হাদীসের নামে জালিয়াতি ৭. মিথ্যার পরিচয় ও চিহ্নিত করণ ড. খোন্দকার আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর (রহ.) ১ টি

যে সকল রাবী মিথ্যা হাদীস বর্ণনা করেন বলে মুহাদ্দিসগণ বুঝতে পেরেছেন তাদেরকে তাঁরা বিভিন্ন বিশেষণে আখ্যায়িত করেছেন। কখনো তারা তাদেরকে সুস্পষ্টত মিথ্যাবাদী ও জালিয়াত বলে আখ্যায়িত করেছেন। কখনো বা তাদেরকে সরাসরি মিথ্যবাদী বা জালিয়াত না বলে অন্যান্য শব্দ ব্যবহার করেছেন। এখানে লক্ষ্যণীয় যে, প্রথম তিন শতাব্দীর মুহাদ্দিসগণ সাধারণত সহজে কাউকে ‘মিথ্যাবাদী’ বলতে চাইতেন না। বিশেষত, যে ব্যক্তির বিষয়ে মুহাদ্দিসগণ অনিচ্ছাকৃত মিথ্যা বলেছেন বলে ধারণা করেছেন তার বিষয়ে কিছু ‘নরম’ শব্দ ব্যবহার করতেন। মিথ্যাবাদী রাবীর বিষয়ে মুহাদ্দিসগণের পরিভাষাকে আমরা সংক্ষেপে নিম্নোক্ত কয়েকভাগে ভাগ করতে পারি:

(ক) সরাসরি মিথ্যাবাদী বা জালিয়াত বলে উল্লেখ করা

রাবীর মিথ্যাচারিতা বুঝাতে মুহাদ্দিসগণ বলে থাকেন:

كاذب، كذاب، يكذب، دجال، وضاع، يضع، أكذب الناس، متهم...

মিথ্যাবাদী, জঘন্য মিথ্যাবাদী, মিথ্যা বলে, দাজ্জাল, জঘন্য জালিয়াত, জাল করে, অভিযুক্ত, একটি হাদীস জাল করেছে, সবচেয়ে বড় মিথ্যাবাদী, মিথ্যার একটি স্তম্ভ, অমুক মুহাদ্দিস তাকে জালিয়াত বলে উল্লেখ করেছেন, অমুক তাঁকে মিথ্যাবাদী বলে অভিযুক্ত করেছেন.... ইত্যাদি।

(খ) বাতিল হাদীস বা বালা মুসিবত বর্ণনাকারী বলে উল্লেখ করা

রাবীর মিথ্যাচারিতা বুঝানোর জন্য ব্যবহৃত পরিভাষাগুলোর অন্যতম:

يحدث بالأباطيل، له أباطيل، له بلايا، مصائب، طامات، من بلاياه، مصائبه، من آفته، آفته قلان، خبيث الحديث، يسرق الحديث...

বাতিল হাদীস বর্ণনা করে, তার কিছু বাতিল হাদীস আছে, তার কিছু বালা-মুসিবত আছে, তার বর্ণিত বালা-মুসিবতের মধ্যে অমুক হাদীসটি,... এ হাদীসের বিপদ অমুক... খবীস হাদীস বর্ণনা করে... হাদীস চুরি করে....

