সম্মানিত পাঠক, ইহূদী-খৃস্টানগণ তাওরাত, ইঞ্জিল ইত্যাদি কিতাবের নামে জালিয়াতি করে তাদের ধর্মকেই বিকৃত করতে সক্ষম হয়েছে। মুসলিম উম্মাহও ইহূদী-খৃস্টানদের হুবহু অনুকরণ করে বিভ্রান্তির গভীরে নিমজ্জিত হবে বলে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) উম্মাতকে বারবার সাবধান করেছেন।[1] আমরা দেখি যে, মুসলিম উম্মাহর মধ্যে হাদীসের নামে জালিয়াতির প্রবণতা ইহূদী-খৃস্টানদের মতই ব্যাপকতা লাভ করে। তবে মহান আল্লাহ দীন ইসলামকে বিকৃতি থেকে রক্ষা করেছেন। সাহাবীদের যুগ থেকে উম্মাতকে সনদ সংরক্ষণ ও সনদ-যাচাইয়ের তাওফীক দিয়ে সত্য ও মিথ্যার পার্থক্য করার পথটি রক্ষা করেছেন। ইহূদী-খৃস্টান ও অন্যান্য ধর্মের সাথে ইসলামের মৌলিক পার্থক্য এখানেই। অন্যান্য ধর্মের ধর্মগ্রন্থগুলোতে সনদ সংরক্ষণ ও বিচারের ব্যবস্থা না থাকায় সহীহ ও জাল এমনভাবে মিশে গিয়েছে যে, পার্থক্য করার কোনো যুক্তিসম্মত পদ্ধতি নেই, ফলে প্রত্যেকে নিজ নিজ যুক্তি-বুদ্ধি ও পছন্দ অনুসারে কিছু সহীহ ও কিছু জাল বলে দাবি করেন। আর ইসলামের মধ্যে জালিয়াতগণ অনেক জালিয়াতি করলেও যাচাই করার পদ্ধতি রয়েছে। কিন্তু যদি কেউ জালিয়াতি করতে চান বা জাল কথা গ্রহণ করতে চান তবে তার কথা ভিন্ন।
সম্মানিত পাঠক, ন্যূনতম পর্যায়ের সাধারণ জ্ঞানের যে কোনো মুসলিম বুঝতে পারেন যে, এ কথাগুলো জাল। কারণ এগুলোর কোনো সনদ নেই। ইসলামের প্রথম ৬/৭ শত বছরের মধ্যে লিখিত কোনো গ্রন্থে সনদ-বিহীনভাবেও এ মিথ্যা কথাগুলো উল্লেখ করা হয় নি। তবে এ সকল হাদীসকে সহীহ বলে গ্রহণ করা আরো ভয়ঙ্কর বিষয়। নিম্নের বিষয়গুলো লক্ষ্য করুন:
(ক) মীলাদের সমর্থকগণ নিশ্চিত করেছেন যে, প্রথম তিন প্রজন্মের কেউ মীলাদ উদযাপন করেন নি। পাকিস্তানের প্রসিদ্ধ গবেষক প্রফেসর ড. তাহির কাদিরী রচিত ‘মীলাদুন্নবী’ গ্রন্থটি পাঠ করলে পাঠক দেখবেন যে, তিনি নিজেও নিশ্চিত করেছেন যে, বাদশাহ কুকবূরী (মৃত্যু ৬৩০ হি) প্রথম মীলাদ উদযাপন শুরু করেন। এছাড়া তিনি মীলাদের সমর্থনে গত ৮০০ বৎসরের অনেক প্রসিদ্ধ আলিমের বক্তব্য উদ্ধৃত করেছেন। তাঁরা সকলেই বলেছেন, প্রথম তিন প্রজন্মের কেউ মীলাদ পালন করেন নি।[2] এখন উপরের জাল হাদীসগুলোকে সহীহ বলে দাবি করার অর্থ সাহাবী, তাবিয়ী ও তাবি-তাবিয়ী তিন প্রজন্মের সকলকে বিভ্রান্ত বলে দাবি করা (নাউযূ বিল্লাহ)। কারণ রাসূলুল্লাহ (ﷺ) ও খুলাফায়ে রাশেদীনের এতগুলো বক্তব্য জানার পরেও যারা মীলাদ পালন করেন নি তাদের চেয়ে হতভাগা-বদকার ও রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর মর্যাদার শত্রু আর কে হতে পারে!! (নাঊযু বিল্লাহ)
(খ) এ সকল হাদীসকে সহীহ বলে মানতে হলে হাজার বৎসরের সকল হাদীস সংকলক মুহাদ্দিসকে নবীজী (ﷺ)-এর দুশমন (!!) বলে গণ্য করতেই হবে। কারণ, ইবন আববাস (রা), আবূ দারদা (রা) থেকে বর্ণিত মীলাদের মর্যাদা বিষয়ক রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর হাদীস এবং আবূ বকর (রা), উমার (রা), উসমান (রা) ও আলী (রা) থেকে বর্ণিত মীলাদের হাদীসগুলো তাঁরা গোপন করেছেন। এ সকল সাহাবী (রা) থেকে সহীহ, যয়ীফ বা জাল সনদে বর্ণিত অতি সাধারণ বিষয়ে অগণিত হাদীস তাঁরা সংকলন করলেন, অথচ এত গুরুত্বপূর্ণ হাদীসগুলো তাঁরা কেউ কোনোভাবে সংকলন করলেন না!!
