পূর্ববর্তী সৃষ্টি, নবীগণ ও তাফসীর বিষয়ক জাল হাদীস

পূর্ববর্তী সৃষ্টি ও পূর্ববর্তী নবীগণ বিষয়ে কুরআন সংক্ষেপ আলোচনা করেছে। শুধু যে বিষয়গুলোতে মানুষের ইহলৌকিক বা পারলৌকিক শিক্ষা রয়েছে সেগুলোই আলোচনা করা হয়েছে। সৃষ্টি ও নবীগণের ঘটনা ইহূদীদের মধ্যে অনেক বিস্তারিতভাবে প্রচলিত। কুরআনে যেহেতু এ সকল বিষয়ে বিশদ বর্ণনা নেই, সে জন্য সাহাবী-তাবিয়ীগণের যুগ থেকেই অনেক মুফাস্সির এ সকল বিষয়ে ইহূদীদের বর্ণনা কৌতুহলের সাথে শুনতেন। পাশাপাশি তাবিয়ী পর্যায়ে অনেক ইহূদী আলিম ইসলাম গ্রহণ করার পরে এ সকল বিষয়ে তাদের সমাজে প্রচলিত অনেক গল্প কাহিনী মুসলিমদের মধ্যে বলেছেন।

এ সকল গল্প-কাহিনী গল্প হিসেবে শুনতে বা বলতে মূলত ইসলামে নিষেধ করা হয় নি। তবে এগুলোকে সত্য মনে করতে নিষেধ করা হয়েছে। কোনো কোনো মুফাস্সির ও ঐতিহাসিক পূর্ববর্তী নবীগণ বিষয়ক বিভিন্ন আয়াতের তাফসীরে ও তাদের জীবন কেন্দ্রিক ইতিহাস বর্ণনায় ইহূদী-খৃস্টানগণের বিকৃত বাইবেল ও অন্যান্য সত্য-মিথ্যা গল্পকাহিনীর উপর নির্ভর করেছেন। প্রথম যুগগুলোতে মুসলিমগণ গল্প হিসেবেই এগুলো শুনতেন। তবে পরবর্তী যুগে এ সকল কাহিনীকে মানুষেরা সত্য মনে করেছেন। কেউ কেউ এগুলোকে হাদীস বলে প্রচার করেছেন।

কুরআন বলেছে, ইহূদী ও খৃস্টানগণ তাওরাত, যাবূর ও ইঞ্জিলকে বিকৃত করেছে। অনেক কথা তারা নিজেরা রচনা করে আল্লাহর কালাম বলে চালিয়েছে। এজন্য হাদীস শরীফে নির্দেশ দেয়া হয়েছে যে, তাদের কথা বর্ণনা করা যাবে, তবে শর্ত হলো, কুরআনের সত্যায়ন ছাড়া কোনো কিছুকে সত্য বলে গ্রহণ করা যাবে না। সাহাবীগণ ইহূদী-খৃস্টানদের তথ্যের উপর নির্ভর করার নিন্দা করতেন। আব্দুল্লাহ ইবনু আববাস (রা) বলেন:

كَيْفَ تَسْأَلُونَ أَهْلَ الْكِتَابِ عَنْ شَيْءٍ وَكِتَابُكُمْ الَّذِي أُنْزِلَ عَلَى رَسُولِ اللَّهِ أَحْدَثُ تَقْرَءُونَهُ مَحْضًا لَمْ يُشَبْ وَقَدْ حَدَّثَكُمْ أَنَّ أَهْلَ الْكِتَابِ بَدَّلُوا كِتَابَ اللَّهِ وَغَيَّرُوهُ وَكَتَبُوا بِأَيْدِيهِمْ الْكِتَابَ وَقَالُوا هُوَ مِنْ عِنْدِ اللَّهِ لِيَشْتَرُوا بِهِ ثَمَنًا قَلِيلا أَلاَ يَنْهَاكُمْ مَا جَاءَكُمْ مِنْ الْعِلْمِ عَنْ مَسْأَلَتِهِمْ؟

