ৩/৬৪-৬৬, কাসতালানী, আল-মাওয়াহিবুল লাদুন্নিয়াহ ২/৩৩৯-৩৯৮।
[8] জূযকানী, আল-আবাতীল, ২/৪৮; ইবনু হাজার, তাবয়ীনুল আজাব, পৃ. ৬৩; সুয়ূতী, যাইলুল লাআলী, পৃ. ১১৭; ইবনু আর্রাক, তানযীহ ২/১৬১; তাহির পাটনী, তাযকিরা, পৃ. ১১৬; শাওকানী, আল-ফাওয়াইদ ২/৫৩৯; আব্দুল হাই লাখনবী, আল-আসার, পৃ. ৫৮।
[9] ইবনু হাজার, তাবয়ীনুল আজাব, পৃ. ৫২; আব্দুল হাই লাখনবী, আল-আসার, পৃ. ৫৮।
[10] ইবনু হাজার, তাবয়ীনুল আজাব, পৃ. ৬৪; ইবনু আর্রাক, তানযীহ ২/১৬১।
[11] আব্দুল হাই লাখনবী, আল-আসার, পৃ. ৭৮।
[12] ইবন হাজার, তাবয়ীনুল আজাব, পৃ. ৬৪; আলী কারী, আল-আসরার, পৃ. ২৮৯; আল-মাসনূ, পৃ. ২০৮; আজলূনী, কাশফুল খাফা ২/৫৫৪; লাখনবী, আল-আসার ৭৭-৭৯।
(ক) সহীহ হাদীসের আলোকে শাবান মাস
পূর্ববর্তী আলোচনা থেকে আমরা দেখেছি যে, সফর থেকে রজব পর্যন্ত ৬ মাসের কোনো বিশেষ ফযীলত হাদীস দ্বারা প্রমাণিত নয়। শা’বান মাস তদ্রূপ নয়। সহীহ হাদীসে শাবান মাসের নিম্নলিখিত ফযীলতগুলো প্রমাণিত:
১. এ মাসে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বেশি বেশি সিয়াম পালন করতে ভালবাসতেন। তিনি সাধারণত এ মাসের অধিকাংশ দিন একটানা সিয়াম পালন করতেন বলে বুখারী ও মুসলিম সংকলিত সহীহ হাদীসে বর্ণিত হয়েছে। এমনকি বুখারী ও মুসলিমের কোনো কোনো হাদীসে উল্লেখ করা হয়েছে যে, তিনি শা’বান মাস পুরোটাই নফল সিয়ামে কাটাতেন। তিনি এ মাসে কিছু সিয়াম পালন করতে সাহাবীগণকে উৎসাহ প্রদান করতেন।[1]
২. আহমাদ, নাসাঈ প্রমুখ মুহাদ্দিস সংকলিত মোটামুটি গ্রহণযোগ্য বা হাসান পর্যায়ের হাদীসে উল্লেখ করা হয়েছে যে, শা’বান মাসে বান্দার আমল আল্লাহর দরবারে পেশ করা হয়; এজন্য এই মাসে বেশি বেশি নফল সিয়াম পালন করা উচিত।[2]
৩. শা’বান মাসের মধ্যম রজনী বা ১৫ই শা’বানের রাতে মহান আল্লাহ তাঁর বান্দাদেরকে ক্ষমা করেন বলে সহীহ হাদীসে বর্ণিত হয়েছে।
এ সকল সহীহ ও হাসান হাদীসের পাশাপাশি এ মাসের ফযীলত ও ইবাদতের বিষয়ে অনেক জাল হাদীস প্রচলিত। এ জাল হাদীসগুলোকে আমরা দু ভাগে ভাগ করতে পারি: ১ সাধারণভাবে শাবান মাস বিষয়ক ও ২. শাবান মাসের মধ্যম রজনী বা ‘শবে বরাত’ বিষয়ক। আমাদের দেশে দ্বিতীয় বিষয়টিই প্রসিদ্ধি লাভ করেছে। এজন্য প্রথম বিষয়ে সংক্ষেপে আলোচনা করে আমরা দ্বিতীয় বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা করব, ইনশা আল্লাহ।
[2] নাসাঈ, আস-সুনান ৪/২০১; আহমাদ, আল-মুসনাদ ৫/২০১।
