১. মধ্য শাবানের রাতে কিয়াম ও দিনে সিয়াম
আলী (রা)-এর সূত্রে রাসূলুল্লাহ ﷺ- থেকে বর্ণিত একটি হাদীস নিম্নরূপ:
إِذَا كَانَتْ لَيْلَةُ النِّصْفِ مِنْ شَعْبَانَ فَقُومُوا لَيْلَهَا وَصُومُوا نَهَارَهَا فَإِنَّ اللَّهَ يَنْزِلُ فِيهَا لِغُرُوبِ الشَّمْسِ إِلَى سَمَاءِ الدُّنْيَا فَيَقُولُ أَلا مِنْ مُسْتَغْفِرٍ لِي فَأَغْفِرَ لَهُ أَلا مُسْتَرْزِقٌ فَأَرْزُقَهُ أَلا مُبْتَلًى فَأُعَافِيَهُ أَلا كَذَا أَلا كَذَا حَتَّى يَطْلُعَ الْفَجْرُ.
‘‘যখন মধ্য শাবানের রাত আসে তখন তোমরা রাতে (সালাতে- দোয়ায়) দন্ডায়মান থাক এবং দিবসে সিয়াম পালন কর। কারণ ঐ দিন সুর্যাস্তের পর মহান আল্লাহ পৃথিবীর আকাশে অবতরণ করেন এবং বলেন, কোন ক্ষমা প্রার্থনাকারী আছে কি? আমি তাকে ক্ষমা করব। কোন রিয্ক অনুসন্ধানকারী আছে কি? আমি তাকে রিয্ক প্রদান করব। কোন দুর্দাশাগ্রস্থ ব্যক্তি আছে কি? আমি তাকে মুক্ত করব। এভাবে সুবহ সাদিক উদয় হওয়া পর্যন্ত চলতে থাকে।’’
এ হাদীসটি ইমাম ইবনু মাজাহ তাঁর উস্তাদ হাসান বিন আলী আল-খাল্লাল থেকে, তিনি আব্দুর রাজ্জাক থেকে, তিনি ইবনু আবি সাব্রাহ থেকে, তিনি ইবরাহীম বিন মুহাম্মাদ থেকে, তিনি মুয়াবিয়া বিন আব্দুল্লাহ বিন জাফর থেকে, তিনি তাঁর পিতা আব্দুলাহ বিন জাফর থেকে, তিনি আলী ইবনু আবী তালিব (রা) থেকে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) থেকে বর্ণনা করেছেন।[1]
ইবনু মাজাহ কর্তৃক সংকলিত হওয়ার কারণে হাদীসটি আমাদের সমাজে বহুল পরিচিত, প্রচারিত ও আলোচিত। কিন্তু মুহাদ্দিসগণ হাদীসটিকে বানোয়াট বা অত্যন্ত দুর্বল পর্যায়ের বলে চিহ্নিত করেছেন।
এ হাদীসটি একমাত্র ইবনু আবি সাব্রাহ ব্যতীত অন্য কেউ বর্ণনা করেন নি। এ হাদীস আলী ইবনু আবি তালিব থেকে তাঁর কোন ছাত্র বর্ণনা করেন নি। আব্দুলাহ বিন জাফর বিন আবি তালিব থেকেও তাঁর কোন ছাত্র হাদীসটি বর্ণনা করেন নি। এমনকি মুয়াবিয়া ও ইবরাহিম বিন মুহাম্মদ থেকেও তাঁদের কোনো ছাত্র হাদীসটি বর্ণনা করেননি। শুধু ইবন আবি সাব্রাহ দাবী করেছেন যে, তিনি ইবরাহীম থেকে উক্ত সনদে হাদীসটি শ্রবণ করেছেন। তাঁর কাছ থেকে আব্দুর রাজ্জাক ও অন্যান্যরা বর্ণনা করেছেন।
ইবনু আবি সাব্রাহ (১৬২ হি) -এর পূর্ণনাম আবু বাকর বিন আব্দুলাহ বিন মুহাম্মদ বিন আবি সাব্রাহ। তিনি মদীনার একজন বড় আলিম ও ফক্বীহ ছিলেন। কিন্তু তুলনামূলক নিরীক্ষা ও বিচারের মাধ্যমে হাদীসের ইমামগণ নিশ্চিত হয়েছেন যে, তিনি হাদীস বর্ণনার ক্ষেত্রে মিথ্যার আশ্রয় নিতেন। অসংখ্য ইমাম তাঁকে মিথ্যা ও বানোয়াট হাদীস বর্ণনাকারী হিসেবে অভিযুক্ত করেছেন। তন্মধ্যে ইমাম আহমাদ, ইয়াহইয়া বিন মায়ীন, আলী ইবনুল মাদীনী, বুখারী, ইবনু আদী, ইবনু হিববান ও হাকিম নাইসাপূরী অন্যতম।[2]
