ব্যাংকের সূদকে হালাল ও জায়েয নিরূপিত করার জন্য একটি বিস্ময়কর তথা অবান্তর কথা এও বলা হয়ে থাকে যে, ব্যাংকের কারবার শরীয়ত-অনুমোদিত মুযারাবাহ[1] (অংশীদারী) ব্যবসায় ও কারবারের মতই! অর্থাৎ ব্যাংক জমাকর্তাদের নিকট থেকে তাদের টাকা ‘মুযারাবাহ’ হিসাবে গ্রহণ করে। যে টাকার মালিক থাকে জমাকর্তা। অতঃপর ব্যাংক সে টাকার মালিক হয়ে অপরকে তা মুযারাবায় লাগানোর জন্য প্রদান করে। আর এ ক্ষেত্রে যাকে টাকা দেওয়া হয়, সে হয় ব্যাংকের মুযারিব (তার টাকায় ব্যবসাকারী)।
কিন্তু বাস্তবে এ ধারণা শরীয়ত অনুমোদিত মুযারাবাহ থেকে সম্পূর্ণম ভিন্ন। কেননা মুযারাবাহতে মুযারিব (ব্যবসাকারী) মালের আমানতদার হয়; দেনাদার (ঋণগ্রহীতা) হয় না। আর মাল তার মালিককে ফেরৎ দেওয়ার যমানত কেবল সেই ক্ষেত্রে আসে যখন মুযারিব (আমানতদার ব্যবসায়ী) সে মালে কোন প্রকার খেয়ানত, রক্ষণা-বেক্ষণে ত্রুটি ও অবহেলা অথবা তাতে কোন অসৎ অভিপ্রায় করে বসে। পক্ষান্তরে যখন মুযারাবাহতে মুযারিবের উপর মালের যমানত নেওয়ার শর্ত আরোপ করা হয় তখন সে মুযারাবাহ শরীয়তসম্মত অবস্থায় থাকে না।
ব্যাংক যে জমাকর্তাদের জমা রাখা টাকার যমানতদার সে কথায় কারো দ্বিমত নেই। তাহলে ব্যাংক একই সাথে অর্থের আমানতদার এবং যমানতদার উভয়ই হওয়া কি প্রকারে সম্ভব? উপরন্তু শরীয়ত অনুমোদিত মুযারাবাহর এক বিধান এই যে, উভয় পক্ষকে লাভ-নোকসানে সমান হারে শরীক হতে হবে এবং কোন পক্ষ অপর পক্ষের হিসাবে নির্দিষ্ট মুনাফা অথবা নির্দিষ্ট মালের নিশ্চিত অধিকারী হতে পারবে না।
সুতরাং টাকার মালিক অথবা মুযারিব (ব্যবসাকারীর) তরফ থেকে নির্দিষ্ট পরিমাণে নিশ্চিত অর্থ যমানত লাভ করা এ প্রকার মুযারাবাহকে বাতিল ও অবৈধ করে ফেলে। আর এ যমানতের শর্তারোপই উক্তপ্রকার কারবারকে হালাল থেকে হারামে পর্যবসিত করে দেয়। কেননা, ইসলামী মুযারাবাহতে এক পক্ষের অর্থ থাকে, আর দ্বিতীয় পক্ষের শ্রম, ব্যয় ও ঝুঁকি নেওয়ার ফলে মাল বৃদ্ধি পায়।
পক্ষান্তরে সূদী (ব্যাংকিং) কারবারে মালের মালিক মুনাফার নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থের নিশ্চিত যমানত লাভ করে থাকে; যদিও সে তাতে কোন প্রকার শ্রম ও মেহনত ব্যয় না-ও করে।
রাফে’ বিন খাদীজ (রাঃ) বলেন,
كُنَّا أَكْثَرَ الأنْصَارِ حَقْلا ، فَكُنَّا نُكْرِى الأرْضَ على أن لنا هذه ولهم هذه، فَرُبَّمَا أَخْرَجَتْ هَذِهِ وَلَمْ تُخْرِجْ هَذِهِ ، فَنُهِينَا عَنْ ذَلِكَ.
