সমকালীন মুসলিম সমাজের দীনদার মুসলিমদের মধ্যে সুপ্রসিদ্ধ বিশ্বাস যে, রাসূলুল্লাহ ﷺ-এর কোনো ছায়া ছিল না। ইসলামের ইতিহাসের প্রথম ৫০০ বৎসরে লিখিত হাদীস, তাফসীর, সীরাতুন্নবী, দালাইলুন নুবুওয়াত ইত্যাদি কোনো গ্রন্থে এ বিষয়টির কোনোরূপ উল্লেখ পাওয়া যায় না। ষষ্ঠ হিজরী শতক থেকে কোনো কোনো আলিম বিষয়টি উল্লেখ করেছেন। মরক্কো ও স্পেনের প্রসিদ্ধ ফকীহ ও মুহাদ্দিস আল্লামা কাযী ইয়ায ইবন মূসা ইয়াহসূবী সাবতী (৫৪৪ হি) ‘আশ শিফা বিতা’রীফি হুকুকিল মুসতাফা ﷺ’ নামক গ্রন্থে রাসূলুল্লাহ ﷺ-এর মু’জিযা, বৈশিষ্ট্য ও অলৌকিকত্ব বিষয়ক আলোচনায় বলেন:
وما ذكر من أنه كان لا ظل شخصه في شمس ولا قمر لأنه كان نورا
‘‘কথিত আছে যে, সূর্যের আলোয় বা চাঁদের আলোয় তাঁর দেহের কোনো ছায়া ছিল না; কারণ তিনি নূর ছিলেন।’’[1]
এখানে লক্ষণীয় যে, আল্লামা কাযী ইয়ায এ কথিত বক্তব্যটির কোনো সনদ বা অন্তত গ্রন্থসূত্র প্রদান করেন নি। এ গ্রন্থটির বিষয়ে মরোক্কোর অধিবাসী বিগত শতকের অন্যতম শ্রেষ্ঠ মুহাদ্দিস, ঐতিহাসিক ও সূফী আল্লামা মুহাম্মাদ ইবন জা’ফর কাত্তানী হাসানী (১৩৪৫ হি) বলেন:
وكتاب (الشفا ... لأبي الفضل عياض... وفيه أحاديث ضعيفة, وأخرى قيل فيها: إِنها موضوعة، تبع فيها ((شفاء الصدور)) (للخطيب أبي الربيع سليمان بن سبع السبتي)
‘‘কাযী ইয়াযের ‘আশ-শিফা’ গ্রন্থটি.. এতে যয়ীফ হাদীসাদি বিদ্যমান। এছাড়া আরো হাদীস বিদ্যমান যেগুলোকে জাল বলা হয়েছে। এগুলোতে (যয়ীফ-জাল হাদীস নির্ভরতায়) তাঁর অনুসরণ করেছেন খতীব আবুর রাবী সুলাইমান ইবন সাবু’ সাবতী তাঁর রচিত ‘‘শিফাউস সুদূর’’ নামক গ্রন্থে।’’[2]
সুলাইমান ইবন সাবু’ কাযী ইয়াযের ছাত্র প্রজন্মের আলিম ছিলেন। তাঁর দৌহিত্র মুহাম্মাদ ইবন হাসান ইবন আতিয়্যাহ ৫৯১ হিজরীতে মৃত্যুবরণ করেন।[3] এতে প্রতীয়মান হয় যে, তিনি ষষ্ঠ হিজরী শতকের মাঝামাঝি মৃত্যুবরণ করেন। রাসূলুল্লাহ ﷺ-এর ছায়া প্রসঙ্গে তিনি বলেন:
إن ظله ﷺ كان لا يقع على الأرض وإنه كان نورا وكان إذا مشى في الشمس أو القمر لا يظهر له ظل.
