হাদীসের নামে জালিয়াতি মীলাদুন্নবী (ﷺ) উদযাপন ড. খোন্দকার আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর (রহ.) ১ টি
৪৭. ৮০০ বছরের সকল মীলাদ-পন্থীই কি সত্যগোপনকারী?

সম্মানিত পাঠক, এখানে আরো একটি বিষয় গুরুত্বপূর্ণ। বিগত ৮০০ বৎসর যাবৎ অগণিত আলিম মীলাদের পক্ষে বইপত্র লিখেছেন। তাঁরা সকলেই মীলাদকে বিদআতে হাসানা বলেছেন এবং ইসলামের প্রথম তিন যুগে কেউ মীলাদ পালন করেন নি বলে বারবার নিশ্চিত করেছেন। উপরের জাল হাদীসগুলোকে সহীহ মানতে হলে আমাদের মানতে হবে যে, তাঁরা সকলেই সত্য গোপন করেছেন এবং মীলাদের অবমর্যাদা করেছেন। তাঁরা আবূ লাহাবের আমল দিয়ে মীলাদ প্রমাণের চেষ্টা করেছেন, অথচ রাসূলুল্লাহ ﷺ ও খুলাফায়ে রাশেদীনের সুস্পষ্ট হাদীসগুলো গোপন করেছেন। হাদীস, তাফসীর, ফিকহ, ইতিহাস, তাসাউফ ইত্যাদি বিষয়ে সকল দুষ্প্রাপ্য গ্রন্থ সংগ্রহ ও অধ্যয়ন করে পানাহার, শয়ন-নিদ্রা, মলমূত্র এবং অন্যান্য অতি সাধারণ বিষয়ের হাদীসগুলো তারা সংগ্রহ, সংকলন ও যাচাই-বাছাই করলেন, অথচ মীলাদের গুরুত্ব বিষয়ে এত গুরুত্বপূর্ণ হাদীসগুলো তারা সংকলন বা মূল্যায়ন কিছুই করলেন না!!

সম্মানিত পাঠক, খৃস্টান প্রচারকণ বাংলাদেশের মুসলিমদের নানাবিধ প্রতারণার মাধ্যমে ধর্মান্তরিত করছেন। জালিয়াতিতে ভরা ‘কিতাবুল মোকাদ্দস’, ইঞ্জিল শরীফ ইত্যাদিকে ‘আল্লাহর কালাম’ হিসেবে পেশ করে তারা মুসলিমদের প্রতারণা করছেন। আমরা যখন ময়দানে তাদের সাথে আলোচনার মাধ্যমে জালিয়াতি প্রমাণ করতে যাই তখন তারা বিভিন্ন অযুহাতে পালিয়ে যান বা এড়িয়ে যান। কিন্তু ময়দান ফাঁকা হলেই তারা সরল মুসলিমদের বলেন, কুরআনেই তো আছে তাওরাত-ইঞ্জিল আল্লাহর কালাম, সেগুলোকে বিশ্বাস করতে হবে। আর আমাদের হাতের এগুলোই আদি-অকৃত্রিম তাওরাত-ইঞ্জিল। কাজেই এগুলো বিশ্বাস না করলে মুসলমান থাকা যাবে না!!

জাল হাদীসের বিষয়টিও একইরূপ। বিগত দেড় হাজার বছর যাবৎ যত জাল হাদীস ও জাল পুস্তক প্রকাশ পেয়েছে, উম্মাতের আলিমগণ সেগুলোর জালিয়াতি উন্মোচন করেছেন। কিন্তু যারা যে কোনোভাবে নিজের মত প্রমাণ করতে বদ্ধপরিকর তারা জালিয়াতির এ সকল প্রমাণ খন্ডনের চেষ্টা না করে এবং হাদীসগুলোর সনদ অনুসন্ধান না করেই সাধারণ মুসলিমদের সামনে এগুলোকে হাদীস হিসেবে পেশ করে নিজেদের মত প্রমাণের চেষ্টা করছেন। জাল ‘নি’মাতুল কুবরা’ গ্রন্থের ও মীলাদ বিষয়ক অন্যান্য জাল হাদীসের একই অবস্থা।