এরই আলোকে আল্লামা শিহাব উদ্দীন আহমাদ বিন আবি বকর আল-বুসীরী (৮৪০ হি) বলেন, ইবনু আবি সাব্রাহর দুর্বলতার কারণে এ সনদটি দুর্বল। ইমাম আহমাদ ও ইবনু মাঈন তাঁকে হাদীস বানোয়াটকারী হিসেবে আখ্যা দিয়েছেন।[3] শাইখ আলবানী বলেছেন, অত্যন্ত দুর্বল বা বানোয়াট। তিনি আরো বলেন, সনদটি বানোয়াট।[4]
২. দুই ঈদ ও মধ্য-শাবানের রাত্রিভর ইবাদত
একটি জাল হাদীসে বলা হয়েছে:
مَنْ أَحْيَا لَيْلَتَيْ الْعِيْدِ وَلَيْلَةَ النِّصْفِ مِنْ شَعْبَانَ لَمْ يَمُتْ قَلْبُهُ يَوْمَ تَمُوْتُ الْقُلُوْبُ
যে ব্যক্তি দুই ঈদের রাত ও মধ্য শাবানের রাত ইবাদতে জাগ্রত থাকবে তার অন্তরের মৃত্যু হবেনা যে দিন সকল অন্তর মরে যাবে।[5]
এ হাদীসের একমাত্র বর্ণনাকারী উপর্যুক্ত ঈসা ইবনু ইবরাহীম ইবনু তাহমান বাতিল হাদীস বর্ণনাকারী হিসাবে সুপরিচিত। ইমাম বুখারী, নাসাঈ, ইয়াহয়িয়া বিন মাঈন ও আবু হাতিম রাযি ও অন্যান্য সকল মুহাদ্দিস একবাক্যে তাকে পরিত্যক্ত বা মিথ্যাবাদী রাবী বলে উল্লেখ করেছেন। এছাড়া ঈসা ইবনু ইবরাহীম নামক এই ব্যক্তি তার উস্তাদ হিসেবে যার নাম উল্লেখ করেছেন সে ‘সালামা বিন সুলাইমান’ দুর্বল রাবী বলে পরিচিত। আর তার উস্তাদ হিসেবে যার নাম উল্লেখ করা হয়েছে সে ‘মারওয়ান বিন সালিম’ মিথ্যা হাদীস বর্ণনার অভিযোগে অভিযুক্ত।[6] এভাবে আমরা দেখছি যে, এ হাদীসটির সনদের রাবীগণ অধিকাংশই মিথ্যাবাদী বা অত্যন্ত দুর্বল। এরা ছাড়া কেউ এ হাদীস বর্ণনা করেন নি। কাজেই হাদীসটি বানোয়াট পর্যায়ের।
এখানে উল্লেখ্য যে, আবূ উমামা (রা) ও অন্যান্য সাহাবী থেকে একাধিক দুর্বল সূত্রে বর্ণিত হয়েছে যে, ‘যে ব্যক্তি দুই ঈদের রাত ইবাদতে জাগ্রত থাকবে তার অন্তরের মৃত্যু হবে না যে দিন সকল অন্তর মরে যাবে।’ এ সকল বর্ণনায় দুই ঈদের রাতের সাথে মধ্য শাবানের রাতকে কেউ যুক্ত করেন নি।[7]
৩. পাঁচ রাত্রি ইবাদতে জাগ্রত থাকা
মুয়ায ইবনু জাবাল (রা) এর সূত্রে বর্ণিত হয়েছে যে,
مَنْ أَحْيَا اللَّيَالِيَ الْخَمْسَ وَجَبَتْ لَهُ الْجَنَّةُ لَيْلَةَ التَّرْوِيَةِ وَلَيْلَةَ عَرَفَةَ وَلَيْلَةَ النَّحْرِ وَلَيْلَةَ الْفِطْرِ وَلَيْلَةَ النِّصْفِ مِنْ شَعْبَانَ
‘‘যে ব্যক্তি পাঁচ রাত (ইবাদতে) জাগ্রত থাকবে তার জন্য জান্নাত অপরিহার্য হবে: যুলহাজ্জ মাসের ৮ তারিখের রাত্রি, আরাফার রাত্রি, ঈদুল আযহার রাত্রি, ঈদুল ফিতরের রাত্রি ও মধ্য শাবানের রাত্রি।’’