‘‘কিভাবে তোমরা ইহূদী খৃস্টানদেরকে কোনো বিষয়ে জিজ্ঞাসা কর? ‘‘অথচ তোমাদের পুস্তক (অর্থাৎ কুরআন) যা রাসূলুল্লাহ ()-এর উপরে অবতীর্ণ হয়েছে তা নবীনতর, তোমরা তা বিশুদ্ধ অবস্থায় পাঠ করছ, যার মধ্যে কোনোরূপ বিকৃতি প্রবেশ করতে পারে নি। এ কুরআন তোমাদেরকে বলে দিয়েছে যে, পূর্ববর্তী গ্রন্থসমূহের অনুসারীগণ (ইহূদী, খৃস্টান ও অন্যান্য জাতি) আল্লাহর পুস্তককে (তাওরাত-ইঞ্জিল ইত্যাদি) পরিবর্তন করেছে এবং বিকৃত করেছে। তারা স্বহস্থে পুস্তক রচনা করে বলেছে যে, তা আল্লাহর পক্ষ থেকে প্রাপ্ত। পার্থিব সামান্য স্বার্থ লাভের জন্য তারা এরূপ করেছে। তোমাদের কাছে যে জ্ঞান আগমন করেছে (কুরআন ও সুন্নাহর জ্ঞান) তা কি তোমাদেরকে তাদেরকে কিছু জিজ্ঞাসা করা থেকে নিবৃত করতে পারে না?’’[1]

এতকিছু সত্ত্বেও ক্রমান্বয়ে মুসলিম সমাজে অগণিত ‘ইসরাঈলীয় রেওয়ায়াত’ প্রবেশ করতে থাকে। পরবর্তী যুগে মুসলিমগণ এগুলোকে কুরআনের বা হাদীসের কথা বলেই বিশ্বাস করতে থাকেন। এ বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা এই বইয়ের পরিসরে সম্ভব নয়। এজন্য সংক্ষেপে কিছু বিষয়ের প্রতি ইঙ্গিত করছি। আল্লাহর দয়া ও তাওফীক হলে এ বইয়ের পরবর্তী খন্ডগুলোতে এ সকল বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনার চেষ্টা করব।

[1] বুখারী, আস-সহীহ ৬/২৬৭৯।
১. বিশ্ব সৃষ্টির তারিখ বা বিশ্বের বয়স বিষয়ক

বিশ্ব সৃষ্টির তারিখ, সময়, বিশ্বের বয়স, আদম (আঃ) থেকে ঈসা (আঃ) পর্যন্ত বা মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ () পর্যন্ত সময়ের হিসাব, আর কতদিন বিশ্ব থাকবে তার হিসাব ইত্যাদি বিষয়ে যা কিছু বলা হয় সবই বাতিল, মিথ্যা ও ভিত্তিহীন কথা। জালিয়াতগণ এ বিষয়ে অনেক কথা বানিয়েছে।

ইহূদী ও খৃস্টানগণের ‘বাইবেলে’ বিশ্বের বয়স প্রদান করা হয়েছে। মানব সৃষ্টির সময় বলা হয়েছে। বাইবেলের হিসাব অনুসারে বর্তমানে বিশ্বের বয়স ৭০০০ (সাত হাজার) বছর মাত্র। এ সকল কথা ঐতিহাসিভাবে এবং বৈজ্ঞানিকভাবে ভুল ও মিথ্যা বলে প্রমাণিত। এ সকল মিথ্যা ও ভুল তথ্যের উপর নির্ভর করে মুসলিম ঐতিহাসিকগণও অনেক কথা লিখেছেন। আর জালিয়াতগণ এ মর্মে অনেক জাল হাদীসও বানিয়েছে।

২. মানুষের পূর্বে অন্যান্য সৃষ্টির বিবরণ

মানব জাতির পূর্বে অন্য কোনো বুদ্ধিমান প্রাণী এ বিশ্বে ছিল কিনা সে বিষয়ে কুরআন ও হাদীসে সুস্পষ্ট কিছু বলা হয় নি। তবে মানুষের পূর্বে মহান আল্লাহ জিন জাতিকে মানুষের মতই বুদ্ধি, ইচ্ছাশক্তি ও ইবাদতের দায়িত্ব দিয়ে সৃষ্টি করেছেন বলে কুরআন কারীমে বিভিন্ন স্থানে উল্লেখ করা হয়েছে। জিন জাতির সৃষ্টির বিস্তারিত বিবরণ কুরআন কারীমে নেই। কোনো সহীহ হাদীসেও এ বিষয়ক বিস্তারিত বর্ণনা পাওয়া যায় না।

জিন জাতির সৃষ্টি রহস্য, জিন জাতির আদি পিতা, জিন জাতির কর্মকান্ড, জিন জাতির নবী-পয়গম্বর, তাদের আযাব-গযব, তাদের বিভিন্ন রাজা-বাদশাহ, নবী-রাসূলের নাম ইত্যাদি বিষয়ে যা কিছু বলা হয় সবই ইহূদী খৃস্টানদের মধ্যে প্রচলিত কুসংস্কার, লোককথা ও অনির্ভরযোগ্য গল্প-কাহিনী।

