পাশ্চাত্য দেশে ব্যাংকের সূচনা এইভাবে হল যে, লোকেরা নিজ নিজ সোনা স্বর্ণকারদের নিকট জমা করে রাখত। ( কারণ সে যুগে নোটের প্রচলন ছিল না।) স্বর্ণকাররা এ স্বর্ণের সমপরিমাণ অর্থের রসিদ লিখে দিত। রসিদে একথা স্পষ্টভাবে উল্লেখ থাকত যে, রসিদবাহকের এত পরিমাণ সোনা অমুক স্বর্ণকারের নিকট গচ্ছিত রয়েছে। অতঃপর ধীরে ধীরে রসিদসমূহ ক্রয়-বিক্রয়, ঋণ পরিশোধ ও আপোসে দেনা-পাওনার কাজে একজন হতে অন্য জনের নিকট স্থানান্তরিত হতে লাগল, কারণ রসিদ দেখিয়ে স্বর্ণকারের নিকট থেকে সোনা উঠিয়ে তার মাধ্যমে লেন-দেন করার চাইতে এ রসিদই এ দ্বিতীয় ব্যক্তিকে (পণ্যের বিনিময়ে) প্রদান করাটা অধিকতর সহজ ছিল। আর একজনকে এ রসিদ সোপর্দ করার অর্থ এক রকম সোনা সোপর্দ করাই ছিল।
এইভাবে লোকে আসল সোনা ফেরত নিতে কমই আসত। এবারে অভিজ্ঞতা দ্বারা স্বর্ণকাররা জানতে পারল যে, লোকেদের যে সোনা তাদের নিকট গচ্ছিত আছে তার বড়জোর দশ ভাগের এক ভাগ মালিকেরা বের করে নিয়ে যায় এবং বাকী নয় ভাগ তাদের অর্থ-ভান্ডারে অযথা পড়েই থাকে। সুতরাং তারা এ সোনা ঋণপ্রার্থী লোকদেরকে ঋণ স্বরূপ দিয়ে তার উপর সূদ আদায় করা শুরু করল। পরন্তু যখন তারা দেখল যে, লোকেরা অধিকাংশ কাগজের রসিদ বিনিময়ের মাধ্যমেই তাদের ব্যবসায় লেন-দেন করছে এবং নিজেদের সোনা ফেরৎ নিতে আসে না, তখন এ আসল সোনা ঋণস্বরূপ দেওয়ার পরিবর্তে তারই সমমূল্যরূপে কাগজী রসিদ বাজারে চালাতে লাগল। আর যেহেতু অভিজ্ঞতায় তারা জানতে পেরেছিল যে, গচ্ছিত স্বর্ণসম্ভার হতে কেবল এক দশমাংশই মালিকেরা তাদের স্বর্ণ ফেরৎ চায়; সেহেতু তারা বাকী নয় ভাগের সমমূল্যের---নয় ভাগের নয় বরং---নববই ভাগের জাল রসিদ তৈরী করে পত্রমুদ্রা (নোট) হিসাবে বাজারে চালাতে এবং ঋণ দিতে আরম্ভ করল।
এ ব্যাপারটি দৃষ্টান্ত স্বরূপ এভাবে বুঝুন; মনে করুন, এক ব্যক্তি স্বর্ণকারের নিকট ১০০ টাকা মূল্যের সোনা জমা রেখেছিল। স্বর্ণকার এক-একশ’ টাকার দশটি রসিদ তৈরী করল এবং তার প্রত্যেকটিতে এই কথা লিখে দিল যে, ‘এই রসিদের স্থলে ১০০ টাকার সোনা আমার নিকট গচ্ছিত আছে।’ উক্ত দশটি রসিদের মধ্যে একটি মাত্র সোনার মালিককে সোপর্দ করল এবং নয় শত টাকার নয়টি রসিদ অন্য লোকেদেরকে ঋণ দিয়ে তার উপর সূদ আদায় করতে শুরু করে দিল।