‘বার চান্দের ফযীলত’ জাতীয় কোনো কোনো পুস্তকে শা’বান মাসের প্রথম রজনীতে বিশেষ সূরা বা আয়াত দিয়ে কয়েক রাক‘আত সালাত আদায়ের কথা, ফাতিমার (রা) জন্য বখশিশ করার কথা, শা’বান মাসে নির্ধারিত পরিমাণ দরূদ শরীফ পাঠের বিশেষ ফযীলতের কথা, শাবান মাসের যে কোনো জুমুআর দিবসে বিশেষ সূরা দ্বারা বিশেষ পদ্ধতিতে কয়েক রাক‘আত সালাত আদায়ের কথা এবং সেগুলোর কাল্পনিক সাওয়াবের কথা লিখা হয়েছে।[1] এগুলো সবই ভিত্তিহীন বানোয়াট কথা। শা’বান মাসে নফল সিয়াম পালন ব্যতীত অন্য কোনো প্রকারের বিশেষ ইবাদতের কথা কোনো হাদীসে বলা হয় নি।
‘মধ্য শাবানের রজনী’ বা ‘শবে বারাত’ বিষয়ক সকল সহীহ, যয়ীফ ও জাল হাদীস সনদ-সহ বিস্তারিত আলোচনা করেছি ‘‘কুরআন-সুন্নাহর আলোকে শবে বরাত: ফযীলত ও আমল’’ নামক গ্রন্থে। এখানে আমি এ বিষয়ক জাল হাদীসগুলো আলোচনা করতে চাই। প্রসঙ্গত এ বিষয়ক সহীহ ও যয়ীফ হাদীসগুলোর বিষয়েও কিছু কথা আসবে।
১. মধ্য শাবানের রাত্রির বিশেষ মাগফিরাত
এ বিষয়টি সহীহ হাদীস দ্বারা প্রমাণিত। হাদীস শরীফে বলা হয়েছে:
إِنَّ اللَّهَ لَيَطَّلِعُ فِي لَيْلَةِ النِّصْفِ مِنْ شَعْبَانَ فَيَغْفِرُ لِجَمِيعِ خَلْقِهِ إِلا لِمُشْرِكٍ أَوْ مُشَاحِنٍ
‘‘মহান আল্লাহ মধ্য শাবানের রাতে তাঁর সৃষ্টির প্রতি দৃকপাত করেন এবং মুশরিক ও বিদ্বেষ পোষণকারী ব্যতীত সকলকে ক্ষমা করে দেন।’’
এ অর্থের হাদীস কাছাকাছি শব্দে ৮ জন সাহাবী: আবূ মূসা আশআরী, আউফ ইবনু মালিক, আব্দুল্লাহ ইবনু আমর, মুয়ায ইবনু জাবাল, আবু সা’লাবা আল-খুশানী, আবূ হুরাইরা, আয়েশা ও আবূ বাকর সিদ্দীক (রাঃ) থেকে বিভিন্ন সনদে বর্ণিত হয়েছে।[1] এ সকল হাদীসের সনদ বিষয়ক বিস্তারিত আলোচনা উপর্যুক্ত গ্রন্থে করেছি। এগুলোর মধ্যে কিছু সনদ দুর্বল ও কিছু সনদ ‘হাসান’ পর্যায়ের। সামগ্রিক বিচারে হাদীসটি সহীহ। শাইখ আলবানী বলেন, ‘‘হাদীসটি সহীহ। তা অনেক সাহাবী থেকে বিভিন্ন সনদে বর্ণিত হয়েছে, যা একটি অন্যটিকে শক্তিশালী হতে সহায়তা করে।...[2]
এ হাদীস থেকে প্রমাণিত হয় যে, এ রাত্রিটি একটি বরকতময় রাত এবং এ রাতে আল্লাহ তাঁর বান্দাদেরকে ক্ষমা করেন। কিন্তু এ ক্ষমা অর্জনের জন্য শিরক ও বিদ্বেষ বর্জন ব্যতীত অন্য কোনো আমল করার প্রয়োজন আছে কি না তা এই হাদীসে উল্লেখ নেই।
২. মধ্য শাবানের রাত্রিতে ভাগ্য লিখন
কিছু কিছু হাদীসে উল্লেখ করা হয়েছে যে, এ রাত্রিতে ভাগ্য অনুলিপি করা হয় বা পরবর্তী বছরের জন্য হায়াত-মউত ও রিযক ইত্যাদির অনুলিপি করা হয়। হাদীসগুলোর সনদ বিস্তারিত আলোচনা করেছি উপর্যুক্ত পুস্তকটিতে। এখানে সংক্ষেপে বলা যায় যে, এ অর্থে বর্ণিত হাদীসগুলো অত্যন্ত দুর্বল অথবা বানোয়াট। এ অর্থে কোনো সহীহ বা গ্রহণযোগ্য হাদীস বর্ণিত হয় নি।
এখানে উল্লেখ্য যে, কুরআন কারীমে মহান আল্লাহ বলেন:
إِنَّا أَنْزَلْنَاهُ فِي لَيْلَةٍ مُبَارَكَةٍ إِنَّا كُنَّا مُنْذِرِينَ فِيهَا يُفْرَقُ كُلُّ أَمْرٍ حَكِيمٍ