কুরআনে উল্লেখ করা হয়েছে যে, ইবলিস জিন জাতির অন্তর্ভুক্ত। আদমকে সাজদা করার নির্দেশ অমান্য করে সে অভিশপ্ত হয়। এ ঘটনার পূর্বে তার জীবনের কোনো ইতিহাস সম্পর্কে কোনো সহীহ বর্ণনা নেই। ইবলিসের জন্ম-বৃত্তান্ত, বংশ ও কর্ম তালিকা, জ্ঞান-গরিমা, ইবাদত-বন্দেগি ইত্যাদি বিষয়ে যা কিছু বলা হয় সবই বিভিন্ন মানুষরে কথা, ইসরাঈলীয় রেওয়ায়াত বা অনির্ভরযোগ্য বিবরণ। ‘কাসাসুল আম্বিয়া’ জাতীয় পুস্তকগুলো এ সকল মিথ্যা কাহিনীতে পরিপূর্ণ।

একটি বহুল প্রচলিত কথা হলো: ‘‘আঠারো হাজর মাখলুকাত’’, অর্থাৎ এ মহাবিশ্বে সৃষ্ট প্রাণীর জাতি-প্রজাতির সংখ্যা হলো ১৮ হাজার। এ কথাটি একান্তই লোকশ্রুতি ও কোনো কোনো আলিমের মতামত। আল্লাহর অগণিত সৃষ্টির সংখ্যা কত লক্ষ বা কত কোটি সে বিষয়ে কোনো তথ্য কোনো সহীহ বা যয়ীফ হাদীসে বর্ণিত হয় নি।

৪. নবী-রাসূলগণের সংখ্যা: ১ বা ২ লক্ষ ২৪ হাজার

কুরআন কারীম থেকে জানা যায় যে, মহান আল্লাহ সকল যুগে সকল জাতি ও সমাজেই নবী-রাসূল প্রেরণ করেছেন। এরশাদ করা হয়েছে:

وَإِنْ مِنْ أُمَّةٍ إِلاَّ خَلاَ فِيْهَا نَذِيْرٌ

‘‘প্রত্যেক জাতিতেই সতর্ককারী প্রেরণ করা হয়েছে।’’[1]

এ সকল নবী-রাসূলের মোট সংখ্যা কুরআনে উল্লেখ করা হয় নি। বরং কুরআন কারীমে এরশাদ করা হয়েছে যে, এ সব নবী-রাসূলগণের কারো কথা আল্লাহ তাঁর রাসূলকে () জানিয়েছেন এবং কারো কথা তিনি তাঁকে জানান নি। এরশাদ করা হয়েছে:

وَرُسُلا قَدْ قَصَصْنَاهُمْ عَلَيْكَ مِنْ قَبْلُ وَرُسُلا لَمْ نَقْصُصْهُمْ عَلَيْكَ

অনেক রাসূল প্রেরণ করেছি যাদের কথা ইতোপূর্বে আপনাকে বলেছি এবং অনেক রাসূল প্রেরণ করেছি যাদের কথা আপনাকে বলি নি।’’[2]

আমাদের মধ্যে অত্যন্ত প্রসিদ্ধ কথা যে নবী-রাসূলগণের সংখ্যা ১ লক্ষ ২৪ হাজার বা ২ লক্ষ ২৪ হাজার। এখানে লক্ষণীয় যে, নবী-রাসূলগণের সংখ্যার বিষয়ে কোনো একটিও সহীহ হাদীস বর্ণিত হয় নি। একাধিক যয়ীফ বা মাউযূ হাদীসে এ বিষয়ে কিছু কথা বর্ণিত হয়েছে। ২ লক্ষ ২৪ হাজারের সুস্পষ্ট বর্ণনা সম্বলিত কোনো সনদ-সহ হাদীস আমি কোথাও দেখতে পাই নি। তবে ১ লক্ষ ২৪ হাজার ও অন্য কিছু সংখ্যা এ ক্ষেত্রে বর্ণিত হয়েছে। সেগুলো নিম্নরূপ:

ক. ১ লক্ষ ২৪ হাজার

একাধিক হাদীসে বর্ণিত হয়েছে যে, নবী-রাসূলগণের সংখ্যা ১ লক্ষ ২৪ হাজার। কিন্ত সবগুলো সনদই অত্যন্ত দুর্বল। কোনো কোনো মুহাদ্দিস এ অর্থের হাদীসকে জাল বলে গণ্য করেছেন।