(গ) মুনকার (আপত্তিকর) বা মাতরূক (পরিত্যক্ত) বলে উল্লেখ করা

‘মুনকার’ অর্থ ‘অস্বীকারকৃত’, ‘আপত্তিকৃত’ বা ‘গর্হিত’। মুহাদ্দিসগণ বিভিন্ন অর্থে রাবীকে এবং হাদীসকে ‘মুনকার’ বলে অভিহিত করেছেন। অনেকে দুর্বল হাদীস বা দুর্বল রাবীকে ‘মুনকার’ বলেছেন। কেউ কেউ মিথ্যাবাদী রাবীকে ‘মুনকার’ বলেছেন। বিশেষত, ইমাম বুখারী রাবীগণের ত্রুটি উল্লেখের বিষয়ে অত্যন্ত ‘নরম’ শব্দ ব্যবহার করতেন। তিনি সরাসরি কাউকে ‘মিথ্যাবাদী’ বলে উল্লেখ করেন নি। বরং অন্য মুহাদ্দিসগণ যাকে মিথ্যাবাদী বলেছেন, তিনি তাকে ‘মুনকার’ বলেছেন, অথবা ‘মাতরূক’ বা ‘মাসকূত আনহু’, ‘মানযূর ফীহ’ অর্থাৎ ‘পরিত্যক্ত’, ‘তাঁর বিষয়ে আপত্তি রয়েছে’ বলেছেন।

মুহাদ্দিসগণের মধ্যে প্রচলিত আরেকটি পরিভাষা: ‘‘মাতরূক’’, অর্থাৎ ‘পরিত্যক্ত’ বা ‘পরিত্যাজ্য’। সাধারণত মুহাদ্দিসগণ অত্যন্ত দুর্বল রাবীকে ‘পরিত্যক্ত’ বলেন। তবে ইমাম বুখারী, নাসাঈ, দারাকুতনী ও অন্য কতিপয় মুহাদ্দিস মিথ্যাবাদী রাবীকে ‘মাতরূক’ বলে অভিহিত করেছেন। বিশেষত ইমাম বুখারী ও ইমাম নাসাঈ কাউকে ‘মাতরূক’ বা পরিত্যক্ত বলার অর্থই হলো যে, তাঁরা তাকে মিথ্যাবাদী বলে অভিযুক্ত করছেন।

অনুরূপভাবে মুহাদ্দিসগণ যদি বলেন যে ‘অমুকের হাদীস বর্ণনা করা বৈধ নয়’ তাহলেও তার মিথ্যাচারিতা বুঝা যায়।

(ঘ) তার হাদীস কিছুই নয়, মূল্যহীন... বলে উল্লেখ করা

কেউ কেউ রাবীর মিথ্যাচারিতা বুঝাতে রাবী বা তার বর্ণিত হাদীসকে

ليس بشيء، لا يساوي شيئا، لا يساوي فلسا....

‘মূল্যহীন’, ‘কিছুই নয়’, ‘এক পয়সাতেও নেয়া যায় না’ বা অনুরূপ কথা বলেছেন। এক্ষেত্রে ইমাম শাফিয়ীর কথা প্রনিধানযোগ্য। ইমাম ইসমাঈল ইবনু ইয়াহইয়া মুযানী (২৬৪ হি) বলেন, একদিন একব্যক্তি সম্পর্কে আমি বলি যে, লোকটি মিথ্যাবাদী। ইমাম শাফিয়ী (২০৪ হি) আমাকে বলেন, তুমি তোমরা কথাবার্তা পরিশীলিত কর। তুমি ‘মিথ্যাবাদী’ (كذاب) না বলে বল, (حديثه ليس بشيء) ‘তার হাদীস কিছুই নয়’।

(ঙ) পতিত, ধ্বংসপ্রাপ্ত, অত্যন্ত দুর্বল ...ইত্যাদি বলে উল্লেখ করা

কিছু শব্দ দ্বারা মুহাদ্দিসগণ রাবীর কঠিন দুর্বলতা ব্যক্ত করেন। যেমন,

ساقط، واه، واه بمرة، هالك، ذاهب الحديث...

পতিত, অত্যন্ত দুর্বল, একেবারেই বাতিল, ধ্বংসগ্রস্থ, তার হাদীস চলে গেছে, উড়ে গেছে... ইত্যাদি। এ সকল রাবীর হাদীস ইচ্ছাকৃত মিথ্যা না হলেও অনিচ্ছাকৃত মিথ্যা এবং একেবারেই অগ্রহণযোগ্য পর্যায়ের। অনেক মুহাদ্দিস এ পর্যায়ের রাবীর হাদীসকেও জাল বা মিথ্যা বলে গণ্য করেছেন।