নূরে মুহাম্মাদী বিষয়ে আরো অনেক জাল ও সনদবিহীন কথা ইবনু আরাবীর পুস্তকাদি, সীরাহ হালাবিয়া, শারহুল মাওয়াহিব ও মীলাদুন্নবী বিষয়ক পুস্তকাদিতে বিদ্যমান। এসকল পুস্তকের উপর নির্ভর করে আমাদের দেশে ‘সাইয়েদুল মুরসালীন’ ও অন্যান্য সীরাতুন্নবী বিষয়ক পুস্তকে এগুলো উল্লেখ করা হয়েছে। এগুলোর বিস্তারিত আলোচনা করা সম্ভব হচ্ছে না। সংক্ষেপে আমরা বলতে পারি যে, ‘রাসূলুল্লাহ (ﷺ) নূর দ্বারা সৃষ্ট’ এ অর্থে বর্ণিত ও প্রচলিত সকল হাদীসই বানোয়াট। এর বড় প্রমাণ যে, ইসলামের ইতিহাসের প্রথম ৫০০ বৎসরে সংকলিত কোনো হাদীস, তাফসীর, সীরাত বা ফিকহের গ্রন্থে এ বিষয়ক একটি সহীহ বা যায়ীফ হাদীসও সনদ-সহ পাওয়া যায় না।
তাফসীর গ্রন্থগুলোতে বিভিন্ন আয়াতের ব্যাখ্যায় অনেক সহীহ, যয়ীফ ও জাল হাদীস আলোচনা করা হয়েছে। আমরা দেখেছি যে, ইমাম তাবারী সূরা মায়িদার ১৫ আয়াতের ব্যাখ্যায় নূর বলতে মুহাম্মাদ (ﷺ)-কে বুঝিয়েছেন। কিন্তু তিনি বা অন্য কোনো প্রাচীন মুফাস্সির রাসূলুল্লাহ (ﷺ) নূর থেকে সৃষ্ট বিষয়ক কোনো হাদীস এখানে উল্লেখ করেন নি। ইতিহাস ও সীরাত বিষয়ক বইগুলোতে অগণিত যয়ীফ ও ভিত্তিহীন রেওয়ায়াতের ভিত্তিতে অনেক অধ্যায় ও অনুচ্ছেদ রচনা করা হয়েছে। কিন্তু ইসলামের প্রথম ৫০০ বছরে লেখা কোনো একটি ইতিহাস বা সীরাত গ্রন্থে ‘নূর মুহাম্মাদী’ বিষয়টি কোনোভাবে আলোচনা করা হয় নি।
এখানে তিনটি বিষয় রয়েছে: (১) ‘রাসূলুল্লাহ নূর প্রদানকারী প্রদীপ হিসেবে প্রেরিত’-এটি কুরআন দ্বারা প্রমাণিত (২) ‘রাসূলুল্লাহ (ﷺ) নূর’- এ কথা কোনো কোনো মুফাস্সির বলেছেন। (৩) ‘রাসূলুল্লাহ ﷺ-নূর দ্বারা সৃষ্ট’- এ কথা একেবারেই ভিত্তিহীন। নিম্নের বিষয়গুলি লক্ষ্য করুন:
(ক) কুরআন-হাদীসের নির্দেশনাকে নিজের পছন্দ অপছন্দের ঊর্ধ্বে সর্বান্তকরণে গ্রহণ করার নামই ইসলাম। সুপথপ্রাপ্ত মুসলিমের দায়িত্ব হলো, ওহীর মাধ্যমে যা জানা যাবে তা সর্বান্তকরণে পরিপূর্ণভাবে গ্রহণ করা এবং নিজের পছন্দ ও মতামতকে ওহীর অনুগত করা। পক্ষান্তরে বিভ্রান্তদের চিহ্ন হলো, নিজের পছন্দ-অপছন্দ অনুসারে ওহীকে গ্রহণ করা বা বাদ দেয়া।
(খ) কুরআন ও হাদীসে বারংবার স্পষ্টভাবে রাসূলুল্লাহ ﷺ-কে মানুষ বলে ঘোষণা করা হয়েছে। কুরআনে আরো বলা হয়েছে যে, তাঁকে আল্লাহ ‘নূর প্রদানকারী প্রদীপ’ রূপে প্রেরণ করেছেন। কুরআনের সুস্পষ্ট বক্তব্য সুস্পষ্টভাবে বিশ্বাস করা মুমিনের দায়িত্ব। এজন্য আমাদের বিশ্বাস করতে হবে যে, তিনি মানুষ এবং তিনি নূর প্রদানকারী প্রদীপ হিসেবে প্রেরিত।
