আমরা দেখেছি যে, ইসলামের গোপন শত্রুরা মুসলিম সমাজে বিভ্রান্তি ছড়ানোর জন্য সর্বপ্রথম হাদীসের নামে মিথ্যা কথা মুসলিম সমাজে ছড়াতে থাকে। ওহীর উপরেই ধর্মের ভিত্তি। ওহীর মাধ্যমে কোনো কথা প্রমাণিত করতে পারলেই তা মুসলিম সমাজে গ্রহণযোগ্যতা পায়। কুরআন অগণিত মানুষের মুখস্থ, কুরআনের নামে সরাসরি মিথ্যা বা বানোয়াট কিছু বলার সুযোগ কখনোই ছিল না। এজন্য হাদীসের নামে মিথ্যা বলার চেষ্টা তারা করেছে।
ক্রমান্বয়ে আরো অনেক মানুষ বিভিন্ন প্রকারের উদ্দেশ্যে হাদীসের নামে মিথ্যা বলতে থাকে। এছাড়া অনেক মানুষ অজ্ঞতা, অবহেলা বা অসাবধানতা বশত হাদীসের নামে মিথ্যা বলেন। কারো মুখে কোনো ভাল কথা, কোনো প্রাচীন প্রজ্ঞাময় বাক্য, কোনো সাহাবী বা তাবিয়ীর কথা শুনে কারো কাছে ভাল লেগেছে। পরবর্তীতে তা বলার সময় রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর কথা বলে বর্ণনা করেছেন। এভাবে বিভিন্ন কারণে হাদীসের নামে জালিয়াতি চলতে থাকে।
আমরা দেখেছি যে, মিথ্যা দু প্রকার: ইচ্ছাকৃত ও অনিচ্ছাকৃত। অনিচ্ছাকৃত মিথ্যার কারণ মূলত স্মৃতির বিভ্রাট, হাদীস মুখস্থকরণে অবহেলা বা হাদীস গ্রহণে অসতর্কতা। আর ইচ্ছাকৃত মিথ্যার কারণ অধিকাংশ ক্ষেত্রে ধর্মের ক্ষতি বা উপকার (!) করা।
আমরা জানি যে, ওহীর সম্পর্ক ধর্মের সাথে। কাজেই ওহীর নামে মিথ্যা বলার সকল উদ্দেশ্যই ধর্ম কেন্দ্রিক। কেউ ধর্মের নামে ধর্মের ক্ষতি করার জন্য হাদীস বানিয়েছেন। কেউ ধর্মের নামে কামাই রুজি করার জন্য বা নিজের ফাতওয়া, দল বা বংশকে শক্তিশালী করার জন্য হাদীস বানিয়েছেন। কেউ ধর্মের নামে নিজের মতামতকে প্রতিষ্ঠিত করতে হাদীস বানিয়েছেন। কেউ নিঃস্বার্থভাবে (!) মানুষদের ভালকাজে উৎসাহ দান ও খারাপ কাজ থেকে নিরুৎসাহিত করার জন্য হাদীস বানিয়েছেন। এ সকল কারণ আমরা তিন শ্রেণিতে ভাগ করতে পারি: ১. ধর্মের ক্ষতি করা, ২. ধর্মের উপকার করা ও ৩. নিজের জাগতিক উদ্দেশ্য হাসিল করা।
মিথ্যার কারণ ও মিথ্যাবাদীদের প্রকরণ সম্পর্কে ৭ম হিজরী শতকের প্রখ্যাত মুহাদ্দিস আল্লামা ইবনুস সালাহ আবু আমর উসমান ইবনু আব্দুর রাহমান (৬৪৩হি) বলেন: হাদীস বানোয়াটকারী জালিয়াতগণ বিভিন্ন প্রকারের। এদের মধ্যে সবচেয়ে ক্ষতিকারক একদল মানুষ যারা নেককার ও দরবেশ বলে সমাজে পরিচিত। এরা এদের অজ্ঞতা ও বিভ্রান্তির কারণে সাওয়াবের আশায় বানোয়াট কথা হাদীসের নামে সমাজে প্রচার করতেন। এদের বাহ্যিক পরহেযগারী, নির্লোভ জীবনযাপন ইত্যাদি দেখে মানুষ সরল মনে এদের কথা বিশ্বাস করে এসকল বানোয়াট কথা হাদীস বলে গ্রহণ করতো। এরপর হাদীসের অভিজ্ঞ ইমামগণ সুক্ষ্ম নিরীক্ষার মাধ্যমে এদের মিথ্যাচার ও জালিয়াতি ধরে ফেলেন এবং প্রকাশ করে দেন।... সাওয়াবের উদ্দেশ্যে নেককাজের ফযীলত ও অন্যায় কাজের শাস্তি বিষয়ক মিথ্যা ও বানোয়াট কথাকে হাদীস নামে প্রচার করাকে এধরনের কেউ কেউ জায়েয মনে করত।[1]
আল্লামা যাইনুদ্দীন ইরাকী (৮০৬হি) বলেন: হাদীস জালকারীগণ তাদের জালিয়াতির উদ্দেশ্য ও কারণের দিক থেকে বিভিন্ন প্রকারের :
১. অনেক যিনদীক মানুষদেরকে বিভ্রান্ত করার জন্য হাদীস বানিয়েছে। হাম্মাদ ইবনু যাইদ বলেছেন: যিনদীকগণ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নামে দশ হাজার হাদীস তৈরি করেছে।
২. অনেকে নিজের ধর্মীয় মতের সমর্থনে হাদীস জাল করেছে।
৩. কিছু মানুষ খলীফা ও আমীরদের পছন্দসই বিষয়ে হাদীস জাল করে তাদের প্রিয়ভাজন হতে চেষ্টা করেছে।
৪. কিছু মানুষ ওয়ায ও গল্প বলে অর্থ কামাই করার মানসে হাদীস জাল করেছে।
৫. কিছু মানুষ নিজে ভাল ছিলেন, কিন্তু তাদের পুত্র বা পরিবারের কোনো সদস্য তাদের পান্ডুলিপির মধ্যে মিথ্যা হাদীস লিখে রাখতো। তারা বেখেয়ালে তা বর্ণনা করতেন।
৬. কেউ কেউ নিজেদের ফাতওয়া বা মাসআলার দলীল প্রতিষ্ঠার জন্য হাদীস বানাতেন।
৭. কেউ কেউ নতুনত্ব ও অভিনবত্ব প্রতিষ্ঠার জন্য বিভিন্ন অপ্রচলিত সনদ ও মতন তৈরি করতেন।
৮. কিছু মানুষ এভাবে মিথ্যা হাদীস তৈরি করাকে দীনদারী মনে করতেন। তারা তাদের বিভ্রান্তির কারণে মনে করতেন যে, মানুষদের ভালর পথে ডাকার জন্য মিথ্যা বলা যায়। এরা নেককার, সংসারত্যাগী বুযুর্গ হিসাবে সমাজে পরিচিত। হাদীস জালিয়াতির ক্ষেত্রে তাদের দ্বারা ক্ষতি হয়েছে সবচেয়ে বেশি ও মারাত্মক। কারণ তারা এ কঠিন পাপকে নেককর্ম ও সাওয়াবের কাজ মনে করতেন; ফলে কোনোভাবেই তাদেরকে এথেকে বিরত করা যেত না। আর তাদের বাহ্যিক তাকওয়া, নির্লোভ জীবন ও দরবেশী দেখে মানুষেরা প্রভাবিত হতেন এবং তাদের মিথ্যাকে সত্য বলে গ্রহণ ও প্রচার করতেন। এজন্যই ইমাম ইয়াহইয়া ইবনু সাঈদ কাত্তান (১৯৮ হি) বলতেন, হাদীসের বিষয়ে নেককার বুযুর্গদের চেয়ে বেশি মিথ্যাবাদী আমি দেখিনি।[2] তিনি নেককার বুযুর্গ বলতে বুঝাচ্ছেন সে সব জাহিলকে যারা নিজেদের নেককার মনে করেন এবং বুযুর্গীর পথে চলেন, কিন্তু হালাল হারাম বুঝেন না।[3]
আমরা এখানে হাদীসের নামে জালিয়াতির প্রধান কারণগুলো ও এতে লিপ্ত মানুষদের বিষয়ে কিছু বিস্তারিত আলোচনা করব।
[2] মুসলিম, আস-সহীহ ১/১৭-১৮।
[3] ইরাকী, ফাতহুল মুগীস, পৃ: ১২২-১২৪।
ইসলামের ইতিহাসের প্রথম অর্ধ শতকের মধ্যে ইসলামী বিজয়ের মাধ্যমে এশিয়া ও আফ্রিকার বিস্থির্ণ এলাকা ইসলামী রাষ্ট্রের মধ্যে প্রবেশ করে। এসব দেশের অনেক অমুসলিম নাগরিক স্বেচ্ছায় ইসলাম গ্রহণ করেন। অনেকে তাদের পূর্ব ধর্ম অনুসরণ করতে থাকেন। ইসলামী রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে তাঁদের নিরাপত্তা প্রদান করা হয়। পক্ষান্তরে কিছু মানুষ তাদের পূর্বের ধর্ম ও মতবাদের প্রতি আনুগত্য ও ভালবাসা সত্ত্বেও প্রকাশ্যে ইসলাম গ্রহণের কথা বলেন। তারা সমাজে মুসলিম বলে গণ্য হলেও প্রকৃতপক্ষে মুসলিম সমাজে বিভ্রান্তি ছড়ানো ও তথ্য সন্ত্রাসের মাধ্যমে মুসলিমগণের বিশ্বাস ও কর্ম নষ্ট করাই ছিল তাদের উদ্দেশ্য। অধিকাংশ ক্ষেত্রে এ শ্রেণীর মানুষদেরকে ‘যিনদীক’ বলা হতো। এরা তাদের ঘৃণ্য উদ্দেশ্য চরিতার্থ করার জন্য অগণিত মিথ্যা কথা সমাজে হাদীস হিসাবে প্রচার করতো। আমার দেখেছি যে, আব্দুল্লাহ ইবনু সাবার নেতৃত্বে এ শ্রেণির মানুষেরাই প্রথম বানোয়াট হাদীস প্রচার শুরু করে।
