২০০৫ খৃস্টাব্দে (الجزء المفقود من الجزء الأول من المصنف): ‘মুসান্নাফ আব্দুর রায্যাকের প্রথম খন্ডের হারানো অংশ’’ নামে একটি বই প্রকাশিত হয়। ‘ঈসা ইবন আব্দুল্লাহ ইবন মুহাম্মাদ ইবন মানি হিমইয়ারী’ নামক সংযুক্ত আরব আমিরাতের একজন আলিম গ্রন্থটি সম্পাদনা করে প্রকাশ করেছেন। প্রসিদ্ধ মুহাদ্দিস ড. মাহমূদ সায়ীদ মামদূহ পুস্তকটির প্রশংসাপত্র লিখেন।
ভূমিকায় শাইখ হিমইয়ারীর বক্তব্য থেকে জানা যায় যে, নূর মুহাম্মাদীই যে প্রথম সৃষ্টি তা তিনি গভীরভাবে বিশ্বাস করেন। কিন্তু এ বিষয়ক হাদীসটির মুসান্নফ আব্দুর রায্যাক গ্রন্থে বিদ্যমান না থাকায় এটি প্রমাণের জন্য তিনি অত্যন্ত অস্থিরচিত্ত ছিলেন। তিনি তুরস্ক, ইয়ামান ও বিশ্বের অন্যান্য দেশের গ্রন্থাগারগুলিতে এ গ্রন্থের পান্ডুলিপিগুলো অনুসন্ধান করে কোথাও কোনো পান্ডুলিপিতে এ হাদীসটি পান নি। হঠাৎ করেই ড. সাইয়িদ মুহাম্মাদ আমীন কাদিরী বারাকাতী নামক একজন ভারতীয় রেজবী সূফী শাইখ তাকে মুসান্নাফ গ্রন্থে প্রথম দুটি খন্ডের একটি পান্ডুলিপি প্রদান করেন যার মধ্যে এ হাদীসটি বিদ্যমান। বিশ্বের কোথাও এ পান্ডুলিপির দ্বিতীয় কোনো কপি পাওয়া যায় না। এতে লেখা আছে ৯৩৮ হিজরীতে বাগদাদ নগরীতে ইসহাক ইবনু আব্দুর রাহমান সুলাইমানী এ পান্ডুলিপিটি লিখেন। তিনি কোন্ পান্ডুলিপি দেখে এটি লিখেছেন, এর সনদ কী ইত্যাদি বিষয় তাতে লেখা নেই। হিমইয়ারী দাবি করেন যে, এ পান্ডুলিপিটি দশম হিজরী শতকেই লেখা এবং এর বয়স প্রায় ৫০০ বৎসর।
এ পান্ডুলিপিটিতে মুসান্নাফ আব্দুর রায্যাকের শুরুতে দশটি পরিচ্ছেদ বিদ্যমান যে অধ্যায়গুলি বিশ্বের অন্য কোনো পান্ডুলিপিতে নেই। প্রথম পরিচ্ছেদটির নাম (ﷺباب في تخليق نور محمد) ‘নূর মুহাম্মাদী সৃষ্টির অধ্যায়’। পরবর্তী পরিচ্ছেদগুলো ওযূ অধ্যায়ের। মুদ্রিত গ্রন্থটির প্রথম অধ্যায়ের নাম ‘কিতাবুল ঈমান’: ঈমান অধ্যায়। এ অধ্যায়ে উপরের একটিই মাত্র পরিচ্ছেদ রয়েছে। এ পরিচ্ছেদে উপরের হাদীসটির সনদ নিম্নরূপ:
عبد الرزاق عن معمر عن ابن المنكدر عن جابر قال:
আব্দুর রায্যাক মা’মার থেকে, তিনি ইবনুল মুনকাদির থেকে, তিনি জাবির থেকে, তিনি বলেন আমি রাসূলুল্লাহ ﷺ কে জিজ্ঞাসা করলাম....।