‘‘তাঁর ছায়া মাটিতে পড়ত না, তিনি নূর ছিলেন, সূর্যের বা চাঁদের আলোয় তিনি যখন হাঁটতেন তখন তাঁর কোনো ছায়া প্রকাশিত হতো না।’’[4]
আমরা দেখছি যে, তিনিও এ বক্তব্যের কোনো সনদ বা তথ্যসূত্র উল্লেখ করেন নি। তাঁর এ গ্রন্থের বিষয়ে ইমাম সাখাবী (৯০২ হি) বলেন:
في مجلدات واختصره بعض الأئمة, وفيه مناكير كثيرة
‘‘গ্রন্থটি অনেকগুলি খন্ডে রচিত। পরবর্তী কোনো কোনো ইমাম তা সংক্ষেপ করেছেন। এতে অনেক আপত্তিকর-ভিত্তিহীন হাদীস বিদ্যমান।’’[5]
ষষ্ঠ হিজরী শতকের অন্য প্রসিদ্ধ আলিম ইমাম আবুল ফারাজ ইবনুল জাওযী (৫০৮-৫৯৭ হি)। তিনি ‘আল-ওয়াফা বিআহওয়ালিল মুসতাফা ﷺ’ নামক গ্রন্থে সনদবিহীনভাবে একটি হাদীস উল্লেখ করে বলেন:
عن ابن عباس قال: لم يكن لرسول الله ﷺ ظل، ولم يقم مع شمس قط إلا غلب ضوؤه ضوء الشمس، ولم يقم مع سراج قط إلا غلب ضوؤه السراج
‘‘ইবন আববাস (রা) থেকে বর্ণিত: রাসূলুল্লাহ ﷺ-এর কোনো ছায়া ছিল না। তিনি যখনই সূর্যের আলোয় দাঁড়াতেন তাঁর আলো সূর্যের আলোর উপর প্রাধান্য লাভ করত। আর যখনই তিনি প্রদীপের আলোয় দাঁড়াতেন তাঁর আলো প্রদীপের আলোর উপর প্রাধান্য লাভ করত।’’[6]
পরবর্তী যুগগুলিতে আলিমগণ এগুলোর সনদ ও সূত্র সন্ধান করেছেন। বিশেষত ইমাম সুয়ূতী (৯১১ হি) ও তাঁর ছাত্রগণ এ বিষয়ে প্রাণান্ত চেষ্টা করেন। ইমাম সুয়ূতী রাসূলুল্লাহ ﷺ-এর এ সকল অলৌকিকত্ব সংকলনের জন্য দীর্ঘ ২০ বৎসর অক্লান্ত পরিশ্রম করে (খাসাইস কুবরা) গ্রন্থটি সংকলন করেন। এছাড়া তিনি ‘‘শিফা’’ গ্রন্থের হাদীসগুলির সূত্র বর্ণনায় গ্রন্থ রচনা করেন। তিনি বলেন:
أخرج الحكيم الترمذي من طريق عبد الرحمن بن قيس الزعفراني عن عبد الملك بن عبد الله بن الوليد عن ذكوان أن رسول اللهﷺ لم يكن يرى له ظل في شمس ولا قمر...
‘‘(চতুর্থ হিজরী শতকের প্রসিদ্ধ আলিম মুহাম্মাদ ইবন আলী ইবনুল হাসান) হাকীম তিরমিযী (মৃত্যু ৩২০ হিজরীর দিকে) উদ্ধৃত করেছেন (দ্বিতীয় হিজরী শতকের রাবী) আব্দুর রাহমান ইবন কাইস যা‘আফরানী থেকে, তিনি আব্দুল মালিক ইবন আব্দুল্লাহ ইবনুল ওয়ালীদ থেকে, তিনি তাবিয়ী যাকওয়ান (মৃত্যু ১০১ হি) থেকে, তিনি বলেন: সূর্যের আলোতে বা চাঁদের আলোতে রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর কোনো ছায়া দেখা যেত না...।’’[7]
ইমাম সুয়ূতীর ছাত্র আল্লামা মুহাম্মাদ ইবন ইউসুফ শামী (৯৪২ হি)। তাঁর রচিত প্রসিদ্ধ সীরাতগ্রন্থ ‘সুবুলুল হুদা ওয়ার রাশাদ ফী সীরাতি খাইরিল ইবাদ’। তিনি লিখেছেন যে, তিনি তিনশতাধিক গ্রন্থ অধ্যয়ন করে এ গ্রন্থটি রচনা করেছেন এবং এটি তাঁর সারা জীবনের সাধনার ফসল। এ গ্রন্থে তিনি বলেন:
قال ذكوان (رح) لم ير لرسول الله ﷺ ظل في شمس ولا قمر. رواه الحكيم الترمذي. وقال: معناه لئلا يطأ عليه كافر فيكون مذلة له.