এসকল ভন্ড যিনদীক কখনো আলীর (রা) ভক্ত সেজে তাঁর ও তাঁর বংশের পক্ষে বানোয়াট হাদীস প্রচার করতো। কখনো বা সূফী-দরবেশ সেজে মানুষদের ধোঁকা দিত এবং পারসিক বা ইহুদী-খৃস্টানদের বৈরাগ্য ও সন্ন্যাস-মার্কা দরবেশীর পক্ষে হাদীস বানাতো। তাদের মূল উদ্দেশ্য ছিল ইসলামী বিশ্বাস নষ্ট করা ও তাকে হাস্যাষ্পদ ও অযৌক্তিক হিসাবে পেশ করা।
এখানে লক্ষণীয় যে, তারা সনদসহ হাদীস বানাতো। তৎকালীন সময়ে সনদ ছাড়া হাদীস বলার কোনো উপায় ছিল না। তারা প্রখ্যাত মুহাদ্দিস ও নির্ভরযোগ্য রাবীগণের নাম জানতো। বিভিন্ন সহীহ হাদীসের সনদ তাদের মুখস্থ ছিল। এসকল সনদের নামে তারা হাদীস বানাতো।
এগুলো দিয়ে সাধারণ মানুষদের ধোঁকা দেয়া খুবই সহজ ছিল। তবে ‘নাকিদ’ মুহাদ্দিসদের কাছে এ ধোঁকার কোনো কার্যকরিতা ছিল না। তাঁরা উপরে বর্ণিত নিরীক্ষার মাধ্যমে এদের জালিয়াতি ধরে ফেলতেন। যেমন একজন বলল যে, আমাকে ইয়াহইয়া ইবনু সাঈদ আল-কাত্তান বলেছেন, তিনি সুফিয়ান সাওরী থেকে, তিনি ইবনু সিরীন থেকে, তিনি আনাস ইবনু মালিক থেকে তিনি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে...। তখন তাঁরা উপরের পদ্ধতিতে সনদে বর্ণিত সকল রাবীর অন্যান্য ছাত্রদের বর্ণিত হাদীসের সাথে এর তুলনা করতেন। পাশাপাশি এ ব্যক্তির অন্যান্য বর্ণনা ও তার কর্ম বিচার করে অতি সহজেই জালিয়াতি ধরে ফেলতেন।
এদের বানানো একটি হাদীস দেখুন। মুহাম্মাদ ইবনু শুজা’ নামক একব্যক্তি বলছে, আমাকে হিববান ইবনু হিলাল, তিনি হাম্মাদ ইবনু সালামা থেকে, তিনি আবুল মাহযাম থেকে তিনি আবু হুরাইরা থেকে, রাসূলুল্লাহ ﷺ-কে প্রশ্ন করা হলো, হে আল্লাহর রাসূল, আমাদের প্রভুর সৃষ্টি কী থেকে? তিনি বলেন: তিনি একটি ঘোড়া সৃষ্টি করেন, এরপর ঘোড়াটিকে দাবড়ান। ঘোড়াটির দেহ থেকে যে ঘাম নির্গত হয় সে ঘাম থেকে তিনি নিজেকে সৃষ্টি করেন।[1]
আমরা সুস্পষ্টত বুঝতে পারছি যে, মহান আল্লাহ সম্পর্কে মুসলিম বিশ্বাসকে হাস্যাষ্পদরূপে তুলে ধরা ও মুসলিম বিশ্বাসকে তামাশার বিষয়ে পরিণত করাই এরূপ জালিয়াতির উদ্দেশ্য।
এসকল জালিয়াত অনেক সময় তাদের জালিয়াতির কথা বলে বড়াই করত। আব্দুল করীম ইবনু আবীল আরজা দ্বিতীয় হিজরী শতকের এরূপ একজন জালিয়াত। ধর্মদ্রোহিতা, জালিয়াতি ইত্যাদি অপরাধে তার মৃত্যুদন্ড প্রদানের নিদের্শ দেন তৎকালীন প্রশাসক মুহাম্মাদ ইবনু সুলাইমান ইবনু আলী। শাস্তির পূর্বে সে বলে, আল্লাহর কসম, আমি চার হাজার বানোয়াট হাদীস জালিয়াতি করে মুসলমানদের মধ্যে প্রচার করে দিয়েছি।[2]
তৃতীয় আববাসীয় খলীফা মাহদী (শাসনকাল ১৫৮-১৬৯ হি) বলেন, আমার কাছে একজন যিনদীক স্বীকার করেছে যে, সে ৪০০ হাদীস বানোয়াট করেছে, যেগুলো এখন মানুষের মধ্যে প্রচারিত হচ্ছে।[3]
[2] ইবনুল জাওযী, আল-মাউদূআত ১/১৫।
[3] ইবনুল জাওযী, আল-মাউদূআত ১/১৫।
সাধারণত মানুষ নিজের ক্ষুদ্রত্ব ও সীমাবদ্ধতা অনুভব করতে চায় না। প্রাচীন যুগ থেকে আজ পর্যন্ত অগণিত মানুষ নিজের বুদ্ধি, বিবেক, বিচার ও প্রজ্ঞা দিয়ে ‘ওহী’-র দুর্বলতা (!) ও অপূর্ণতা (!!) দূর (!!!) করতে চেষ্টা করেছে ও করছে। সকলেরই চিন্তা ওহীর মধ্যে এ কথাটি কেন থাকল না! এ কথাটি না হলে ধর্মের পূর্ণতা আসছে না। ঠিক আছে আমি কথাটি ওহীর নামে বলি। তাহলে ধর্ম পূর্ণতা লাভ করবে!!!
এদের মধ্যে অনেকে নিজে কোনো মনগড়া ধর্মীয় মতবাদ তৈরী করেছে বা অনুসরণ করেছে এবং এ মতের পক্ষে ‘ওহী’ জালিয়াতি করেছে। রাসূলুল্লাহ ﷺ-এর ইন্তেকালের পরে অর্ধ শতাব্দী অতিক্রান্ত হতে না হতেই মুসলিম সমাজে নও-মুসলিমদের মধ্যে পূর্ববর্তী ধর্মের প্রভাব, ইসলামের গোপন শত্রুদের অপপ্রচার ও বিভিন্ন সমাজের সাহিত্য, দর্শন ইত্যাদির প্রভাবে নতুন নতুন ধর্মীয় মতবাদের উদ্ভাবন ঘটে। আলী (রা) ও সকল সাহাবীর বিরুদ্ধে জিহাদ ও মনগড়া ইসলাম প্রতিষ্ঠার উন্মাদনা নিয়ে প্রতিষ্ঠিত হয় খারিজী মতবাদ। আলী (রা) এর ভক্তি ও ভালবাসার ছদ্মাবরণে মুসলমানদের মধ্যে ইহুদী, খৃস্টান ও অগ্নিপূজকদের মতবাদ ছড়ানোর জন্য প্রচারিত হয় শিয়া মতবাদ। মহান আল্লাহর মর্যাদা রক্ষার ভুয়া দাবীতে প্রতিষ্ঠিত হয় ‘কাদারিয়া’ মতবাদ, যাতে তাকদীর বা মানুষের ভাগ্যের বিষয়ে মহান আল্লাহর জ্ঞানকে অস্বীকার করা হতো। মহান আল্লাহর ক্ষমতা প্রমাণের বাড়াবাড়িতে প্রতিষ্ঠিত হয় ‘জাবারিয়া’ মতবাদ, যাতে মানুষের ইচ্ছাশক্তি ও কর্মক্ষমতাকে অস্বীকার করা হতো। মহান আল্লাহর একত্ব প্রতিষ্ঠার মনগড়া দাবিতে প্রতিষ্ঠিত হয় ‘জাহ্মিয়া’, ‘মুতাজিলা’ ইত্যাদি মতবাদ, যেখানে মহান আল্লাহর গুণাবলি অস্বীকার করা হতো।
রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর সাহাবীগণ কুরআন ও হাদীসের নির্দেশনা হুবহু আক্ষরিকভাবে বিশ্বাস ও পালন করেছেন। সাহাবীগণকে ভালবাসতে হবে আবার রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর বংশধরদেরকেও ভালবাসতে হবে। উভয়ের মধ্যে কোনো বৈপরীত্য নেই, নেই কোনো বাড়াবাড়ির অবকাশ। মানুষের ভাগ্যের বিষয়ে আল্লাহর জ্ঞান ও নির্ধারণ যেমন সত্য, তেমনি সত্য মানুষের কর্মক্ষমতা ও ইচ্ছাশক্তি। উভয় বিষয়ের সকল আয়াত ও হাদীস সহজভাবে বিশ্বাস করেছেন তাঁরা। এগুলোর মধ্যে কোনো বৈপরীত্য তাঁরা দেখেন নি।
কিন্তু নতুন মতের উদ্ভাবকগণ কুরআন-হাদীসের কিছু নির্দেশনা মানতে যেয়ে বাকীগুলো অস্বীকার বা ব্যাখ্যা করেছেন। প্রত্যেকে নিজের মতকেই সঠিক বলে মনে করেছেন এবং দাবি করেছেন যে, তার মতই আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের (ﷺ) পক্ষে এবং এ মতের পক্ষে হাদীস বানানোর অর্থ হলো আল্লাহ ও তার রাসূলের (ﷺ) পক্ষে হাদীস বানানো। কিছু বানোয়াট বা মিথ্যা কথাকে ওহীর নামে বা হাদীসের নামে বলে যদি আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের (ﷺ) ‘সঠিক পছন্দের (!!) মতকে’ শক্তিশালী করা যায় তাহলে অসুবিধা কি?! এ তো ভাল কাজ বলে গণ্য হওয়া উচিত। এজন্য তাদের কেউ কেউ যখন তাদের মতের পক্ষে সুস্পষ্ট কোনো হাদীস পান নি তখন প্রয়োজনে নিজেদের পক্ষে ও বিরোধীদের বিপক্ষে হাদীস বানিয়ে প্রচার করেছেন। ফিকহী ও মাসআলাগত মতভেদের ক্ষেত্রেও কখনো কখনো মিথ্যা হাদীস তৈরী করা হয়েছে।[1]