প্রসিদ্ধ মুহাদ্দিসগণ পান্ডুলিপি এবং এতে বিদ্যমান হাদীসগুলোর সনদ ও মতন বিচার করে সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণ করেছেন যে, পান্ডুলিপিটি পুরোটাই জাল। আমাদের এ গ্রন্থের পরিসরে বিস্তারিত আলোচনা সম্ভব নয়। আমরা সংক্ষেপে নিম্নের বিষয়গুলোর দিকে পাঠকের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি:
(১) তুর্কি সুলতানগণ বিগত কয়েকশত বৎসর যাবৎ বিশ্বের সকল দুষ্প্রাপ্য পান্ডুলিপি সংগ্রহ করেছেন, যেগুলি তুরস্কের বিভিন্ন লাইব্রেরিতে বিদ্যমান। খোদাবখশ লাইব্রেরী-সহ ভারতেও অনেক প্রসিদ্ধ গ্রন্থাগারে মুসলিম বিশ্বের প্রাচীন ও দুষ্প্রাপ্য পান্ডুলিপিগুলি সংরক্ষিত। উপনিবেশ সময়ে ইংল্যান্ড, ফ্রান্স ইত্যাদি দেশের পন্ডিতগণ মুসলিম দেশগুলো থেকে সকল পান্ডুলিপি সংগ্রহ করে নিজেদের দেশের যাদুঘর ও পাঠাগারে সংরক্ষণ করেছেন। বিশ্বের কোনো যাদুঘরে বা লাইব্রেরিতে নেই এমন একটি পান্ডুলিপি আল্লামা রেজা খান ব্রেলবীর ভক্ত কোনো পীর সাহেবের বাড়িতে পাওয়া যাবে! বিশেষত আল্লামা আহমাদ রেযা খান ব্রেলবী (১২৭২-১৩৪০ হি/ ১৮৫৬-১৯২১খৃ) গবেষণা অধ্যয়নকে ওহাবীদের পরিচয় বলে গণ্য করতেন। তিনি বলেন:
أهل سنة بحر قوالي وعرس : ديوبندي بحر تصنيفات ودرس
خرج سني بر قبور وخانقاه : خرج نجدي بر علوم ودرس كاه
‘‘আহল সুন্নাত কাওয়ালী ও উরশের সাগর; দেওবন্দি (ওহাবী) গ্রন্থরচনা ও পাঠদানের সমূদ্র । সুন্নীর খরচ কবর ও খানকার জন্য। নজদীর (ওহাবীর) খরচ ইলম ও মাদরাসার জন্য।’’[1]
এমন একজন পীর সাহেব ৫০০ বৎসর যাবৎ একটি পান্ডুলিপি সংরক্ষণ করলেন, বিশ্বের বিশেষজ্ঞ আলিমদেরকে দিয়ে এর বিশুদ্ধতা প্রমাণ না করে তিনি ‘নূর মুহাম্মাদী’ প্রমাণের জন্য ‘পাগলপারা’ শাইখ হিমইয়ারীকেই তা প্রদান করলেন! তিনিও তা কাউকে দেখতে দিচ্ছেন না!
(২) পান্ডুলিপিটি ৯৩৩ হিজরী সালে লেখা বলে দাবি করা হয়েছে। কিন্তু লিপিকার কার কাছ থেকে শুনে বা কোন্ পান্ডুলিপি দেখে লিখেছেন তা বলেন নি। আবার ৯৩৩ সাল থেকে ১৪২৫ সাল পর্যন্ত ৫০০ বৎসর পান্ডুলিপিটি কোথায় ছিল তারও কোনো বিবরণ এতে নেই। ইসলামী পান্ডুলিপি সম্পর্কে অভিজ্ঞ সকলেই জানেন যে, এটি পান্ডুলিপির জালিয়াতি প্রমাণ করে।