(গ) কুরআন বা হাদীসে এক স্থানেও বলা হয় নি যে, আপনি বলুন ‘আমি নূর’ বা ‘মুহাম্মাদ নূর’। কুরআনের একটি আয়াতের ব্যাখ্যায় কোনো কোনো মুফাস্সির বলেছেন যে, সেখানে ‘নূর’ বলতে রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-কে বুঝানো হয়েছে। এ ব্যাখ্যাও রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বা কোনো সাহাবী থেকে প্রমাণিত নয়, বরং পরবর্তী কোনো কোনো মুফাস্সির একথা বলেছেন।
(ঘ) আমরা কুরআন-হাদীসের দ্ব্যর্থহীন নির্দেশকে দ্ব্যর্থহীনভাবেই গ্রহণ করব। আর মুফাস্সিরদের কথাকে তার স্থানেই রাখব। আমরা বলতে পারি: কুরআন ও হাদীসের নির্দেশ অনুসারে নিঃসন্দেহে রাসূলুল্লাহ ﷺ মানুষ। উক্ত আয়াতের ব্যাখ্যায় নূর বলতে আমরা ‘কুরআন’-কে বুঝাবো। কারণ কুরআনে সুস্পষ্টত ‘কুরআন’কে নূর বলা হয়েছে, কিন্তু কোথাও রাসূলুল্লাহ ﷺ-কে সুস্পষ্টত নূর বলা হয় নি; কাজেই তাঁর বিষয়ে একথা বলা থেকে বিরত থাকাই শ্রেয়। অথবা আমরা বলতে পারি: কুরআন-হাদীসের নির্দেশ অনুসারে নিঃসন্দেহে রাসূলুল্লাহ ﷺ মানুষ। তবে উক্ত আয়াতের ব্যাখ্যায় মানব জাতির হেদায়াতের আলোক-বর্তিকা হিসেবে তাঁকে নূর বলা যেতে পারে।
(ঙ) কিন্তু যদি কেউ বলেন যে, তিনি ‘হাকীকতে’ বা প্রকৃত অর্থে নূর ছিলেন, মানুষ ছিলেন না, শুধু মাজাযী বা রূপক অর্থেই তাঁকে মানুষ বলা যেতে পারে, তবে আমরা বুঝতে পারি যে, তিনি নিজের মন-মর্জি অনুসারে কুরআন ও হাদীসের সুস্পষ্ট দ্ব্যর্থহীন নির্দেশনা বাতিল করে এমন একটি মত গ্রহণ করলেন, যার পক্ষে কুরআন ও হাদীসের একটিও দ্ব্যর্থহীন বাণী নেই।
(চ) নূর মুহাম্মাদী বিষয়ক এ সকল হাদীসে বারংবারই বলা হয়েছে ইহূদী, খৃস্টান, কাফির, মুশরিক, মুমিন, মুসলিম ভাল-মন্দ সকল শ্রেণীর মানুষ, জিন, ফিরিশতা ও মহাবিশ্ব মুহাম্মাদ ﷺ-এর নূর দ্বারা সৃষ্ট, অর্থাৎ সকলেই আল্লাহর নূর থেকে সৃষ্ট! এভাবে আমরা তাঁর মর্যাদা কতটুকু বাড়াচ্ছি?
সম্মানিত পাঠক, একজন নেককার মানুষ আমাকে প্রশ্ন করেন: রাসূলুল্লাহ ﷺ নূরের তৈরি হলে আপনাদের সমস্যা কী? কেনই বা আপনারা এ বিষয়ক হাদীসগুলোকে জাল প্রমাণ করতে এত সচেষ্ট?
পাঠক, আমার মনেও একই প্রশ্ন: ‘রাসূলুল্লাহ ﷺ নূরের তৈরি’- একথা বললে আল্লাহর কী সমস্যা হতো? কুরআন ও হাদীসে ফিরিশতা, জিন ও মানুষের নূর, আগুন ও মাটি দিয়ে তৈরির কথা কতবার বলা হলো! কিন্তু একটিবারও মুহাম্মাদ ﷺ-এর নূর দ্বারা সৃষ্টির কথা বলা হলো না কেন? কেনই বা আল্লাহ এবং তাঁর রাসূল বারংবার তাঁকে মানুষ বলে প্রমাণ করতে সচেষ্ট হলেন?