ইবনু হিববান প্রমুখ মুহাদ্দিস তাদের সনদে ইবরাহীম ইবনু হিশাম ইবনু ইয়াহইয়া আল-গাস্সানী (২৩৮ হি) নামক তৃতীয় হিজরী শতকের একজন রাবীর সূত্রে একটি হাদীস বর্ণনা করেছেন। এ ইবরাহীম বলেন, আমাকে আমার পিতা, আমার দাদা থেকে, তিনি আবূ ইদরীস খাওলানী থেকে, তিনি আবূ যার গিফারী থেকে বলেছেন:

قُلْتُ يَا رَسُوْلَ اللهِ كَمِ الأَنْبِيَاءُ قَالَ مِائَةُ أَلْفٍ وَأَرْبَعَةٌ وَعِشْرُوْنَ أَلْفاً قُلْتُ يَا رَسُوْلَ اللهِ كَمِ الرُّسُلُ مِنْهُمْ قَالَ ثَلاَثُ مِائَةٍ وَثَلاَثَةَ عَشَرَ جَمٌّ غَفِيْرٌ

‘‘আমি বললাম, হে আল্লাহর রাসূল, নবীগণের সংখ্যা কত? তিনি বলেন, এক লক্ষ চবিবশ হাজার। আমি বললাম, হে আল্লাহর রাসূল, এদের মধ্যে রাসূল কত জন? তিনি বলেন, তিন শত তের জন, অনেক বড় সংখ্যা।’’[3]

হাদীসটির বর্ণনাকারী ইবরাহীম ইবনু হিশামের বিষয়ে মুহাদ্দিসদের কিছুটা মতভেদ রয়েছে। তাবারানী ও ইবনু হিববান তাকে মোটামুটি গ্রহণযোগ্য বলে গণ্য করেছেন। অন্যান্য মুহাদ্দিস তাকে মিথ্যাবাদী রাবী বলে চিহ্নিত করেছেন। আবূ যুরআ বলেন: লোকটি কায্যাব বা মহা-মিথ্যাবাদী। আবূ হাতিম রাযী তার কাছে হাদীস গ্রহণ করতে গমন করেন। তিনি তার কাছ থেকে তার পান্ডুলিপি নিয়ে তার মৌখিক বর্ণনার সাথে মিলিয়ে অগণিত বৈপরীত্য ও অসামঞ্জস্য দেখতে পান। ফলে তিনি বলেন: বুঝা যাচ্ছে যে, লোকটি কখনো হাদীস শিক্ষার পিছনে সময় ব্যয় করে নি। লোকটি মিথ্যাবাদী বলে মনে হয়। যাহাবী তাকে মাতরূক বা পরিত্যক্ত বলে উল্লেখ করেছেন।[4]

যেহেতু হাদীসটি ইবরাহীম ইবনু হিশাম ছাড়া আর কেউ বর্ণনা করেন নি, সেহেতু ইবনুল জাওযী হাদীসটিকে জাল বলে গণ্য করেছেন।[5]

ইমাম আহমাদ এ অর্থে অন্য‎ একটি হাদীস সংকলন করেছেন। এ হাদীসে মু‘আন ইবনু রিফা‘আহ নামক একজন রাবী বলেন, আমাকে আলী ইবনু ইয়াযিদ বলেছেন, কাসিম আবূ আব্দুর রাহমান থেকে, তিনি আবূ উমামা (রা) থেকে... নবীগণের সংখ্যা কত? তিনি বলেন ১ লক্ষ ২৪ হাজার... ।’’[6]

এ হাদীসের রাবী মু‘আন ইবনু রিফা‘আহ আস-সুলামী কিছুটা দুর্বল রাবী ছিলেন।[7] তার উস্তাদ আলী ইবনু ইয়াযিদ আরো বেশি দুর্বল ছিলেন। ইমাম বুখারী তাকে ‘মুনকার’ বা ‘আপত্তিকর’ বলেছেন। ইমাম নাসাঈ, দারাকুতনী প্রমুখ মুহাদ্দিস তাকে ‘পরিত্যক্ত’ বলে উল্লেখ করেছেন।[8] তার উস্তাদ কাসিম আবূ আব্দুর রাহমানও (১১২ হি) দুর্বল ছিলেন। এমনকি ইমাম আহমাদ, ইবনু হিববান প্রমুখ মুহাদ্দিস বলেছেন যে, কাসিম সাহাবীগণের নামে এমন অনেক কথা বর্ণনা করেন যে,মনে হয় তিনি ইচ্ছাকৃতভাবেই এ ভুলগুলো বলছেন। তিনি দাবী করতেন যে, তিনি ৪০ জন বদরী সাহাবীকে দেখেছেন, অথচ তাঁর জন্মই হয়েছে প্রথম শতকের মাঝামাঝি।[9]

