ব্যাংকের সূদকে হালাল ও জায়েয করার জন্য একটি যুক্তি এও পেশ করা হয়ে থাকে যে, আল্লাহ তাআলা যখন সূদকে হারাম করেন, তখন প্রচলিত ছিল সোনা-চাঁদির মুদ্রা। অতএব সেই মুদ্রাতেই সূদ হারাম এবং অধুনা প্রচলিত কাগজের নোটে সূদ হারাম নয়। কেননা সূদ বিষয়ে যে সমস্ত হাদীস বর্ণিত হয়েছে, তা কেবল কয়েকটি নির্দিষ্ট জিনিসের মধ্যে সীমাবদ্ধ। আর তা হল খেজুর, গম, যব, লবণ, সোনা ও চাঁদি (খাদহীন স্বচ্ছ রৌপ্য)। এগুলোর মধ্যে সোনা ও চাঁদিতে সূদ পাওয়া যায়---আর এর যুক্তিও নিতান্ত স্পষ্ট। কারণ, উভয় বস্ত্তই হল মূল্যবান ও উৎকৃষ্ট পদার্থ। যার নিজস্ব মূল্যমান আছে যদিও বা তা মুদ্রা ও টাকা-পয়সার মত ব্যবহার না করা হয়।
আরো অবাক হওয়ার কথা এই যে, অনেকে বলেছে, এই কাগজের নোটের মূল্যমান তার ক্রয়-ক্ষমতা হরাস পাওয়ার দরুন কমে যায়। আর এ রকম হয় মুদ্রাস্ফীতির সময়। অর্থাৎ টাকার মালিক ব্যাংক থেকে যে সূদ গ্রহণ করে, তা সে এ ঘাটতির বিনিময়ে গ্রহণ করে থাকে যা মুদ্রাস্ফীতির কারণে তার অর্থে আপতিত হয়। বরং কখনো কখনো ব্যাংকের এই সূদ মুদ্রাস্ফীতিজনিত এ ঘাটতি অপেক্ষাও কম পরিমাণের হয়ে থাকে। দৃষ্টান্ত স্বরূপ, ব্যাংক ১০% সূদ দেয়, আর মুদ্রাস্ফীতির হার ১৫%। তাহলে এ ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে যে, বাস্তবপক্ষে ব্যাংকে টাকা জমাকর্তা ৫% ক্ষতি ও নোকসানের শিকার হয়।
তর্কের খাতিরে যদি এ কথা মেনেও নেওয়া হয় যে, কেবলমাত্র সোনা-চাঁদির টাকাতেই যাকাত ফরয এবং সোনা-চাঁদীর মুদ্রাতেই সূদ জারী হয়, তাহলে তার মতলব এই দাঁড়ায় যে, কাগজের নোটে যাকাত নেই; যা ইসলামের তৃতীয় রুক্ন এবং কাগজের নোট বিনিময় করার ক্ষেত্রে সূদ নেওয়া-দেওয়া হালাল; অথচ তা শুধু হারামই নয় বরং সাতটি বিধ্বংসকারী বিষয়াবলীর অন্যতম।[1]
পরন্তু যুক্তিবাদীদের উক্ত যুক্তি মূলেই বাতিল। কেননা, বর্তমানে কাগজের নোটের মাধ্যমেই ক্রয়-বিক্রয় ও পণ্য বিনিময় হয়ে থাকে; বিবাহে মোহর দেওয়া হয়, এবং ভাড়া ও মজুরী আদায় করা হয় (যেমন সে কালে সোনাচাঁদির মুদ্রার মাধ্যমেই অনুরূপ আদান-প্রদান হত)। মোট কথা, এই নোটের উপরেই যাবতীয় শরয়ী প্রভাব-প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত হয়। আর এই নোট যার কাছে যত বেশী থাকে, সে তত বড় ধনবান বলে সমাজে পরিচিত।