‘‘যাকওয়ান (রাহ) বলেন: সূর্যের বা চাঁদের আলোয় রাসূলুল্লাহ ﷺ-এর ছায়া দেখা যেত না। হাকীম তিরমিযী কথাটি সংকলন করেছেন। তিনি বলেছেন: এর অর্থ হলো; যেন কোনো কাফির তাঁর ছায়া পদদলিত করতে না পারে; কারণ এতে তাঁর অবমাননা হয়।’’[8]
দশম-একাদশ হিজরী শতকের প্রসিদ্ধ হানাফী ফকীহ ও মুহাদ্দিস মোল্লা আলী কারী (১০১৪হি) কাযী ইয়াযের বক্তব্য ব্যাখ্যা করে বলেন:
ذكره الحكيم الترمذي في نوادر الأصول عند عبد الرحمن بن قيس، وهو مطعون، عن عبد الملك بن عبد الله بن الوليد، وهو مجهول، عن ذكوان
‘‘ছায়া না থাকার হাদীসটি হাকীম তিরমিযী ‘নাওয়াদিরুল উসূল’ গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন। তিনি আব্দুর রাহমান ইবন কাইস থেকে উদ্ধৃত করেছেন। আব্দুর রাহমান ইবন কাইস অভিযুক্ত রাবী। তিনি আব্দুল মালিক ইবনু আব্দুল্লাহ্ ইবনুল ওয়ালীদ থেকে, তিনি অজ্ঞাত পরিচয়। তিনি যাকওয়ান থেকে।’’[9]
মোল্লা আলী কারী অন্যত্র বলেন:
وَفِي حَدِيثِ ابْنِ عَبَّاسٍ قَالَ: لَمْ يَكُنْ لِرَسُولِ اللَّهِ ﷺ ظِلٌّ، وَلَمْ يَقُمْ مَعَ شَمْسٍ قَطُّ ...وَلَمْ يَقُمْ مَعَ سِرَاجٍ قَطُّ إِلاَّ غَلَبَ ضَوْءُهُ ذَكَرَهُ ابْنُ الْجَوْزِيِّ...
‘‘ইবন আববাসের হাদীস: ‘রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর কোনো ছায়া ছিল না। তিনি যখনই সূর্যের আলোয় ... প্রদীপের আলোয় দাঁড়াতেন তাঁর আলো ... প্রাধান্য লাভ করত।’ হাদীসটি ইবনুল জাওযী উল্লেখ করেছেন। ’’[10]
উল্লেখ্য যে, আল্লামা আহমাদ ইবন মুহাম্মাদ কাসতালানী (৯২৩ হি), মুহাম্মাদ ইবন আব্দুল বাকী যারকানী (১১২২ হি) ও অন্যান্য আলিমও ইবনুল জাওযী ও হাকীম তিরমিযীর সূত্র প্রদান করেছেন।[11] ইবনুল জাওযী উদ্ধৃত হাদীসটির সনদ তিনি নিজে বা অন্য কেউ উল্লেখ করেন নি। নবম হিজরী শতকের প্রসিদ্ধ ঐতিহাসিক ইমাম তাকিউদ্দীন আহমাদ ইবন আলী মাকরীযী (৮৪৫হি) এ হাদীসটির শুরুতে একটি সনদ উল্লেখ করে বলেন:
قال أحمد بن عبد الله الغدافي أخبرنا عمرو بن أبي عمرو عن محمد بن السائب عن أبي صالح عن ابن عباس : لم يكن....