এক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি অগ্রগামী ছিলেন শিয়াগণ। নবী-বংশের ভক্তির নামে তাঁরা অগণিত বানোয়াট কথা ধর্মবিশ্বাসের অংশ বানিয়েছিলেন। এরপর সেগুলোর সমর্থনে অগণিত হাদীস বানিয়ে প্রচার করেছেন। নবীদের পরে সকল মানুষের মধ্যে আলীর শ্রেষ্ঠত্ব, আলীর অগণিত অলৌকিক ক্ষমতা, আলীর পুনরায় দুনিয়ায় ফিরে আসা, আলী বংশের মাহাত্ম্য, তাঁকে ও তাঁর বংশধরদেরকে বাদ দিয়ে যারা খলীফা হয়েছেন তাঁদের যুলুম ও শাস্তি, যারা তাঁর বিরোধিতা করেছেন তাঁদের ভয়ঙ্কর পরিণতি ও শাস্তি, যারা তাঁকে সর্বশ্রেষ্ঠ বলে মানেন নি বা অন্যান্য সাহাবীদেরকে ভালবেসেছেন তাদের ভয়ঙ্কর শাস্তি ইত্যাদি বিষয়ে অগণিত বানোয়াট কথাকে তারা হাদীস নামে প্রচার করেছেন।
তাঁদের জালিয়াতি এতই ব্যাপক ছিল যে, তাদের আলিমগণও সেকথা স্বীকার করতে বাধ্য হয়েছেন। ৭ম হিজরী শতকের প্রখ্যাত শীয়া আলিম, আলী (রা)-এর বক্তৃতা সংকলন বলে কথিত ও প্রচারিত ‘নাহজুল বালাগাত’ নামক গ্রন্থের ব্যাখ্যাকার ইবনু আবীল হাদীদ আব্দুল হামীদ ইবনু হিবাতুল্লাহ (৬৫৬ হি) বলেন: ‘‘ফযীলত বা মর্যাদা জ্ঞাপক হাদীসের ক্ষেত্রে প্রথম মিথ্যাচারের শুরু হয়েছিল শিয়াদের দ্বারা। তারা প্রথমে তাদের নেতার পক্ষে বিভিন্ন হাদীস জালিয়াতি করে প্রচার করেন। বিরোধীদের সাথে প্রচন্ড শত্রুতা ও হিংসা তাদেরকে এ কর্মে উদ্বুদ্ধ করে।...’’[2]
[2] মুহাম্মাদ আজ্জাজ আল-খতীব, আস-সুন্নাতু কাবলাত তাদবীন পৃ: ১৯৫।
রাসূলুল্লাহ ﷺ-এর নামে মিথ্যা কথা বলা ও প্রচার করার ক্ষেত্রে সবচেয়ে কঠিন ও ঘৃণ্য ভুমিকা পালন করেছে কুরআন ও সুন্নাতের শিক্ষার বিষয়ে অজ্ঞ কিছু ধার্মিক মানুষের ‘মানুষকে ভাল পথে নেয়ার আগ্রহ।’ কুরআনের ফযীলত, বিভিন্ন সূরার ফযীলত, বিভিন্ন সময়ে বা দিনে বিভিন্ন প্রকারের সালাতের ফযীলত, বিভিন্ন প্রকার যিকিরের ফযীলত ইত্যাদি সর্বপ্রকারের নেক কর্মের ফযীলত, বিভিন্ন পাপ বা অন্যায় কাজের শাস্তি ইত্যাদি বিষয়ে অসংখ্য হাদীস বানানো হয়েছে এ উদ্দেশ্যে।[1]
জাল হাদীস তৈরী ও প্রচারের ক্ষেত্রে এ সকল নেককার মানুষরা ছিলেন সবচেয়ে বেশি ক্ষতিকারক। এদেরকে দু’ভাগে ভাগ করা যায়। কিছু নেককার মানুষ অনিচ্ছাকৃতভাবে মিথ্যা বলতেন। এরা এদের সরলতার কারণে হাদীস নামে যা শুনতেন তাই বিশ্বাস করতেন এবং বর্ণনা করতেন। অনেক সময় কোনো সুন্দর কথা বা জ্ঞানের বাক্য শুনলে তারা তা অসতর্কভাবে হাদীস বলে বর্ণনা করতেন। আর কিছু নেককার বলে পরিচিত মানুষ ইচ্ছাকৃতভাবে মিথ্যা বলতেন।
সূফী দরবেশ আল্লাহওয়ালা মানুষেরা সরলমনা ভালো মানুষ। সবাইকে সরল মনে বিশ্বাস করা ও দয়া করাই তাঁদের কাজ। আর মুহাদ্দিসের কাজ দারোগার কাজ। দরবেশের শুরু বিশ্বাস দিয়ে আর দারোগার শুরু অবিশ্বাস দিয়ে। কোনো মানুষ যদি তার কোনো বিপদের কথা বলে, বা কোনো অপরাধের জন্য ওজর পেশ করে তখন সাধারণত সরল প্রাণ মানুষেরা তা বিশ্বাস করে ফেলেন। কিন্তু একজন দারগা প্রথমেই অবিশ্বাস দিয়ে শুরু করেন। তিনি তাকে বিভিন্ন প্রশ্ন করে জানতে চেষ্টা করেন, সে ধোঁকা দিচ্ছে না সত্য কথা বলছে। এরপর তিনি তা বিশ্বাস করেন।
কুরআন কারীম ও হাদীস শরীফের অগণিত নির্দেশের আলোকে সাহাবীগণের যুগ থেকে সাহাবীগণ ও পরবর্তী মুহাদ্দিসগণ ওহী বা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের হাদীসের বিশুদ্ধতা রক্ষায় সদাজাগ্রত প্রহরী বা দারোগার দায়িত্ব পালন করছেন। সুক্ষ্ম নিরীক্ষা ও যাচাই ছাড়া তারা রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর নামে বলা কোনো কথা সঠিক বলে গ্রহণ করেন নি।
পক্ষান্তরে সরলপ্রাণ ‘যাহিদ’ সূফী-দরবেশগণ রাসূলুল্লাহর (ﷺ) নামে কোনো কথা শোনামাত্র আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েন। রাসূলুল্লাহর (ﷺ) নামে কেউ মিথ্যা বলতে পারে তা কখনো তাঁরা চিন্তা করেননি। তাঁরা যা শুনেছেন সবই ভক্তের হৃদয় দিয়ে শুনেছেন, সরল বিশ্বাসে মেনে নিয়েছেন, আমল করেছেন এবং অন্যকে আমল করতে উৎসাহ দিয়েছেন। এজন্য তাবে-তাবিয়ীদের যুগ থেকেই মুহাদ্দিসগণ এধরনের নেককার দরবেশদের হাদীস গ্রহণ করতেন না। ইমাম মালিক (১৭৯ হি.) বলতেন: মদীনায় অনেক দরবেশ আছেন, যাদের কাছে আমি লাখ টাকা আমানত রাখতে রাজি আছি, কিন্তু তাঁদের বর্ণিত একটি হাদীসও আমি গ্রহণ করতে রাজি নই।[1]
ইয়াহইয়া ইবন সাঈদ আল-কাত্তান (১৯৮ হি.) বলেন : ‘‘নেককার বুযুর্গরা রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর হাদীসের বিষয়ে যত বেশি মিথ্যা বলেন অন্য কোনো বিষয়ে তাঁরা এমন মিথ্যা বলেন না।’’ ইমাম মুসলিম (২৬১ হি) এ কথার ব্যাখ্যায় বলেন: এ সকল নেককার মানুষেরা ইচ্ছা করে মিথ্যা বলেন না, কিন্তু বেখেয়ালে তাঁরা মিথ্যাচারে লিপ্ত হন। কারণ তাঁরা হাদীস সঠিকভাবে মুখস্থ রাখতে পারেন না, উল্টে পাল্টে ফেলেন, অধিকাংশ সময় মনের আন্দাজে হাদীস বলেন, ফলে অনিচ্ছাকৃতভাবে মিথ্যাচারে লিপ্ত হন।’’[2]
ইবনুস সালাহ (৬৪৩ হি), নাবাবী (৬৭৬ হি), ইরাকী (৮০৬) ও অন্যান্য মুহাদ্দিস অনিচ্ছাকৃত মিথ্যার একটি উদাহরণ উল্লেখ করেছেন। এ অনিচ্ছাকৃত মিথ্যা হাদীসটি ইমাম ইবনু মাজাহ্ তাঁর সুনানে সংকলন করেছেন। তিনি বলেন: আমাদেরকে ইসমাঈল ইবনু মুহাম্মাদ আত-তালহী বলেছেন, আমাদেরকে সাবিত ইবনু মূসা আবু ইয়াযিদ বলেছেন, তিনি শারীক থেকে, তিনি আ’মাশ থেকে, তিনি আবু সুফিয়ান থেকে, তিনি জাবির (রা) থেকে, তিনি বলেছেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন:
مَنْ كَثُرَتْ صَلاَتُهُ بِاللَّيْلِ حَسُنَ وَجْهُهُ بِالنَّهَارِ
‘‘যার রাতের সালাত অধিক দিবসে তার চেহারা সৌন্দর্যময় হয়।’’[3]