‘‘আমি তো তা অবতীর্ণ করেছি এক মুবারক রজনীতে এবং আমি তো সতর্ককারী। এ রজনীতে প্রত্যক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় স্থিরীকৃত হয়।’’[3]
এ বাণীর ব্যাখ্যায় তাবিয়ী ইকরিমাহ, বলেন, এখানে ‘মুবারক রজনী’ বলতে ‘মধ্য শাবানের রাতকে’ বুঝানো হয়েছে। ইকরিমাহ বলেন, এ রাতে গোটা বছরের সকল বিষয়ে ফয়সালা করা হয়।[4]
মুফাস্সিরগণ ইকরিমার এ মত গ্রহণ করেন নি। ইমাম তাবারী বিভিন্ন সনদে ইকরিমার এ ব্যাখ্যা উদ্ধৃত করার পরে তার প্রতিবাদ করেছেন। তিনি উল্লেখ করেছেন যে, ইকরিমার এ মত ভিত্তিহীন। তিনি বলেন যে, সঠিক মত হলো, এখানে ‘মুবারক রজনী’ বলতে ‘লাইলাতুল কদর’-কে বুঝানো হয়েছে। আল্লাহ যে রাত্রিতে কুরআন অবতীর্ণ করেছেন সে রাত্রিকে এক স্থানে লাইলাতুল কদর: ‘তাকদীরের রাত’ বা ‘মর্যাদার রাত’ বলে অভিহিত করেছেন[5]। অন্যত্র এ রাত্রিকেই ‘লাইলাতুম মুবারাকা’ বা ‘বরকতময় রজনী’ বলে অভিহিত করেছেন। এবং এ রাত্রিটি নিঃসন্দেহে রামাদান মাসের মধ্যে; কারণ অন্যত্র আল্লাহ ঘোষণা করেছেন যে, তিনি রামাদান মাসে কুরআন নাযিল করেছেন।[6] এথেকে প্রমাণিত হয় যে, মুবারক রজনী রামাদান মাসে, শাবান মাসে নয়।[7]
পরবর্তী মুফাস্সিরগণ ইমাম তাবারীর সাথে ঐকমত্য পোষণ করেছেন। তাঁরা বলেছেন যে, ‘মুবারক রজনী’ বলতে এখানে ‘মহিমান্বিত রজনী’ বা ‘লাইলাতুল কদর’ বুঝানো হয়েছে। তাঁদের মতে ‘লাইলাতুম মুবারাকা’ এবং ‘লাইলাতুল কদর’ একই রাতের দুটি উপাধি। দুটি কারণে মুফাস্সিরগণ ইকরিমার তাফসীরকে বাতিল ও অগ্রহণযোগ্য বলে মনে করেছেন:
(ক) ইকরিমার মতটি কুরআনের সুস্পষ্ট বাণীর সাথে সাংঘর্ষিক। কুরআনে বলা হয়েছে যে, আল্লাহ রামাদান মাসে কুরআন নাযিল করেছেন। অন্যত্র বলেছেন যে, একটি মুবারক রাত্রিতে ও একটি মহিমান্বিত রাত্রিতে তিনি কুরআন নাযিল করেছেন। এ সকল আয়াতের সমন্বিত সুস্পষ্ট অর্থ হলো, আল্লাহ রামাদান মাসের এক রাত্রিতে কুরআন নাযিল করেছেন এবং সে রাতটি বরকতময় ও মহিমান্বিত। মুবারক রজনীকে শবে বরাত বলে দাবী করলে এ আয়াতগুলোর স্পষ্ট অর্থ বিভিন্ন অপব্যাখ্যার মাধ্যমে বাতিল করতে হয়।
(খ) বিভিন্ন সাহাবী ও তাবিয়ী থেকে বর্ণিত হয়েছে যে, তাঁরা ‘মুবারক রজনী’-র ব্যাখ্যায় বলেছেন যে, এ রাতটি হলো ‘লাইলাতুল কদর’ বা ‘মহিমান্বিত রজনী’। সাহাবীগণের মধ্য থেকে ইবনু আববাস (রা) ও ইবনু উমার (রা) থেকে অনুরূপ ব্যাখ্যা বর্ণিত হয়েছে। তাবিয়ীগণের মধ্যে থেকে আবু আব্দুর রহমান আল-সুলামী (৭৪ হি), মুজাহিদ বিন জাবর (১০২ হি), হাসান বসরী (১১০ হি), ক্বাতাদা ইবনু দি‘আমা (১১৭ হি) ও আব্দুর রহমান বিন যায়েদ বিন আসলাম মাদানী (১৮২ হি) বিশেষ ভাবে উল্লেখযোগ্য। তাঁরা সকলেই বলেছেন যে, লাইলাতুম মুবারাকাহ অর্থ লাইলাতুল কদর।[8]
৩. মধ্য-শাবানের রাত্রিতে দোয়া-মুনাজাত