এ থেকে আমরা দেখতে পাই যে, এ হাদীসটিও অত্যন্ত দুর্বল। আরো দু একটি অত্যন্ত দুর্বল সনদে এ সংখ্যাটি বর্ণিত হয়েছে। সামগ্রিক বিচারে এ সংখ্যাটি ‘মাউযূ’ না হলেও দুর্বল বলে গণ্য। আল্লাহই ভাল জানেন।[10]

খ. ৮ হাজার পয়গম্বর

আবূ ইয়ালা মাউসিলী মূসা ইবনু আবীদাহ আর-রাবাযী থেকে, তিনি ইয়াযিদ ইবনু আবান আর-রাকাশী থেকে বর্ণনা করেছেন, আনাস ইবনু মালিক (রা) বলেছেন, রাসূলুল্লাহ () বলেছেন:

بَعَثَ اللهُ ثَمَانِيَةَ آلاَفِ نَبِيٍّ أَرْبَعَةَ آلاَفٍ إِلَى بَنِيْ إِسْرَائِيْلَ وَأَرْبَعَةَ آلاَفٍ إِلَى سَائِرِ النَّاسِ

মহান আল্লাহ ৮ হাজার নবী প্রেরণ করেছেন। ৪ হাজার নবী বনী ইসরাঈলের মধ্যে এবং বাকী চার হাজার অবশিষ্ট মানব জাতির মধ্যে।’’[11]

এ হাদীসটিও দুর্বল। ইমাম ইবনু কাসীর বলেন, এ সনদটিও দুর্বল। আর-রাবাযী দুর্বল। তার উস্তাদ রাকাশী তার চেয়েও দুর্বল।’’ ইবনু কাসীর আলোচনা করেছেন যে, আরো একটি সনদে এ সংখ্যা বর্ণিত হয়েছে। সনদটি বাহ্যত মোটামুটি গ্রহণযোগ্য।[12]

গ. এক হাজার বা তারও বেশি পয়গম্বর

অন্য হাদীসে রাসূলুল্লাহ () বলেন,

إنِّيْ خَاتِمُ أَلْفِ نَبِيٍّ أَوْ أَكْثَرَ

‘‘আমি এক হাজার বা তারো বেশি নবীর শেষ নবী।’’[13]

ইবনু কাসীর, হাইসামী প্রমুখ মুহাদ্দিস উল্লেখ করেছেন যে, সংখ্যার বর্ণনায় অন্যান্য হাদীসের চেয়ে এ হাদীসটি কিছুটা গ্রহণযোগ্য, যদিও এর সনদেও দুর্বলতা রয়েছে।[14]

[1] সূরা (৩৫) ফাতির: আয়াত ২৪। আরো দেখুন, সূরা (১০) ইউনূস: ৪৭ আয়াত।

[2] সূরা (৫) নিসা: আয়াত ১৬৪। আরো দেখুন: সূরা (৪০) গাফির/মুমিন: আয়াত ৭৮।

[3] ইবনু হিববান, আস-সহীহ ১/৭৬-৭৯।

[4] ইবনুল জাওযী, আদ-দু‘আফা ওয়াল মাতরূকীন ১/৫৯; যাহাবী, মীযানুল ই’তিদাল ১/২০১; ইবনু হাজার, লিসানুল মীযান ১/১২২।

[5] ইবনু কাসীর, আত-তাফসীর ১/৫৮৬-৫৮৭।

[6] আহমাদ, আল-মুসনাদ ৫/২৬৫। শাইখ আর্নাউত বলেন: হাদীসটির সনদ অত্যন্ত দুর্বল।

[7] ইবনুল জাওযী, আদ-দু‘আফা ৩/১২৬; ইবনু আদী, আল-কামিল ৬/৩২৮; যাহাবী, মীযানুল ই’তিদাল ৬/৪৫৫; ইবনু হাজার, লিসানুল মীযান ৭/৩৯১।

[8] নাসাঈ, আদ-দু‘আফা, পৃ. ৭৭, ইবনুল জাওযী, আদ-দু‘আফা ২/২০০; ইবনু হাজার, তাকরীব, পৃ. ৪০৬।