জালিয়াতি ও বিকৃতির অগণিত অকাট্য প্রমাণ জানার পরেও ইহূদী-খৃস্টানগণ বিভিন্ন অজুহাতে তাদের জাল ধর্মগ্রন্থগুলো প্রচার করে চলেছেন। মুসলিম উম্মাহর মধ্যেও কিছু মানুষ এরূপই করছেন। তুরস্কের মাকতাবাতুল হাকীকাহ প্রকাশিত এ জাল বইটির জালিয়াতি সুস্পষ্ট হওয়া সত্ত্বেও এবং এতে উল্লেখিত হাদীসগুলো সনদবিহীন ও ভিত্তিহীন হওয়া সত্ত্বেও মীলাদ সমর্থক কিছু আলিম এ বইটির অনুবাদ ও প্রচার করছেন। হাদীসগুলোর সনদ অনুসন্ধানের কোনোরূপ চেষ্টাও করছেন না। ইহূদী-খৃস্টান ধর্মে জাল কথাগুলো সহীহ কথার সাথে মিশে গিয়েছে। তবে সনদ ব্যবস্থার মাধ্যমে আল্লাহ উম্মাতে মুহাম্মাদীর জন্য যাচাইয়ের পথ খোলা রেখেছেন। হাজার বছর চলে গেলেও এবং হাজার হাজার প্রসিদ্ধ ইমাম আলিমের নামে জালিয়াতি করলেও কোনো জাল কথাই ইসলামের মধ্যে অনুপ্রবেশ করতে পারে না। সত্যানুসন্ধানীর জন্য নিরপেক্ষ ও বস্ত্তনিষ্ঠ যাচাইয়ের পথ উন্মুক্ত।

রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর নামে বা সাহাবী-তাবিয়ীগণের নামে মীলাদের পক্ষে এতগুলো হাদীস দেখে মুমিনের জন্য আনন্দিত হওয়াই স্বাভাবিক। তবে তাঁর ঈমানের দাবি যে, তিনি প্রথমেই এগুলোর সনদ ও সূত্র উদ্ধার করার চেষ্টা করবেন। নয়শত বা হাজার বছর পরে একজন আলিম একটি হাদীস বলছেন, তাহলে নিশ্চয় পুরাতন কোনো গ্রন্থে তা রয়েছে। মীলাদের পক্ষের বা বিপক্ষের প্রত্যেক আলিমের দায়িত্ব এগুলোর সনদ অনুসন্ধান ও যাচাই। যদি সনদ পাওয়া যায় ও গ্রহণযোগ্য হয় তবে সেগুলো মেনে নেওয়া প্রত্যেক মুমিনের ঈমানের দাবি। আর যদি সনদ না পাওয়া যায় বা সনদ জাল বলে প্রমাণ হয় তবে এগুলোকে প্রত্যাখ্যান করা প্রত্যেক মুমিনের দায়িত্ব। ইবন হাজার হাইতামী এবং অন্যান্য ইমাম ও মুহাদ্দিস উল্লেখ করেছেন যে, হাদীসের সনদ না জেনে বা অন্তত হাদীসের কোন গ্রন্থে তা সংকলিত তা নিশ্চিত না হয়ে সনদ-বিহীন হাদীস উল্লেখ করা ভয়ঙ্কর হারাম কর্ম এবং কোনো খতীব, ওয়ায়িজ বা লেখক এরূপ করলে তাকে রাষ্ট্রীয় ভাবে শাস্তি দেওয়া জরুরী।[1]

সম্মানিত পাঠক, মীলাদ ও অন্য যে কোনো বিষয়ে পক্ষে-বিপক্ষে ভিন্ন মত পোষণ করা, ইজতিহাদ করা ও প্রমাণ পেশ করার অধিকার সকলেরই রয়েছে। কিন্তু তাই বলে জালিয়াতি!! মহান আল্লাহ আমাদের হেফাযত করুন।

[1] ইবন হাজার হাইতামী, আল-ফাতাওয়া আল-হাদীসিয়্যাহ (বৈরুত, তুরাস), পৃষ্ঠা ৬৩-৬৪ ও ১২১-১২২।