মুহাদ্দিসগণ তুলনামূলক নিরীক্ষার মাধ্যমে নিশ্চিতরূপে জানতে পেরেছেন যে, এ কথা রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর নামে বানোয়াট কথা। তবে তা ইচ্ছাকৃত মিথ্যা না অনিচ্ছাকৃত মিথ্যা সে বিষয়ে তাঁরা মতভেদ করেছেন।
ইবনু মাজাহর উস্তাদ ইসমাঈল ও অন্যান্য অনেক মুহাদ্দিস এ হাদীসটি আবু ইয়াযিদ সাবিত ইবনু মূসা ইবনু আব্দুর রাহমান (২২৯ হি) থেকে শুনেছেন ও লিখেছেন। একমাত্র তিনিই এ হাদীসটির বর্ণনাকারী। তিনি দাবী করেন যে, শারীক ইবনু আব্দুল্লাহ (১৭৮ হি) তাকে এ হাদীসটি বলেছেন।
মুহাদ্দিসগণ শারীকের সকল ছাত্রের হাদীস, শারীকের উস্তাদ সুলাইমান ইবনু মিহরান আল-আ’মাশ (১৪৭ হি)-এর সকল ছাত্রের হাদীস, আ’মাশের উস্তাদ আবু সুফিয়ান তালহা ইবনু নফি’-এর সকল ছাত্রের হাদীস এবং জাবির (রা)-এর অন্যান্য ছাত্রের হাদীস সংগ্রহ করে তুলনা করেছেন এবং নিশ্চিত হয়েছেন যে এ হাদীসটি একমাত্র সাবিত ছাড়া কেউ বর্ণনা করেন নি। তাঁরা দেখেছেন যে, ‘সাবিত’ ‘শারীক’-এর এমন কোনো ঘনিষ্ঠ ছাত্র বা দীর্ঘকালীন সহচর ছিলেন না যে, শারীক অন্য কোনো ছাত্রকে না বলে শুধুমাত্র তাঁকেই এ হাদীসটি বলবেন। এছাড়া সাবিত বর্ণিত অন্যান্য হাদীস নিরীক্ষা করে তাঁরা সেগুলোর কিছু কিছু হাদীসে মারাত্মক ভুল দেখতে পেয়েছেন। এভাবে সামগ্রিক নিরীক্ষার মাধ্যমে তাঁরা নিশ্চিত হয়েছেন যে, সাবিত ইচ্ছাকৃত বা অনিচ্ছাকৃতভাবে মিথ্যা বলেছেন।
সাবিত ইবনু মূসা তৃতীয় হিজরী শতকের একজন নেককার আবিদ ও দরবেশ ছিলেন। তাঁর ধার্মিকতার কারণে সাধারণভাবে অনেক মুহাদ্দিস তাঁর প্রতি ভাল ধারণা পোষণ করতেন। তবে তুলনামূলক নিরীক্ষার মাধ্যমে তাঁরা দেখেছেন যে, তাঁর বর্ণিত হাদীসের মধ্যে বেশ কিছু হাদীস ভুল বা মিথ্যা বলে প্রমাণিত। তিনি যে সকল উস্তাদের সূত্রে হাদীসগুলো বলছেন, সে সকল উস্তাদের দীর্ঘদিনের বিশেষ ছাত্র বা অন্য কোনো ছাত্র সে হাদীস বলছেন না। এজন্য কোনো কোনো মুহাদ্দিস তাকে ‘মিথ্যাবাদী’ বলেছেন। ইমাম ইয়াহইয়া ইবনু মাঈন (২৩৩ হি) সাবিত সম্পর্কে বলেন: ‘তিনি মিথ্যাবাদী’।[4]
পক্ষান্তরে আবু হাতিম রাযী (২৭৭ হি), ইবনু আদী (৩৬৫ হি) প্রমুখ মুহাদ্দিস সাবিতের এ মিথ্যাকে ‘অনিচ্ছাকৃত’ বলে মনে করেছেন। তাঁরা বলেন যে, সাবিত মূলত হাদীস বর্ণনাকারী ছিলেন না। সাধারণ আবিদ ছিলেন। তিনি ৭/৮ টি হাদীস বর্ণনা করেছেন। এগুলোর মধ্যে দুটি হাদীস বাদে বাকীগুলো তিনি ঠিকমতই বর্ণনা করেছেন। এতে মনে হয় তাঁর ভুল অনিচ্ছাকৃত। এজন্য তাঁরা তাকে সুস্পষ্টভাবে ‘মিথ্যাবাদী’ না বলে ‘দুর্বল’ বলেছেন।[5]
কোনো কোনো মুহাদ্দিস সাবিতের ‘অনিচ্ছাকৃত মিথ্যা’র কারণ উল্লেখ করেছেন। মুহাম্মাদ ইবনু আব্দুল্লাহ ইবনু নুমাইর (২৩৪ হি) বলেন, হাদীসটি বাতিল। সাবিত বুঝতে না পেরে হাদীসটি বলেছেন। শারীক ইবনু আব্দুল্লাহ হাসি-মশকরা করতে ভালবাসতেন। আর সাবিত ছিলেন নেককার আবিদ মানুষ। সম্ভবত, শারীক যখন হাদীস বলছিলেন তখন সাবিত সেখানে উপস্থিত হন। শারীক বলছিলেন: আমাদেরকে আ’মাশ, তিনি আবু সুফিয়ান থেকে, তিনি জাবির (রা) থেকে, তিনি রাসূলুল্লাহ ﷺ থেকে। এমতাবস্থায় সাবিত সেখানে প্রবেশ করেন। সাবিতকে দেখে শারীক হাদীস বলা বন্ধ করে তার সরলতা মন্ডিত উজ্জল চেহারা লক্ষ্য করে বলেন: ‘যার রাতের সালাত অধিক হয়, দিবসে তার চেহারা সৌন্দর্যময় হয়।’ শারীকের এ কথা সাবিত ভুলবশত উপরের সনদে বর্ণিত হাদীস মনে করেন। এভাবে তিনি শারীকের একটি কথাকে ভুলবশত রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর কথা বলে বর্ণনা করেন। এ কারণে ইবনু সালাহ, নাবাবী, ইরাকী ও অন্যান্য কোনো কোনো মুহাদ্দিস এ হাদীসটিকে ‘অনিচ্ছাকৃত মিথ্যা’-র উদাহরণ হিসাবে পেশ করেছেন।[6]
[2] মুসলিম, আস-সহীহ ১/১৭-১৮; ইবনু আদী, আল-কামিল ২/১৯২, ২১৩-২১৪, ৩০১, ৩/৩৩৫, ৪/১১৪-১২০, ১৭৪-১৭৬, ৩৫১, ৩৯৯-৪০৩, ৬/১৭৪-১৯৫, ৭/২৩০।
[3] ইবনু মাজাহ, আস-সুনান ১/৪২২।
[4] যাহাবী, মীযানুল ই’তিদাল ২/৮৯, ইবনু হাজার, তাহযীবুত তাহযীব ২/১৪।
[5] ইবনু আদী, আল-কামিল ২/৯৯; যাহাবী, মীযানুল ই’তিদাল ২/৮৯।
[6] ইবনু আদী, আল-কামিল ২/৯৯, যাহাবী; মীযানুল ই’তিদাল ২/৮৮; ইরাকী, আত-তাকয়ীদ, পৃ: ১২৯; ফাতহুল মুগীস, পৃ: ১২৭, ১২৮; সুয়ূতী, তাদরীবুর রাবী ১/২৮৭।
‘নেককার’ বলে পরিচিত কিছু মানুষ এর চেয়েও জঘন্য কাজে লিপ্ত হতেন। তারা ইচ্ছাকৃতভাবে বানোয়াট কথা রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর নামে বলতেন। হাদীস জালিয়াতিতে এরাই ছিলেন সবচেয়ে ভয়ঙ্কর ও ক্ষতিকারক। তারা যে সকল বিষয়ে হাদীস বানিয়েছেন, তার অনেক বিষয়ে অনেক সহীহ হাদীস রয়েছে। কিন্তু এসকল নেককার (!) মানুষ অনুভব করেছেন যে, এ সকল সহীহ হাদীসের ভাষা ও সেগুলিতে বর্ণিত পুরস্কার বা শাস্তিতে মানুষের আবেগ আসে না। তাই তারা আরো জোরালো ভাষায়, বিস্তারিত কথায়, অগণিত পুরস্কার ও কঠিনতম শাস্তির কথা বলে হাদীস বানিয়েছেন, যেন মানুষেরা তা শুনেই প্রভাবিত হয়ে পড়ে। এভাবে তাঁরা ‘ওহীর’ অপূর্ণতা (!) মানবীয় বুদ্ধি দিয়ে পূরণ (!) করতে চেয়েছেন। সবচেয়ে কঠিন বিষয়, তাদের ‘ধার্মিকতা’র কারণে সমাজের অনেক মানুষই তাদের এসকল জালিয়াতির খপ্পরে পড়তেন। তাঁরা এগুলোকে হাদীস বলে বিশ্বাস করেছেন। শুধুমাত্র ‘নাকিদ’ মুহাদ্দিসগণ তুলনামূলক নিরীক্ষার মাধ্যমে তাদের জালিয়াতি ধরেছেন।
শয়তান এদেরকে বুঝিয়েছিল যে, আমরা তো রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর বিরুদ্ধে নয়, পক্ষেই মিথ্যা বলছি। এ সকল মিথ্যা ছাড়া মানুষদের হেদায়েত করা সম্ভব নয়। কাজেই ভাল উদ্দেশ্যে মিথ্যা বলা শুধু জায়েযই নয় বরং ভাল কাজ। শয়তান তাদেরকে বুঝতে দেয় নি যে, মিথ্যা ছাড়া মানুষদেরকে ভাল পথে আনা যাবে না একথা ভাবার অর্থ হলো, ওহী মানুষের হেদায়েত করতে সক্ষম নয় বলে চিন্তা করা! কুরআন-হাদীস তার কার্যকরিতা হারিয়ে ফেলেছে। কাজেই আজগুবি মিথ্যা দিয়ে মানুষকে হেদায়েত করতে হবে! কি জঘন্য চিন্তা!
