হাদীসের নামে জালিয়াতি মৃত্যু, জানাযা, দুআ, যিকর ইত্যাদি ড. খোন্দকার আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর (রহ.) ১ টি

সালাতুল জানাযা আদায়, মৃতের অনুগমন, লাশ বহন, দাফনে অংশ গ্রহণ ইত্যাদি সুন্নাহ নির্দেশিত গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত। লাশ বহনের ক্ষেত্রে অনেক ফকীহ উল্লেখ করেছেন যে, চারিদিক থেকে অন্তত দশ পা করে লাশ বহন করা উচিত। এ প্রসঙ্গে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) থেকে দুটি হাদীস বর্ণিত:

من اتبع جَنَازَة فَأخذ بجوانب السرير الْأَرْبَع غفر لَهُ أَرْبَعُونَ ذَنبا كلهَا من الْكَبَائِر

‘‘যে ব্যক্তি মৃতের অনুগমনের সময় খাটিয়ার চারিদিক থেকে ধরবে তার চল্লিশটি গোনাহ ক্ষমা করা হবে, সবগুলোই কবীরা গোনাহ।’’

من حمل قَوَائِم السرير الْأَرْبَع إِيمَانًا واحتسابًا (حط) الله - عَزَّ وَجَلَّ - عَنهُ أَرْبَعِينَ كَبِيرَةগ্ধ .

‘‘ যে ব্যক্তি ঈমান ও ইখলাসের সাথে খাটিয়ার চারিটি খুটি বহন করবে আল্লাহ তার চল্লিশটি কবীরা গোনাহ ক্ষমা করবেন।’’

প্রথম হাদীসের একমাত্র বর্ণনাকারী সিওয়ার ইবন মুসআব হামাযানী (سوار بن مصعب الهمذاني) এবং দ্বিতীয় হাদীসের একমাত্র বর্ণনাকারী আলী ইবন আবী সারা শাইবানী (علي بن أبي سارة)। ইয়াহইয়া ইবন মায়ীন, বুখারী, নাসায়ী, ইবন আবী হাতিম, দারাকুতনী, ইবন হিববান, ইবন আদী, আবূ নুআইম ইসপাহানী, যাহাবী প্রমুখ মুহাদ্দিস ইমাম এদের দুজনকে একেবারেই দুর্বল, অগ্রহণযোগ্য, মুনকার ও মাতরূক বা পরিত্যক্ত বলে উল্লেখ করেছেন।[1] এজন্য হাদীসগুলোকে ইবনুল জাওযী, আলবানী প্রমুখ মুহাদ্দিস মাউযূ বা মুনকার এবং সুয়ূতী, ইবনু আর্রাক প্রমুখ মুহাদ্দিস দুর্বল বলে গণ্য করেছেন।[2]

ফকীহগণ এ প্রসঙ্গে নিম্নের হাদীসটি উল্লেখ করেছেন:

مَنْ حَمَلَ جِنَازَةً أَرْبَعِينَ خُطْوَةً كَفَّرَتْ أَرْبَعِينَ كَبِيرَةً

‘‘যে ব্যক্তি চল্লিশ পা লাশ বহন করবে তার চল্লিশটি কবীরা গোনাহ ক্ষমা করা হবে।’’[3]

এ শব্দে এ হাদীসটি কোনো হাদীসের গ্রন্থে বর্ণিত হয়েছে বলে আমি জানতে পারি নি। বাহ্যত এটি উপরের দ্বিতীয় হাদীসটিরই আরেকটি ভাষ্য।

লক্ষ্যণীয় যে, চারিদিক থেকে খাটিয়া বহনের বিষয়ে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) থেকে বর্ণিত হাদীসগুলো অগ্রহণযোগ্য হলেও সাহাবীগণ থেকে এ বিষয়ে গ্রহণযোগ্য সনদে তাঁদের মতামত বর্ণিত। আবূ দারদা (রা) বলেন:

مِنْ تَمام أَجْرِ الْجِنَازَة ... وَأَن يَحْمِلَ بأَرْكَانِهَا الأَرْبَعَة

‘‘জানাযার সাওয়াবের পূর্ণতার মধ্যে রয়েছে... খাটিয়ার চারটি খুটি ধরে তা বহন করা....।’’ হাদীসটির সনদ সহীহ।[4]

আব্দুল্লাহ ইবন মাসঊদ (রা) বলেন:

إِذا تبع أحدكُم الْجِنَازَة فليأخذ بجوانب (السرير) الْأَرْبَعَة ثمَّ ليتطوع بعد أَو ليذر؛ فَإِنَّهُ من السّنة