এরপর তারা আরো এক পা অগ্রসর হল। আর তা এই যে, যে যুগে এই আধুনিক মহাজনরা উক্ত জাল পুঁজির সাহায্যে প্রচুর অর্থশক্তি সঞ্চয় করে মাথা তুলে উঠছিল সেই যুগেই পশ্চিম ইউরোপে একদিকে শিল্প ও বাণিজ্য বন্যার বেগে বেড়ে চলেছিল এবং অপর দিকে সভ্যতা ও সংস্কৃতির একটি নতুন ইমারত গড়ে উঠছিল---যা ইউনিভার্সিটি থেকে শুরু করে মিউনিসিপ্যালিটি পর্যন্ত জন-জীবনের সর্বক্ষেত্রে নতুন গঠন চাচ্ছিল। এসব কাজের জন্য দরকার ছিল পুঁজির। অপর দিকে সোনার মালিকরাও নিজের মূলধন নিয়ে বিভিন্ন কারবার শুরু করতে লাগল। এবারে স্বর্ণকার মহাজনরা যখন দেখল যে, লোকেরা তাদের নিজেদের পুঁজি ব্যবসায় খাটাতে শুরু করেছে, তখন তারা প্রমাদ গণল। তারা এ স্বর্ণমালিকদেরকে বুঝিয়ে বলতে লাগল, ‘আপনারা এত সব ঝামেলা কেন পোহান? এভাবে নিজে নিজে ব্যবসা করলে তো নিজেকেই হিসাব-নিকাশ রাখতে হবে। এছাড়া নোকসানের পাল্লায়ও তো পড়তে পারেন। তাছাড়া মুনাফার বৃদ্ধি-হরাস আপনার আয় আমদানীর উপর প্রভাব ফেলবে। অতএব এসব করার পরিবর্তে আপনি আপনার অর্থ আমাদের নিকট জমা করুন। আমরা আপনার সে অর্থের রক্ষণাবেক্ষণও করব, তার হিসাব-নিকাশও বিনা পয়সায় রাখব, আর আপনার নিকট কিছু নেওয়ার পরিবর্তে উল্টে আপনাকেই তার সূদ আদায় করতে থাকব।’ এই নতুন কৌশলের ফলেই সঞ্চিত অর্থের শতকরা ৯০ ভাগ বরং এর চাইতেও বেশী অর্থ সরাসরি রুজি-রোজগার ও সংস্কৃতির কাজে ব্যবহূত হওয়ার পরিবর্তে সূদখোর মহাজনদের ভোগে চলে গেল এবং এইভাবে প্রায় সকল প্রকার ব্যবসায় বিনিয়োগযোগ্য পুuঁজ তাদের হস্তগত হল। অবশেষে পরিস্থিতি এই দাঁড়াল যে, মহাজনরা তো পূর্ব থেকেই তাদের ভুয়ো পুঁজি সূদী কারবারে খাটিয়ে আসছিল, এখন অন্যদের পুঁজিও তারা সস্তা হার সূদে নিয়ে চড়া হার সূদে ঋণ দিতে লাগল।
অতঃপর এ দলটি তৃতীয় পদক্ষেপ উঠালো। তারা চিন্তা করল ব্যবসায়ের বিভিন্ন শাখায় যেমন যৌথ পুঁজির কোম্পানী গঠিত হচ্ছে ঠিক অনুরূপভাবে অর্থ-ব্যবসার ক্ষেত্রেও কোম্পানী গঠন করতে হবে এবং এর জন্য উচ্চমানের সংগঠন কায়েম করতে হবে। সুতরাং তাই করা হল এবং এইভাবেই আধুনিক ব্যাংক-ব্যবস্থার উৎপত্তি হল। যে ব্যাংক আজ সারা দুনিয়ার অর্থব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণ ও পরিচালনা করছে।
এইভাবে দুনিয়ার প্রথম ব্যাংক ১১৫৭ খ্রীষ্টাব্দে ইটালীর এক শহর ভেনিস (VENICE)এ প্রতিষ্ঠালাভ করে; যার নাম ছিল BANACODELLA PIZZADI RIAALRO। অতঃপর এরপরে ১৪০১ খ্রীষ্টাব্দে বারশিলোনা শহরে আমানত রাখা যায় এমন ব্যাংক প্রতিষ্ঠা হয়। আর এর পর থেকেই ব্যাংকের পরম্পরা সারা দুনিয়াতে ছড়িয়ে পড়ে।[1]