হাদীসের নামে জালিয়াতি ৬. মিথ্যার প্রকারভেদ ড. খোন্দকার আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর (রহ.) ১ টি
৬. ২. ২. প্রচলিত কথা হাদীস নামে চালানো

অনেক সময় দুর্বল রাবী বা মিথ্যাবাদী রাবী ভুলক্রমে বা ইচ্ছাকৃতভাবে কোনো সাহাবী বা তাবিয়ীর কথা, অথবা কোনো প্রবাদ বাক্য, নেককার ব্যক্তির বাণী, পূর্ববর্তী নবীদের নামে প্রচলিত কথা, চিকিৎসা বিজ্ঞানের কোনো কথা, কোনো প্রসিদ্ধ পন্ডিতের বাণী বা অনুরূপ কোনো প্রচলিত কথাকে ‘হাদীসে রাসূল’ বলে বর্ণনা করেন। আল্লামা ইরাকী (৮০৬হি) এ জাতীয় মাউদূ হাদীসের দুটি উদাহরণ উল্লেখ করেছেন। প্রথম উদাহরণ

حُبُّ الدُّنْيَا رَأْسُ كُلِّ خَطِيْـئَـةٍ

‘দুনিয়ার ভালবাসা সকল পাপের মূল।’ আল্লামা ইরাকী বলেন, এ বাক্যটি মূলত কোনো কোনো নেককার আবিদের কথা। ঈসা (আঃ)-এর কথা হিসাবেও প্রচার করা হয়। তবে রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর কথা হিসেবে এর কোনো ভিত্তি নেই। আর দ্বিতীয় উদাহরণ:

اَلْمَـعِـدَةُ بَـيْـتُ الدَّاءِ وَالْحِـمْيَـةُ رَأْسُ الدَّوَاءِ.

‘পাকস্থলী রোগের বাড়ি আর খাদ্যভ্যাস নিয়ন্ত্রণ সকল ঔষধের মূল।’

কথাটি চিকিৎসকদের কথা। হাদীস হিসেবে এর কোনো ভিত্তি নেই।[1]

উপরে ‘সনদের মধ্যে কমবেশি করা’ শীর্ষক অনুচ্ছেদে আমরা এ জাতীয় কিছু উদাহরণ দেখেছি। এ প্রকারের ‘মিথ্যা’ বা জালিয়াতির আরো অনেক উদাহরণ আমরা দ্বিতীয় অধ্যায়ে দেখতে পাব। এখানে আমাদের দেশে আলিমগণের মধ্যে প্রচলিত এরূপ একটি হাদীসের কথা উল্লেখ করছি।

আমাদের দেশে ‘হাদীস’ বলে প্রচলিত একটি কথা:

مَا رَأَى الْمُسْـلِمُونَ حَسَـنـًا فـَهُـوَ عِـنْدَ اللَّهِ حَسَنٌ

‘‘মুসলিমগণ যা ভাল মনে করবেন তা আল্লাহর কাছে ভাল।’’

আমাদের দেশে সাধারণভাবে কথাটি হাদীসে নাবাবী বলে প্রচারিত। কথাটি মূলত আব্দুল্লাহ ইবনু মাসঊদ (রা)-এর। একে রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর কথা হিসাবে বর্ণনা করলে তাঁর নামে মিথ্যা বলা হবে। ইবনু মাসঊদ বলেন:

إِنَّ اللَّهَ نَظَرَ فِي قُلُوبِ الْعِبَادِ فَوَجَدَ قَلْبَ مُحَمَّدٍ ﷺ خَيْرَ قُلُوبِ الْعِبَادِ فَاصْطَفَاهُ لِنَفْسِهِ فَابْتَعَثَهُ بِرِسَالَتِهِ ثُمَّ نَظَرَ فِي قُلُوبِ الْعِبَادِ بَعْدَ قَلْبِ مُحَمَّدٍ فَوَجَدَ قُلُوبَ أَصْحَابِهِ خَيْرَ قُلُوبِ الْعِبَادِ فَجَعَلَهُمْ وُزَرَاءَ نَبِيِّهِ يُقَاتِلُونَ عَلَى دِينِهِ فَمَا رَأَى الْمُسْلِمُونَ حَسَنًا فَهُوَ عِنْدَ اللَّهِ حَسَنٌ وَمَا رَأَوْا سَيِّئًا فَهُوَ عِنْدَ اللَّهِ سَيِّئٌ.