তাদের এসব মনগড়া কথা যে, ওহীর পক্ষে বা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের (ﷺ) পক্ষে সে কথা দাবী করার অধিকার তাদের কে দিয়েছে? তারা যে কথাকে ইসলামের পক্ষে বলে বলে মনে করেছে তা সর্বদা ইসলামের সবচেয়ে বেশি ক্ষতি করেছে। আজগুবি গল্প, অল্প কাজের অকল্পনীয় সাওয়াব, সামান্য অন্যায়ের বা পাপের ঘোরতর শাস্তি, সৃষ্টির বিভিন্ন বিষয় নিয়ে কাল্পনিক কাহিনী, কাল্পনিক অলৌকিক কাহিনী, বিভিন্ন বানোয়াট ফযীলতের কাহিনী ইত্যাদি মুসলিম উম্মাহকে ইসলামের মূল শিক্ষা থেকে বিচ্যুত করেছে। অগণিত কুসংস্কার ছড়িয়েছে তাদের মধ্যে। নফল ‘ইবাদতের’ সাওয়াবে বানানো মনগড়া সাওয়াবের কল্প কাহিনী মুসলিম উম্মাহকে ফরয দায়িত্ব ভুলিয়ে দিয়েছে। অগণিত মনগড়া ‘আমল’ মুসলমানদেরকে কুরআন ও সহীহ হাদীসে বর্ণিত কর্ম থেকে দূরে সরিয়ে দিয়েছে। আমরা পরবর্তী অধ্যায়ে বানোয়াট হাদীসগুলো আলোচনার সময় এসবের অনেক উদাহরণ দেখতে পাব।
‘ওহীর পক্ষে মিথ্যা বলার’ কারণেই যুগে যুগে সকল ধর্ম বিকৃত হয়েছে। ওহীর পক্ষে মিথ্যা বলে বিভ্রান্ত হওয়ার প্রকৃষ্ট উদাহরণ খৃস্টধর্মের বিকৃতিকারী পৌল নামধারী শৌল এবং তার অনুসারী খৃস্টানগণ। এরা ‘ঈশ্বরের’ মর্যাদা বৃদ্ধির জন্য, ‘যীশু’-র মর্যাদা বৃদ্ধির জন্য ও অধিক সংখ্যক মানুষকে ‘সুপথে’ আনয়ন করার জন্য ওহীর নামে মিথ্য বলেছে। এরা ভেবেছে যে, আমরা ঈশ্বরের বা যীশুর পক্ষে বলছি, কাজেই এ মিথ্যায় কোনো দোষ নেই। কিন্তু তারা মূলত শয়তানের খেদমত করেছে। আল্লাহ বলেন:
قُلْ يَاأَهْلَ الْكِتَابِ لا تَغْلُوا فِي دِينِكُمْ غَيْرَ الْحَقِّ وَلا تَتَّبِعُوا أَهْوَاءَ قَوْمٍ قَدْ ضَلُّوا مِنْ قَبْلُ وَأَضَلُّوا كَثِيرًا وَضَلُّوا عَنْ سَوَاءِ السَّبِيلِ
‘‘বল হে কেতাবীগণ, তোমরা তোমাদের দীন (ধর্ম) সম্বন্ধে অন্যায় বাড়াবাড়ি করো না; এবং যে-সম্প্রদায় ইতোপূর্বে পথভ্রষ্ট হয়েছে, অনেককে পথভ্রষ্ট করেছে এবং সরলপথ থেকে বিচ্যুত হয়েছে তাদের খেয়াল-খুশীর অনুসরণ করো না।’’[1]
মুসলিম উম্মাহর মধ্যেও এ ধরনের পথভ্রষ্ট খেয়াল-খুশীমত ওহী বানানো সম্প্রদায়ের অস্তিত্ব দেখা দিয়েছে। তবে সনদ ও সনদ নিরীক্ষা ব্যবস্থার ফলে এদের জালিয়াতি ধরা পড়ে গিয়েছে। এ সকল ‘নেককার জালিয়াত’ বিভিন্ন পদ্ধতিতে হাদীস তৈরি করতেন।
ক. কিছু মানুষ কুরআন এবং কুরআনের বিভিন্ন সূরা তিলাওয়াতের ‘অগণিত’ কাল্পনিক সাওয়াব বর্ণনা করে হাদীস তৈরি করতেন।
খ. অন্য অনেকে প্রসিদ্ধ ও প্রচলিত বিভিন্ন নেক আমলের সাওয়াব বর্ণনায় হাদীস তৈরি করতেন। যেমন তাসবীহ, যিকির, তাহাজ্জুদ, চাশত ইত্যাদি ইবাদতের জন্য সহীহ হাদীসে অনেক সাওয়াব বর্ণিত হয়েছে। তারা মনে করতেন যে, এসকল হাদীস মানুষের চিত্তাকর্ষণ করতে পারে না। এজন্য এ সকল বিষয়ে ‘আকর্ষণীয়’ হাদীস তৈরি করতেন। অনুরূপভাবে সুন্নাতের পক্ষে ও বিদ‘আতের বিপক্ষে অনেক সহীহ হাদীস রয়েছে। এ সকল জালিয়াত সেগুলোতে খুশি হতে পারেন নি। তাঁরা সুন্নাতের সাওয়াব, মর্যাদা এবং বিদ‘আতের পাপ ও বিদ‘আতীদের কঠিন পরিণতি ও ভয়ঙ্কর শাস্তির বিষয়ে অনেক হাদীস বানিয়েছেন।
গ. কেউ কেউ বিভিন্ন প্রকারের ‘নেক আমল’ তৈরি করে তার ফযীলতে হাদীস বানাতেন। যেমন বিভিন্ন মাসের জন্য বিশেষ পদ্ধতির সালাত, সপ্তাহের প্রত্যেক দিনের জন্য বিশেষ সালাত, আল্লাহকে স্বপ্নে দেখা, রাসূলুল্লাহ ﷺ-কে স্বপ্নে দেখা, জান্নাতে নিজের স্থান দেখা ইত্যাদি উদ্দেশ্য সাধনের জন্য বিশেষ সালাত। অনুরূপভাবে বিভিন্ন ‘দরুদ’, ‘যিকির’, ‘দোয়া’, ‘মুনাজাত’ ইত্যাদি বানিয়ে সেগুলোর বানোয়াট ফযীলত উল্লেখ করে হাদীস তৈরি করেছেন। এরূপ অগণিত ‘ইবাদত’ তারা তৈরি করেছেন এবং এগুলির ফযীলতে কল্পনার ফানুস উড়িয়ে অগণিত সাওয়াব ও ফযীলতের কাহিনী বলেছেন।
ঘ. অনেক মানুষের অন্তর নরম করার জন্য সংসার ত্যাগ, লোভ ত্যাগ, ক্ষুধার ফযীলত, দারিদ্রে্যর ফযীলত, বিভিন্ন কাহিনী, শাস্তি, পুরস্কার বা অনুরূপ গল্প কাহিনী বানিয়ে রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর নামে চালিয়েছেন।
এখানে এ ধরনের দু’এক ব্যক্তির স্বীকারোক্তি উল্লেখ করছি। এ সকল মানুষ মুহাদ্দিসগণের কাছে তাদের মিথ্যা সনদগুলো প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করত। তবে তাঁদের নিরীক্ষামূলক প্রশ্নের মুখে অনেক সময় স্বীকার করতো যে, তারা হাদীস জালিয়াতি করেছে।
দ্বিতীয় হিজরী শতকের একজন প্রখ্যাত আলিম, আবিদ ও ফকীহ আবু ইসমাহ নূহ ইবনু আবু মারিয়াম (১৭৩ হি)। হাদীস, ফিকহ, ইতিহাস ইত্যাদি বিভিন্ন বিষয়ে তার চৌকস পান্ডিত্যের কারণে তাকে ‘আল-জামি’ বলা হতো। খলীফা মানসূরের সময়ে (১৩৬-১৫৮ হি) তাকে খোরাসানের মারভ অঞ্চলের বিচারপতি নিয়োগ করা হয়। তাকে সে এলাকার অন্যতম আলিম বলে গণ্য করা হতো। মু’তাযিলা, জাহমিয়া, আহলুর রাই ফকীহ ও বিদ‘আতী সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে তিনি কঠোর ছিলেন।
এত কিছু সত্ত্বেও তিনি হাদীসের নামে মিথ্যা কথা বলতেন। তিনি কুরআনের বিভিন্ন সূরার ফযীলতে কিছু হাদীস বর্ণনা করতেন। মুহাদ্দিসগণ তাকে প্রশ্ন করেন: আপনি ইকরিমাহ থেকে আব্দুল্লাহ ইবনু আববাস থেকে কুরআনের প্রত্যেক সূরার ফযীলতে যে হাদীস বলেন তা আপনি কোথায় পেলেন? ইকরিমাহ-এর ঘনিষ্ট ছাত্রগণ বা অন্য কোনো ছাত্র এ হাদীস বর্ণনা করেন না, অথচ আপনি কিভাবে তা পেলেন? তখন তিনি বলেন: আমি দেখলাম, মানুষ কুরআন ছেড়ে দিয়েছে। তারা আবু হানীফার ফিকহ এবং ইবনু ইসহাকের মাগাযী নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। এজন্য আমি তাদেরকে কুরআনের দিকে ফিরিয়ে আনতে এ হাদীস বানিয়েছি।[2]