হাদীসটি ইস্পাহানী ‘তারগীব’ গ্রন্থে সুওয়াইদ ইবনু সাঈদ-এর সূত্রে উদ্ধৃত করেছেন। সুওয়াইদ, আব্দুর রাহীম ইবনু যাইদ আল‘আম্মী থেকে, তিনি তার পিতা থেকে, তিনি ওয়াহ্ব ইবনু মুনাবিবহ থেকে, তিনি মুয়ায ইবনু জাবাল থেকে, তিনি রাসূলুল্লাহ (ﷺ) থেকে হাদীসটি বর্ণনা করেছেন।
হাদীসটির বর্ণনাকারী আব্দুর রাহীম ইবনু যাইদ আল-‘আম্মী (১৮৪হি) নামক ব্যক্তি মিথ্যা ও জাল হাদীস বর্ণনাকারী বলে প্রসিদ্ধ ছিলেন। ইমাম বুখারী, নাসাঈ, ইয়াহইয়া ইবনু মায়ীন, আহমাদ ইবনু হাম্বাল, আবূ হাতিম রাযী, আবূ দাঊদ ও অন্যান্য সকল মুহাদ্দিস এ ব্যক্তির মিথ্যাবাদিতার বিষয় উল্লেখ করেছেন। এজন্য এ হাদীসটি মাওযূ বা জাল হাদীস বলে গণ্য। ইবনুল জাওযী, ইবনু হাজার আসকালানী, মুহাম্মাদ নাসিরুদ্দীন আলবানী প্রমুখ মুহাদ্দিস এ বিষয়ে আলোচনা করেছেন।[8]
৪. এ রাত্রিতে রহমতের দরজাগুলো খোলা হয়
আবুল হাসান আলী ইবনু মুহাম্মাদ ইবনু আর্রাক (৯৬৩ হি) তাঁর মাউযূ বা জাল হাদীস সংকলনের গ্রন্থে ইবনু আসাকির-এর বরাত দিয়ে বানোয়াট ও ভিত্তিহীন হাদীস হিসেবে নিম্নের হাদীসটি উল্লেখ করেছেন। উবাই ইবনু কা’ব (রা) এর সূত্রে কথিত হয়েছে যে, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেন:
‘‘মধ্য শাবানের রাতে জিবরাঈল (আঃ) আমার কাছে আগমন করে বলেন, আপনি দাঁড়িয়ে নামায পড়ুন এবং আপনার মাথা ও হস্তদ্বয় উপরে উঠান। আমি বললাম, হে জিবরাঈল, এটি কোন্ রাত? তিনি বলেন, হে মুহাম্মাদ, এ রাতে আসমানের দরজাসমূহ খুলে দেয়া হয় এবং রহমতের ৩০০ দরজা খুলে দেওয়া হয়। ... তখন রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বাকী গোরস্তানে গমন করেন। তিনি যখন সেখানে সাজদারত অবস্থায় দোয়া করছিলেন, তখন জিবরাঈল সেখানে অবতরণ করে বলেন, হে মুহাম্মাদ, আপনি আকাশের দিকে মাথা তুলুন। তিনি তখন তাঁর মস্তক উত্তোলন করে দেখেন যে, রহমতের দরজাগুলো খুলে দেয়া হয়েছে। প্রত্যেক দরজায় একজন ফিরিশতা ডেকে বলছেন, এ রাত্রিতে যে সাজদা করে তার জন্য মহা সুসংবাদ...।’’
হাদীসটি উদ্ধৃত করে ইবনু আর্রাক উল্লেখ করেছেন যে, এ হাদীস একটি মাত্র সূত্রে বর্ণিত হয়েছে, যে সূত্রের রাবীগণ সকলেই অজ্ঞাতপরিচয় এবং হাদীসটি বানোয়াট ও ভিত্তিহীন হিসেবে বিবেচিত।[9]
৫. পাঁচ রাতের দোয়া বিফল হয় না
আবূ উমামার (রা) সূত্রে, রাসূলুল্লাহর (ﷺ) নামে কথিত আছে,
خَمْسُ لَيَالٍ لاَ تُرَدُّ فِيْهِنَّ الدَّعْوَةُ: أَوَّلُ لَيْلَةٍ مِنْ رَجَبٍ، وَلَيْلَةُ النِّصْفِ مِنْ شَعْبَان َوَلَيْلَةُ الْجُمُعَةِ، وَلَيْلَةُ الْفِطْرِ، وَلَيْلَةُ النَّحْرِ