অর্থাৎ, ‘আমরা আনসারগণের মধ্যে সবচেয়ে অধিক খেতের মালিক ছিলাম। (নিজে চাষ করতে না পারলে) আমরা তা ভাগচাষে অপরকে প্রদান করতাম। আর শর্ত এই হত যে, এই খেতের ফসল আমাদের হবে এবং এ খেতের ফসল ভাগীদারদের ভাগে হবে। এতে কখনো এক খেতে ফসল হত এবং অন্যটিতে হত না। এ দেখে নবী (ﷺ) এই ধরনের ভাগচাষ থেকে আমাদেরকে নিষেধ করলেন।’[2]
উপরোক্ত হাদীস থেকে বুঝা গেল যে, জমির মালিক ও ভাগচাষী উভয় পক্ষকেই জমির কোন একটা দিককে নির্দিষ্ট করে নিতে নিষেধ করা হয়েছে। কারণ কখনো কখনো এমনও হয় যে, এ নির্দিষ্টীকৃত দিক বা অংশ আপদমুক্ত থেকে ফসল অধিক প্রদান করে, আবার কখনো আপদগ্রস্ত হয়ে যথেষ্ট অথবা কিছুই প্রদান করে না। যার ফলে উভয় পক্ষের মধ্য হতে কোন এক পক্ষের নিশ্চিত লাভ এবং অপর পক্ষের নিশ্চিত ক্ষতির সম্ভাবনা থাকে। আর এই ধরনের একতরফা লাভ ও ক্ষতি ইসলামের ন্যায়পরায়ণ দৃষ্টিতে পছন্দনীয় নয়। ইসলামের ন্যায়-পরায়ণতা; যা নবী (ﷺ) উক্ত হাদীসে বর্ণনা করেছেন তা হল এই যে, ভাগচাষেও উভয় পক্ষ লাভ-নোকসানে সমানহারে ভাগীদার হবে।
প্রিয় পাঠক! এবারে আপনি ইনসাফের নজরে গভীর চিন্তা করে দেখুন যে, এও কি কোন যুক্তিসম্মত ও বিবেক-গ্রাহ্য কারবার, যাতে উভয় পক্ষের সমান অধিকারের দু’টি মানুষের মধ্যে এক জনের কখনো নোকসান হবে এবং কখনো লাভ, আর অপর জন কেবল লাভে লাভই সঞ্চয় করে যাবে?
এ ধরনের ইনসাফহীন কারবারকে কোন্ শরীয়ত ও কোন্ বিবেক মেনে নিতে পারে? পরন্তু এ কারবারে আশা বর্তমান থাকাও তার বৈধতার কোন প্রকার দলীল হতেই পারে না। কারণ এই শ্রেণীর আশাব্যঞ্জক লাভের সম্ভাবনা তো চাষীর জন্য ‘মুখাবারাহ’র ক্ষেত্রেও থাকে। এই আশায় সে এ ভাগচাষ করেও থাকে। কিন্তু তা সত্ত্বেও হাদীসের স্পষ্ট উক্তি অনুযায়ী মুখাবারাহ অবৈধ।[3]
এর জন্য নবী (ﷺ) এর সতর্কবাণী রয়েছে; তিনি বলেন,
من لم يذر المخابرة فليأذن بحرب من الله ورسوله.
অর্থাৎ, যে ব্যক্তি মুখাবারাহ ত্যাগ করে না, সে আল্লাহ ও তাঁর রসূলের তরফ থেকে যুদ্ধ ঘোষণা শুনে নিক্![4]
উল্লিখিত বর্ণনায় নবী সল্লাল্লাহু আলাইহি অসাল্লাম মুখাবারাহকে সূদের একটি শ্রেণী নিরূপিত করে অবৈধ ঘোষণা করেছেন। আর যেভাবে সূদখোরের বিরুদ্ধে আল্লাহ ও তদীয় রসূল (ﷺ) যুদ্ধ ঘোষণা করেছেন ঠিক সেই ভাবেই মুখাবারাহকারীদের বিরুদ্ধেও রয়েছে যুদ্ধের ঘোষণা।
মুখাবারাহ হল এক প্রকার ভাগচাষ। এতে জমির মালিক ভাগচাষীকে এই চুক্তির উপর তার জমি চাষ করতে দেয় যে, চাষী মালিককে এ জমির ফসলের নির্দিষ্ট পরিমাণের ভাগ প্রদান করবে। মনে করুন, আপনার একটি জমি আছে। আপনি সেই জমিটি যায়েদকে এই চুক্তির উপর চাষ করতে সোপর্দ করলেন যে, সে আপনাকে এ জমির ফসলের নির্দিষ্ট একটি পরিমাণ ভাগস্বরূপ প্রদান করবে। যেমন মনে করুন, প্রত্যেক ফসলের সময় আপনাকে ৫ মন দিতে বাধ্য থাকবে; তাতে সে জমির উৎপন্ন ফসল অধিক হোক অথবা মোটেই না হোক।
অথবা মনে করুন যে, যতটা ফসল পানির নালার ধারে-পাশে উৎপন্ন হবে, তা সে আপনাকে দেবে এবং বাকী সে (চাষী) নেবে। এ ধরনের ভাগচাষকে ‘মুখাবারাহ’ বলা হয়।
এবারে যদি আপনি ব্যাংকের কারবার নিয়ে একটু গভীরভাবে ভাবনা-চিন্তা করে দেখেন, তাহলে এ কথা বুঝতে পারবেন যে, তা হুবহু মুখাবারাহ ভাগচাষের মতই কারবার; যা হারাম ও অবৈধ।
[2] (বুখারী ২৩২৭নং, মুসলিম ৩৯৩০নং, আবু দাঊদ ৩৩৯২নং, নাসাঈ ৩৯০৮নং, ইবনে মাজাহ ২৪৫৮নং)
[3] (মুসলিম, আবু দাঊদ ৩৪০৭নং)
[4](আবু দাঊদ ৩৪০৬নং, হাকেম ২/২৮৬ আর তিনি বলেন, হাদীসটি মুসলিমের শর্তে সহীহ) আল্লামা আলবানীর নিকট হাদীসটি যয়ীফ। দেখুন, যয়ীফ আবু দাঊদ ৭৩৯নং, সিলসিলাহ যয়ীফাহ ৯৯৩নং, যয়ীফ জামেউস সগীর ৫৮৪১নং) -অনুবাদক।