(৩) পান্ডুলিপির যে পৃষ্ঠাগুলি বইটিতে ছাপা হয়েছে সেগুলি প্রমাণ করে যে, এটি আধুনিকযুগের ভারতীয় লিখন পদ্ধতিতে লেখা।
(৪) এ বইটিতে দাবি করা হয়েছে যে, মুসান্নাফ আব্দুর রায্যাক গ্রন্থের প্রথম অধ্যায় ‘কিতাবুল ঈমান’ বা ‘ঈমান অধ্যায়’। অথচ প্রাচীনকাল থেকে মুহাদ্দিসগণ মুসান্নাফ আব্দুর রায্যাকের অধ্যায়গুলির বর্ণনায় ‘কিতাবুল ঈমান’-এর কথা উল্লেখ করেন নি; বরং কিতাবুত তাহারাহ বা পবিত্রতার অধ্যায় দিয়ে এ পুস্তকের শুরু বলে উল্লেখ করেছেন।[2]
(৫) বিশ্বে কোনো মুসান্নাফ গ্রন্থ কিতাবুল ঈমান দিয়ে শুরু করা হয় নি। ইমাম আব্দুর রায্যাক (২১১ হি)-এর পরে আব্দুল্লাহ ইবন মুহাম্মাদ ইবন ইবরাহীম ইবন উসমান আবু বাকর ইবন আবী শাইবা (২৩৫ হি) তাঁর প্রসিদ্ধ ‘মুসান্নাফ’ গ্রন্থ রচনা করেন। এটিও ‘কিতাবুত তাহারাত’ দিয়ে শুরু। উল্লেখ্য যে, অধ্যায়, পরিচ্ছেদ ও হাদীসের বিন্যাসে উভয় মুসান্নাফ প্রায় একইরূপ।
(৬) এ জাল পুস্তকটির দাবি অনুসারে ইমাম আব্দুর রায্যাক তাঁর মুসান্নাফ গ্রন্থের প্রথম অধ্যায় ‘কিতাবুল ঈমানে’ একটিই মাত্র পরিচ্ছেদ সংকলন করেন! হাদীসের গ্রন্থগুলো সম্পর্কে সামান্যতম জ্ঞান থাকলেও কি একথা কল্পনা করা যায়? বিশ্বের শতশত হাদীসগ্রন্থের মধ্যে একটি গ্রন্থও কি পাওয়া যায় যার ‘কিতাবুল ঈমান’-এর মধ্যে একটিই মাত্র পরিচ্ছেদ বিদ্যমান?!
(৭) পান্ডুলিপিটি যিনি রচনা করেছেন তিনি হাদীস সম্পর্কে অভিজ্ঞ, তবে ভাল অভিজ্ঞ নন। বইটির দ্বিতীয় হাদীসের সনদ নিম্নরূপ:
عبد الرزاق عن ابن جريج قال: أخبرني البراء قال:
‘‘আব্দুর রায্যাক: ইবন জুরাইজ থেকে, ইবনু জুরাইজ বলেন: আমাকে বারা (রা) বলেন...’’।[3] জুরাইজ (১৫০ হি) একজন তাবি-তাবিয়ী। বারা ইবন আযিব (৭১ হি) বা কোনো সাহাবীকে তিনি দেখেনও নি। কোনো তাবি-তাবিয়ী যদি বলেন: ‘‘অমুক সাহাবী থেকে’’ তবে তা ‘মুনকাতি’ বলে গণ্য। আর যদি কোনো তাবি তাবিয়ী বলেন যে, অমুক সাহাবী তাকে বলেছেন, তবে তিনি মিথ্যাবাদী বলে গণ্য হন। ইবন জুরাইজ কখনোই মিথ্যাবাদী ছিলেন না; তবে এ পান্ডুলিপিটির লেখক জ্ঞানের স্বল্পতা বা জালিয়াতির ব্যবস্তায় এরূপ ভয়ঙ্কর মিথ্যা লিখেছেন। এরূপ আরেকটি মহামিথ্যা বইটির ২৪ নং হাদীসের সনদ:
عبد الرزاق عن ابن جريج عن الزهري أنه سمع عقبة بن عامر...