‘‘পাঁচ রাতের দোয়া বিফল হয় না: রজব মাসের প্রথম রাত, মধ্য শাবানের রাত, জুমুআর রাত, ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আযহার রাত।’’
এ হাদীসটি হাফিয আবুল কাসিম ইবনু আসাকির (৫৭১ হি) তার ‘তারীখ দিমাশক’ গ্রন্থে আবু সাঈদ বুনদার বিন মুহাম্মাদ বিন মুহাম্মাদ রূইয়ানির সূত্রে, তিনি ইবরাহীম বিন আবি ইয়াহয়িয়া থেকে, তিনি আবু কা’নাব থেকে, তিনি আবু উমামা বাহিলী (রা) থেকে বর্ণনা করেছেন। ইমাম সুয়ুতী তাঁর ‘‘আল জামে আল সাগীর’’ গ্রন্থে ইবন আসাকিরের উদ্ধৃতি দিয়ে হাদীসটি যয়ীফ হিসাবে উল্লেখ করেছেন।[10] নাসিরুদ্দীন আলবানী হাদীসটিকে বানোয়াট হিসেবে উল্লেখ করেছেন।[11] কারণ এ হাদীসের মূল ভিত্তি হলো ইবরাহীম ইবনু মুহাম্মাদ ইবনু আবী ইয়াহইয়া (১৮৪ হি) নামক একজন মুহাদ্দিস। ইমাম মালিক, আহমাদ, বুখারী, ইয়াহইয়া ইবনু মাঈন, ইয়াহইয়া আল-কাত্তান, নাসাঈ, দারাকুতনী, যাহাবী, ইবনু হিববান ও অন্যান্য মুহাদ্দিস তাকে রাফিযী শিয়া, মুতাযিলী ও ক্বাদরিয়া আক্বীদায় বিশ্বাসী বলে অভিযুক্ত করেছেন এবং মিথ্যাবাদী ও অপবিত্র হিসেবে আখ্যা দিয়েছেন। ইমাম শাফিয়ী প্রথম বয়সে তার শিষ্যত্ব গ্রহণ করেছিলেন বিধায় কোনো কোনো শাফিয়ী মুহাদ্দিস তাঁর দুর্বলতা কিছুটা হাল্কা করার চেষ্টা করেন। তবে শাফিয়ী মাযহাবের অভিজ্ঞ মুহাদ্দিসগণ এবং অন্যান্য সকল মুহাদ্দিস এক কথায় তাকে মিথ্যাবাদী ও পরিত্যক্ত বলে ঐকমত্য পোষণ করেছেন।
ইমাম শাফিয়ী নিজেও তাঁর এ শিক্ষকের দুর্বলতা ও অগ্রহণযোগ্যতা সম্পর্কে সচেতন ছিলেন। তিনি পরবর্তী জীবনে তার সূত্রে কোনো হাদীস বললে তার নাম উল্লেখ না করে বলতেন, আমাকে বলা হয়েছে, বা শুনেছি বা অনুরূপ কোনো বাক্য ব্যবহার করতেন।[12] এ হাদীসটির ক্ষেত্রেও ইমাম শাফিয়ী বলেন, আমাকে বলা হয়েছে যে, আগের যুগে বলা হতো, পাঁচ রাতে দোয়া করা মুস্তাহাব....। ইমাম শাফিয়ী বলেন, এ সকল রাতে যে সব আমলের কথা বলা হয়েছে সেগুলোকে আমি মুসতাহাব মনে করি।[13]
এছাড়া সনদের অন্য রাবী আবু সাঈদ বুনদার বিন উমরও মিথ্যাবাদী ও হাদীস জালকারী বলে পরিচিত।[14]
এখানে উল্লেখ্য যে, হাফিয আব্দুর রায্যাক সান‘আনী এ হাদীসটি অন্য একটি সনদে ইবনু উমারের (রা) নিজস্ব বক্তব্য হিসাবে উদ্ধৃত করেছেন।[15] আব্দুর রায্যাক সান‘আনী বলেন, আমাকে এক ব্যক্তি বলেছেন, তিনি বায়লামানীকে বলতে শুনেছেন, তার পিতা বলেছেন, ইবনু উমার বলেছেন, পাঁচ রাতের দোয়া বিফল হয় না। ....’’