মধ্য শাবানের রজনীর ফযীলত বিষয়ে বর্ণিত তৃতীয় প্রকারের হাদীসগুলোতে এ রাত্রিতে সাধারণভাবে দোয়া করার উৎসাহ প্রদান করা হয়েছে। এ রাতে দোয়া করা, আল্লাহর কাছে নিজের প্রয়োজন মেটানোর জন্য আকুতি জানানো এবং জীবিত ও মৃতদের পাপরাশি ক্ষমালাভের জন্য প্রার্থনার উৎসাহ প্রদান করা হয়েছে। এ অর্থে কোনো সহীহ বা গ্রহণযোগ্য হাদীস নেই। এ অর্থে বর্ণিত হাদীসগুলোর মধ্যে কিছু হাদীস দুর্বল এবং কিছু হাদীস জাল।
৪. অনির্ধারিত সালাত ও দোয়া
মধ্য শাবানের রাত্রি সম্পর্কে বর্ণিত কিছু হাদীসে এ রাত্রিতে সালাত আদায় ও দোয়ার কথা উল্লেখ করা হয়েছে। এ সকল হাদীস এ রাত্রির সালাতের জন্য কোনো নির্ধারিত রাক‘আত, নির্ধারিত সূরা বা নির্ধারিত পদ্ধতি উল্লেখ করা হয় নি। শুধু সাধারণভাবে এ রাত্রিতে তাহাজ্জুদ আদায় ও দোয়া করার বিষয়টি এ সকল হাদীস থেকে জানা যায়। এ অর্থে বর্ণিত হাদীসগুলো প্রায় সবই বানোয়াট। দু-একটি হাদীস দুর্বল হলেও বানোয়াট নয়।
৫. নির্ধারিত রাক‘আত, সূরা ও পদ্ধতিতে সালাত
শবে বরাত বিষয়ক অন্য কিছু হাদীসে এ রাত্রিতে বিশেষ পদ্ধতিতে, বিশেষ সুরা পাঠের মাধ্যমে, নির্দ্দিষ্ট সংখ্যক রাকআত সালাত আদায়ের বিশেষ ফযীলতের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। মুহাদ্দিসগণের সর্বসম্মত মত অনুযায়ী এই অর্থে বর্ণিত সকল হাদীস বানোয়াট। হিজরী চতুর্থ শতকের পরে রাসুলুলাহ (ﷺ) -এর নামে বানিয়ে এগুলো প্রচার করা হয়েছে। এখানে এ জাতীয় কয়েকটি জাল ও বানোয়াট হাদীস উল্লেখ করছি।
৬. ৩০০ রাক‘আত, প্রতি রাক‘আতে ৩০ বার সূরা ইখলাস
‘‘যে ব্যক্তি মধ্য শাবানের রাতে প্রত্যেক রাকআতে ৩০বার সুরা ইখলাস পাঠের মাধ্যমে ৩০০ রাকআত সালাত আদায় করবে জাহান্নামের আগুন অবধারিত এমন ১০ ব্যক্তির ব্যাপারে তার সুপারিশ গ্রহণ করা হবে।’’ হাদীসটি ইবনুল ক্বাইয়িম বাতিল বা ভিত্তিহীন হাদীস সমূহের মধ্যে উল্লেখ করেছেন।[9]
৭. ১০০ রাক‘আত, প্রতি রাক‘আতে ১০ বার সুরা ইখলাস
মধ্য শাবানের রজনীতে এ পদ্ধতিতে সালাত আদায়ের প্রচলন হিজরী চতুর্থ শতকের পরে মানুষের মধ্যে প্রসিদ্ধি লাভ করে। মুহাদ্দিস ও ঐতিহাসিকগণ উল্লেখ করেছেন যে, ৪৪৮ হি. সনে বাইতুল মুকাদ্দাসে প্রথম এ রাত্রিতে এ পদ্ধতিতে সালাত আদায়ের প্রচলন শুরু হয়।[10] এ সময়ে বিভিন্ন মিথ্যাবাদী গল্পকার ওয়ায়িয এ অর্থে কিছু হাদীস বানিয়ে বলেন। এ অর্থে ৪টি হাদীস বর্ণিত হয়েছে যার প্রত্যেকটিই বানোয়াট ও ভিওিহীন।
