হাদীসের নামে জালিয়াতি শুভাশুভ, সাজসজ্জা, পানাহার ও বিবিধ ড. খোন্দকার আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর (রহ.) ১ টি

শুভাশুভ ও উন্নতি-অবনতি বিষয়ে ইসলামের নির্দেশনা

বিভিন্ন প্রচলিত ইসলামী গ্রন্থে এবং আমাদের সমাজের সাধারণ মুসলিমদের মধ্যে প্রচলিত বিশ্বাস আছে যে, অমুক দিন, বার, তিথি, সময় বা মাস অশুভ, অযাত্রা ইত্যাদি। অনুরূপভাবে মনে করা হয়, বিভিন্ন কাজের অশুভ ফল রয়েছে এবং এ সকল কাজের কারণে মানুষ দরিদ্র হয় বা মানুষের ক্ষতি হয়। এ বিশ্বাস বা ধারণা শুধু ইসলাম বিরোধী কুসংস্কারই নয়; উপরন্তু এরূপ বিশ্বাসের ফলে ঈমান নষ্ট হয় বলে হাদীস শরীফে বলা হয়েছে।

রাসূলুল্লাহ () অশুভ, অযাত্রা, অমঙ্গল ইত্যাদি বিশ্বাস করতে এবং যে কোনো বিষয়ে আগাম হতাশা এবং নৈরাশ্যবাদ (pessimism) অত্যন্ত অপছন্দ করতেন। পক্ষান্তরে তিনি সকল কাজে সকল অবস্থাতে শুভ চিন্তা, মঙ্গল-ধারণা ও ভাল আশা করা পছন্দ করতেন।[1] শুভ চিন্তা ও ভাল আশার অর্থ হলো আল্লাহর রহমতের আশা অব্যাহত রাখা। আর অশুভ ও অমঙ্গল চিন্তার অর্থ হলো আল্লাহর রহমত থেকে নিরাশ হওয়া। রাসূলুল্লাহ () বলেছেন:

الطِّيَرَة شِرْكٌ، الطِّيَرَةُ شِرْكٌ، الطِّيَرَةُ شِرْكٌ

‘‘অশুভ বা অযাত্রা বিশ্বাস করা বা নির্ণয়ের চেষ্টা করা শির্ক, অশুভ বা অযাত্রা বিশ্বাস করা বা নির্ণয়ের চেষ্টা করা শির্ক, অশুভ বা অযাত্রা বিশ্বাস করা বা নির্ণয়ের চেষ্টা করা শির্ক।[2]

এ বিষয়ে আরো অনেক হাদীস বর্ণিত হয়েছে।

আল্লাহ যা কিছু নিষিদ্ধ করেছেন তাই অমঙ্গলের কারণ। বান্দার জন্য অমঙ্গল বলেই তো আল্লাহ বান্দার জন্য তা নিষিদ্ধ করেছেন। এ সকল কর্মে লিপ্ত হলে মানুষ আল্লাহর রহমত ও বরকত থেকে বঞ্চিত হয়। আল্লাহর নিষিদ্ধ হারাম দুই প্রকারের: (১) হক্কুল্লাহ বা আল্লাহর হক্ক সম্পর্কিত হারাম ও (২) হক্কুল ইবাদ বা সৃষ্টির অধিকার সম্পর্কিত হারাম। দ্বিতীয় প্রকারের হারামের জন্য মানুষকে আখেরাতের শাস্তি ছাড়াও দুনিয়াতে পার্থিব ক্ষতির মাধ্যমে শাস্তি পেতে হবে বলে বিভিন্ন হাদীসের আলোকে জানা যায়। জুলুম করা, কারো সম্পদ তার ইচ্ছার বাইরে চাঁদাবাজি, যৌতুক বা অন্য কোনো মাধ্যমে গ্রহণ করা, ওজন, পরিমাপ বা মাপে কম দেওয়া, পিতামাতা, স্ত্রী, প্রতিবেশী, দরিদ্র, অনাথ, আত্মীয়-স্বজন বা অন্য কোনো মানুষের অধিকার নষ্ট করা, কাউকে তার প্রাপ্য থেকে বঞ্চিত করা, আল্লাহর কোনো সৃষ্টির বা মানুষের ক্ষতি করা বা সাধারণ ভাবে ‘হক্কুল ইবাদ’ নষ্ট করা পার্থিব অবনতির কারণ।