এ সনদে আব্দুর রায্যাককে যিনি হাদীসটি বলেছেন, তিনি অজ্ঞাত পরিচয়। পরবর্তী রাবী মুহাম্মাদ বিন আব্দুর রাহমান বিন বায়লামানী হাদীস-জালিয়াত হিসেবে প্রসিদ্ধ ছিলেন।[16] উক্ত মুহাম্মাদের পিতা, সনদের পরবর্তী রাবী আব্দুর রাহমান বিন বায়লামানীও দুর্বল ও অনির্ভরযোগ্য রাবী।[17]
৬. শবে বরাতের গোসল
শবে বরাত বিষয়ক প্রচলিত মিথ্যা কথাগুলোর অন্যতম হলো এ রাতে গোসল করার ফযীলত। বিষয়টি যদিও সম্পূর্ণ মিথ্যা, ভিত্তিহীন ও জঘন্য বানোয়াট কথা, তবুও আমাদের সমাজে তা অত্যন্ত প্রচলিত। আমাদের দেশের প্রচলিত প্রায় সকল পুস্তকেই এ জাল কথাটি লিখা হয় এবং ওয়াযে আলোচনায় বলা হয়। প্রচলিত একটি বই থেকে উদ্ধৃত করছি: ‘‘একটি হাদীসে আছে, যে ব্যক্তি উক্ত রাত্রিতে এবাদতের উদ্দেশ্যে সন্ধ্যায় গোসল করিবে, সে ব্যক্তির গোসলের প্রত্যেকটি বিন্দু পানির পরিবর্তে তাহার আমল নামায় ৭০০ (সাতশত) রাকাত নফল নামাযের ছওয়াব লিখা যাইবে। গোসল করিয়া দুই রাকাত তাহিয়্যাতুল অজুর নামায পড়িবে।...’’[18]
এ মিথ্যা কথা দ্বারা প্রভাবিত হয়ে কঠিন শীতের দিনেও অনেকে গোসল করেন। উপরন্তু ফোঁটা ফোঁটা পানি পড়ার আশায় শরীর ও মাথা ভাল করে মোছেন না। এর ফলে অনেকে, বিশেষত, মহিলারা বড় চুলের কারণে ঠান্ডা-সর্দিতে আক্রান্ত হন। আর এ কষ্ট শরীয়াতের দৃষ্টিতে পন্ডশ্রম ছাড়া কিছুই নয়। কারণ, সুন্নাতের আলোকে এই রাতে গোসল করে ইবাদত করা আর ওযু করে ইবাদত করার মধ্যে কোনোরূপ পার্থক্য নেই। অনুরূপভাবে এ রাতে গোসল করা এবং অন্য কোনো রাতে গোসল করার মধ্যেও কোনো পার্থক্য নেই।
৭. এ রাতে নেক আমলের সুসংবাদ
এ বিষয়ে আমাদের দেশের প্রচলিত একটি কথা:
طُوْبَى لِمَنْ يَعْمَلُ فِىْ لَيْلَةِ النِّصْفِ مِنْ شَعْبَانَ خَيْراً
‘‘মহা সুসংবাদ তার জন্য সে শাবান মাসের মধ্যম রজনীতে নেক আমল করে...।’’ এ কথাটি উপরে উল্লিখিত উবাই ইবনু কা’র (রা) এর নামে প্রচারিত জাল হাদীসটি থেকে গ্রহণ করা।
৮. এ রাতে হালুয়া-রুটি বা মিষ্টান্ন বিতরণ
এ রত্রিতে হালুয়া-রুটি তৈরি করা, খাওয়া, বিতরণ করা, মিষ্টান্ন বিতরণ করা ইত্যাদি সবই বানোয়াট ও ভিত্তিহীন কর্ম। এ রাতে এ সকল ইবাদত করলে কোনো বিশেষ সাওয়াব বা অতিরিক্ত সাওয়াব পাওয়া যাবে এ মর্মে কোনো হাদীস বর্ণিত হয় নি।
৯. ১৫ শা’বানের দিনে সিয়াম পালন