‘আহমাদ ইবন আব্দুল্লাহ গাদ্দাফী বলেন, আমাদেরকে (তাবিয়ী) আমর ইবন আবী আমর বলেন (১৫০ হি), তিনি (তাবি-তাবিয়ী) মুহাম্মাদ ইবনুস সায়িব (১৪৬ হি) থেকে, তিনি (তাবিয়ী) আবূ সালিহ বাযাম থেকে, তিনি ইবন আববাস থেকে, তিনি বলেন: রাসূলুল্লাহ ﷺ-এর কোনো ছায়া ছিল না...।’’[12]
আহমাদ ইবন আব্দুল্লাহ গাদ্দাফী নামের কোনো রাবীর পরিচয় জানতে পারি নি। আর ইমাম মাকরীযী এ সনদ কোথায় পেলেন তাও জানান নি।
এভাবে সুয়ূতী, হালাবী, শামী, আলী কারী প্রমুখের আজীবনের গবেষণা ও অনুসন্ধান থেকে আমরা নিম্নের তথ্যগুলি আমরা জানতে পারি:
(ক) চতুর্থ শতকে হাকীম তিরমিযীর পূর্বে কোনো মুহাদ্দিস কোনো হাদীসের গ্রন্থে এ হাদীস বা এ অর্থে অন্য কোনো হাদীস সংকলন করেন নি।
(খ) ইমাম সুয়ূতী তাঁর জামি কাবীরের ভূমিকায় উল্লেখ করেছেন, যে সকল হাকীম তিরমিযী সংকলন করেছেন কিন্তু অন্য কোনো মুহাদ্দিসের গ্রন্থে পাওয়া যায় না সেগুলি সন্দেহাতীতভাবে অনির্ভরযোগ্য।[13] আমরা দেখেছি যে, মোল্লা আলী কারী, আবূ জাফর সিদ্দিকী ও অন্যান্য মুহাদ্দিস হাকীম তিরমিযীর গ্রন্থগুলি জাল হাদীসে পরিপূর্ণ হওয়ার কারণে সেগুলি পড়তে নিষেধ করেছেন।
(গ) আব্দুর রাহমান যা‘আফরানী থেকে শতাধিক বৎসর সময়ে হাদীসটি কে বা কারা বর্ণনা করে হাকীম তিরমিযীকে শুনালেন তা তিনি বলেন নি।
(ঘ) হাদীসটি মুরসাল। আমরা দেখেছি ইবনুল জাওযী এ বিষয়ক হাদীসের বর্ণনাকারী হিসেবে ইবনু আববাস (রা)-এর নাম উল্লেখ করেছেন। কিন্তু সুয়ূতী ও তাঁর ছাত্রগণের অনুসন্ধানে এ একটিমাত্র মুরসাল সনদ ছাড়া অন্য কোনো সনদ পাওয়া যায় নি। তাবিয়ী যাকওয়ান কার মাধ্যমে এ তথ্যটি জেনেছেন তা বলেন নি। তাঁর ছাত্র আব্দুল মালিক ইবন আব্দুল্লাহও অজ্ঞাত।
(ঙ) সর্বোপরি এ হাদীসটির মূল বর্ণনাকারী আব্দুর রাহমান ইবন কাইস যা‘আফরানী সুপরিচিত জালিয়াত। ইমাম আব্দুর রাহমান ইবন মাহদী, ইমাম আবূ যুরআত, ইমাম আহমাদ, ইমাম সালিহ যাজরাহ, ইমাম বুখারী ও অন্যান্য সকল মুহদ্দিস তাকে জালিয়াত ও পরিত্যক্ত বলে উল্লেখ করেছেন।[14]
আমরা ইতোপূর্বে ‘মুসান্নাফ আব্দুর রায্যাক-এর প্রথম খন্ডের হারানো অংশ’ নামক পুস্তকটির বিষয় আলোচনা করেছি। এ পুস্তকে এ হাদীসটি উল্লেখ করা হয়েছে। আমরা দেখেছি যে, পুস্তকটি সন্দেহাতীতভাবেই জাল। এটিকে ‘আব্দুর রায্যাক সানআনী’ রচিত বলে মনে করলে মুসলিম উম্মাহর সকল ইমাম, মুহাদ্দিস, ফকীহ ও বুজুর্গকে রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর মর্যাদা গোপনকারী বলে গণ্য করতেই হবে। আব্দুর রায্যাক হাদীসটি বর্ণনা ও সংকলন করবেন, অথচ ইমাম আহমাদ, বুখারী, মুসলিম ও অন্যান্য মুহাদ্দিসগণ হাজার বছর ধরে তাদের গ্রন্থগুলিতে হাদীসটি বয়কট করবেন বলে কল্পনাও করা যায় না। বিশেষত সুয়ূতী, শামী ও আলী কারী তাঁদের গ্রন্থে মুসান্নাফ আব্দুর রায্যাক থেকে হাজার হাজার উদ্ধৃতি প্রদান করবেন, অথচ এ হাদীসটি প্রমাণ করতে মুসান্নাফ গ্রন্থের ‘সহীহ হাদীস’ বাদ দিয়ে শতবৎসর পরে রচিত অনির্ভরযোগ্য বলে প্রসিদ্ধ গ্রন্থের উদ্ধৃতি দিবেন তা কল্পনা করা যায় না।