এর প্রথমটি আলী (রা)-এর সূত্রে রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর নামে প্রচারিত: যে ব্যক্তি মধ্য শাবানের রাতে ১০০ রাকআত সালাত আদায় করবে, প্রত্যেক রাকআতে সুরা ফাতিহা ও ১০ বার সুরা ইখলাস পাঠ করবে সে উক্ত রাতে যত প্রয়োজনের কথা বলবে আল্লাহ তায়ালা তার সকল প্রয়োজন পূরণ করবেন। লাওহে মাহফুযে তাকে দুর্ভাগা লিপিবদ্ধ করা হলেও তা পরির্বতন করে সৌভাগ্যবান হিসেবে তার নিয়তি নির্ধারণ করা হবে, আল্লাহ তায়ালা তার কাছে ৭০ হাজার ফিরিশতা প্রেরণ করবেন যারা তার পাপরাশি মুছে দেবে, বছরের শেষ পর্যন্ত তাকে সুউচ্চ মর্যাদায় আসীন রাখবে, এছাড়াও আল্লাহ তায়ালা ‘আদন’ জান্নাতে ৭০ হাজার বা ৭ লাখ ফিরিশতা প্রেরণ করবেন যারা জান্নাতের মধ্যে তার জন্য শহর ও প্রাসাদ নির্মাণ করবে এবং তার জন্য বৃক্ষরাজি রোপন করবে...। যে ব্যক্তি এ নামায আদায় করবে এবং পরকালের শান্তি কামনা করবে মহান আল্লাহ তার জন্য তার অংশ প্রদান করবেন।
হাদীসটি সর্বসম্মতভাবে বানোয়াট ও জাল। এর বর্ণনাকারীগণ কেউ অজ্ঞাত পরিচয় এবং কেউ মিথ্যাবাদী জালিয়াত হিসেবে পরিচিত।[11]
এ বিষয়ক দ্বিতীয় জাল হাদীসটিতে জালিয়াতগণ ইবনু উমার (রা)-এর সূত্রে রাসূলুল্লাহ ﷺ-এর নামে বলেছে: ‘‘যে ব্যক্তি মধ্য শাবানের রাতে এক শত রাকআত সালাতে এক হাজার বার সুরা ইখলাস পাঠ করবে তার মৃত্যুর পূর্বে আল্লাহ তা‘য়ালা তার কাছে ১০০ জন ফিরিশতা প্রেরণ করবেন, তন্মধ্যে ত্রিশজন তাকে জান্নাতের সুসংবাদ দিবে, ত্রিশজন তাকে জাহান্নমের আগুন থেকে নিরাপত্তার সুসংবাদ প্রদান করবে, ত্রিশজন তাকে ভুলের মধ্যে নিপতিত হওয়া থেকে রক্ষা করবে এবং দশজন তার শত্রুদের ষড়যন্ত্রের জবাব দেবে।’’
এ হাদীসটিও বানোয়াট। সনদের অধিকাংশ রাবী অজ্ঞাতপরিচয়। বাকীরা মিথ্যাবাদী হিসাবে সুপরিচিত।[12]
এ বিষয়ক তৃতীয় জাল হাদীসটিতে মিথ্যাবাদীগণ বিশিষ্ট তাবিয়ী ইমাম আবু জাফর মুহাম্মাদ আল বাকির (১১৫ হি) থেকে রাসূলুল্লাহ ﷺ-এর বরাতে বর্ণনা করেছে: ‘‘যে ব্যক্তি মধ্য শাবানের রাতে ১০০ রাকআত সালাতে ১০০০ বার সুরা ইখলাস পাঠ করবে তার মৃত্যুর পূর্বেই মহান আল্লাহ তার কাছে ১০০ ফিরিশতা প্রেরণ করবেন। ৩০ জন তাকে জান্নাতের সুসংবাদ দিবে, ৩০ জন তাকে জাহান্নামের আগুন থেকে মুক্তি দিবে, ৩০ জন তার ভুল সংশোধন করবে এবং ১০ জন তার শত্রুদের নাম লিপিবদ্ধ করবে।’’
এ হাদীসটিও বানোয়াট। সনদের কিছু রাবী অজ্ঞাতপরিচয় এবং কিছু রাবী মিথ্যাবাদী হিসাবে সুপরিচিত।।[13]
১০০ রাকআত সংক্রান্ত এ বিশেষ পদ্ধতিটি হিজরী চতুর্থ শতাব্দী থেকে বিভিন্ন গল্পকার ওয়ায়িযদের মাধ্যমে সাধারণ মানুষের কাছে প্রসিদ্ধি লাভ করে এবং যুগে যুগে তা বৃদ্ধি পেতে থাকে। এক পর্যায়ে ভারতীয় ওয়ায়িযগণ এ সালাতের পদ্ধতির মধ্যে প্রত্যেক দু রাকআতের পরে ‘‘তাসবীহুত তারাবীহ’’র প্রচলন করেন এবং ১০০ রাকআত পূর্ণ হওয়ার পর কতিপয় সাজদা, সাজদার ভিতরে ও বাহিরে কতিপয় দোয়া সংযুক্ত করেছেন।