ইসলামের প্রথম হাজার বৎসরে সংকলিত হাদীসগ্রন্থগুলোতে হাঁটাচলা, পানাহার, মলমূত্র ইত্যাদি বিষয়ে অগণিত অধ্যায়, পরিচ্ছেদ ও অনুচ্ছেদ বিদ্যমান। কিন্তু ‘কিরাআতুল মাওলিদ’ (মীলাদ পাঠ), ‘আমালুল মাওলিদ’ (মীলাদ পালন), ‘ইহতিফালুল মাওলিদ’ (মীলাদ উদযাপন) ইত্যাদি নামে এ সকল হাদীসের গ্রন্থে একটি অধ্যায় তো দূরের কথা, একটি পরিচ্ছেদ, অনুচ্ছেদও তারা লিখেন নি এবং একটি হাদীসও তাঁরা সংকলন করেন নি।
(খ) ইমাম আবূ হানীফাসহ চার ইমাম ও ইসলামের প্রথম ৬০০ বৎসরের সকল ফকীহ একইভাবে রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর মর্যাদা ও মীলাদের দুশমন বলে গণ্য হবেন। কারণ, তাঁরা তাঁদের ফিকহী গ্রন্থগুলোতে অতি সামান্য বিষয় নিয়েও আলোচনা করেছেন। কিন্তু তাঁদের কারো গ্রন্থে ‘কিরাআতুল মাওলিদ’ (মীলাদ পাঠ), ‘আমালুল মাওলিদ’ (মীলাদ পালন), ‘তাযীমুল মাওলিদ’ (মীলাদের তাযীম) ইত্যাদি নামে কোনো একটি অধ্যায়, পরিচ্ছেদ, অনুচ্ছেদ বা মাসআলা তাঁরা লিখলেন না। এর গুরুত্বও বললেন না!
(গ) উম্মাতের প্রথম ৬০০ বৎসরের সকল আলিমই মীলাদ-বিরোধী ও রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর মর্যাদার দুশমন (!!!) বলে গণ্য হবেন। কারণ, ৬০৪ হিজরী সালে মীলাদুন্নবী পালনের উদ্ভব হওয়ার পর থেকে বিগত ৮০০ বৎসরে উম্মাতের আলিম ও বুজুর্গগণ মীলাদুন্নবী বিষয়ে হাজার হাজার পুস্তক-পুস্তিকা রচনা করেছেন। কিন্তু এর আগের ৬০০ বৎসরে একজন আলিম বা বুজুর্গ মীলাদুন্নবী বিষয়ে একটি পুস্তিকাও রচনা করেন নি। মীলাদের সমর্থক আলিমগণও বারবার উল্লেখ করেছেন যে, মীলাদ বিষয়ক প্রথম বই রচনা করেন আল্লামা আবুল খাত্তাব ইবনু দেহিয়া (৬৩৩ হি.)। তাঁর রচিত এ বইয়ের নাম: ‘‘আত-তানবীর ফী মাওলিদিল বাশির আন নাযীর’’।[3] পূর্ববর্তী ৬০০ বৎসরের ইমাম, ফকীহ, মুজতাহিদ, মুজাদ্দিদ, পীরানে পীর, বুজুর্গ কেউ মীলাদ বিষয়ে একটি পুস্তিকাও লিখেন নি। তাঁরা অনেক বই লিখেছেন, কিন্তু তাঁদের লেখা বইয়ের মধ্যে ‘কিরাআতুল মাওলিদ’ (মীলাদ পাঠ) বা ‘আমালুল মাওলিদ’ (মীলাদ পালন) বিষয়ে একটি ছোট্ট অনুচ্ছেদ বা বাক্যও লিখেন নি!