[9] ইবনুল জাওযী, আদ-দু‘আফা ৩/১৪; যাহাবী, মীযানুল ই’তিদাল ৫/৪৫৩; ইবনু হাজার, তাকরীব, পৃ. ৪৫০।

[10] বিস্তারিত আলোচনা দেখনু, ইবনু কাসীর, তাফসীর ১/৫৮৭-৫৮৮; হাইসামী, মাওয়ারিদুয যামআন ১/১৯৬-১৯৮ (সম্পাদকের টীকা); মাজমাউয যাওয়ায়িদ ১/৩৯৩; ড. আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর, কুরআন-সুন্নাহের আলোকে ইসলামী আকীদা, পৃ. ২৮৮-২৯০।

[11] ইবনু কাসীর, তাফসীর ১/৫৮৮; তাবারানী, আল-মু’জামুল আউসাত ১/২৩৬-২৩৭।

[12] ইবনু কাসীর, তাফসীর ১/৫৮৮।

[13] আহমাদ, আল-মুসনাদ ৩/৭৯; হাকিম, আল-মুসতাদরাক ২/৬৫৩; হাইসামী, মাজমাউয যাওয়ায়িদ ৭/৩৪৬।

[14] ইবনু কাসীর, তাফসীর /৫৮৮; হাইসামী, মাজমাউয যাওয়াইদ ৭/৩৪৬।

কুরআনে ২৫ জন নবীর নাম উল্লেখ করা হয়েছে: আদম[1], ইদরীস[2], নূহ[3], হুদ[4], সালিহ[5], ইবরাহীম[6], লূত[7], ইসমাঈল[8], ইসহাক[9], ইয়াকূব[10], ইউসূফ[11], আইয়ূব[12], শুয়াইব[13], মূসা[14], হারূন[15], ইউনূস[16], দাউদ[17], সুলাইমান[18], ইল্ইয়াস[19], ইল্ইয়াসা’[20], যুলকিফল[21], যাকারিয়া[22], ইয়াহইয়া[23], ঈসা[24], মুহাম্মাদ[25] (صلى الله عليهم وسلم)।[26]

কুরআন কারীমে উল্লেখ করা হয়েছে যে, উযাইরকে ইহূদীগণ আল্লাহর পুত্র বলে দাবি করত।[27] কিন্তু তাঁর নবুয়ত সম্পর্কে কিছুই বলা হয় নি। আবূ হুরাইরা (রা) বলেন, রাসূলুল্লাহ () বলেছেন:

مَا أَدْرِيْ أعُزَيْرٌ نَبِيُّ هُوَ أَمْ لاَ

‘‘আমি জানি না যে, উযাইর নবী ছিলেন কি না।’’[28]

মূসার খাদেম হিসাবে ইউশা ইবনু নূন-এর নাম হাদীসে উল্লেখ করা হয়েছে। রাসূলুল্লাহ () থেকে বর্ণিত কোনো সহীহ হাদীসে অন্য কোনো নবীর নাম উল্লেখ করা হয় নি। কোনো কোনো অত্যন্ত যয়ীফ বা জাল হাদীসে আদম (&আ) এর পুত্র ‘‘শীস’’-এর নাম উল্লেখ করা হয়েছে। কালুত, হাযকীল, হাযালা, শামূয়েল, জারজীস, শামঊন, ইরমিয়, দানিয়েল প্রমুখ নবীগণের নাম, জীবণবৃত্তান্ত ইত্যাদি বিষয়ে যা কিছু বলা হয় সবই মূলত ইসরাঈলীয় বর্ণনা ও সেগুলোর ভিত্তিতে মুফাসসির ও ঐতিহাসিকগণের মতামত।


[1] ২৫ বার তাঁর নাম উলেলখ করা হয়েছে। দেখুন: সূরা বাকার ৩১ আয়াত ....

[2] ২ বার। দেখুন: সূরা মারইয়াম ৫৬ আয়াত ...

[3] ৪৩ বার। দেখুন: সূরা আল-ইমরান ৩৩ আয়াত ....

[4] ৮ বার। দেখুন: সূরা বাকারা ১২৪ আয়াত ....

[5] ৯ বার। দেখুন: সূরা আরাফ-৭৩ আয়াত ....

[6] ৬৯ বার। দেখুন: সূরা বাকারা ১২৪ আয়াত ....

[7] ১৭ বার। দেখুন: সূরা হুদ ৭০ আয়াত ....

[8] ১২ বার। দেখুন: সূরা বাকারা ১২৫ আয়াত ...

[9] ১৭ বার। দেখুন: সূরা বাকারা ১৩৩ আয়াত ....