তৃতীয় হিজরী শতকের প্রসিদ্ধ আবিদ, আলিম ও ওয়ায়িয আহমাদ ইবনু মুহাম্মাদ ইবনু গালিব গুলাম খালীল (২৭৫ হি)। তিনি রাজধানী বাগদাদের অন্যতম শ্রেষ্ঠ সংসারত্যাগী আবিদ বলে প্রসিদ্ধ ছিলেন। তিনি সর্বদা শাক সব্জি খেতেন, অতি সাধারণ জীবন যাপন করতেন এবং অত্যন্ত হৃদয়গ্রাহী ওয়ায করতেন। ‘আহলুর রাই’ বলে কথিত (হানাফী) ফকীহগণের বিরুদ্ধে, মু’তাযিলা, শিয়া, কাদারিয়া, জাবারিয়া ও অন্যান্য বিদআতী মতের বিরুদ্ধে তিনি ছিলেন অত্যন্ত কঠোর। সাধারণের মধ্যে তার ওয়াজের প্রভাব ছিল অনেক। শ্রোতাদের মন নরম করতে ও তাদের হেদায়েতের উদ্দেশ্যে তিনি নিত্যনতুন গল্প কাহিনী হাদীসের নামে জালিয়াতি করে বলতেন। প্রসিদ্ধ মুহাদ্দিসগণের নামে সনদ তৈরি করে তিনি মিথ্যা হাদীসগুলো বলতেন।
আবু জা’ফার ইবনুশ শুআইরী বলেন, একদিন গুলাম খালীল হাদীস বলতে গিয়ে বলেন, আমাকে বাকর ইবনু ঈসা (২০৪ হি) বলেছেন, তিনি আবু উওয়ানা থেকে....। আমি বললাম, বাকর ইবনু ঈসা তো অনেক পুরাতন মানুষ। ইমাম আহমাদ (২৪১ হি) ও তাঁর প্রজন্মের মানুষেরা তার কাছ থেকে হাদীস শুনেছেন। আপনি তাকে জীবিত দেখেন নি। একথা বলার পরে তিনি চুপ করে চিন্তা করতে থাকেন। আমি ভয় পেয়ে গেলাম। তিনি আমার বিরুদ্ধে কিছু বলে ফেলেন কিনা। এজন্য আমি বললাম: হতে পারে যে, আপনার উস্তাদ বাকর ইবনু ঈসা অন্য আরেক ব্যক্তি। তিনি চুপ করে থাকলেন। পরদিন তিনি আমাকে বললেন: আমি গতরাতে চিন্তা করে দেখেছি, বসরায় আমি ‘বাকর ইবনু ঈসা’ নামের ৬০ ব্যক্তির কাছ থেকে হাদীস শুনেছি![3]
মিথ্যার বাহাদুরি দেখুন! হাদীসের ‘নকিদ’ ইমামদের কাছে এ ধরনের ‘ঠান্ডা’ মিথ্যার কোনো মূল্য নেই। বসরায় কোন্ যুগে কতজন ‘রাবী’ ছিলেন নামধামসহ তাদের বর্ণিত হাদীস তারা সংগ্রহ ও সংকলিত করেছেন। এজন্য এরা অনেক সময় এঁদের কাছে জালিয়াতি স্বীকার করতে বাধ্য হতো।
চতুর্থ শতকের অন্যতম মুহাদ্দিস আব্দুল্লাহ ইবনু আদী (৩৬৫ হি) বলেন, হাদীস সংগ্রহের সফরে যখন হার্রান শহরে ছিলাম তখন আবু আরূবার মাজলিসে আবু আব্দুল্লাহ নাহাওয়ান্দী বলেন, আমি গুলাম খালীলকে বললাম, শ্রোতাদের হৃদয়-কাড়া যে হাদীসগুলো বলছেন সেগুলো কোথায় পেলেন? তিনি বলেন: মানুষের হৃদয় নরম করার জন্য আমি এগুলো বানিয়েছি।[4]
এ সকল নেককার মানুষের জালিয়াতির ক্ষতি সম্পর্কে হাদীস শাস্ত্রের সকল ইমামই আলোচনা করেছেন। ইতোপূর্বে আমরা এ বিষয়ে ইবনুস সালাহ, নাবাবী ও ইরাকীর বক্তব্য দেখেছি। এ বিষয়ে আল্লামা সাইয়্যেদ শরীফ জুরজানী হানাফী (৮১৬ হি.) লিখেছেন: ‘‘মাওযূ বা বানোয়াট হাদীসের প্রচলনে সবচেয়ে ক্ষতি করেছেন দুনিয়াত্যাগী দরবেশগণ, তাঁরা অনেক সময় সাওয়াবের নিয়্যাতেও মিথ্যা হাদীস বানিয়ে বলেছেন।’’[5]
ইবন হাজার আসকালানী (৮৫২ হি.) বলেন : ‘‘বর্ণিত আছে যে, কোনো কোনো সূফী সাওয়াবের বর্ণনায় ও পাপাচারের শাস্তির বর্ণনায় মিথ্যা হাদীস বানানো ও প্রচার করা জায়েয বলে মনে করতেন।’’[6]
সুয়ূতী (৯১১ হি) বলেন, জালিয়াতির উদ্দেশ্য অনুসারে মিথ্যাবাদী জালিয়াতগণ বিভিন্ন প্রকারের। এদের মধ্যে সবচেয়ে মারাত্মক ও ক্ষতিকর ছিলেন কিছু মানুষ যাদেরকে সংসারত্যাগী নির্লোভ নেককার বলে মনে করা হতো। তাঁরা তাঁদের বিভ্রান্তির কারণে আল্লাহর কাছে সাওয়াব পাওয়ার আশায় মিথ্যা হাদীস বানাতেন।... (২য় শতকের প্রখ্যাত দরবেশ) আবু দাউদ নাখয়ী সুলাইমান ইবনু আমর রাত জেগে তাহাজ্জুদ আদায়ে ও দিনের পর দিন নফল সিয়াম পালনে ছিলেন অতুলনীয়। তা সত্ত্বেও তিনি মিথ্যা হাদীস বানিয়ে প্রচার করতেন।... আবু বিশর আহমাদ ইবনু মুহাম্মাদ আল-মারওয়াযী খোরাসানের অন্যতম ফকীহ, আবিদ ও সুন্নাতের সৈনিক ছিলেন। সুন্নাতের পক্ষে এবং বিদ‘আত ও বিদ‘আতপন্থীদের বিরুদ্ধে তিনি ছিলেন খড়গহস্ত। কিন্তু তিনি মিথ্যা কথাকে হাদীসের নামে প্রচার করতেন। ... ওয়াহ্ব ইবনু ইয়াহইয়া ইবনু হাফস (২৫০ হি) তার যুগের অন্যতম নেককার আবিদ ও ওয়ায়িয ছিলেন। ২০ বছর তিনি কারো সাথে কোনো জাগতিক কথা বলেন নি। তিনিও হাদীসের নামে জঘন্য মিথ্যা কথা বলতেন।[7]
আল্লামা আলী কারী (১০১৪ হি.) লিখেছেন: অত্যধিক ইবাদত বন্দেগিতে লিপ্ত সংসারত্যগী দরবেশগণ শবে-বরাতের নামায, রজব মাসের নামায ইত্যাদি বিভিন্ন ফযীলতের বিষয়ে অনেক বানোয়াট কথা হাদীস নামে প্রচার করেছেন। তাঁরা মনে করতেন এতে তাঁদের সাওয়াব হবে, দীনের খেদমত হবে। বানোয়াট হাদীসের ক্ষেত্রে নিজেদের এবং অন্যান্য মুসলমানদের সবচেয়ে বেশি ক্ষতি করেছেন এ সকল মানুষ। তাঁরা এ কাজকে নেককাজ ও সাওয়াবের কাজ মনে করতেন, কাজেই তাঁদেরকে কোনো প্রকারেই বিরত রাখা সম্ভব ছিল না। অপরদিকে তাঁদের নেককর্ম, সততা, ইবাদত বন্দেগি ও দরবেশীর কারণে সাধারণ মুসলিম ও আলিমগণ তাঁদের ভালবাসতেন ও অত্যন্ত শ্রদ্ধা করতেন। তাঁদের কথাবার্তা আগ্রহের সাথে গ্রহণ করতেন ও বর্ণনা করতেন। অনেক সময় ভালো মুহাদ্দিসও তাঁদের আমল আখলাকে ধোঁকা খেয়ে তাঁদের বানোয়াটি ও মিথ্যা হাদীস অসতর্কভাবে গ্রহণ করে নিতেন।[8]
[2] ইবনুল জাওযী, আল-মাউদূআত ১/১৮; যাহাবী, মীযানুল ই’তিদাল ৭/৫৫-৫৭।
[3] যাহাবী, মীযানুল ই’তিদাল ১/২৮৫।
[4] ইবনু আদী, আল-কামিল ১/১৯৫।
[5] আব্দুল হাই লাখনবী, যাফরুল আমানী ফী মুখতাসারিল জুরজানী, ৪৩৩ পৃ:।
[6] মোললা আলী কারী, শারহু শারহি নুখবাতিল ফিকার, পৃ: ৪৫১।
[7] সুয়ূতী, তাদরীবুর রাবী ১/২৮১-২৮৩।
[8] মোললা আলী কারী, শারহু শারহি নুখবাতুল ফিকর, পৃ: ৪৪৭-৪৪৮।
উপর্যুক্ত উদ্দেশ্যগুলো মুলত ধর্মীয়। ধর্মীয় উদ্দেশ্য ছাড়াও জাগতিক বিভিন্ন উদ্দেশ্যে অনেক মানুষ হাদীস বানিয়েছেন। অর্থ কামাই, সম্মান বা সুনাম অর্জন, রাজা-বাদশাহদের দৃষ্টি আকর্ষণ, দরবারে মর্যাদা লাভ, রাজনৈতিক বা গোষ্ঠিগত প্রাধান্য প্রতিষ্ঠা ইত্যাদি উদ্দেশ্যে তারা হাদীস বানিয়েছেন।
