হাদীসের নামে জালিয়াতি ৩. মিথ্যা প্রতিরোধে সাহাবীগণ ড. খোন্দকার আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর (রহ.) ১ টি
৩. ৩. ইচ্ছাকৃত মিথ্যার সম্ভাবনা রোধ করা

সাহাবীগণের যুগের প্রথম দিকে সাহাবীগণই হাদীস বর্ণনা করতেন। এক সাহাবী অন্য সাহাবীকে অথবা পরবর্তী প্রজন্ম তাবিয়ীগণকে হাদীস শুনাতেন ও শিক্ষা দিতেন। রাসূলুল্লাহ -এর ইন্তেকালের ২০/২৫ বছরের মধ্যে একদিকে যেমন অনেক সাহাবী ইন্তেকাল করেন, তেমনি অপরদিকে অনেক তাবিয়ী হাদীস বর্ণনা ও শিক্ষাদান শুরু করেন। আমরা ইতোপূর্বে আলোচনা করেছি যে, এ সময় থেকে কোনো কোনো নও মুসলিম তাবিয়ীর মধ্যে ইচ্ছাকৃত মিথ্যার প্রবণতা দেখা দেয়। তখন সাহাবীগণ হাদীস গ্রহণের বিষয়ে আরো বেশি সতর্কতা অবলম্বন করতে থাকেন।

এক সাহাবী অন্য সাহাবীকে হাদীস বর্ণনা করলে শ্রোতা বা শিক্ষার্থী সাহাবী বর্ণনাকারীর ব্যক্তিগত সততা ও সত্যপরায়ণতায় কোনো সন্দেহ করতেন না বা তিনি নিজ কর্ণে হাদীসটি রাসূলুল্লাহ () থেকে শুনেছেন না অন্য কেউ তাকে বলেছেন সে বিষয়েও প্রশ্ন করতেন না। রাসূলুল্লাহ ()-এর সাহচর্য প্রাপ্ত সকল মানুষই ছিলেন তাঁরই আলোয় আলোকিত মহান মানুষ এবং সত্যবাদিতায় আপোষহীন। তবে বিস্মৃতি, অনিচ্ছাকৃত ভুল বা হৃদয়ঙ্গমের অপূর্ণতা-জনিত ভুল হতে পারে বিধায় উপরোক্ত বিভিন্ন পদ্ধতিতে তাঁরা বর্ণিত হাদীসের নির্ভুলতা যাচাই করতেন।

তাবিয়ী বর্ণনাকারীদের হাদীস গ্রহণের ক্ষেত্রে তাঁরা উপরোক্ত নিরীক্ষার পাশাপাশি অতিরিক্ত দু’টি বিষয় যুক্ত করেন। প্রথমত: তাঁরা বর্ণনাকারীর ব্যক্তিগত সত্যপরায়ণতা ও বিশ্বস্ততার বিষয়ে অনুসন্ধান করতেন এবং দ্বিতীয়ত: তাঁরা বর্ণনাকারী কার কাছ থেকে হাদীসটি শুনেছেন তা (reference) জানতে চাইতেন। প্রথম বিষয়টিকে হাদীস বিজ্ঞানের পরিভাষায় ‘عدالة’ যাচাই করা বলা হয়। আমরা বাংলায় একে ‘ব্যক্তিগত সততা ও সত্যপরায়ণতা’ যাচাই বলে অভিহিত করতে পারি। দ্বিতীয় বিষয়টিকে হাদীসের পরিভাষায় ‘سند’ বর্ণনা বলা হয়। বাংলায় আমরা একে ‘সূত্র (reference) উল্লেখ করা’ বলতে পারি।

উসমান (রা)-এর খিলাফতকালে (২৩-৩৫হি) মদীনার কেন্দ্র থেকে দূরে অবস্থিত নও-মুসলিমদের মধ্যে বিভ্রান্তিকর প্রচারণার কারণে মুসলিম উম্মাহর মধ্যে বিভক্তি ও হানাহানি ঘটে এবং নও-মুসলিমদের মধ্যে সত্যপরায়ণতার কমতি দেখা দেয়। তখন থেকেই সাহাবীগণ উপরের দুটি পদ্ধতি গ্রহণ করেন। প্রথম হিজরী শতকের প্রখ্যাত তাবিয়ী মুহাম্মাদ ইবনু সিরীন (১১০ হি) বলেন:

لَمْ يَكُونُوا يَسْأَلُونَ عَنِ الإِسْنَادِ فَلَمَّا وَقَعَتِ الْفِتْنَةُ قَالُوا سَمُّوا لَنَا رِجَالَكُمْ فَيُنْظَرُ إِلَى أَهْلِ السُّنَّةِ فَيُؤْخَذُ حَدِيثُهُمْ وَيُنْظَرُ إِلَى أَهْلِ الْبِدَعِ فَلا يُؤْخَذُ حَدِيثُهُمْ.

