হাদীসের নামে জালিয়াতি জাল হাদীস প্রমাণে জাল পুস্তক ড. খোন্দকার আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর (রহ.) ১ টি
(গ) বুখারী ও মুসলিম-সহ সকলেই কি নবী-বিরোধী ছিলেন?

সম্মানিত পাঠক, যদি ‘মুসান্নাফ আব্দুর রায্যাক-এর প্রথম খন্ডের হারানো অংশ’ নামক পুস্তকটি সঠিক প্রমাণ হয় তবে ইমাম আহমাদ ও সিহাহ-সিত্তার সংকলকগণ-সহ ও তৃতীয় শতক থেকে উম্মাতের সকল মুহাদ্দিস, ফকীহ ও বুজুর্গ রাসূলুল্লাহ ﷺ-এর মর্যাদার বিরোধী ও দীনের দুশমন বলে প্রমাণ হবে। কারণ তাঁরা ইমাম আব্দুর রায্যাকের মুসান্নাফের মধ্যে বিদ্যমান এতগুলি সহীহ হাদীসকে জেনে শুনে গোপন করেছেন। হাদীস সংকলন বিষয়ে যাদের সামান্যতম জ্ঞান আছে তারা বিষয়টি সহজেই উপলব্ধি করতে পারবেন।

পূর্বের আলোচনা থেকে আমরা জেনেছি যে, দ্বিতীয় হিজরীর প্রথমার্ধ থেকে মুসলিম বিশ্বের আলিমগণ হাদীসের সন্ধানে প্রতিটি গ্রাম ও শহর পরিভ্রমণ করতে থাকেন। এ সময় থেকে কোনো হাদীসই আর শুধু একটি সনদে বর্ণিত হয় নি। দ্বিতীয় হিজরী শতক থেকে মুহাদ্দিসগণ একটি হাদীস অনেক সনদে বর্ণনা করতেন এবং তাঁদের গ্রন্থগুলোতে সংকলন করতেন। এখন নিম্নের বিষয়গুলি লক্ষ্য করুন:

(১) জাবির ইবন আব্দুল্লাহ (রা) ৭৫ হিজরীতে মৃত্যুবরণ করেন। ফলে অনেক তাবিয়ী তাঁর থেকে হাদীস শিক্ষার সুযোগ পান। তাঁর ছাত্রের সংখ্যা ১৬৫ জনেরও বেশি। অবাক বিষয় যে, এতবড় গুরুত্বপূর্ণ হাদীস তাঁর একজন মাত্র ছাত্র বর্ণনা করবেন, অন্য কেউই করবেন না।

(২) মুহাম্মাদ ইবনুল মুনকাদির (মৃুত্যু ১৩০ হি) দ্বিতীয় হিজরী শতকের প্রথমার্ধের সুপ্রসিদ্ধ তাবিয়ী। সিহাহ সিত্তা ও অন্যান্য গ্রন্থের মধ্যেই তাঁর দেড় শতাধিক ছাত্রের বর্ণনা বিদ্যমান। তাঁদের মধ্যে রয়েছেন ইমাম জাফর সাদিক, ইমাম আবূ হানীফা, ইমাম মালিক, ইমাম আওযায়ী, সুফিয়ান সাওরী, শুবা ইবনুল হাজ্জাজ, ইবনুল মাজিশূন, ইবন জুরাইজ, আমর ইবন দীনার ও অন্যান্য সুপ্রসিদ্ধ ইমাম ও মুহাদ্দিস। হাদীসের গ্রন্থগুলিতে একটি সহীহ হাদীস খুঁজে পাওয়া যায় না যা ইবনুল মুনকাদির থেকে শুধু একজন ছাত্র বর্ণনা করেছেন, অন্য কোনো ছাত্রই বর্ণনা করেন নি। তাহলে এ হাদীসটি মা’মার ইবনু রাশিদ ছাড়া অন্য কেউ বর্ণনা করলেন না কেন? ইবনুল মুনকাদির গোপন করে রেখেছিলেন? না ইমাম আবূ হানীফা, ইমাম মালিক, সুফইয়ান সাওরী ও অন্যান্য ছাত্র হাদীসটি তাঁর মুখ থেকে শোনার পরেও গোপন করেছিলেন?