শাসক-প্রশাসকদের কাছে যাওয়ার ও তাদের প্রিয়পাত্র হওয়ার জন্য মানুষ অনেক কিছুই করে থাকে। দ্বিতীয় হিজরী শতকে কোনো কোনো দুর্বল ঈমান ‘আলিম’ খলীফা বা আমীরদের মন জয় করার জন্য তাদের পছন্দ মোতাবেক হাদীস বানানোর চেষ্টা করেছেন। এ ধরনের একটি ঘটনার বর্ণনা দিয়ে তৃতীয় হিজরী শতকের প্রসিদ্ধ মুহাদ্দিস যুহাইর ইবনু হারব (২৩৪ হি) বলেন: তৃতীয় আববাসী খলীফা মুহাম্মাদ মাহ্দী (রাজত্ব ১৫৮-১৬৯ হি)-এর দরবারে কয়েকজন মুহাদ্দিস আগমন করেন। তাঁদের মধ্যে একজন ছিলেন গিয়াস ইবনু ইবরাহীম আন-নাখয়ী। খলীফা মাহ্দী উন্নত জাতের কবুতর উড়াতে ও কবুতরের প্রতিযোগিতা করাতে ভালবাসতেন। খলীফার পছন্দের দিকে লক্ষ্য করে গিয়াস নামক এ ব্যক্তি তার সনদ উল্লেখ করে বলেন, রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন, ‘তীর নিক্ষেপ, ঘোড়া ও পাখি ছাড়া আর কিছুতে প্রতিযোগিতা নেই।’ একথা শুনে মাহদী খুশী হন এবং উক্ত মুহাদ্দিসকে ১০ হাজার টাকা হাদিয়া প্রদানের নির্দেশ দেন। কিন্তু যখন গিয়াস দরবার ত্যাগ করছিলেন তখন মাহদী বলেন, আমি বুঝতে পারছি যে, আপনি মিথ্যা বলেছেন। আমি আপনাকে মিথ্যা বলতে প্ররোচিত করেছি। তিনি কবুতরগুলো জবাই করতে নির্দেশ দেন। তিনি আর কখনো উক্ত মুহাদ্দিসকে তার দরবারে প্রবেশ করতে দেন নি।[1]
এখানে লক্ষণীয় যে, মূল হাদীসটি সহীহ, যাতে ঘোড়দৌড়, উটদৌড় ও তীর নিক্ষেপে প্রতিযোগিতা ও পুরস্কার প্রদানে উৎসাহ দেয়া হয়েছে।[2] এ ব্যক্তি খলীফার মনোরঞ্জনের জন্য সেখানে ‘পাখি’ শব্দটি যোগ করেছে।
পঞ্চম আববাসী খলীফা হারূন আর-রাশীদ (শাসনকাল ১৯৩-১৭০ হি) রাষ্ট্রীয় সফরে মদীনা আগমন করেন। তিনি মসজিদে নাবাবীর মিম্বারে উঠে বক্তৃতা প্রদানের ইচ্ছা করেন। তাঁর পরনে ছিল কাল শেরোয়ানী। তিনি এ পোশাকে মিম্বারে নাবাবীতে আরোহণ করতে দ্বিধা করছিলেন। মদীনার মশহুর আলিম ও বিচারক ওয়াহ্ব ইবনু ওয়াহ্ব আবুল বুখতুরী তখন বলেন: আমাকে জা’ফর সাদিক বলেছেন, তাঁকে তাঁর পিতা মুহাম্মাদ আল-বাকির বলেছেন, জিবরাঈল (আঃ) কালো শেরোয়ানী পরিধান করে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে আগমন করেন।[3]
এভাবে তিনি খলীফার মনোরঞ্জনের জন্য একটি মিথ্যা কথাকে হাদীস বলে চালালেন। আবুল বুখতুরী হাদীস জালিয়াতিতে খুবই পারদর্শী ছিলেন।
[2] তিরমিযী, মুহাম্মাদ ইবনু ঈসা (২৭৯ হি), আস-সুনান ৪/২০৫।
[3] খতীব বাগদাদী, তারীখ বাগদাদ ১৩/৪৫২।
ওয়াযের মধ্যে শ্রোতাদের দৃষ্টি-আকর্ষণ, মনোরঞ্জন, তাদের মধ্যে প্রভাব বিস্তার ও নিজের সুনাম, সুখ্যাতি ও নগদ উপার্জন বৃদ্ধির জন্য অনেক মানুষ ওয়াযের মধ্যে বানোয়াট কথা হাদীস নামে বলেছেন। মিথ্যা ও জাল হাদীসের প্রসারে এসকল ওয়ায়েয ও গল্পকারদের ভূমিকা ছিল খুব বড়। হাদীসের নামে মিথ্যা কথা বানিয়ে বলতে এদের দুঃসাহস ও প্রত্যুৎপন্নমতিতা ছিল খুবই বেশি। তাদের অনেকেই শ্রোতাদের অবাক করে পকেট খালি করার জন্য শ্রোতাদের চাহিদা মত মিথ্যা বানিয়ে নিতেন দ্রুত। এছাড়া কোনো জালিয়াতের জাল হাদীস বা গল্প কাহিনী আকর্ষণীয় হলে অন্যান্য ওয়ায়িয জালিয়াতরা তা চুরি করত এবং নিজের নামে সনদ বানিয়ে প্রচার করত।[1]
এদের বুদ্ধি ও দুঃসাহসের নমুনা দেখুন। তৃতীয় হিজরী শতকের অন্যতম শ্রেষ্ঠ মুহাদ্দিস ইমাম ইয়াহইয়া ইবনু মাঈন (২৩৩ হি) ও ইমাম আহমাদ ইবনু হাম্বাল (২৪১ হি)। তৃতীয় হিজরী শতকের প্রথমার্ধে বাগদাদে ও পুরো মুসলিম বিশ্বে তাঁদের পরিচিতি। তাঁরা দুজন একদিন বাগদাদের এক মসজিদে সালাত আদায় করেন। সালাতের পরে একজন ওয়ায়িয ওয়ায করতে শুরু করেন। ওয়াযের মধ্যে তিনি বলেন: আমাকে আহমাদ ইবনু হাম্বাল ও ইয়াহইয়া ইবনু মাঈন দুজনেই বলেছেন, তাঁদেরকে আব্দুর রাযযাক, তাঁকে মা’মার, তাকে কাতাদাহ, তাকে আনাস বলেছেন, রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন, যদি কেউ ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু’ বলে তবে এর প্রত্যেক অক্ষর থেকে একটি পাখি তৈরি করা হয়, যার ঠোঁট স্বর্ণের, পালকগুলো মহামূল্য পাথরের....। এভাবে সে তার আজগুবি গল্প ও অগণিত সাওয়াবের কাল্পনিক কাহিনী বর্ণনা করে। ওয়ায শেষে উপস্থিত শ্রোতাদের অনেকেই তাকে কিছু কিছু ‘হাদিয়া’ প্রদান করেন।
ওয়ায চলাকালীন সময়ে আহমাদ ও ইয়াহইয়া অবাক হয়ে একজন আরেকজনকে প্রশ্ন করেন, এ হাদীস কি আপনি সে ব্যক্তিকে বলেছেন? উভয়েই বলেন, জীবনে আজই প্রথম এ ‘হাদীস’টি শুনছি। ওয়ায শেষে মানুষের ভীড় কমে গেলে ইয়াহইয়া লোকটিকে কাছে আসতে ইঙ্গিত করেন। লোকটি কিছু হাদীয়া পাবে ভেবে তাড়াতাড়ি এগিয়ে আসে। ইয়াহইয়া তাকে জিজ্ঞাসা করেন, এ হাদীসটি তোমাকে কে বলেছেন? সে বলে: ইয়াহইয়া ইবনু মাঈন ও আহমাদ ইবনু হাম্বাল। তিনি বলেন: আমি তো ইয়াহইয়া এবং ইনি আহমাদ। আমরা দুজনের কেউই এ হাদীস জীবনে শুনিনি, কাউকে শেখানো তো দূরের কথা। মিথ্যা যদি বলতেই হয় অন্য কারো নামে বল, আমাদের নামে বলবে না। তখন লোকটি বলে, আমি সবসময় শুনতাম যে, ইয়াহইয়া ইবনু মাঈন একজন আহাম্মক এখন সে কথার প্রমাণ পেলাম। ইয়াহইয়া বলেন, কিভাবে? সে বলে, আপনারা কি মনে করেন যে, দুনিয়াতে আপনারা ছাড়া আর কোনো ইয়াহইয়া ইবনু মাঈন ও আহমাদ ইবনু হাম্বাল নেই? আমি আপনার সাথী আহমাদ ছাড়া ১৬ জন আহমাদ ইবনু হাম্বালের কাছ থেকে হাদীস শিক্ষা করেছি। একথা শুনে আহমাদ ইবনু হাম্বাল মুখে কাপড় দিয়ে বলেন, লোকটিকে যেতে দিন। তখন লোকটি দুজনের দিকে উপহাসের দৃষ্টিতে তাকিয়ে চলে গেল।[2]