‘‘তাঁরা (সাহাবীগণ) সনদ বা তথ্যসূত্র সম্পর্কে কোনো প্রশ্ন করতেন না। যখন (উসমানের খেলাফতের শেষদিকে: ৩০-৩৫ হি) ফিতনা-ফাসাদ ঘটে গেল তখন তাঁরা বললেন: তোমাদেরকে যারা হাদীস বলেছেন তাদের নাম উল্লেখ কর। কারণ দেখতে হবে, তারা যদি আহলুস সুন্নাত বা সুন্নাত-পন্থী হন তাহলে তাদের হাদীস গ্রহণ করা হবে। আর তারা যদি আহলুল বিদ‘আত বা বিদ‘আত-পন্থী হন তাহলে তাদের হাদীস গ্রহণ করা হবে না।’’[1]

প্রখ্যাত সাহাবী আব্দুল্লাহ ইবনু আববাস (৬৮ হি) বলেন:

إِنَّمَا كُنَّا نَحْفَظُ الْحَدِيثَ وَالْحَدِيثُ يُحْفَظُ عَنْ رَسُولِ اللَّهِ ﷺ فَأَمَّا إِذْ رَكِبْتُمْ كُلَّ صَعْبٍ وَذَلُولٍ فَهَيْهَاتَ.

‘‘আমরা তো হাদীস মুখস্থ করতাম এবং রাসূলুল্লাহ ()-এর হাদীস (যে কোনো বর্ণনাকারী থেকে) মুখস্থ করা হতো। কিন্তু তোমরা যেহেতু খানাখন্দক ও ভালমন্দ সব পথেই চলে গেলে সেহেতু এখন (বর্ণনাকারীর বিচার-নিরীক্ষা ছাড়া) কোনো কিছু গ্রহণ করার সম্ভাবনা সুদূর পরাহত।’’[2]

তাবিয়ী মুজাহিদ (১০৪ হি) বলেন:

جَاءَ بُشَيْرٌ الْعَدَوِيُّ إِلَى ابْنِ عَبَّاسٍ فَجَعَلَ يُحَدِّثُ وَيَقُولُ: قَالَ رَسُولُ اللَّهِ ﷺ، قَالَ رَسُولُ اللَّهِ ﷺ، فَجَعَلَ ابْنُ عَبَّاسٍ لا يَأْذَنُ لِحَدِيثِهِ وَلا يَنْظُرُ إِلَيْهِ. فَقَالَ: يَا ابْنَ عَبَّاسٍ مَالِي لا أَرَاكَ تَسْمَعُ لِحَدِيثِي أُحَدِّثُكَ عَنْ رَسُولِ اللَّهِ ﷺ وَلا تَسْمَعُ؟ فَقَالَ ابْنُ عَبَّاسٍ: إِنَّا كُنَّا مَرَّةً إِذَا سَمِعْنَا رَجُلا يَقُولُ: قَالَ رَسُولُ اللَّهِ ﷺ ابْتَدَرَتْهُ أَبْصَارُنَا وَأَصْغَيْنَا إِلَيْهِ بِآذَانِنَا فَلَمَّا رَكِبَ النَّاسُ الصَّعْبَ وَالذَّلُولَ لَمْ نَأْخُذْ مِنَ النَّاسِ إِلا مَا نَعْرِفُ.

‘‘(তাবিয়ী) বাশীর ইবনু কা’ব আল-আদাবী ইবনু আববাসের (রা) কাছে আগমন করেন এবং হাদীস বলতে শুরু করেন। তিনি বলতে থাকেন: রাসূলুল্লাহ বলেছেন, রাসূলুল্লাহ বলেছেন। কিন্তু ইবনু আববাস (রা) তার দিকে কর্ণপাত ও দৃষ্টিপাত করলেন না। তখন বাশীর বলেন: হে ইবনু আববাস, আমার কি হলো! আপনি আমার হাদীস শুনছেন কি? আমি আপনাকে রাসূলুল্লাহ ()-এর হাদীস বর্ণনা করছি অথচ আপনি কর্ণপাত করছেন না!? তখন ইবনু আববাস বলেন: একসময় ছিল যখন আমরা যদি কাউকে বলতে শুনতাম: ‘রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন’ তখনই আমাদের দৃষ্টিগুলো তার প্রতি আবদ্ধ হয়ে যেত এবং আমরা পূর্ণ মনোযোগ দিয়ে তার প্রতি কর্ণপাত করতাম। কিন্তু যখন মানুষ খানাখন্দক ভালমন্দ সব পথেই চলে গেল তখন থেকে আমরা আর মানুষদের থেকে কোনো কিছু গ্রহণ করি না, শুধুমাত্র সুপরিচিত ও পরিজ্ঞাত বিষয় ব্যতিরেকে।[3]

[1] মুসলিম, আস-সহীহ ১/১৫।

[2] মুসলিম, আস-সহীহ ১/১৩।

[3] মুসলিম, আস-সহীহ ১/১৩।