আমরা দেখেছি যে, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) শাবান মাসের বেশি বেশি সিয়াম পালন করতেন, এমনকি প্রায় সারা মাসই সিয়ামরত থাকতেন। আমরা আরো দেখেছি যে, শা’বান মাসের মধ্যম রজনীর ফযীলত সহীহ হাদীস দ্বারা প্রমাণিত। এই রাত্রিতে সাধারণভাবে দোয়া-ইসতিগফার বা সালাত আদায়ের উৎসাহ জ্ঞাপক কিছু যয়ীফ বা মোটামুটি গ্রহণযোগ্য হাদীস রয়েছে। কিন্তু পরদিন সিয়াম পালনের বিষয়ে কোনো গ্রহণযোগ্য হাদীস পাওয়া যায় না। ইবনু মাজাহ সংকলিত আলী (রা)-এর নামে বর্ণিত হাদীসটিতে সিয়াম পালনের কথা বলা হয়েছে। তবে হাদীসটির সনদ নির্ভরযোগ্য নয়। শবে বরাতের রাতে ১৪ রাক‘আত সালাত আদায় বিষয়ক হাদীসেও পরদিন সিয়াম পালনের ফযীলত উল্লেখ করা হয়েছে। কিন্তু হাদীসটি জাল। এ বিষয়ক আরেকটি জাল হাদীস আমাদের সমাজে প্রচলিত:
مَنْ صَامَ يَوْمَ خَامِسَ عَشَرَ شَعْبَانَ لَمْ تَمْسَسْهُ النَّارُ أَبَداً
‘‘যে ব্যক্তি শাবান মাসের ১৫ তারিখে সিয়াম পালন করবে, জাহান্নামের আগুন কখনোই তাকে স্পর্শ করবে না।’’[19]
১০. প্রচলিত কিছু ভিত্তিহীন কথাবার্তার নমুনা
আমাদের দেশে প্রচলিত পুস্তকাদিতে অনেক সময় লেখকগণ বিশুদ্ধ ও অশুদ্ধকে একসাথে মিশ্রিত করেন। অনেক সময় সহীহ হাদীসের অনুবাদে অনেক বিষয় প্রবেশ করান যা হাদীসের নামে মিথ্যায় পরিণত হয়। অনেক সময় নিজেদের খেয়াল-খুশি মত বুখারী, মুসলিম ইত্যাদি গ্রন্থের নাম ব্যবহার করেন। এগুলোর বিষয়ে আমাদের সতর্ক হওয়া প্রয়োজন। মহান আল্লাহ দয়া করে আমাদের লেখকগণের পরিশ্রম কবুল করুন, তাদের ভুলত্রুটি ক্ষমা করুন এবং আমাদের সকলকে তাঁর সন্তুষ্টির পথে চলার তাওফীক প্রদান করুন। শবে বরাত বিষয়ক কিছু ভিত্তিহীন কথা আমাদের দেশে প্রচলিত একটি পুস্তক থেকে উদ্ধৃত করছি। প্রায় সকল পুস্তকেই এ কথাগুলো কম বেশি লিখা হয়েছে।
‘‘হাদীসে আছে, যাহারা এই রাত্রিতে এবাদত করিবে আল্লাহ তাআলা আপন খাছ রহমত ও স্বীয় অনুগ্রহের দ্বারা তাহাদের শরীরকে দোজখের অগ্নির উপর হারাম করিয়া দিবেন। অর্থাৎ তাহাদিগকে কখনও দোজখে নিক্ষেপ করিবেন না। হযরত (ﷺ) আরও বলেন- আমি জিবরাইল (আঃ) এর নিকট শুনিয়াছি, যাহারা শা‘বানের চাঁদের ১৫ই তারিখের রাত্রিতে জাগিয়া এবাদত বন্দেগী করিবে, তাহারা শবে ক্বদরের এবাদতের সমতুল্য ছওয়াব পাইবে।
আরও একটি হাদীসে আছে, হযরত (ﷺ) বলিয়াছেন, শাবানের চাঁদের ১৫ই তারিখের রাত্রিতে এবাদতকারী আলেম, ফাজেল, অলী, গাউছ, কুতুব, ফকীর, দরবেশ ছিদ্দীক, শহীদ, পাপী ও নিষ্পাপ সমস্তকে আল্লাহ তা‘আলা মার্জনা করিবেন। কিন্তু যাদুকর, গণক, বখীল, শরাবখোর, যেনাকার, নেশাখোর, ও পিতা-মাতাকে কষ্টদাতা- এই কয়জনকে আল্লাহ তা‘আলা মাফ করিবেন না। আরও একটি হাদীসে আছে, আল্লাহ তা‘আলা শাবানের চাঁদের ১৫ই তারিখের রাত্রিতে ৩০০ খাছ রহমতের দরজা খুলিয়া দেন ও তাঁহার বান্দাদের উপর বে-শুমার রহমত বর্ষণ করিতে থাকেন।