আল্লামা আব্দুল হাই লাখনবী (১৩০৬ হি) বানোয়াট ও ভিত্তিহীন হাদীস সমুহের মধ্যে এ হাদীসটি উল্লেখ করেছেন। যার সারমর্ম হলো, মধ্য শাবানের রাতে পঞ্চাশ সালামে ১০০ রাকআত সালাত আদায় করতে হবে। প্রত্যেক রাকাতে সুরা ফাতিহার পর ১০ বার সুরা ইখলাস পাঠ করতে হবে। প্রত্যেক দুই রাকআত পর ‘তাসবীহুত তারাবীহ’ পাঠ করবে, এর পর সাজদা করবে। সাজদার মধ্যে কিছু নির্ধারিত বানোয়াট দোয়া পাঠ করবে। অতঃপর সাজদা থেকে মাথা তুলবে এবং নবী (ﷺ) এর উপর দুরূদ পাঠ করবে ও কিছু নির্ধারিত বানোয়াট দোয়া পাঠ করবে। অতঃপর দ্বিতীয় সাজদা করবে এবং তাতে কিছু নির্ধারিত বানোয়াট দোয়া পাঠ করবে।[14]
৮. ৫০ রাক‘আত
ইমাম যাহাবী এ হাদীসটি ভিত্তিহীন ও বানোয়াট হাদীস হিসেবে হাদীসটির বর্ণনাকারী অজ্ঞাত রাবী মুহাম্মাদ বিন সাঈদ আলমীলী আত তাবারীর জীবনীতে উল্লেখ করেছেন। উক্ত মুহাম্মাদ বিন সাঈদ এ হাদীসটি তার মতই অজ্ঞাত রাবী মুহাম্মদ বিন আমর আল বাজালী এর সনদে আনাস (রা) থেকে মারফু হিসেবে বর্ণনা করেনঃ যে ব্যক্তি মধ্য শাবানের রাতে ৫০ রাকআত সালাত আদায় করবে, সে ব্যক্তি আল্লাহ তা‘আলার কাছে যত প্রকার প্রয়োজনের কথা বলবে তার সবটুকুই পূরণ করে দেয়া হবে। এমনকি লাওহে মাহফুযে তাকে দুর্ভাগ্যবান হিসেবে লিপিবদ্ধ করা হলেও তা পরিবর্তন করে তাকে সৌভাগ্যবান করা হবে। এবং আল্লাহ তা‘আলা তার কাছে ৭ লাখ ফেরেশতা প্রেরণ করবেন যারা তার নেকী লিপিবদ্ধ করবে, অপর ৭ লাখ ফেরেশতা প্রেরণ করবেন যারা তার জন্য বেহেশতে প্রাসাদ নির্মাণ করবে ..... এবং ৭০ হাজার একত্ববাদীর জন্য তার সুপারিশ গ্রহণ করা হবে...। ইমাম যাহাবী এ মিথ্যা হাদীসটি উল্লেখ করে বলেন, যে ব্যাক্তি এ হাদীসটি বানোয়াট করেছে আল্লাহ তা‘আলা তাকে লাঞ্চিত করুন।[15]
৯. ১৪ রাক‘আত
ইমাম বায়হাকী তাঁর সনদে আলী (রা) থেকে বর্ণনা করেন, তিনি বলেন: আমি রাসূলুল্লাহ্ ﷺ-কে মধ্য শাবানের রাতে ১৪ রাকআত সালাত আদায় করতে দেখেছি। সালাত শেষে বসে তিনি ১৪ বার সূরা ফাতিহা, ১৪ বার সূরা ইখলাস, ১৪ বার সূরা ফালাক, ১৪ বার সূরা নাস, ১ বার আয়াতুল কুরসী এবং সূরা তাওবার শেষ দু আয়াত তিলাওয়াত করেন, এ সব কাজের সমাপ্তির পর আমি তাঁকে এগুলো সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করলাম। তিনি বললেন: তুমি আমাকে যে ভাবে করতে দেখেছ এভাবে যে করবে তার আমলনামায় ২০টি কবুল হজ্জের সাওয়াব লেখা হবে এবং ২০ বছরের কবুল সিয়ামের সাওয়াব লিখা হবে। পরদিন যদি সে সিয়াম পালন করে তবে দু বছরের সিয়ামের সাওয়াব তার আমলনামায় লেখা হবে।
হাদীসটি উল্লেখ করার পর ইমাম বায়হাকী বলেন: ইমাম আহমাদ বলেছেন যে, এ হাদীসটি আপত্তিকর, পরিত্যক্ত, জাল ও বানোয়াট বলে প্রতীয়মান। হাদীসটির সনদে অজ্ঞাত পরিচয় বর্ণনাকারীগণ রয়েছে।[16]