বাকী থাকল মুদ্রাস্ফীতির কারণে মুদ্রামান তথা ক্রয়-ক্ষমতা হরাস ও বৃদ্ধি পাওয়ার কথা; যা বাস্তব ও সত্য হলেও এ ক্ষেত্রে হক বলে বাতিল উদ্দেশ্য ও অর্থ গ্রহণ করা হয়েছে। ১৯৮৮ সনে কুয়েতে অনুষ্ঠিত ইসলামী কন্ফারেন্সের ইসলামী ফিক্হ আলোচনা সভায় উক্ত বিষয়ে পর্যালোচনা করা হয়। এই আলোচনাচক্রে উলামাগণ দুই দলে বিভক্ত হয়ে যান; এক দলের মতে মুদ্রাস্ফীতির ফলে মুদ্রামান কমে যাওয়া বিবেচ্য বিষয় নয়।
অতএব যদি নোট অবশিষ্ট এবং ক্রয়-বিক্রয় প্রচলিত থাকে, তাহলে সেই নোটই (ঋণে) ফেরৎ যোগ্য। অর্থাৎ যদি ডলার দিয়ে থাকে, তবে ডলারই ফেরৎ পাবে। টাকা নিয়ে থাকলে টাকাই ফেরৎ দিতে হবে; যদিও তার মুল্যমান এক শ’তে এক হাজার কমে যায়। উলামাদের এই দল কাগজের নোটকে প্রত্যেক বিষয়ে সে কালের সোনা-চাঁদির মুদ্রার স্থলাভিষিক্ত ও বিকল্প মনে করেন।
এঁদের দ্বিতীয় দল কাগজের নোটকে মৌলিকভাবে সোনা-চাuঁদর মুদ্রার মান দান করেন। কিন্তু সাধারণভাবে তার স্থলাভিষিক্ত মনে করেন না। অর্থাৎ অধিকাংশ ক্ষেত্রে নোটকে স্বর্ণ ও রৌপ্যমুদ্রার বিকল্প মনে করেন; কিন্তু সর্বক্ষেত্রে তা মনে করেন না।
পক্ষান্তরে মুদ্রাস্ফীতিজনিত নোটের মূল্যমান কমা-বাড়া বিবেচ্য হলে তা সকল প্রকার লেনদেনেই হওয়া উচিত। সুতরাং আইন এই করে দেওয়া উচিত যে, ঋণগ্রহীতাকে বর্তমান মুদ্রাস্ফীতির হার অনুপাতে তার ঋণ পরিশোধ করতে হবে; আর সেই হার অনুসারে তার ঋণ পরিশোধ করতে পারবে না, যে হার পাঁচ বছর পূর্বে ঋণ নেওয়ার সময় ছিল। কিন্তু এসব লেনদেনের ক্ষেত্রে লোকেরা মুদ্রাস্ফীতির কথা ভুলে থাকবে আর শুধুমাত্র ব্যাংকের সাথে লেনদেনের ক্ষেত্রে তা স্মরণে ও খেয়ালে রাখবে--এমন কথা কি আশ্চর্যজনক নয়? সুতরাং আরোপিত সূদ অপেক্ষা মুদ্রাস্ফীতির হার বেশী হলে ব্যাংকের নিকটেও এ মুদ্রাস্ফীতিজনিত ঘাটতি পূরণ দাবী করা উচিত। কিন্তু তা কেউ করে কি?
এবারে আপনি ভেবে দেখুন যে, লোকেরা যখন ব্যাংকে টাকা জমা করবে অথবা অন্য কাউকে ঋণ দেবে, তখন মুদ্রাস্ফীতির কথা ও হিসাব মনে মনে রাখবে, অথচ যখন সে নিজে নেবে তখন ঋণগ্রহীতার ব্যাপারে তা ভুলে বসবে এটা কি ভুল ও অসৎ বাহানা নয়; যা সূদকে হালাল করার জন্য অবলম্বন করা হয়েছে?
বস্ত্ততঃ এ সমস্যা হল একটি মৌলিক সমস্যা। আর ব্যাংকের মৌলিক কারবার হল সূদী কারবার। অতএব যে কোন নোট, কারেন্সী, সোনা, চাঁদি অথবা অন্য কোন মালে যে অতিরিক্ত অংশ দেওয়া-নেওয়ার শর্ত আরোপ করা হয়, তা যে কোন অবস্থা ও যে কোন ক্ষেত্র ও পরিস্থিতিতে সূদ বলেই গণ্য। এই জন্য এ ধরনের কৌশল বা বাহানার মাধ্যমে সূদ হালাল হতে পারে না; কারণ সত্য ও হক সূর্যবৎ স্পষ্ট।