সম্মানিত পাঠক, প্রকৃত বিষয় তো আল্লাহই জানেন। তবে বাহ্যত এর দুটি কারণ: (১) সুন্নাতে নববীর প্রতিষ্ঠা এবং (২) শিরকের পথ রুদ্ধ করা।
(ক) ধর্মীয় ‘মহাপুরুষ’ বা ধর্মপ্রবর্তকের বিষয়ে অন্যান্য ধর্মাবলম্বীদের সাথে মুসলিমদের একটি মৌলিক পার্থক্য রয়েছে। হিন্দুগণ শ্রীকৃষ্ণকে ঈশ্বরের অবতার ও মুক্তির দূত বলে বিশ্বাস করেন; কিন্তু কখনোই কর্মে-আচরণে তাঁর অনুকরণ-অনুসরণের কথা ভাবেন না। খৃস্টানগণ ঈসা (আঃ)-কে তাঁদের শাফাআতকারী-ত্রাণকর্তা (savior) ও মধ্যস্থ-ওসীলা (mediator) হিসেবে বিশ্বাস করেন; কিন্তু কখনোই তাঁর অনুকরণ-অনুসরণের কথা চিন্তা করেন না। কারণ তাঁরা বিশ্বাস করেন যে, এ সকল ‘মহাপুরুষ’ অলৌকিক সত্ত্বা ছিলেন; অন্যদের মত মানুষ ছিলেন না। কাজেই তাঁরা অনেক কিছুই করতে পারেন যা সাধারণ মানুষের জন্য সম্ভব বা সঠিক নয়। এজন্য আল্লাহর করুণা ও জান্নাত লাভের জন্য তাঁদের ভক্তি করতে হবে এবং নির্দেশ পালন করতে হবে; তাঁদের পরিপূর্ণ অনুকরণ সম্ভব নয় বা প্রয়োজন নেই। পক্ষান্তরে মুসলিমগণ বিশ্বাস করেন যে, মহান আল্লাহর রহমত, মাগফিরাত ও প্রেম লাভের রাসূলুল্লাহ ﷺ-এর ভক্তি ও ভালবাসার পাশাপাশি তাঁর পরিপূর্ণ ‘ইত্তিবা’ বা অনুকরণ-অনুসরণ করতে হবে।
বস্ত্তত কোনো ‘উসওয়া হাসানা’ বা ‘অনুকরণীয় মডেল’ ছাড়া মানুষ বাস্তব জীবনে কোনো আদর্শ বাস্তবায়ন করতে পারে না। ইসলামী বিশ্বাসে মুহাম্মাদ ﷺ-ই এরূপ অনুপম আদর্শ। মুহাম্মাদ ﷺ পাথর বা অস্ত্রের আঘাতে জর্জরিত হয়েও শত্রুকে ক্ষমা করেছেন, রাতের গভীরে সালাত আদায় করতে করতে পবিত্র পদযুগল ফুলে গিয়েছে, তাঁর পবিত্র চোখের পানিতে সাজদার স্থান আদ্র হয়েছে, প্রচন্ড ক্ষুধায় পেটে পাথর বেঁধেছেন; কিন্তু অন্যায়, দুর্নীতি বা পরমুখাপেক্ষিতার প্রশ্রয় দেন নি; সকল অত্যাচার সহ্য করেও তাওহীদের ক্ষেত্রে আপোষহীন থেকেছেন, কোনোদিন কোনো খাদিম, স্ত্রী বা অন্য কাউকে গালি দেন নি বা ঝগড়া করেন নি। মুমিন যখন চিন্তা করেন যে, মুহাম্মাদ ﷺ আমাদের মত মাটির মানুষ হয়ে যদি এরূপ করতে পারেন তবে আমি কেন পারব না? তখন তাঁর জন্য এ মহান আদর্শ পালন সহজ হয়ে যায়।
কিন্তু যখন মুমিন বিশ্বাস করবেন যে, তিনি আমাদের মত মাটির মানুষ নন; বরং আল্লাহর সত্ত্বা থেকে সৃষ্ট অলৌকিক সত্ত্বা, তিনি তো অনেক কিছুই করতে পারেন! তখন তিনি শুধু ভক্তিই করতে পারেন; কিন্তু অনুকরণের প্রেরণা লাভ করতে পারেন না। তখন তাঁকে অনুকরণের জন্য মডেল হিসেবে অন্য কোনো ‘গুরু’, ‘পুরোহিত’ বা ‘মডেল’ খুঁজতে হয়।