‘‘যখন তোমাদের কেউ লাশের অনুগমন করবে তখন সে যেন খাটিয়ার চারদিক থেকেই ধরে। এরপর ইচ্ছা করলে অতিরিক্ত কিছু করবে বা ছেড়ে দেবে। এটি সুন্নাতের অন্তর্ভুক্ত।’’

ইবন মাসঊদের (রা) পুত্র আবূ উবাইদা হাদীসটি বর্ণনা করেছেন। তিনি নির্ভরযোগ্য। কোনো কোনো মুহাদ্দিস বলেছেন, তিনি তাঁর পিতা থেকে হাদীস নিজে শুনেন নি। এজন্য সনদ বিচ্ছিন্ন বলে গণ্য। তবে অন্যান্য মুহাদ্দিস ইবন মাসঊদ (রা) থেকে আবূ উবাইদার বর্ণনা সহীহ বলে গণ্য করেছেন।[5]

তাবিয়ী আলী ইবন আব্দুল্লাহ আযদী বলেন:

رَأَيْتُ ابْنَ عُمَرَ فِيْ جَنَازَةٍ حَمَلَ بِجَوَانِبِ السَّرِيْرِ الأَرْبَعِ قَالَ بَدَأَ بِمَيَامِنِهَا

‘‘আমি আব্দুল্লাহ ইবন উমার (রা)-কে একটি জানাযায় দেখলাম। তিনি খাটিয়ার চারদিক থেকে বহন করলেন। তিনি ডান থেকে শুরু করলেন...।[6]

হাদীসটির সনদ বাহ্যত হাসান পর্যায়ের। এভাবে আমরা দেখছি যে, চারদিক থেকে খাটিয়া বহনের বিষয়টি সাহাবীগণের সুন্নাত দ্বারা প্রমাণিত। তবে দশ পা করে বহনের বিষয়টি একেবারেই অপ্রমাণিত ও ভিত্তিহীন।

[1] বুখারী, আত-তারীখুল কাবীর, ৪/১৬৯, ৬/২৭৮; আদ-দুআফা আস-সাগীর, পৃষ্ঠা ৫৮; ইবন আবী হাতিম, আল-জারহু ওয়াত তাদীল ৪/২৭১-২৭২, ৬/১৮৯; ইবন হিববান, আল-মাজরূহীন ২/১০৪; আবূ নুআইম ইসপাহানী, আদ-দুআফা, পৃষ্ঠা ৯০; নাসায়ী, আদ-দুআফা, পৃ. ১৮৭; ইবন আদী, আল-কামিল ৩/৪৫৪-৪৫৬; ইবনুল জাওযী, আদ-দুআফা ওয়াল মাতরূকীন ২/১৯৩; যাহাবী, আল-কাশিফ ২/৪০, মীযানুল ই’তিদাল ৫/১৫৮; ইবন হাজার, তাহযীবুত তাহযীব ৭/২৮৫-২৮৬।

[2] তাবারানী, আল-মু’জামুল আউসাত ৬/৯৯; ইবনু হাজার, লিসানুল মীযান ২/৫৫; তালখীসুল হাবীর ২/১১১; ইবনুল জাওযী, আল-মাউদূ‘আত ২/৩৮৩; হাইসামী, মাজমাউয যাওয়াইদ ৩/২৬; সুয়ূতী, আল-লাআলী ২/৪০৫; ইবনু আর্রাক, তানযীহ ২/৩৬৬-৩৬৭; তাহির পাটনী, তাযকিরা, পৃ. ২১৬-২১৭।

[3] সারাখসী, আল-মাবসূত ২/১০১; কাসানী, বাদাইউস সানাইঅ ১/৩০৯।

[4] ইবন আবী শাইবা, আল-মুসান্নাফ (মুহাম্মাদ আওয়ামা: শামিলা) ৩/২৮৩; ইবনুল মুলাক্কিন, আল-বাদরুল মুনীর (শামিলা) ৫/২২৪; ইবনুত তুরকমানী, আল-জাওহারুন নাকী ৪/২০।

[5] বিস্তারিত আলোচনা দেখুন: ইরশীফ মুলতাকা আহলিল হাদীস-১ (শামিলা ৩.২৮): আব্দুর রাহমান ফকীহ ৪১/৪০৬।

[6] আব্দুর রায্যাক, আল-মুসান্নাফ ৩/৫১৩; ইবন আবী শাইবা, আল-মুসান্নাফ ৩/২৮৩।