অন্যান্য মুহাদ্দিস হাদীসটিকে জাল বলে গণ্য করার বিষয়ে ইমাম বাইহাকীর সাথে ঐকমত্য পোষণ করেছেন। আল্লামা ইবনুল জাওযী ও ইমাম সুয়ুতী বলেন: হাদীসটি বানোয়াট, এর সনদ অন্ধকারাচ্ছন্ন। .... সনদের মধ্যে মুহাম্মাদ বিন মুহাজির রয়েছেন। ইমাম আহমাদ বিন হাম্বাল বলেন: মুহাম্মদ বিন মুহাজির হাদীস বানোয়াট-কারী।[17]
১০. ১২ রাক‘আত, প্রত্যেক রাক‘আতে ৩০ বার সূরা ইখলাস
জালিয়াতগণ আবু হুরাইরা (রা) পর্যন্ত একটি জাল সনদ তৈরী করে তাঁর সূত্রে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) থেকে বর্ণনা করেছে: ‘‘যে ব্যক্তি মধ্য শা’বানের রাতে ১২ রাকআত সালাত আদায় করবে, প্রত্যেক রাকাতে ৩০ বার সূরা ইখলাস পাঠ করবে, সালাত শেষ হওয়ার পূর্বেই বেহেশতের মধ্যে তার অবস্থান সে অবলোকন করবে এবং তার পরিবারের সদস্যদের মধ্য থেকে জাহান্নাম নির্ধারিত হয়েছে এমন দশ ব্যক্তির ব্যাপারে তার সুপারিশ গ্রহণ করা হবে।’’
এ হাদীসের সনদের অধিকাংশ বর্ণনাকারীই অজ্ঞাত। এছাড়াও সনদের মধ্যে কতিপয় দুর্বল ও পরিত্যাজ্য বর্ণনাকারী রয়েছে।[18]
উপরের আলোচনার মাধ্যমে আমাদের কাছে সুস্পষ্ট ভাবে প্রতিভাত হয়েছে যে, মধ্য শা’বানের রাতে নির্দ্দিষ্ট পদ্ধতিতে নির্দ্দিষ্ট সূরার মাধ্যমে নির্দ্দিষ্ট রাকআত সালাত আদায় সংক্রান্ত হাদীস সমূহ বানোয়াট ও ভিত্তিহীন। মুহাদ্দিসগণ এ ব্যাপারে সকলেই একমত। কিন্তু কতিপয় নেককার ও সরলপ্রাণ ফকীহ ও মুফাস্সির তাঁদের রচনাবলিতে এগুলোর জালিয়াতি ও অসারতা উল্লেখ ছাড়াই এসকল ভিত্তিহীন হাদীস স্থান দিয়েছেন। এমনকি কেউ কেউ এগুলোর উপর ভিত্তি করে ফতোয়া প্রদান করেছেন ও তদনুযায়ী আমল করেছেন, যা পরবর্তীতে এ রীতি প্রসারিত হওয়ার ক্ষেত্রে সহায়তা করেছে।
মোল্লা আলী ক্বারী (১০১৪ হি) মধ্য শাবানের রাতে সালাত আদায়ের ফযীলত সংক্রান্ত হাদীসগুলোর অসারতা উল্লেখপূর্বক বলেন, সবচেয়ে আশ্চর্যের ব্যাপার হলো যে, যারা সুন্নাতের ইলমের সন্ধান পেয়েছেন তারা এগুলো দ্বারা প্রতারিত হন কি করে! এ সালাত চতুর্থ হিজরী শতকের পর ইসলামের মধ্যে অনুপ্রবেশ করেছে যার উৎপত্তি হয়েছে বায়তুল মুকাদ্দাস থেকে। এব্যাপারে অসংখ্য জাল হাদীস তৈরী করা হয়েছে যার একটিও সঠিক বা নির্ভরযোগ্য নয়।[19] তিনি আরো বলেন, হে পাঠক, এ সকল ভিত্তিহীন মিথ্যা হাদীস ‘কুতুল কুলুব’, ‘এহয়িয়াউ উলুমিদ্দীন’ ও ইমাম সা‘লাবীর তাফসীর গ্রন্থে উল্লেখ থাকার কারণে আপনারা প্রতারিত ও বিভ্রান্ত হবেন না।[20] ইসমাঈল বিন মুহাম্মদ আজলুনীও (১১৬২ হি) অনুরূপ মন্তব্য করেছেন।[21]