আমরা যখন বলি যে, ইসলামের প্রথম ৬০০ বৎসর মীলাদ পালন ছিল না, পরে উদ্ভব হয়েছে তখন বিষয়টি খুবই সহজ হয়ে যায়। যেহেতু তাঁদের সময়ে কেউ মীলাদ পালন করার বিষয়টি জানতই না সেহেতু তাঁরা এ বিষয়ে কিছু লিখেন নি। কিন্তু যখন প্রমাণ হয় যে, হাদীসে নববী এবং সাহাবী-তাবিয়ীগণের বক্তব্যে মীলাদের গুরুত্ব বিদ্যমান তখন বিষয়টি ভিন্ন হয়ে যায়। হাদীসে মীলাদের এত গুরুত্ব থাকা সত্ত্বেও তাঁরা মীলাদের বিষয়ে একটি লাইন লিখলেন না! জীবনে মীলাদ পালন করলেন না! তাঁরা কেমন মুসলমান???
বিষয়টি কী প্রমাণ করে? স্বভাবতই প্রমাণ করে যে, উম্মাতের প্রথম ৬০০ বৎসরে মুসলিমগণ ‘কিরাআতুল মাওলিদ’ (মীলাদ পাঠ), ‘আমালুল মাওলিদ’ (মীলাদ পালন) ইত্যাদি কিছুই জানতেন না। কিন্তু যদি কেউ উপরের হাদীসগুলোকে সহীহ বলে দাবি করেন তবে তাকে মানতেই হবে যে, উম্মাতের প্রথম ৬০০ বৎসরের সকল ইমাম, মুজাদ্দিদ, পীরানে পীর, বুজুর্গ সকলেই মীলাদ বিরোধী ছিলেন। শুধু তাই নয়, উপরন্তু তাঁরা মীলাদ বিষয়ক হাদীস গোপনের মত মহাপাপ করেছেন।
(ঘ) ইমাম শাফিয়ীর প্রতিটি বক্তব্য সংকলন ও আলোচনা করেছেন বাইহাকী, নাবাবী ও অন্যান্য শাফিয়ী মুহাদ্দিস-ফকীহ। ইবন হাজার হাইতামী শাফিয়ীর নামে জালকৃত এ বইয়ে মীলাদের গুরুত্ব বিষয়ে তাঁর এ মহান বক্তব্যটি তাঁরা সকলেই গায়েব করে দিয়েছেন! শাফিয়ী মাযহাবের কোনো গ্রন্থে এ বক্তব্য নেই। এমনকি ইবন হাজার হাইতামীর লেখা শাফিয়ী মাযহাবের বড়বড় ফিকহী গ্রন্থেও তিনি মীলাদ বিষয়ে ইমাম শাফিয়ীর এ বক্তব্য উদ্ধৃত করেন নি। আমাদের মানতে হবে যে, এ বক্তব্য জাল অথবা নাবাবী, বাইহাকী, গাযালী, সুয়ূতী, ইবন হাজার আসকালানী, ইবন হাজার হাইতামী ও সকল শাফিয়ী ফকীহ তাঁদের ঈমানী ত্রুটির কারণে মীলাদের প্রসঙ্গ গোপন করেছেন!!
[2] ড. তাহির কাদিরী, মীলাদুন্নবী (লাহোর, মিনহাজুল কুরআন পাবলিকেশন্স ২০০৪) পৃ ৫০৩, ৬১৫, ৬২৬-৬৩১, ৬৩৮-৬৩৯, ৯২৬।
[3] ইবন খাল্লিকান, ওয়াফায়াতুল আ’ইয়ান ৩/৪৪৯; সুয়ূতী, আল-হাবী (শামিলা) ১/২৭২, ১/১৮১-১৮২; ইবন হাজার হাইতামী, তুহফাতুল মুহতাজ ফী শরাহিল মিনহাজ (শামিলা) ৩১/৩৭৬-৩৭৭, ৩৮১; মুফতি আহমাদ ইয়ার খান, জা‘আল হক ২/৪০-৪১।