[10] ১৬ বার। দেখুন: সূরা বাকারা ১৩২ আয়াত ....

[11] ২৭ বার। দেখুন: সূরা আনআম ৮৪ আয়াত ....

[12] ৪ বার। দেখুন: সূরা নিসা ১৬৩ আয়াত ....

[13] ১১ বার। দেখুন: সূরা আরাফ ৮৫ আয়াত ....

[14] ১৩৬ বার। দেখুন: সূরা বাকারা ৫১ আয়াত ....

[15] ২০ বার। দেখুন: সূরা বাকারা ২৪৮ আয়াত ....

[16] ৪ বার। দেখুন: সূরা নিসা ১৬৩ আয়াত ....

[17] ১৬ বার। দেখুন: সূরা বাকারা ২৫১ আয়াত ....

[18] ১৭ বার। দেখুন: সূরা বাকারা ১০২ আয়াত ....

[19] ৩ বার। দেখুন: সূরা আনআম ৮৫ আয়াত ....

[20] ২ বার। দেখুন: সূরা আনআম ৮৬ ও সূরা সাদ ৪৮ আয়াত।

[21] ২ বার। দেখুন: সূরা আম্বিয়া ৮৫ ও সূরা সাদ ৪৮ আয়াত।

[22] ৭ বার তাঁর নাম উলেলখিত হয়েছে। দেখুন: সূরা আল-ইমরান ৩৭ আয়াত ....

[23] ৫ বার। দেখুন: সূরা আল-ইমরান ৩৯ আয়াত ....

[24] ২৫ বার। দেখুন: সূরা বাকারা ৮৭ আয়াত ....

[25] ৪ বার তাঁর নাম উলেলখিত হয়েছে। সূরা আল-ইমরান ১৪৪, সূরা আহযাব ৪০, সূরা মুহাম্মাদ ২ ও সূরা ফাতহ ২৯ আয়াত। আললাহ কুরআনে সকল নবী-রাসূলের ক্ষেত্রে তাঁদের নাম ধরে সম্বোধন করেছেন এবং তাদের ঘটনা বর্ণনার সময় তাঁদের নাম উলেলখ করেছেন। কিন্তু মুহাম্মাদ (ﷺ)-এর ক্ষেত্রে কুরআনে ‘‘হে নবী’’ বা ‘‘হে রাসূল’’ বলে তাঁকে সম্বোধন করা হয়েছে। আর তাঁর সম্পর্কে কিছু বলতে গেলে ‘‘নবী’’ ‘‘রাসূল’’ বা ‘‘আবদ’’ বলা হয়েছে। এজন্য কুরআনে শুধুমাত্র ৪টি স্থান ছাড়া কোথাও তাঁর নাম উলেলখিত হয় নি।

[26] ইবনু কাসীর, তাফসীর ১/৫৮৬; কুরতুবী, তাফসীর, ৩/৩১;

[27] সূরা ৯: তাওবা, আয়াত ৩০।

[28] আবূ দাউদ, আস-সুনান ৪/২১৮; আযীম আবাদী, আউনুল মা’বুদ ১২/২৮০।

মহান আল্লাহ কুবআন কারীমে বারংবার বলেছেন যে, তিনি নবী ও রাসূলগণকে গ্রন্থাদি প্রদান করেছেন। কিন্তু এ সকল কিতাব ও সহীফার কোনো সংখ্যা কুরআন কারীমে বা কোনো সহীহ হাদীসে উল্লেখ করা হয় নি। ‘১০৪’ কিতাব ও সহীফার কথাটি আমাদের দেশে অত্যন্ত প্রসিদ্ধ। কোনো নির্ভরযোগ্য হাদীসে কথাটি পাওয়া যায় না। উপরে ১ লক্ষ ২৪ হাজার পয়গম্বর’ বিষয়ক যে হাদীসটি আবূ যার (রা) থেকে বর্ণিত হয়েছে, সে হাদীসের মধ্যে এ ১০৪ সহীফা ও কিতাবের কথাটি উল্লেখ করা হয়েছে। আমরা দেখেছি যে, এ হাদীসটি জাল অথবা অত্যন্ত দুর্বল।