রাসূলুল্লাহ ﷺ-এর ছায়া ছিল বলে কোনে কোনো হাদীসে উল্লেখ করা হয়েছে। মুসনাদ আহমাদ ও অন্যান্য গ্রন্থে সংকলিত এক হাদীসে বলা হয়েছে, রাসূলুল্লাহ ﷺ একবার তাঁর স্ত্রী যাইনাব বিনত জাহশ (রা)-এর আচরণে কষ্ট পেয়ে কয়েক মাস তাঁর গৃহে গমন থেকে বিরত থাকেন। কয়েকমাস পর একদিন দুপুরে তিনি তাঁর গৃহে গমন করেন। এ প্রসঙ্গে যাইনাব (রা) বলেন:
قالت: فبينما أنا يوماً بنصف النهار؛ إذا أنا بظل رسول الله ﷺ مُقْبِل (فلما كان شهر ربيع الأول دخل عليها فرأت ظله فقالت إن هذا لظل رجل وما يدخل على النبي ﷺ فمن هذا فدخل النبي ﷺ)
‘‘এমতাবস্থায় একদিন দুপুরে আমি হঠাৎ রাসূলুল্লাহ ﷺ-এর ছায়া দেখতে পেলাম..। দ্বিতীয় বর্ণনায়: (প্রায় তিন মাস পরে) রবিউল আউআল মাসে একদিন রাসূলুল্লাহ ﷺ তাঁর গৃহে গমন করেন। যাইনাব (রা) তাঁর ছায়া দেখতে পান। তিনি বলেন: এ তো পুরুষ মানুষের ছায়া! রাসূলুল্লাহ ﷺ তো আমার নিকট আসেন না! তাহলে এ কার ছায়া? তখন রাসূলুল্লাহ ﷺ তাঁর গৃহে প্রবেশ করেন।’’
হাদীসটি উল্লেখ করে ইমাম হাইসামী বলেন: ‘‘হাদীসের একজন বর্ণনাকারী সুমাইয়া (শুমাইসা)। আবূ দাউদ ও অন্যান্য মুহাদ্দিস তাঁর হাদীস গ্রহণ করেছেন। কেউ তাকে দুর্বল বলেন নি। অন্যান্য রাবী নির্ভরযোগ্য।’’ শুমাইসা নামক এ মহিলা তাবিয়ী আয়েশা (রা)-এর ছাত্রী ছিলেন। ইয়াহইয়া ইবন মায়ীন, ইবন আবী হাযিম, দারাওয়ারদী ও অন্যান্য মুহাদ্দিস তাঁকে সিকাহ বা নির্ভরযোগ্য বলেছেন। শু’বা ইবনুল হাজ্জাজ ও অন্যান্য প্রসিদ্ধ তাবিয়ী মুহাদ্দিস তাঁর হাদীস গ্রহণ করেছেন। সনদের অন্যান্য বর্ণনাকারী সহীহ মুসলিমের রাবী। এভাবে আমরা দেখছি যে, হাদীসটি সহীহ।[15]
উপরের হাদীসতাত্ত্বিক আলোচনার ভিত্তিতে আমরা বলতে পারি:
(ক) সনদতাত্ত্বিকভাবে আমরা দেখলাম যে, তাঁর ছায়া প্রকাশিত না হওয়ার বিষয়টি প্রমাণিত নয়। এ বিষয়ক দুটি হাদীসেরই পুরো সনদ বা সনদের দীর্ঘ অংশ অপরিজ্ঞাত। এছাড়া সনদে অজ্ঞাত পরিচয় ও জালিয়াত রাবী বিদ্যমান। এর বিপরীতে তাঁর ছায়া প্রকাশিত হতো অর্থের হাদীসটি সহীহ বা অধিকতর শক্তিশালী। যদি উভয় হাদীস সহীহ প্রমাণিত হতো তাহলে বলা যেত যে, কখনো তাঁর ছায়া প্রকাশিত হতো এবং কখনো হতো না।