‘‘আব্দুর রায্যাক, ইবন জুরাইজ থেকে, তিনি যুহরী থেকে, তিনি উকবা ইবন আমির (রা) কে বলতে শুনেছেন...।’’[4]
উকবা ইবন আমির (রা) ৪৪ হিজরীতে মিসরের গভর্নর নিযুক্ত হন এবং ৬০ হিজরীতে ইন্তেকাল করেন। ইমাম যুহরী ৫০ বা ৫৮ হিজরী সালে মদীনায় জন্মগ্রহণ করেন। যুহরী কখনো উকবা থেকে হাদীস শুনেন নি। পান্ডুলিপিটির লেখক অজ্ঞতা বশত এরূপ লিখেছেন।
[2] মুহাম্মাদ ইবন খাইর ইশবিলী (৫৭৫ হি); ফিহরিসত (বৈরুত, দারুল কুতুব, ১৯৯৮), পৃ১০৮।
[3] হিমইয়ারী, আল-জুযউল মাফকূদ, পৃষ্ঠা ৫৫।
[4] হিমইয়ারী, আল-জুযউল মাফকূদ, পৃষ্ঠা ৮৪।
আলোচ্য ‘হারানো’ পুস্তকটির ৩-৪ পৃষ্ঠায় মিসরের নাগরিক ও আরব আমিরাতে অবস্থানকারী প্রসিদ্ধ মুহাদ্দিস ড. মাহমূদ সায়ীদ মামদূহ-এর একটি প্রশংসাপত্র বিদ্যমান। বস্ত্তত পুস্তকটির সম্পাদক শাইখ হিমইয়ারী তাঁর পান্ডুলিপি মাত্র দুজন আলিমকে দেখতে দেন: শাইখ আদীব কামাদানী ও ড. মাহমূদ সায়ীদ। শাইখ কামাদানী সিরিয়ার একজন মুহাদ্দিস ও পান্ডুলিপি বিশেষজ্ঞ। সংযুক্ত আরব আমিরাতের দুবাই প্রদেশের ওয়াকফ মন্ত্রণালয়ে গবেষক হিসেবে তিনি কর্মরত ছিলেন। এ সময়ে শাইখ হিমইয়ারীও একই মন্ত্রণালয়ে কর্মরত ছিলেন ও উভয়ে বন্ধু ছিলেন। তিনি বলেন, শাইখ হিমইয়ারী মুসান্নাফ আব্দুর রায্যাকের কোনো পান্ডুলিপি থেকে নূর মুহাম্মাদী বিষয়টি প্রমাণ করতে অত্যন্ত অস্থির ছিলেন এবং সবাইকে বিষয়টি বলতেন। তাঁর এ অস্থিরতা দেখে ভারতের একজন ব্রেলবী পীর এ পান্ডুলিপিটি তাকে এনে দেন। পান্ডুলিটি পেয়ে হিমইয়ারী আনন্দ প্রকাশ করতে বিশাল মেজবানির আয়োজন করেন।
হিমইয়ারী কামাদানী ও মাহমূদ সায়ীদকে পান্ডুলিপিটি দেখতে দেন। কামাদানী পান্ডুলিপির কাগজ, কালি ও লিখনপদ্ধতি দেখে প্রথম দৃষ্টিতেই এটিকে জাল বলেন। তিনি বলেন: পান্ডলিপিটির বয়স দুবছরের বেশি কখনোই হতে পারে না। কিন্তু হিমইয়ারী এটিকে জাল বলে মানতে কিছুতেই রাজি হন না। কামাদানী তাকে বলেন: আপনি দুবাইয়ের পান্ডুলিপি বিষয়ক গবেষণা প্রতিষ্ঠান জুমুআতুল মাজিদ কেন্দ্রে প্রেরণ করে এর বয়স, কাগজ, কালি ও লিখনির বিষয় যাচাই করুন এবং পান্ডুলিপির সংগ্রাহক কোথা থেকে তা অনুলিপি করেছে তা জানুন। হিমইয়ারী বলেন: পান্ডুলিপিটির সংগ্রাহক বলেছেন সোভিয়েট ইউনিয়নের একটি লাইব্রেরি থেকে তারা পান্ডুলিপিটির অনুলিপি করে এনেছেন, তবে মূল পান্ডুলিপিটি যুদ্ধে নষ্ট হয়ে গিয়েছে! মুসান্নাফ-এর অবশিষ্ট অংশের পান্ডুলিপি দেখাতে বললে তারা অপারগতা প্রকাশ করেন![1]