আল্লামা শাওকানী (১২৫০ হি) শবে বরাতের রাত্রিতে আদায়কৃত এ সালাত সংক্রান্ত হাদীসের ভিত্তিহীনতা উল্লেখ পূর্বক বলেন, এ সকল হাদীস দ্বারা এক দল ফকীহ প্রতারিত হয়েছেন। যেমন ‘এহয়িয়াউ উলূমিদ্দীন’ গ্রন্থকার ইমাম গাযালী ও অন্যান্যরা। এমনিভাবে কতিপয় মুফাস্সিরও প্রতারিত হয়েছেন। এ সালাতের বিষয়ে বিভিন্ন ধরনের জাল হাদীস রচিত হয়েছে। এ সকল হাদীস মাউযূ বা বানোয়াট হওয়ার অর্থ হলো, এই রাত্রিতে নির্ধারিত পদ্ধতিতে নির্ধারিত রাক‘আত সালাত আদায়ের প্রচলন বাতিল ও ভিত্তিহীন। তবে কোনো নির্ধারিত রাক‘আত, সূরা বা পদ্ধতি ব্যতিরেকে সাধারণ ভাবে এ রাত্রিতে ইবাদত বা দোয়া করার বিষয়ে দুই একটি যয়ীফ হাদীস রয়েছে।’’[22]
[2] আলবানী, সাহীহাহ (সিলসিলাতুল আহাদীসিস সাহীহাহ) ৩/১৩৫।
[3] সূরা (৪৪) দুখান: আয়াত ৩-৪।
[4] তাবারী, তাফসীর ২৫/১০৭-১০৯।
[5] সূরা (৯৭) কাদ্র: আয়াত ১।
[6] সূরা (২) বাকারা: আয়াত ১৮৫।
[7] তাবারী, তাফসীর ২৫/১০৭-১০৯।
[8] নাহহাস, মা’আনিল কুরআন ৬/৩৯৫; যামাখশারী, আল-কাশশাফ ৩/৪২৯; ইবনুল আরাবী, আহকামুল কুরআন ৪/১৬৯০; ইবনু আতিয়্যাহ্, আল- মুহাররার আল ওয়াজীয ৫/৬৮-৬৯; কুরতুবী, তাফসীর ১৬/১২৬; আবু হাইয়্যান, আল-বাহর আল-মুহীত ৮/৩২-৩৩; ইবনু কাছীর, তাফসীর ৪/১৪০; সুয়ূতী, আদদুররুল মানসূর ৫/৭৩৮-৭৪২; আবুস সু’উদ, তাফসীর-ই-আবিস সু’উদ ৮/৫৮; শাওকানী, ফাতহুল ক্বাদীর ৪/৫৭০-৫৭২; আলুসী, রূহুল মা’আনী ১৩/১১০; থানবী, তাফসীর-ই আশরাফী ৫/৬১৫-৬১৬; শানক্বীতী, মুহাম্মদ আমীন, আদওয়া আল- বায়ান ৭/৩১৯; সাবুনী, মুহাম্মদ আলী, সাফওয়াতুত তাফাসীর ৩/১৭০-১৭১; মুফতী শফী, মা’আরেফ আল-কুরআন ৭/৮৩৫-৮৩৬।
[9] ইবনুল কাইয়িম, নাক্বদুল মানকুল ১/৮৫।
[10] মোল্লা আলী ক্বারী, মিরক্বাতুল মাফাতীহ ৩/৩৮৮।
[11] ইবনুল জাওযী, আল-মাওদু‘আত ২/৪৯-৫০; সুয়ুতী, আল-লাআলী, ২/৫৭-৫৮; ইবনু আর্রাক, তানযীহ, ২/৯২-৯৩; মোল্লা ক্বারী, আল-আসরার, পৃ- ৩৩০-৩৩১; আল মাসনু’, পৃ- ২০৮-২০৯; শাওকানী, আল ফাওয়ায়েদ ১/৭৫-৭৬।
[12] ইবনুল জাওযী, আল-মাউদূ‘আত, ২/৫০-৫১; ইবনু হাজার, লিসানুল মীযান ৫/২৭১; সুয়ূতী, আল লাআলী, ২/৫৯; ফাকিহানী, মুহাম্মদ বিন ইসহাক্ব, আখবারু মাক্কাহ ৩/৮৬-৮৭।
[13] ইবনুল জাওযী, আল-মাউদূ ‘আত, ২/৫১; সুয়ূতী, আল-লাআলী, ২/৫৯।
[14] আব্দুল হাই লাখনবী, আল-আসার আল-মারফুআ, পৃ- ১১৩-১১৪।
[15] যাহাবী, মীযানুল ই’তিদাল, ৬/১৬৮-১৬৯।
[16] বায়হাকী, শুআবুল ঈমান, ৩/৩৮৬ - ৩৮৭, হাদীস নং - ৩৮৪১।
[17] ইবনুল জাওযী, আল-মাউদূআত, ২/৫২; সুয়ূতী, আল-লাআলী, ২/৫৯-৬০।
[18] ইবনুল জাওযী, আল-মাউদূআত, ২/৫২; সুয়ূতী, আল-লাআলী, ২/৫৯।
[19] মোল্লা ‘আলী ক্বারী, আল-আসরার, পৃ- ৩৩০-৩৩১; ইবনুল কাইয়িম, আল-মানার আল-মুনীফ, পৃ- ৮৯-৯৯।
[20] মোল্লা আলী ক্বারী, আল মাসনূ’, পৃষ্ঠা- ২০৮-২০৯।
[21] আজলুনী, কাশফুল খাফা, ২/৫৫৪-৫৫৫।
[22] শাওকানী, আল-ফাওয়ায়িদ ১/৭৬।