(খ) অলৌকিক বিষয় সর্বদা মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করে এবং মানুষ সহজে তা ভুলে না। এজন্য রাসূলুল্লাহ ﷺ-এর অলৌকিক বিষয়গুলো অনেকগুলি সনদে বর্ণিত। মি’রাজ, চাঁদ দ্বিখন্ডিত করা, সূর্যগ্রহণ, খাদ্য ও পানীয় বিষয়ক মুজিযা ইত্যাদি সবই এরূপ। অথচ মুসলিম উম্মাহর প্রথম প্রায় ৫০০ বৎসরে প্রসিদ্ধ চার ইমাম বা অন্য কোনো ইমাম, ফকীহ, মুহাদ্দিস, আকীদাবিদ বা বুজুর্গ তাঁর ছায়া না থাকার বিষয়টি কোনোভাবে উল্লেখ করেন নি। এতে প্রমাণিত হয় যে, এ বিষয়ক হাদীসগুলো একেবারেই ভিত্তিহীন।
(গ) মহান আল্লাহ তাঁর মহান রাসূল (ﷺ)-কে অনেক অলৌকিক বৈশিষ্ট্য প্রদান করেছিলেন। সহীহ সনদে বর্ণিত এ সকল অলৌকিক বৈশিষ্ট্য বিশ্বাস করা মুমিনের দায়িত্ব। পাশাপাশি কুরআন ও সহীহ হাদীসে বর্ণিত অলৌকিকত্ব ও বৈশিষ্ট্যই তাঁর মর্যাদা প্রমাণের জন্য যথেষ্ট; জাল বা দুর্বল হাদীসের উপর বিশ্বাস ও ভক্তির ভিত্তি স্থাপনের কোনো প্রয়োজন নেই।
(ঘ) রাসূলুল্লাহ ﷺ-এর ছায়া প্রকাশিত না হওয়ার মত অলৌকিকত্ব মহান আল্লাহ তাঁকে প্রদান করতে পারেন। তিনি তাঁকে এর চেয়ে অনেক বড় বড় বৈশিষ্ট্য প্রদান করেছেন। তবে বিষয়টি অবশ্যই সহীহ সনদে প্রমাণিত হতে হবে। তা না হলে আমরা তাঁর নামে মিথ্যা বলার পাপে পাপী হব।
(ঙ) সর্বাবস্থায় কুরআন ও সহীহ হাদীস দ্বারা প্রমাণিত বিষয়গুলি বাদ দিয়ে এরূপ বিষয়কে রাসূলুল্লাহ ﷺ-এর মর্যাদার মূল বিষয় বলে গণ্য করা খুবই দুঃখজনক। মহান আল্লাহই ভাল জানেন। আমরা তাঁর তাওফীক প্রার্থনা করছি।
[2] কাত্তানী, আর-রিসালাতুল মুসতাতরাফা, পৃষ্ঠা ১০৬।
[3] মুহাম্মাদ ইবন আব্দুল্লাহ কুযায়ী, আত-তাকমিলা লিকিতাবিস সিলাহ (শামিলা) ২/১৬০।
[4] শামী, মুহাম্মাদ ইবনু ইউসূফ (৯৪২হি.), সুবুলুল হুদা/ সীরাহ শামিয়্যাহ ২/৯০।
[5] সাখাবী, ই’লানুত তাওবীখ, পৃ ১১০; কাত্তানী, আর-রিসালাতুল মুসতাতরাফা (শামিলা) ১১/২৪।
[6] ইবনুল জাওযী, আল-ওয়াফা, পৃষ্ঠা ৪১২; শামী, সীরাহ শামিয়্যাহ ২/৪০।
[7] সুয়ূতী, আল-খাসাইসুল কুবরা ১/১২২; মানাহিলুস সাফা..আহাদীসিস শিফা, পৃষ্ঠা ১৭৩।
[8] শামী, মুহাম্মাদ ইবনু ইউসূফ (৯৪২ হি), সীরাহ শামিয়াহ (সুবুলুল হুদা) ২/৯০।
[9] আলী কারী, শারহুশ শিফা ১/৭৫৩।
[10] মোল্লা আলী কারী, জামউল ওয়াসাইল ফী শারহিশ শামাইল (দারুল আকসা: শামিলা) ১/২১৭।
[11] কাসতালানী, আল-মাওয়াহিবুল্লাদুন্নিয়্যাহ ২/২৭৫; যারকানী, শারহুল মাওয়াহিবিল লাদুন্নিয়া ৭/১৯৯-২০০।
[12] মাকরীযী, ইমতাউল আসমা‘আ বিমা লিন্নাবিয়্যি মিনাল আহওয়াল.. (বৈরুত, দারুল কুতুবিল ইলমিয়্যাহ, ১ম প্রকাশ, ১৯৯৯: শামিলা) ২/১৭০।
[13] সুয়ূতী, জামিউল আহাদীস (শামিলা ) ১/৬
[14] ইবন আদী, আল-কামিল ৪/২৯১; যাহাবী, মীযানুল ই’তিদাল ৪/৩০৯।
[15] আহমাদ ইবন হাম্বাল, আল-মুসনাদ ৬/১৩১; হাইসামী, মাজমাউয যাওয়াইদ ৪/৩২৩; আলবানী, ইরওয়াউল গালীল ৭/৮৫; সাহীহাহ ১৩/৮।