দ্বিতীয় ব্যক্তি ড. মাহমূদ সায়ীদ মুহাম্মাদ মামদূহ প্রসিদ্ধ মুহাদ্দিস ও হাদীস গবেষক। তিনি পান্ডুলিপিটির সম্পাদক শাইখ হিমইয়ারীর মত সূফী আকীদার অনুসারী এবং সালাফীগণের বিরোধী। শাইখ আলবানী ও সালাফীগণের বিরুদ্ধে তাঁর অবস্থান সুপরিচিত। আমরা দেখেছি তিনি এ ‘হারানো’ পুস্তকের প্রশংসাপত্র লিখেন। কিন্তু দু বছর পরে ২০০৭ সালে তিনি তাঁর প্রশংসাপত্র প্রত্যাহার করে এবং বইটির অনির্ভরযোগ্যতা বর্ণনা করে একটি প্রবন্ধ প্রকাশ করেন। প্রবন্ধটির নাম (بيان من الشيخ محمود سعيد حول ما طبع باسم الجزء المفقود من مصنف عبد الرزاق) ‘মুসান্নাফ আব্দুর রায্যাকের হারানো অংশ নামে যা ছাপা হয়েছে তার বিষয়ে শাইখ মাহমূদ সায়ীদের বক্তব্য’।
এ প্রবন্ধে তিনি উল্লেখ করেছেন যে, আকীদা ও আমলে তিনি শাইখ হিমইয়ারীকে অত্যন্ত শ্রদ্ধা করেন ও ভালবাসেন। হিমইয়ারী তাঁকে যখন এ পান্ডুলিপিটি দেখান তখন তিনি দুটি কারণে এর বিশুদ্ধতার বিষয়ে সন্দেহ পোষণ করেন: (১) পান্ডুলিপিটির কাগজ এবং কালি নতুন এবং (২) পান্ডুলিপির উপর এর সনদ, শ্রবণ, মালিকানা ইত্যাদির তথ্য লেখা নেই। দুবাইয়ের জুমুআতুল মাজিদ কেন্দ্রে পান্ডুলিপিটি পাঠালে তারা বলে যে, পান্ডুলিপিটির বয়স সর্বোচ্চ ৫০ বা ৬০ বৎসর। হিমইয়ারী এ পুস্তকটি প্রকাশের সিদ্ধান্ত নেন এবং তাঁকে একটি প্রশংসাপত্র লিখে দিতে অনুরোধ করেন। তিনি পান্ডুলিপিটি পুরো না পড়ে, শুধু তার ভূমিকার উপর নির্ভর করে একটি প্রশংসাপত্র লিখেন। পরবর্তীতে বিভিন্ন তথ্য-উপাত্তের মাধ্যমে তিনি নিশ্চিত হয়েছেন যে, পান্ডুলিপিটি অনির্ভরযোগ্য। মুমিনের জন্য ভুলের পক্ষে হুজ্জতি না করে ভুল স্বীকার করে সত্যগ্রহণ উত্তম। এজন্য তিনি ‘মুসান্নাফ আব্দুর রায্যাক-এর প্রথম খন্ডের হারানো অংশ’ নামের পুস্তকটিতে তাঁর লেখা প্রশংসাপত্র প্রত্যাহার করলেন। এর সাথে তাঁর কোনো সম্পর্ক নেই।
তিনি আরো বলেন যে, আলোচিত পুস্তকের বাতিলকৃত প্রশংসাপত্রে তিনি ‘নূর মুহাম্মাদী’ বিষয়ক হাদীসটির প্রসঙ্গ মোটেও উল্লেখ করেন নি। কারণ তাঁর উস্তাদ আহমাদ গুমারী, আব্দুল্লাহ গুমারী ও অন্যান্য প্রসিদ্ধ মুহাদ্দিস এ হাদীসটি জাল বলে নিশ্চিত করেছেন। একটি বইয়ের প্রশংসাপত্র লেখার জন্য বইটির মধ্যে বিদ্যমান সকল হাদীস বা জাল হাদীসের বিষয় ব্যাখ্যা করা প্রয়োজনীয় বলে তিনি মনে করেন নি। এজন্যই তিনি উক্ত প্রশংসাপত্রে হাদীসটির জালিয়াতির প্রসঙ্গ আলোচনা করেন নি।
বিস্তারিত আলোচনার পর তিনি লিখেন: ‘‘মোট কথা ‘মুসান্নাফ আব্দুর রাযযাকের প্রথম খন্ডের হারানো অংশ’ নামে প্রকাশিত বইটি একেবারেই অনির্ভরযোগ্য। এ বইটির রেফারেন্স দেওয়া বা অনুবাদ করা যাবে না।’’[2]
[2] ড. মাহমূদ সায়ীদ, আল-ইত্তিজাহাতল হাদীসিয়্যাহ ফিল কারনির রাবিয় আশারা (কাইরো, দারুল বাসায়ির, ১৪৩০/২০০৯), পৃষ্ঠা ৭২৭-১৩০।