কালইউবী কিতাবে লিখিত আছে,- একদিন হযরত ঈসা (আঃ) জিজ্ঞাসা করিয়াছিলেন হে খোদাতাআলা! এ যামানায় আমার চেয়ে বুযর্গ আর কেহ আছে কি? তদুত্তরে আল্লাহ তাআলা বলিলেন, হাঁ, নিশ্চয়ই। সম্মুখে একটু গিয়াই দেখ। ইহা শুনিয়া ঈসা (আঃ) সম্মুখের দিকে চলিতে লাগিলেন ..... তখন বৃদ্ধ বলিলেন, আমি এতদ্দেশীয় একজন লোক ছিলাম। আমার মাতার দোওয়ায় আল্লাহ তাআলা আমাকে এই বুযুর্গী দিয়াছেন। সুতরাং আজ ৪০০ বৎসর ধরিয়া আমি এই পাথরের ভিতরে বসিয়া খোদা তাআলার এবাদত করিতেছি এবং প্রত্যহ আমার আহারের জন্য খোদা তাআলা বেহেশত হইতে একটি ফল পাঠাইয়া থাকেন। ইহা শুনিয়া হযরত ঈসা (আঃ) ছেজদায় পড়িয়া কাঁদিতে লাগিলেন। ... তখন আল্লাহ তাআলা বলিলেন, হে ঈসা (আঃ)! জানিয়া রাখ যে, শেষ যমানার নবীর উম্মতের মধ্যে যে ব্যক্তি শাবানের চাঁদের পনরই তারিখের রাত্রে জাগিয়া এবাদত বন্দেগী করিবে ও সেদিন রোযা রাখিবে নিশ্চয়ই সে ব্যক্তি আমার নিকট এই বৃদ্ধের চেয়েও বেশী বুযুর্গ এবং প্রিয় হইতে পারিবে। তখন ঈসা (আঃ) কাঁদিয়া বলিলেন, হে খোদা তাআলা! তুমি আমাকে যদি নবী না করিয়া আখেরী যমানার নবীর উম্মত করিতে তাহা হইলে আমার কতই না সৌভাগ্য হইত! যেহেতু তাঁহার উম্মত হইয়া এক রাত্রিতে এত ছওয়াব কামাই করিতে পারিতাম। ... হাদীসে আছে, শাবানের চাঁদের চৌদ্দই তারিখের সূর্য অস্ত যাইবার সময় নিম্নলিখিত দোওয়া ৪০ বার পাঠ করিলে ৪০ বৎসরের ছগীরা গুনাহ মাফ হইয়া যাইবে।
لاَ حَوْلَ وَلاَ قُوَّةَ إِلاَّ بِاللهِ
... দুই দুই রাকাত করিয়া চারি রাকাত নামায পড়িবে ... সূরা ফাতেহার পর প্রত্যেক রাকাতেই সূরা এখলাছ দশবার করিয়া পাঠ করিবে ও এই নিয়মেই নামায শেষ করিবে। হাদীসে শরীফে আছে,- যাহারা এই নামায পড়িবে নিশ্চয়ই আল্লাহ তাহাদের চারিটি হাজত পুরা করিয়া দিবেন ও তাহাদের সমস্ত গুনাহ মাফ করিয়া দিবেন।
তৎপর ঐ রাতে দুই দুই রাকাত করিয়া আরও চারি রাকাত নফল নামায পড়িবে। ... প্রত্যেক রাকাতে সূরা ক্বদর একবার ও সূরা এখলাছ পঁচিশবার পাঠ করিবে এবং এই নিয়মে নামায শেষ করিবে।
হাদীস শরীফে আছে,- মাতৃগর্ভ হইতে লোক যেরূপ নিষ্পাপ হইয়া ভুমিষ্ট হয়, উল্লিখিত ৪ রাকাত নামায পড়িলেও সেইরূপ নিষ্পাপ হইয়া যাইবে। (মেশকাত) হাদীস শরীফে আছে,- যাহারা এই নামায পাঠ করিবে, আল্লাহ তাআলা তাহাদের পঞ্চাশ বৎসরের গুনাহ মার্জনা করিয়ো দিবেন। (তিরমিজী) আরও হাদীসে আছে,- যাহারা উক্ত রাত্রে বা দিনে ১০০ হইতে ৩০০ মরতবা দরূদ শরীফ হযরত (ﷺ) এর উপর পাঠ করিবে নিশ্চয়ই আল্লাহ তাআলা তাহাদের উপর দোজখ হারাম করিবেন। হযরত (দঃ)ও সুপারিশ করিয়া তাহাদিগকে বেহেশতে লইবেন। (সহীহ বোখারী) আর যাহারা উক্ত রাত্রিতে সূরা দোখান সাতবার ও সূরা ইয়াসীন তিনবার পাঠ করিবে, আল্লাহ তাহাদের তিনটি মকছুদ পুরা করিবেন। যথাঃ- (১) হায়াত বৃদ্ধি করিবেন। (২) রুজি-রেজক বৃদ্ধি করিবেন। (৩) সমস্ত পাপ মার্জনা করেবেন।’’[20]