(৩) মা’মার ইবনু রাশিদ (৯৬-১৫৪ হি) প্রসিদ্ধ তাবি-তাবিয়ী। প্রসিদ্ধ গ্রন্থগুলোতেই তাঁর প্রায় ৭৫ জন ছাত্রের বর্ণিত হাদীস পাওয়া যায়। রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর একটি সহীহ হাদীসও খুঁজে পাওয়া যায় না যা মামার ইবনু রাশিদ থেকে শুধু একজন ছাত্র বর্ণনা করেছেন। তাঁর প্রতিটি হাদীসই একাধিক ছাত্র বর্ণনা করেছেন। তাহলে এ হাদীসটি আব্দুর রায্যাক ছাড়া অন্য কেউ বর্ণনা করলেন না কেন? রাসূলুল্লাহ ﷺ-এর মর্যাদা গোপন করতে?

(৪) ইমাম আব্দুর রায্যাক ইবন হাম্মাম সানআনী (১২৬-২১১ হি) দ্বিতীয়-তৃতীয় হিজরী শতকের অন্যতম শ্রেষ্ঠ মুহাদ্দিস। প্রসিদ্ধ গ্রন্থগুলোতে তাঁর শতাধিক ছাত্রের বর্ণনা বিদ্যমান। একটিও সহীহ মারফূ (নববী) হাদীস পাওয়া যায় না যা আব্দুর রায্যাক থেকে তার একজন মাত্র ছাত্র বর্ণনা করেছেন। তাহলে এ হাদীসটি অন্য কোনো ছাত্র বর্ণনা করলেন না কেন? রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর মর্যাদা গোপন করার উদ্দেশ্যে?

(৫) মুসান্নাফ আব্দুর রায্যাক-এর মধ্যে বিদ্যমান সকল মারফূ (নববী) হাদীস তাঁর সনদে ও অন্যান্য সনদে সিহাহ সিত্তা ও তৃতীয়-চতুর্থ-পঞ্চম হিজরী শতকে সংকলিত হাদীস গ্রন্থগুলিতে সংকলিত। পাঠক, আপনি রাসূলুল্লাহ ﷺ-এর একটি সহীহ বা যয়ীফ হাদীসও দেখাতে পারবেন না যা মুসান্নাফে আব্দুর রায্যাকে সংকলিত কিন্তু বিশ্বের অন্য কোনো হাদীসগ্রন্থে এক বা একাধিক সনদে সংকলিত নয়। এখন প্রশ্ন হলো: ইমাম বুখারী, ইমাম মুসলিম, সিহাহ সিত্তার প্রণেতাগণ ও পরবর্তী যুগগুলোর মুহাদ্দিসগণ ইমাম আব্দুর রায্যাক-এর মুসান্নাফ গ্রন্থের সকল মারফূ বা নববী হাদীস গ্রহণ ও সংকলন করলেন, কিন্তু এ গ্রন্থে বিদ্যমান নূর মুহাম্মাদী বিষয়ক ‘সহীহ সনদে’ (!) সংকলিত এতগুলো হাদীসের একটিও তাঁরা সংকলন করলেন না কেন? হাজার বছর ধরে একটি হাদীস-গ্রন্থেও এসকল হাদীসের একটিও নেই কেন? তাঁরা সকলেই কি রাসূলুল্লাহ ﷺ-এর মর্যাদা গোপন করতে চেয়েছেন?

(৬) সহীহুল বুখারীর একটি অধ্যায়ের নাম ‘কিতাব বাদয়িল খালক’ ‘সৃষ্টির শুরুর অধ্যায়’। এ অধ্যায়ে সাপ, বিচ্ছু, মাছি, জিন, ফিরিশতা ইত্যাদি বিষয়ক কত হাদীস ইমাম বুখারী সংকলন করেছেন। কিন্তু তাঁর উস্তাদগণের উস্তাদ আব্দুর রায্যাকের মুসান্নাফে সংকলিত নূর মুহাম্মাদী বিষয় কয়েক ডজন সহীহ (!) হাদীসের একটিও তিনি উল্লেখ করলেন না! আব্দুর রায্যাক বর্ণিত প্রায় ১৫০টি হাদীস তিনি তাঁর সহীহ গ্রন্থে সংকলন করলেন অথচ নূর মুহাম্মাদ বিষয়ক এতগুলো সহীহ (!) হাদীস তিনি গ্রহণ করলেন না!