সম্মানিত পাঠক, যদি ‘মুসান্নাফ আব্দুর রায্যাক-এর প্রথম খন্ডের হারানো অংশ’ নামক পুস্তকটি সঠিক প্রমাণ হয় তবে ইমাম আহমাদ ও সিহাহ-সিত্তার সংকলকগণ-সহ ও তৃতীয় শতক থেকে উম্মাতের সকল মুহাদ্দিস, ফকীহ ও বুজুর্গ রাসূলুল্লাহ ﷺ-এর মর্যাদার বিরোধী ও দীনের দুশমন বলে প্রমাণ হবে। কারণ তাঁরা ইমাম আব্দুর রায্যাকের মুসান্নাফের মধ্যে বিদ্যমান এতগুলি সহীহ হাদীসকে জেনে শুনে গোপন করেছেন। হাদীস সংকলন বিষয়ে যাদের সামান্যতম জ্ঞান আছে তারা বিষয়টি সহজেই উপলব্ধি করতে পারবেন।
পূর্বের আলোচনা থেকে আমরা জেনেছি যে, দ্বিতীয় হিজরীর প্রথমার্ধ থেকে মুসলিম বিশ্বের আলিমগণ হাদীসের সন্ধানে প্রতিটি গ্রাম ও শহর পরিভ্রমণ করতে থাকেন। এ সময় থেকে কোনো হাদীসই আর শুধু একটি সনদে বর্ণিত হয় নি। দ্বিতীয় হিজরী শতক থেকে মুহাদ্দিসগণ একটি হাদীস অনেক সনদে বর্ণনা করতেন এবং তাঁদের গ্রন্থগুলোতে সংকলন করতেন। এখন নিম্নের বিষয়গুলি লক্ষ্য করুন:
(১) জাবির ইবন আব্দুল্লাহ (রা) ৭৫ হিজরীতে মৃত্যুবরণ করেন। ফলে অনেক তাবিয়ী তাঁর থেকে হাদীস শিক্ষার সুযোগ পান। তাঁর ছাত্রের সংখ্যা ১৬৫ জনেরও বেশি। অবাক বিষয় যে, এতবড় গুরুত্বপূর্ণ হাদীস তাঁর একজন মাত্র ছাত্র বর্ণনা করবেন, অন্য কেউই করবেন না।
(২) মুহাম্মাদ ইবনুল মুনকাদির (মৃুত্যু ১৩০ হি) দ্বিতীয় হিজরী শতকের প্রথমার্ধের সুপ্রসিদ্ধ তাবিয়ী। সিহাহ সিত্তা ও অন্যান্য গ্রন্থের মধ্যেই তাঁর দেড় শতাধিক ছাত্রের বর্ণনা বিদ্যমান। তাঁদের মধ্যে রয়েছেন ইমাম জাফর সাদিক, ইমাম আবূ হানীফা, ইমাম মালিক, ইমাম আওযায়ী, সুফিয়ান সাওরী, শুবা ইবনুল হাজ্জাজ, ইবনুল মাজিশূন, ইবন জুরাইজ, আমর ইবন দীনার ও অন্যান্য সুপ্রসিদ্ধ ইমাম ও মুহাদ্দিস। হাদীসের গ্রন্থগুলিতে একটি সহীহ হাদীস খুঁজে পাওয়া যায় না যা ইবনুল মুনকাদির থেকে শুধু একজন ছাত্র বর্ণনা করেছেন, অন্য কোনো ছাত্রই বর্ণনা করেন নি। তাহলে এ হাদীসটি মা’মার ইবনু রাশিদ ছাড়া অন্য কেউ বর্ণনা করলেন না কেন? ইবনুল মুনকাদির গোপন করে রেখেছিলেন? না ইমাম আবূ হানীফা, ইমাম মালিক, সুফইয়ান সাওরী ও অন্যান্য ছাত্র হাদীসটি তাঁর মুখ থেকে শোনার পরেও গোপন করেছিলেন?
(৩) মা’মার ইবনু রাশিদ (৯৬-১৫৪ হি) প্রসিদ্ধ তাবি-তাবিয়ী। প্রসিদ্ধ গ্রন্থগুলোতেই তাঁর প্রায় ৭৫ জন ছাত্রের বর্ণিত হাদীস পাওয়া যায়। রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর একটি সহীহ হাদীসও খুঁজে পাওয়া যায় না যা মামার ইবনু রাশিদ থেকে শুধু একজন ছাত্র বর্ণনা করেছেন। তাঁর প্রতিটি হাদীসই একাধিক ছাত্র বর্ণনা করেছেন। তাহলে এ হাদীসটি আব্দুর রায্যাক ছাড়া অন্য কেউ বর্ণনা করলেন না কেন? রাসূলুল্লাহ ﷺ-এর মর্যাদা গোপন করতে?