কুরআন কারীমে নূহ (আঃ)-এর বিষয়ে বলা হয়েছে যে, তিনি ৯৫০ বছর জীবিত ছিলেন। এছাড়া অন্য কোনো নবীর আয়ুষ্কাল কুরআন কারীমে উল্লেখ করা হয় নি। আদম (আঃ) এর আয়ুষ্কাল ১ হাজার বৎসর বলে একটি হাদীসে উল্লেখ করা হয়েছে। এ বিষয়ক আর কোনো তথ্য পাওয়া যায় না। নবীগণের আয়ুষ্কাল বিষয়ক যা কিছু আমাদের দেশে প্রচলিত বই পুস্তকে লিখিত রয়েছে সবই ইহূদী খৃস্টানগণের বিকৃত গ্রন্থাবলি থেকে গৃহীত তথ্য।

নবী-রাসূলগণের জীবনবৃত্তান্ত কুরআন বা হাদীসে বিস্তারিত আলোচনা করা হয় নি। ইলইয়াস, ইলইয়াসা’ ও যুলকিফল (আঃ) সম্পর্কে শুধু নাম উল্লেখ ছাড়া কিছুই বলা হয় নি। ইদরীস (আঃ)-এর বিষয়টিও প্রায় অনুরূপ। অন্যান্য নবী-রাসূলগণের ক্ষেত্রে তাঁদের জীবনের শিক্ষণীয় কিছু দিক শুধু আলোচনা করা হয়েছে। আমাদের দেশের প্রচলিত ‘কাসাসুল আম্বিয়া’ ও বিভিন্ন নবীর জীবনী বিষয়ক পুস্তকাদিতে যা কিছু লিখা হয়েছে তার অধিকাংশই জাল, ভিত্তিহীন ও ইসরাঈলীয় রেওয়ায়াতের সমষ্টি। এ গ্রন্থের পরিসরে এ সকল দিক বিস্তারিত আলোচনা সম্ভব নয়। এখানে সংক্ষেপে কিছু বিষয়ের প্রতি ইঙ্গিত করছি।

আমাদের মধ্যে বহুল প্রচলিত কথা যে, আদম (আঃ) গন্দম (গম) গাছের ফল খেয়েছিলেন। কথাটি একেবারেই ভিত্তিহীন এবং কুরআন বা হাদীসে কোথাও তা নেই। আদম ও হাওয়া (আঃ)-কে আল্লাহ একটি বিশেষ বৃক্ষের কাছে গমন করতে নিষেধ করেন। পরবর্তীতে তাঁরা শয়তানের প্ররোচনায় এ বৃক্ষ থেকে ভক্ষণ করেন। কুরআন ও হাদীসে বিভিন্ন স্থানে এ কথা বলা হয়েছে। কিন্তু এ বৃক্ষ বা ফলের নাম কোথাও বলা হয় নি। পরবর্তী যুগে ইহূদীদের গল্পকাহিনীর ভিত্তিতে মুফাস্সিরগণ গম, আঙুর, খেজুর... ইত্যাদি বিভিন্ন গাছের নাম বলেছেন। এগুলো সবই অনুমানভিত্তিক কথা। হাদীসে এ বিষয়ে কিছুই বলা হয় নি। মুমিনের দায়িত্ব হলো, এ ঘটনা থেকে শিক্ষা গ্রহণ করা, গাছের বা ফলের নাম জানা নয়। সর্বাবস্থায় এ সকল মানবীয় মতামতকে আল্লাহ বা তাঁর রাসূলের () কথা বলে মনে করা যাবে না।[1]

এ গন্দম ফল নিয়ে আরো অনেক বানোয়াট কথা আমাদের দেশের প্রচলিত কাসাসুল আম্বিয়া ও এ জাতীয় গ্রন্থে পাওয়া যায়। আদমের মনে কূটতর্ক জন্মে, জিবরাঈল তা বের করে পুতে রাখেন, সেখান থেকে গন্দম গাছ হয় .... ইত্যাদি...। সবই বানোয়াট ও ভিত্তিহীন কথা।

বাইবেলে বলা হয়েছে যে, হাওয়া (আঃ) আগে ফল খান, এরপর আদম (আঃ)-কে প্ররোচিত করেন। এজন্য নারীকে জন্মগতভাবে অপরাধী বলে গণ্য করা হয়েছে (তীমথিয় ২/১২-১৪) কুরআন বা হাদীসে এভাবে কোথাও বলা হয় নি। কুরআনে সর্বদা ফলভক্ষণের জন্য আদমকে দায়ী করা হয়েছে।

[1] ইবনু কাসীর, কাসাসুল আম্বিয়া ১/১৯।
দেখানো হচ্ছেঃ থেকে ১০ পর্যন্ত, সর্বমোট ২৩ টি রেকর্ডের মধ্য থেকে পাতা নাম্বারঃ 1 2 3 পরের পাতা »