আল্লাহ তাঁর বান্দাদের হৃদয়ের দিকে দৃষ্টিপাত করেন। তিনি মুহাম্মাদ (ﷺ)-এর হৃদয়কে সমস্ত সৃষ্টি জগতের মধ্যে সর্বোত্তম হৃদয় হিসাবে পেয়েছেন। এজন্য তিনি তাঁকে নিজের জন্য বেঁছে নেন এবং তাঁকে রিসালাতের দায়িত্ব দিয়ে প্রেরণ করেন। এরপর তিনি মুহাম্মাদ ﷺ -এর হৃদয়ের পরে অন্যান্য বান্দাদের হৃদয়গুলোর দিকে দৃষ্টিপাত করেন। তখন তিনি তাঁর সাহাবীগণের হৃদয়গুলোকে সর্বোত্তম হৃদয় হিসাবে পেয়েছেন। এজন্য তিনি তাঁদেরকে তাঁর নবীর সহচর ও পরামর্শদাতা বানিয়ে দেন, তাঁরা তাঁর দীনের জন্য যুদ্ধ করেন। অতএব, মুসলমানগণ (অর্থাৎ, রাসূলুল্লাহ ﷺ -এর সহচর পরামর্শদাতা পবিত্র হৃদয় সাহাবীগণ) যা ভালো মনে করবেন তা আল্লাহর কাছেও ভালো। আর তাঁরা যাকে খারাপ মনে করবেন তা আল্লাহর কাছেও খারাপ।’’[2]

কোনো কোনো ফকীহ বা আলিম ভুলবশত কথাটি হাদীসে নাবাবী বলে উল্লেখ করেছেন। পরবর্তী যুগের মুহাদ্দিসগণ হাদীসের সকল গ্রন্থ তালাশ করে নিশ্চিত হয়েছেন যে, হাদীসটি রাসূলুল্লাহ (ﷺ) থেকে বর্ণিত হয় নি। আল্লামা যাইলায়ী আব্দুল্লাহ ইবনু ইউসূফ (৭৬২ হি), ইবনু কাসীর ইসমাঈল ইবনু উমার (৭৭৪ হি), ইবনু হাজার আসকালানী আহমাদ ইবনু আলী (৮৫২ হি), সাখাবী, মুহাম্মাদ ইবনু আব্দুর রাহমান (৯০২হি) ও অন্যান্য মুহাদ্দিস উল্লেখ করেছেন যে, হাদীসটি আব্দুল্লাহ ইবনু মাসঊদের (রা) কথা হিসাবে হাসান সনদে বর্ণিত। রাসূলুল্লাহ ﷺ-এর কথা হিসাবে কোথাও বর্ণিত হয়নি।[3]

[1] ইরাকী, ফাতহুল মুগীস, পৃ: ১২৭, ১২৮; সুয়ূতী, তাদরীবুর রাবী ১/২৮৭।

[2] আহমাদ, আল-মুসনাদ ১/৩৭৯; তাবারানী, আল-মু’জামুল আউসাত ৪/৫৮, হাকিম, আল-মুসতাদরাক ৩/৮৩; হাইসামী, মাজমাউয যাওয়াইদ ১/১৭৭।

[3] যাইলায়ী, আব্দুল্লাহ ইবনু ইউসূফ (৭৬২ হি), নাসবুর রাইয়াহ ৪/১৩৩; ইবনু কাসীর ইসমাঈল ইবনু উমার (৭৭৪ হি), তুহফাতুল তালিব পৃ: ৪৫৫; ইবনু হাজার আসকালানী, আদ-দিরাইয়াহ ২/১৮৭; সাখাবী, আল-মাকাসিদুল হাসানা, পৃ: ৩৬৮; আল-আজলূনী, ইসমাঈল ইবনু মুহাম্মাদ (১১৬২ হি), কাশফুল খাফা ২/২৪৫।