(৪) ইমাম আব্দুর রায্যাক ইবন হাম্মাম সানআনী (১২৬-২১১ হি) দ্বিতীয়-তৃতীয় হিজরী শতকের অন্যতম শ্রেষ্ঠ মুহাদ্দিস। প্রসিদ্ধ গ্রন্থগুলোতে তাঁর শতাধিক ছাত্রের বর্ণনা বিদ্যমান। একটিও সহীহ মারফূ (নববী) হাদীস পাওয়া যায় না যা আব্দুর রায্যাক থেকে তার একজন মাত্র ছাত্র বর্ণনা করেছেন। তাহলে এ হাদীসটি অন্য কোনো ছাত্র বর্ণনা করলেন না কেন? রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর মর্যাদা গোপন করার উদ্দেশ্যে?
(৫) মুসান্নাফ আব্দুর রায্যাক-এর মধ্যে বিদ্যমান সকল মারফূ (নববী) হাদীস তাঁর সনদে ও অন্যান্য সনদে সিহাহ সিত্তা ও তৃতীয়-চতুর্থ-পঞ্চম হিজরী শতকে সংকলিত হাদীস গ্রন্থগুলিতে সংকলিত। পাঠক, আপনি রাসূলুল্লাহ ﷺ-এর একটি সহীহ বা যয়ীফ হাদীসও দেখাতে পারবেন না যা মুসান্নাফে আব্দুর রায্যাকে সংকলিত কিন্তু বিশ্বের অন্য কোনো হাদীসগ্রন্থে এক বা একাধিক সনদে সংকলিত নয়। এখন প্রশ্ন হলো: ইমাম বুখারী, ইমাম মুসলিম, সিহাহ সিত্তার প্রণেতাগণ ও পরবর্তী যুগগুলোর মুহাদ্দিসগণ ইমাম আব্দুর রায্যাক-এর মুসান্নাফ গ্রন্থের সকল মারফূ বা নববী হাদীস গ্রহণ ও সংকলন করলেন, কিন্তু এ গ্রন্থে বিদ্যমান নূর মুহাম্মাদী বিষয়ক ‘সহীহ সনদে’ (!) সংকলিত এতগুলো হাদীসের একটিও তাঁরা সংকলন করলেন না কেন? হাজার বছর ধরে একটি হাদীস-গ্রন্থেও এসকল হাদীসের একটিও নেই কেন? তাঁরা সকলেই কি রাসূলুল্লাহ ﷺ-এর মর্যাদা গোপন করতে চেয়েছেন?
(৬) সহীহুল বুখারীর একটি অধ্যায়ের নাম ‘কিতাব বাদয়িল খালক’ ‘সৃষ্টির শুরুর অধ্যায়’। এ অধ্যায়ে সাপ, বিচ্ছু, মাছি, জিন, ফিরিশতা ইত্যাদি বিষয়ক কত হাদীস ইমাম বুখারী সংকলন করেছেন। কিন্তু তাঁর উস্তাদগণের উস্তাদ আব্দুর রায্যাকের মুসান্নাফে সংকলিত নূর মুহাম্মাদী বিষয় কয়েক ডজন সহীহ (!) হাদীসের একটিও তিনি উল্লেখ করলেন না! আব্দুর রায্যাক বর্ণিত প্রায় ১৫০টি হাদীস তিনি তাঁর সহীহ গ্রন্থে সংকলন করলেন অথচ নূর মুহাম্মাদ বিষয়ক এতগুলো সহীহ (!) হাদীস তিনি গ্রহণ করলেন না!