(খ) ধর্মের মধ্যে শিরকের প্রবেশের কারণ ‘নবী-ওলীগণের’ বিষয়ে অতিভক্তি, তাঁদেরকে আল্লাহর সত্ত্বার অংশ বা অবতার (God incarnate) আল্লাহর যাত বা সিফাতের (সত্ত্বা বা বিশেষণের) মুজাস্সাম বা দেহরূপ (in flesh) বলে বিশ্বাস করা। তাওহীদী দীনকে এভাবে শিরকে রূপান্তরিত করার অন্যতম উদাহরণ খৃস্টধর্ম। প্রচলিত বাইবেলেও ঈসা (আঃ) বারংবার বলছেন যে, আমি মানুষ, আমাকে ভাল বলবে না, আমি গাইব জানি না, আল্লাহই ভাল, তিনিই সব জানেন, একমাত্র তাঁরই ইবাদত কর...। তবে তিনি আল্লাহকে পিতা বলেছেন। হিব্রু ভাষায় সকল মানুষকে, বিশেষত নেককার মানুষকে ‘ইবনুল্লাহ’ বা ‘আল্লাহর পুত্র’ বলা হয়। তিনি বলেছেন: ‘যে আমাকে দেখল সে আল্লাহকে দেখল’, যে আমাকে মানল সে আল্লাহকে মানল’। এরূপ কথা সকল নবীই বলেন। কিন্তু সাধু পল অতিভক্তিকে পুঁজি করে খৃস্টধর্মকে বিকৃত করেন। ক্রমান্বয়ে খৃস্টানগণ দাবি করেন ঈসা (আঃ) আল্লাহর ‘যাতের অংশ’ (same substance) এবং তাঁর ‘কালিমা’ বিশেষণের মুজাস্সাম বা দেহধারী রূপ (the Word was made flesh)। তিনি নূর থেকে আগত নূর। এর বিপরীত কিছু বলাকে তাঁরা ঈসা মাসীহের সাথে বেয়াদবি ও দুশমনি বলে গণ্য করলেন।
এ বিষয়ে বিস্তারিত জানতে আমার লেখা ‘কিতাবুল মোকাদ্দস, ইঞ্জিল শরীফ ও ঈসায়ী ধর্ম’’ পুস্তিকাটি পাঠ করুন। এখানে খৃস্টধর্মের বিশ্বাসের সাক্ষ্য বা নাইসীন ক্রীড (Nicene creed) থেকে কিছু উদ্ধৃতি প্রদান করছি:
We believe in one God, .. and in one Lord Jesus Christ, the Son of God ... of the substance of the Father... light of light ... was incarnate, .. But the holy catholic and apostolic Church of God anathematizes those .. who say, that the Son of God was of any other substance or essence...
‘‘আমরা বিশ্বাস করি এক ঈশ্বরে... এবং একজন প্রভু যীশু খৃস্টে, ঈশ্বরের পুত্র,& ... পিতারই যাত (সত্তা) থেকে.. নূর থেকে নূর ..মুজাস্সাম হন (দেহ ধারণ করেন)... কিন্তু পবিত্র মহাসম্মেলন... অভিশাপ দিচ্ছে তাদেরকে ...যারা বলে যে ঈশ্বরের পুত্র ঈশ্বরের যাত (সত্তা) ছাড়া অন্য কোনো বস্ত্ত বা সারবস্ত্তর...।’’ পাঠক, প্রয়োজনে (the creed) লিখে ইন্টারনেটে সার্চ করুন।
শেষ দীন ও বিশ্বধর্ম হিসেবে ইসলামের সংরক্ষণের জন্য মহান আল্লাহ এ অতিভক্তির পথ রুদ্ধ করেছেন। আর এজন্যই মুহাম্মাদ ﷺ-এর বাশারিয়্যাত বা মানুষ হওয়ার বিষয়টি এত গুরুত্ব সহকারে বর্ণনা করা হয়েছে। উপরন্তু ঈমানের সাক্ষ্যে ‘আবদুহূ ওয়া রাসূলুহু’ বলে তাঁর বান্দা ও মানুষ হওয়ার বিষয়টি রিসালাতের ঈমানের অবিচ্ছেদ্য অংশ বানানো হয়েছে।