উপরের কথাগুলো সবই বানোয়াট। সবচেয়ে দুঃখজনক কথা যে, গ্রন্থকার এখানে মেশকাত, তিরমিযী ও বুখারীর উদ্ধৃতি দিয়েছেন ভিত্তিহীন কিছু কথার জন্য, যে কথাগুলো এ গ্রন্থগুলো তো দূরের কথা কোনো হাদীসের গ্রন্থেই নেই। এভাবে প্রতারিত হচ্ছেন সরলপ্রাণ বাঙালি পাঠক।
[2] ইবনু হাজার , তাক্বরীব, পৃ ৬৩২; তাহযীব, ১২/২৫-২৬ ।
[3] আল- বুসীরী, যাওয়ায়েদ ইবন মাজাহ, পৃষ্ঠা ২০৩।
[4] আলবানী, যায়ীফু সুনান ইবন মাজাহ, পৃ, ১০৬; যায়ীফাহ, ৫/১৫৪।
[5] যাহাবী, মীযানুল ইতিদাল, ৫/৩৮১-৩৮২; ইবনু হাজার, লিসানুল মীযান, ৪/৩৯১।
[6] ইবনুল জাওযী, আল-ইলাল আল-মুতানাহিয়া ২/৫৬২; ইবনু হাজার, আল-ইসাবা ফী তাময়ীযীস সাহাবা ৫/৫৮০; তালখীস আল-হাবীর, ২/৬০৬।
[7] ইবনু মাজাহ, আস সুনান ১/৫৬৭; আল-বূসীরী, মিসবাহুয যুজাজাহ ২/৮৫।
[8] আল-মুনযিরী, তারগীব ২/৯৬; যাহাবী, মীযানুল ই’তিদাল ৪/৩৩৬; আলবানী, যায়ীফাহ ২/১২।
[9] ইবনু আর্রাক, তানযীহ্ ২/১২৬।
[10] সুয়ুতী, আল-জামে আস-সাগীর, ১/৬১০; দাইলামী, আল-ফিরদাউস, ২/১৯৬।
[11] আলবানী, যায়ীফুল জামে, পৃ ৪২০; যায়ীফাহ, ৩/৬৪৯-৬৫০।
[12] ইবনু হিববান, আল-মাজরূহীন, ১/১০৫-১০৭; ইবনু ‘আদী, আল-কামিল, ১/৩৫৩-৩৬৭; ইবনুল জাওযী, আদ-দুয়াফা ১/৫১; যাহাবী, মীযানুল ইতিদাল, ১/১৮২-১৮৫; ইবনু হাজার, তাহযীব ১/১৩৭-১৩৯।
[13] শাফিয়ী, মুহাম্মাদ বিন ইদরীস, আল-উম্ম ১/২৩১; বাইহাকী, আস-সুনানুল কুবরা ৩/৩১৯; ইবনু হাজার, তালখীসুল হাবীর ২/৬০৬।
[14] যাহাবী, মীযানুল ইতিদাল, ২/৭০; ইবনু হাজার, লিসানুল মীযান, ২/৬৪।
[15] আব্দুর রয্যাক, আল-মুসান্নাফ ৪/৩১৭; বায়হাকী, শুআবুল ঈমান, ৩/৩৪২।
[16] বুখারী, আততারীখুল কাবীর, ১/১৬৩; ইবনু আদী, আল-কামিল, ৭/৩৮২-৩৮৬; ইবনুল জাওযী, আদ-দুআফা ৩/৭৫; ইবনু হাজার, তাহযীব ৬/১৩৫; ৯/২৬১; তাক্বরীব, পৃ. ৪৯২।
[17] ইবনু হাজার, তাহযীব, ৬/১৩৫; তাক্বরীব, পৃষ্ঠা ৩৩৭ ।
[18] মাও. গোলাম রহমান, মকছুদোল মো’মেনীন, পৃ. ২৪০। আরো দেখুন: মুফতী হাবীব ছামদানী, বার চান্দের ফযীলত, পৃ. ২৬; অধ্যাপিকা কামরুন নেসা দুলাল, পৃ. ৩০৯।
[19] মাও. গোলাম রহমান, মকছুদোল মোমেনীন, পৃ.২৩৫; মুফতী ছামদানী, বার চান্দ.. পৃ. ২৫।
[20] মাও. গোলাম রহমান, মকছুদোল মো’মেনীন, পৃ. ২৩৬-২৪১।