(৭) উবাদা ইবনুস সামিত (রা), আব্দুল্লাহ ইবন আববাস (রা) ও অন্যান্য সাহাবী থেকে বিভিন্ন সহীহ সনদে বর্ণিত:
إِنَّ أَوَّلَ مَا خَلَقَ اللَّهُ تَبَارَكَ وَتَعَالَى الْقَلَمُ../ أَوَّلَ شَيْءٍ خلقه الله القلم
‘আল্লাহ সর্বপ্রথম ‘কলম’ সৃষ্টি করেন’। এ সকল হাদীস ইমাম আহমাদ, তিরমিযী, আবূ দাউদ এবং অন্যান্য মুহাদ্দিস বিভিন্ন সনদে সংকলন করেছেন। ইমাম ইবন আবী শাইবা তাঁর মুসান্নাফ গ্রন্থে (كتاب الأوائل: أول ما فُعِل...) ‘‘সর্বপ্রথম বিষয়ক অধ্যায়: প্রথম কী হলো...’’ নামে একটি অধ্যায় সংকলন করেছেন। এ অধ্যায়েও তিনি ‘সর্বপ্রথম কলম সৃষ্টির’ এ হাদীসটি উদ্ধৃত করেছেন। কিন্তু তিনি বা অন্য কোনো মুহাদ্দিস সর্বপ্রথম সৃষ্টি, সৃষ্টির শুরু বা অন্য কোনো অধ্যায়ে নূর মুহাম্মাদী বিষয়ক হাদীসগুলো উল্লেখ করেন নি। কেন? রাসূলুল্লাহ ﷺ-এর মর্যাদা কমিয়ে কলম-এর মর্যাদা বাড়ানোর জন্য?
(৮) সম্মানিত পাঠক, মুসান্নাফ আব্দুর রায্যাকের মধ্যে বিদ্যমান অধ্যায় ও পরিচ্ছেদগুলো মুসান্নাফ ইবন আবী শাইবা ও অন্যান্য সকল হাদীস গ্রন্থে বিদ্যমান। কিন্তু ‘তাখলীক নূর মুহাম্মাদ ﷺ’ (নূর মুহাম্মাদীর সৃষ্টি) নামে একটি অধ্যায় মুসলিম বিশ্বের কোনো একটি হাদীসের গ্রনেহও নেই। ৫০০ বৎসর পর্যন্ত সংকলিত ফিকহ ও আকীদার কোনো গ্রন্থেও ‘নূর মুহাম্মাদ’ বিষয়ক অধ্যায়, পরিচ্ছেদ, অনুচ্ছেদ বা সামান্যতম কোনো আলোচনা নেই। তাঁরা মুসান্নাফ আব্দুর রায্যাক থেকে অগণিত হাদীস গ্রহণ করলেন, সংকলন করলেন এবং এগুলিকে প্রমাণ হিসেবে পেশ করলেন অথচ নূর মুহাম্মাদ বিষয়ক এতগুলো হাদীস এভাবে এড়িয়ে গেলেন কেন?
(৯) এ ‘হারানো’ বইটি যদি সত্যই আব্দুর রায্যাক রচিত হয় তাহলে বুঝতে হবে যে, ইমাম আহমাদ-সহ ইমাম আব্দুর রায্যাকের ছাত্রগণ, পরবর্তী সকল মুহাদ্দিস, ফকীহ, আকীদাবিদ ও বুজুর্গগণ রাসূলুল্লাহ ﷺ-এর মর্যাদা গোপন করতেই এরূপ করেছেন (নাউযূ বিল্লাহ)! আর তাঁদেরকে যদি আমরা রাসূলুল্লাহ ﷺ-এর মর্যাদা প্রতিষ্ঠার অতন্দ্র প্রহরী বলে গণ্য করি তবে এ পুস্তকটিকে জাল বলে নিশ্চিতভাবে বিশ্বাস করতে হবে। তৃতীয় কোনো ব্যাখ্যা কি পাঠক দেখাতে পারবেন?
সম্মানিত পাঠক, কোন্টি আপনার দৃষ্টিতে গ্রহণযোগ্য? একটি জাল হাদীসকে প্রমাণ করতে এভাবে হাজার বছরের সকল মুহাদ্দিস, ফকীহ, আকীদাবিদ ও বুজুর্গকে রাসূলুল্লাহ ﷺ-এর মর্যাদা গোপনকারী বলা? অথবা চার ইমাম-সহ উম্মাতের প্রথম শতকগুলোর ইমাম, মুহাদ্দিস, ফকীহ, আকীদাবিদ ও বুজুর্গগণ যে সকল হাদীস কোনোভাবে উল্লেখ করেন নি এবং যে বিষয়ে মোটেও কথা বলেন নি সে হাদীস ও সে বিষয় বর্জন করা?