(৭) উবাদা ইবনুস সামিত (রা), আব্দুল্লাহ ইবন আববাস (রা) ও অন্যান্য সাহাবী থেকে বিভিন্ন সহীহ সনদে বর্ণিত:

إِنَّ أَوَّلَ مَا خَلَقَ اللَّهُ تَبَارَكَ وَتَعَالَى الْقَلَمُ../ أَوَّلَ شَيْءٍ خلقه الله القلم

‘আল্লাহ সর্বপ্রথম ‘কলম’ সৃষ্টি করেন’। এ সকল হাদীস ইমাম আহমাদ, তিরমিযী, আবূ দাউদ এবং অন্যান্য মুহাদ্দিস বিভিন্ন সনদে সংকলন করেছেন। ইমাম ইবন আবী শাইবা তাঁর মুসান্নাফ গ্রন্থে (كتاب الأوائل: أول ما فُعِل...) ‘‘সর্বপ্রথম বিষয়ক অধ্যায়: প্রথম কী হলো...’’ নামে একটি অধ্যায় সংকলন করেছেন। এ অধ্যায়েও তিনি ‘সর্বপ্রথম কলম সৃষ্টির’ এ হাদীসটি উদ্ধৃত করেছেন। কিন্তু তিনি বা অন্য কোনো মুহাদ্দিস সর্বপ্রথম সৃষ্টি, সৃষ্টির শুরু বা অন্য কোনো অধ্যায়ে নূর মুহাম্মাদী বিষয়ক হাদীসগুলো উল্লেখ করেন নি। কেন? রাসূলুল্লাহ ﷺ-এর মর্যাদা কমিয়ে কলম-এর মর্যাদা বাড়ানোর জন্য?

(৮) সম্মানিত পাঠক, মুসান্নাফ আব্দুর রায্যাকের মধ্যে বিদ্যমান অধ্যায় ও পরিচ্ছেদগুলো মুসান্নাফ ইবন আবী শাইবা ও অন্যান্য সকল হাদীস গ্রন্থে বিদ্যমান। কিন্তু ‘তাখলীক নূর মুহাম্মাদ ﷺ’ (নূর মুহাম্মাদীর সৃষ্টি) নামে একটি অধ্যায় মুসলিম বিশ্বের কোনো একটি হাদীসের গ্রনেহও নেই। ৫০০ বৎসর পর্যন্ত সংকলিত ফিকহ ও আকীদার কোনো গ্রন্থেও ‘নূর মুহাম্মাদ’ বিষয়ক অধ্যায়, পরিচ্ছেদ, অনুচ্ছেদ বা সামান্যতম কোনো আলোচনা নেই। তাঁরা মুসান্নাফ আব্দুর রায্যাক থেকে অগণিত হাদীস গ্রহণ করলেন, সংকলন করলেন এবং এগুলিকে প্রমাণ হিসেবে পেশ করলেন অথচ নূর মুহাম্মাদ বিষয়ক এতগুলো হাদীস এভাবে এড়িয়ে গেলেন কেন?

(৯) এ ‘হারানো’ বইটি যদি সত্যই আব্দুর রায্যাক রচিত হয় তাহলে বুঝতে হবে যে, ইমাম আহমাদ-সহ ইমাম আব্দুর রায্যাকের ছাত্রগণ, পরবর্তী সকল মুহাদ্দিস, ফকীহ, আকীদাবিদ ও বুজুর্গগণ রাসূলুল্লাহ ﷺ-এর মর্যাদা গোপন করতেই এরূপ করেছেন (নাউযূ বিল্লাহ)! আর তাঁদেরকে যদি আমরা রাসূলুল্লাহ ﷺ-এর মর্যাদা প্রতিষ্ঠার অতন্দ্র প্রহরী বলে গণ্য করি তবে এ পুস্তকটিকে জাল বলে নিশ্চিতভাবে বিশ্বাস করতে হবে। তৃতীয় কোনো ব্যাখ্যা কি পাঠক দেখাতে পারবেন?

সম্মানিত পাঠক, কোন্টি আপনার দৃষ্টিতে গ্রহণযোগ্য? একটি জাল হাদীসকে প্রমাণ করতে এভাবে হাজার বছরের সকল মুহাদ্দিস, ফকীহ, আকীদাবিদ ও বুজুর্গকে রাসূলুল্লাহ ﷺ-এর মর্যাদা গোপনকারী বলা? অথবা চার ইমাম-সহ উম্মাতের প্রথম শতকগুলোর ইমাম, মুহাদ্দিস, ফকীহ, আকীদাবিদ ও বুজুর্গগণ যে সকল হাদীস কোনোভাবে উল্লেখ করেন নি এবং যে বিষয়ে মোটেও কথা বলেন নি সে হাদীস ও সে বিষয় বর্জন করা?