রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর কথা যেভাবে শুনতে হবে ঠিক অবিকল সেভাবেই বলতে হবে। সনদের মধ্যে কমবেশি করাও জালিয়াতি। মুহাদ্দিসগণ এজন্য সনদের মধ্যে কমবেশি করাকে জালিয়াতি বলে গণ্য করেছেন। মাউকূফ বা মাকতূ’ হাদীসকে অর্থাৎ সাহাবীর কথা বা তাবিয়ীর কথাকে মারফূ হাদীস রূপে বা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু (ﷺ)-এর কথা রূপে বর্ণনা করা, মুরসাল বা মুনকাতি’ হাদীসকে মুত্তাসিল রূপে বর্ণনা করা, সনদের কোনো একজন দুর্বল বর্ণনাকারীর পরিবর্তে অন্য একজন প্রসিদ্ধ বর্ণনাকারীর নাম ঢুকানো বা যে কোনো প্রকারে হাদীসের সনদের মধ্যে পরিবর্তন করা হাদীসের নামে মিথ্যাচার বলে গণ্য। এধরনের মিথ্যাচার ইচ্ছাকৃত বা অনিচ্ছাকৃত হতে পারে। ইচ্ছাকৃত মিথ্যাচারী ‘মিথ্যাবাদী’ ও জালিয়াত বলে গণ্য। অনিচ্ছাকৃত মিথ্যাচারী অগ্রহণযোগ্য, দুর্বল ও পরিত্যক্ত বলে গণ্য। এ বিষয়ে দু-একটি উদাহরণ দেখুন।
আবু সামুরাহ আহমাদ ইবনু সালিম ২য়-৩য় হিজরী শতকের একজন ‘রাবী’। তিনি বলেন: আমাদেরকে শারীক বলেছেন, আ’মাশ থেকে, তিনি আতিয়্যা থেকে তিনি আবু সাঈদ খুদরী থেকে বলেছেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন: (علي خـيـر البـرية) ‘‘আলী সকল সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ।’’
মুহাদ্দিসগণ নিরীক্ষার মাধ্যমে দেখেন যে, আবু সালামাহ আহমাদ ইবনু সালিম অত্যন্ত দুর্বল রাবী ছিলেন। তিনি বিভিন্ন মুহাদ্দিস থেকে তাদের নামে এমন সব হাদীস বর্ণনা করেছেন যা অন্য কেউ বর্ণনা করেন নি। তার একটি মিথ্যা বা ভুল বর্ণনা হলো এ হাদীসটি। এ হাদীসটি শারীক ইবনু আব্দুল্লাহর অন্যান্য ছাত্রও বর্ণনা করেছেন, এছাড়া শারীকের উস্তাদ আ’মাশ থেকে শারীক ছাড়াও অন্য অনেকে বর্ণনা করেছেন। কিন্ত তারা বলেছেন: আ’মাশ থেকে, তিনি আতিয়্যাহ থেকে বলেছেন, জাবির (রা) বলতেন: (كنا نعد عليا خيرنا) ‘‘আমরা আলীকে আমাদের মধ্যে উত্তম বলে মনে করতাম।’’
তাহলে আমরা দেখছি যে, আবু সালামাহ ইচ্ছাকৃত বা অনিচ্ছাকৃতভাবে তিনটি বিষয় পরিবর্তন করেছেন।
প্রথমত: হাদীসটি আতিয়্যাহ জাবির থেকে বর্ণনা করেছেন, অথচ আবু সালামাহ আতিয়্যার উস্তাদের নাম ভুল করে আবু সাঈদ খুদরী বলে উল্লেখ করেছেন। এভাবে তিনি সনদের মধ্যে সাহাবীর নাম পরিবর্তন করেছেন।
দ্বিতীয়ত: তিনি হাদীসটির শব্দ বা মতনও পরিবর্তন করেছেন।
তৃতীয়ত: তিনি সনদের মধ্যে পরিবর্তন করে জাবিরের কথাকে রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর কথা বলে বর্ণনা করেছেন।
হাদীসটি মূলত জাবিরের (রা) নিজের কথা, অথচ তিনি একে রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর কথা হিসাবে বর্ণনা করেছেন। আর এটিই হলো সবচেয়ে মারাত্মক পরিবর্তন। কারণ এখানে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) যা বলেন নি তা তার নামে বলা হয়েছে, যা অত্যন্ত বড় অপরাধ। কোন সাহাবী, তাবিয়ী বা বুজুর্গের কথা বা জ্ঞান মূলক প্রবাদকে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কথা হিসাবে উল্লেখ করা মাওযূ বা বানোয়াট হাদীসের একটি বিশেষ প্রকার।[1] আমরা একটু পরেই বিষয়টি আবারো উল্লেখ করব, ইনশা আল্লাহ।
ইবরাহীম ইবনুল হাকাম ইবনু আবান তৃতীয় হিজরী শতকের একজন রাবী। তিনি হাদীস বর্ণনার ক্ষেত্রে জালিয়াতি করতেন। তবে সনদের মধ্যে। তৃতীয় শতকের মুহাদ্দিস আববাস ইবনু আব্দুল আযীম বলেন: ইবরাহীম ইবনুল হাকাম তার পিতার সূত্রে তাবিয়ী ইকরিমাহ থেকে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে কিছু হাদীস শিক্ষা করেন ও লিখে রাখেন। এ হাদীসগুলো তার পান্ডুলিপিতে এভাবে মুরসাল রূপেই লিখিত ছিল। কোনো সাহাবীর নাম তাতে ছিল না। পরবর্তী সময়ে তিনি এগুলোতে আব্দুল্লাহ ইবনু আববাস, আবু হুরাইরা প্রমুখ সাহাবীর (রা) নাম উল্লেখ করে বর্ণনা করতেন। এ সনদগত মিথ্যাচারের ফলে তিনি গ্রহণযোগ্যতা হারিয়ে ফেলেন।[2]
[2] ইবনু আদী, আল-কামিল ১/২৪১-২৪২।