কিন্তু আল্লাহর কোনো সৃষ্টির মধ্যে, কোনো বার, তারিখ, তিথি, দিক ইত্যাদির মধ্যে অথবা কোনো মোবাহ কর্মের মধ্যে কোনো অশুভ প্রভাব আছে বলে বিশ্বাস করা কঠিন অন্যায় ও ঈমান বিরোধী। আমাদের সমাজে এ জাতীয় অনেক কথা প্রচলিত আছে। এগুলোকে সবসময় হাদীস বলে বলা হয় না। কিন্তু পাঠক সাধারণভাবে মনে করেন যে, এগুলো নিশ্চয়ই আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের কথা। তা না হলে কিভাবে আমরা জানলাম যে, এতে মঙ্গল হয় এবং এতে অমঙ্গল হয়? এগুলো বিশ্বাস করা ঈমান বিরোধী। আর এগুলোকে আল্লাহ বা তাঁর রাসূলের বাণী মনে করা অতিরিক্ত আরেকটি কঠিন অন্যায়।

শুভ, অশুভ. উন্নতি, অবনতি ইত্যাদি বিষয়ক ভিত্তিহীন কথাবার্তা

১. শনি, মঙ্গল, অমাবস্যা, পূর্ণিমা ইত্যাদি

শনিবার, মঙ্গলবার, অমাবস্যা, পূর্ণিমা, কোনো তিথি, স্থান বা সময়কে অমঙ্গল অযাত্রা বা অশুভ বলে বিশ্বাস করা জঘন্য মিথ্যা ও ঘোরতর ইসলাম বিরোধী বিশ্বাস। অমুক দিনে বাঁশ কাঁটা যাবে না, চুল কাটা যাবে না, অমুক দিনে অমুক কাজ করতে নেই...ইত্যাদি সবই মিথ্যা ও ভিত্তিহীন কুসংস্কার। এগুলো বিশ্বাস করলে শির্কের গোনাহ হবে।

২. চন্দ্রগ্রহণ, সূর্যগ্রহণ, রংধনু, ধুমকেতু ইত্যাদি

চন্দ্রগ্রহণ, সূর্যগ্রহণ, রংধনু, ধুমকেতু ইত্যাদি প্রাকৃতিক নিদর্শনাবলি বিশেষ কোনো ভাল বা খারাপ প্রভাব রেখে যায় বলে যা কিছু বলা হয় সবই বানোয়াট ও মিথ্যা কথা। অমুক চাঁদে গ্রহণ হলে অমুক হয়, বা অমুক সময়ে রঙধনু দেখা দিলে অমুক ফল হয়, এ ধরনের কথাগুলো বানোয়াট।[3]

৩. বুধবার বা মাসের শেষ বুধবার

বুধবারকে বা মাসের শেষ বুধবারকে অমঙ্গল, অশুভ, অযাত্রা বা খারাপ বলে বা বুধবারের নিন্দায় কয়েকটি বানোয়াট হাদীস প্রচলিত আছে। এগুলো সবই মিথ্যা। আল্লাহর সৃষ্টি দিন, মাস, তিথি সবই ভাল। এর মধ্যে কোন কোন দিন বা সময় বেশি ভাল। যেমন শুক্রবার, সোমবার ও বৃহস্পতিবার বেশি বরকতময়। তবে অমঙ্গল, অশুভ বা অযাত্রা বলে কিছু নেই।[4]

৪. অবনতির কারণ বিষয়ক ভিত্তিহীন কথাবার্তা

বিভিন্ন প্রচলিত পুস্তকে উল্লেখ করা হয়েছে যে, নিম্নের কাজগুলোকে অশুভ, খারাপ ফলদায়ক বা দারিদ্র আনয়নকারী:

  1. হাঁটতে হাঁটতে ও অযু ব্যতীত দরুদ শরীফ পাঠ করা।
  2. বিনা ওযুতে কুরআন কিংবা কুরআনের কোনো আয়াত পাঠ করা।

এ কথা দুটি একদিকে যেমন বানোয়াট কথা, অপরদিকে এ কথা দ্বারা মুমিনকে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি ইবাদত থেকে বিরত রাখা হয়। গোসল ফরয থাকলে কুরআন পাঠ করা যায় না। ওযু ছাড়া কুরআন তিলাওয়াত জায়েয। রাসূলুল্লাহ ও সাহাবীগণ ওযু ছাড়াও মুখস্থ কুরআন তিলাওয়াত করতেন। ওযু অবস্থায় যিক্র, দোয়া, দরুদ-সালাম ইত্যাদি পাঠ করা ভাল। তবে আল্লাহর যিক্র, দোয়া ও দরুদ-সালাম পাঠের জন্য ওযু বা গোসল জরুরী নয়। রাসূলুল্লাহ () ও সাহাবীগণের সুন্নাত হলো, হাঁটতে, চলতে, বসে, শুয়ে ওযুসহ ও ওযু ছাড়া পাক-নাপাক সর্বাবস্থায় নিজের মুখ ও মনকে আল্লাহর যিক্র, দোয়া ও দরুদ পাঠে রত রাখা।

  1. বসে মাথায় পাগড়ি পরিধান করা।
  2. দাঁড়িয়ে পায়জামা পরিধান করা।
  3. কাপড়ের আস্তিন ও আঁচল দ্বারা মুখ পরিষ্কার করা।
  4. ভাঙ্গা বাসনে বা গ্লাসে পানাহার করা।
  5. রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে খাওয়া।
  6. খালি মাথায় পায়খানায় যাওয়া বা খালি মাথায় আহার করা।
  7. পরিধানে কাপড় রেখে সেলাই করা।
  8. লুঙ্গি-গামছা চেপার সময় পায়ে পানি ফেলা
  9. ফুঁক দিয়ে প্রদীপ নেভানো।
  10. ভাঙ্গা চিরুনী ব্যবহার করা বা ভাঙ্গা কলম ব্যবহার করা।
  11. দাঁত দ্বারা নখ কাটা।
  12. রাত্রিকালে ঘর ঝাড়ু দেওয়া।
  13. কাপড় দ্বারা ঘর ঝাড়ু দেওয়া।
  14. ভাঙ্গা আয়নায় মুখ দেখা বা রাত্রে আয়নায় মুখ দেখা।
  15. হাঁটতে হাঁটতে দাত খেলাল করা।
  16. কাপড় দ্বারা দাঁত পরিষ্কার করা।
  17. ঘরের ঝুলকালি বা মাকড়াসার বাসা পরিষ্কার না করা.......।

এরূপ আরো অনেক কথা প্রচলিত। সবই বানোয়াট কথা। কোনো জায়েয কাজের জন্য কোনোরূপ ক্ষতি বা কুপ্রভাব হতে পারে বলে বিশ্বাস করা কঠিন অন্যায়। আর এগুলোকে হাদীস বলে মনে করা কঠিনতর অন্যায়।

৫. উন্নতির কারণ বিষয়ক ভিত্তিহীন কথাবার্তা

মহান আল্লাহ বান্দাকে যে সকল কর্মের নির্দেশ দিয়েছেন সবই তার জন্য পার্থিব ও পারলৌকিক কল্যাণ, উন্নতি ও মঙ্গল বয়ে আনে। সকল প্রকার ফরয, ওয়াজিব, সুন্নাত, নফল-মুস্তাহাব কর্ম মানুষের জন্য আখিরাতের সাওয়াবের পাশাপাশি জাগতিক বরকত বয়ে আনে। আল্লাহ বলেন:

وَلَوْ أَنَّ أَهْلَ الْقُرَى آَمَنُوا وَاتَّقَوْا لَفَتَحْنَا عَلَيْهِمْ بَرَكَاتٍ مِنَ السَّمَاءِ وَالأَرْضِ

‘‘যদি জনপদবাসিগণ ঈমান এবং তাকওয়া অর্জন করতো (আল্লাহর নিষিদ্ধ কাজ বর্জন করতো ও নির্দেশিত কাজ পালন করতো) তবে তাদের জন্য আমি আকাশমন্ডলী ও পৃথিবীর বরকত-কল্যাণসমূহ উন্মুক্ত করে দিতাম।’’[5]

এভাবে আমরা দেখছি যে, ঈমান ও তাকওয়ার কর্মই বরকত আনয়ন করে। তবে সৃষ্টির সেবা ও মানবকল্যাণমূলক কর্মে আল্লাহ সবচেয়ে বেশি খুশি হন এবং এরূপ কাজের জন্য মানুষকে আখিরাতের সাওয়াব ছাড়াও পৃথিবীতে বিশেষ বরকত প্রদান করেন বলে বিভিন্ন হাদীসে উল্লেখ করা হয়েছে।

এ প্রসঙ্গে অনেক বানোয়াট কথাও বলা হয়। যেমন বলা হয় যে, নিম্নের কাজগুলি করলে মানুষ ধনী ও সৌভাগ্যশালী হতে পারে:

  1. আকীক পাথরের আংটি পরিধান করা।
  2. বৃহস্পতিবারে নখ কাটা।
  3. সর্বদা জুতা বা খড়ম ব্যবহার করা।
  4. ঘরে সিরকা রাখা।
  5. হলদে রঙের জুতা পরা।
  6. যে ব্যক্তি জমরুদ পাথরের বা আকীক পাথরের আংটি পরবে বা সাথে রাখবে সে কখনো দরিদ্র হবে না এবং সর্বদা প্রফুল্ল থাকবে।

অনুরূপভাবে অমুক কাজে মানুষ স্বাস্থ্যবান ও সবল হয়, স্মরণশক্তি বৃদ্ধি পায়, অমুক কাজে স্বাস্থ্য নষ্ট হয় বা স্মরণশক্তি নষ্ট হয়, অমুক কাজে দৃষ্টি শক্তি বাড়ে, অমুক কাজে দৃষ্টিশক্তি কমে, অমুক কাজে বার্ধক্য আনে, অমুক কাজে শরীর মোটা হয়, অমুক কাজে শরীর দুর্বল হয় ইত্যাদি সকল কথাই বানোয়াট।

[1] বুখারী, আস-সহীহ ৫/২১৭১; মুসলিম, আস-সহীহ ৪/১৭৪৫।

[2] তিরমিযী, আস-সুনান ৪/১৬০; ইবনু হিববান, আস-সহীহ ১৩/৪৯১; হাকিম, আল-মুসতাদরাক ১/৬৪; আবূ দাঊদ, আস-সুনান ৪/১৭; ইবনু মাজাহ, আস-সুনান ২/১১৭০। তিরমিযী, ইবনু হিববান, হাকিম প্রমুখ হাদীসটিকে সহীহ বলেছেন।

[3] তাহির পাটনী, তাযকিরা, পৃ. ২২১; ইবনু আর্রাক, তানযীহ ১/১৭৮, ১৭৯, ১৯১; শাওকানী, আল-ফাওয়াইদ ২/৫৬৮।

[4] ইবনুল জাওযী, আল-মাউদূ‘আত ১/৩৭৪-৩৭৬; সুয়ূতী, আল-লাআলী ১/৪৮১-৪৮৬; সাখাবী, আল-মাকাসিদ, পৃ. ৩৬৪; মুল্লা আলী কারী, আল-আসরার, পৃ: ১৯৯-২০০, ২৭৫; আল-মাসনূ‘য় ১২৫; মুখতাসারুল মাকাসিদ, পৃ: ১৬৬, ২০৮।

[5] সূরা (৭) আ‘রাফ: ৯৬ আয়াত।