৪র্থ হিজরী শতকের অন্যতম মুহাদ্দিস আবু হাতিম মুহাম্মাদ ইবনু হিববান আল-বুসতী (৩৫৪ হি) বলেন: আমি আমার হাদীস সংগ্রহের সফর কালে সিরিয়ার ‘তাজরোয়ান’ নামক শহরে প্রবেশ করি। শহরের জামে মসজিদে সালাত আদায়ের পরে এক যুবক দাঁড়িয়ে ওয়ায শুরু করে। ওয়াযের মধ্যে সে বলে: আমাকে আবু খালীফা বলেছেন, তাঁকে ওয়ালীদ বলেছেন, তাঁকে শু’বা বলেছেন, তাঁকে কাতাদা বলেছেন, তাঁকে আনাস (রা) বলেছেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন, যদি কেউ কোনো মুসলিমের প্রয়োজন পূরণ করে তাহলে আল্লাহ তাকে এত এত পুরস্কার প্রদান করবেন... এভাবে সে অনেক কথা বলে। তার কথা শেষ হলে আমি তাকে ডেকে বললাম, তোমার বাড়ি কোথায়? সে বলে: আমি বারদায়া এলাকার মানুষ। আমি বললাম, তুমি কি কখনো বসরায় গিয়েছ? সে বলল: না। আমি বললাম: তুমি কি আবু খালীফাকে দেখেছ? সে বলল: না। আমি বললাম: তাহলে কিভাবে তুমি আবু খালীফা থেকে হাদীস বর্ণনা করছ, অথচ তুমি তাকে কোনোদিন দেখনি? যুবকটি বলল: এ বিষয়ে প্রশ্ন করা ভদ্রতা ও আদবের খেলাফ। এ একটি মাত্র সনদই আমার মুখস্থ আছে। আমি যখনই কোনো হাদীস বা কথা কারো মুখে শুনি, আমি তখন সে কথার আগে এ সনদটি বসিয়ে দিয়ে কথাটি বর্ণনা করি। ইবনু হিববান বলেন, তখন আমি যুবকটিকে রেখে চলে আসলাম।[3]
৬ষ্ঠ হিজরী শতকের প্রখ্যাত মুহাদ্দিস আবুল ফারাজ ইবনুল জাওযী (৫৯৭ হি) বলেন, আমাদের এলাকায় একজন ওয়ায়িয আছেন। তিনি বাহ্যত পরহেযগার ও আল্লাহভীরু মানুষ। কাজে কর্মে দরবেশী ও তাকওয়া প্রকাশ করেন। তার বিষয়ে আমাকে আমার দুজন অত্যন্ত নির্ভরযোগ্য আলিম বন্ধু বলেছেন, এক আশুরার দিনে ঐ লোকটি বলেন, রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন, যে আশুরার দিনে এ কাজ করবে তার এই পুরস্কার, যে এ কাজ করবে তার এ পুরস্কার... এভাবে অনেক কাজের অনেক প্রকার পুরস্কার বিষয়ক অনেক হাদীস তিনি বলেন। আমরা জিজ্ঞাসা করলাম, এই হাদীসগুলো আপনি কোথা থেকে মুখস্থ করলেন? তিনি বলেন: আল্লাহর কসম, আমি কখনোই হাদীসগুলো শিখিনি বা মুখস্থ করিনি। এ মুহূর্তেই এগুলো আমার মনে এল এবং আমি বললাম।[4]
ইবনুল জাওযী বলেন, আমার সমকালীন একজন ওয়ায়িয এসব মিথ্যা হাদীস দিয়ে একটি বইও লিখেছে। সে বইয়ের একটি জাল হাদীস নিম্নরূপ:
একদিন হাসান (রা) ও হুসাইন (রা) খলীফা উমার (রা) এর ঘরের মধ্যে প্রবেশ করেন। উমার (রা) ব্যস্ত ছিলেন। হাতের কাজ শেষ করে মাথা উঠিয়ে তিনি তাঁদের দুজনকে দেখতে পান। তিনি উঠে দাঁড়িয়ে তাঁদেরকে চুমু খান, প্রত্যেককে ১০০০ মুদ্রা প্রদান করেন এবং বলেন, আমাকে ক্ষমা করুন, আমি আপনাদের আগমন বুঝতে পারিনি। তাঁরা দুজন ফিরে যেয়ে তাঁদের পিতা আলী (রা)-এর কাছে উমারের আদব ও বিনয়ের কথা উল্লেখ করেন। তখন আলী (রা) বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-কে বলতে শুনেছি, উমার ইবনুল খাত্তাব ইসলামের নূর ও জান্নাতবাসীদের প্রদীপ। তাঁরা দুজন উমারের কাছে ফিরে যেয়ে তাঁকে এ হাদীস শোনান। তখন তিনি কাগজ ও কালি চেয়ে নিয়ে লিখেন: বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম, জান্নাতের যুবকদের দুই নেতা আমাকে বলেছেন, তাঁরা তাঁদের পিতা আলী মুরতাযা থেকে, তাঁদের নানা নবী মুসতাফা (ﷺ) থেকে, তিনি বলেছেন, উমার ইসলামের নূর ও জান্নাতবাসীদের প্রদীপ। উমার ওসীয়ত করেন যে, তাঁর মৃত্যুর পরে যেন তাঁর কাফনের মধ্যে বুকের উপরে এ কাগজটি রাখা হয়। তাঁর মৃত্যুর পরে তাঁর ওসীয়ত মত কাজ করা হয়। পরদিন সকালে সকলে দেখতে পান যে, কাগজটি কবরের উপরে রয়েছে এবং তাতে লিখা রয়েছে: হাসান ও হুসাইন সত্য বলেছেন, তাঁদের পিতা সত্য বলেছেন, রাসূলুল্লাহ ﷺ সত্য বলেছেন, উমার ইসলামের নূর ও জান্নাতবাসীদের প্রদীপ।
ইবনুল জাওযী বলেন, সবচেয়ে দুঃখ ও আফসোসের বিষয় হলো, এ জঘন্য বানোয়াট মিথ্যা ও আজগুবি কথা লিখেই সে সন্তুষ্ট থাকে নি। আমাদের যুগের অনেক আলিমকে তা দেখিয়েছে। হাদীসের সনদ ও বিশুদ্ধতা বিষয়ক জ্ঞানের অভাব আলিমদের মধ্যেও এত প্রকট যে, অনেক আলিম এ জঘন্য মিথ্যাকেও সঠিক বলে উল্লেখ করেছেন।[5]
[2] ইবনুল জাওযী, আল-মাউদূআত ১/২১-২২।
[3] ইবনুল জাওযী, আল-মাউদূআত ১/২২।
[4] ইবনুল জাওযী, আল-মাউদূআত ১/২০।
[5] ইবনুল জাওযী, আল-মাউদূআত ১/২০-২১।
বিভিন্ন বংশ, জাতি, দেশ বা শহরের মানুষেরা নিজেদের প্রাধান্য ও মর্যাদা প্রতিষ্ঠার জন্য অনেক সময় জালিয়াতির আশ্রয় নিয়েছেন। আরব জাতি ও আরবী ভাষা এবং পারসিক জাতি ও ফার্সী ভাষার পক্ষে ও বিপক্ষে হাদীস জালিয়াতি করা হয়েছে। বিভিন্ন বর্ণের বা পেশার পক্ষে বা বিপক্ষে হাদীস বানানো হয়েছে। এ সকল বানোয়াট কথার মধ্যে রয়েছে: ‘আল্লাহর কাছে সবচেয়ে ঘৃণিত ভাষা হলো ফারসী ভাষা।’ ‘আল্লাহ যখন ক্রোধান্বিত হন তখন আরবীতে ওহী নাযিল করেন। আর যখন তিনি সন্তুষ্ট থাকেন তখন ফার্সী ভাষায় ওহী নাযিল করেন।’ ‘আরশের আশেপাশে যে সকল ফিরিশতা রয়েছেন তারা ফার্সী ভাষায় কথা বলেন।’ অনুরূপভাবে তাঁতীদের বিরুদ্ধে, স্বর্ণকারদের বিরুদ্ধে ও অন্যান্য পেশার বিরুদ্ধে কুৎসা ও নিন্দা মূলক হাদীস তৈরি করা হয়েছে পেশাগত হিংসাহিংসির কারণে।
বিভিন্ন শহর, দেশ বা জনপদের ফযীলতে বা নিন্দায় হাদীস বানানো হয়েছে। বলতে গেলে তৃতীয় হিজরী শতকের পরিচিত প্রায় সকল শহর ও দেশের প্রশংসায় বা নিন্দায় হাদীস বানানো হয়েছে। মক্কা, মদীনা ইত্যাদি যে সকল শহরের ফযীলতে সহীহ হাদীস রয়েছে সেগুলোর জন্যও অনেক ‘চিত্তাকর্ষক’ জাল হাদীস বানানো হয়েছে।[1]
আমরা বলেছি যে, তৎকালীন যুগে সনদ ও মতন ছিল হাদীসের অবিচ্ছেদ্য দুটি অংশ। সনদ ও মতনের সমন্বিত রূপকেই হাদীস বলা হত। এ সমন্বিতরূপের হাদীস মুহাদ্দিসগণের মধ্যে সুপরিচিত ছিল। অনেক সময় কোনো মুহাদ্দিস প্রসিদ্ধির বা স্বকীয়তার জন্য এ সমন্বিত রূপের মধ্যে পরিবর্তন করতেন। এক সনদের হাদীস অন্য সনদে বা এক রাবীর হাদীস অন্য রাবীর নামে বর্ণনা করতেন। মিথ্যার প্রকারভেদের মধ্যে আমরা মিথ্যা সনদ বানানোর বিষয়ে দু একটি উদাহরণ উল্লেখ করব, ইনশা আল্লাহ।