ব্যবসা বা ক্রয়-বিক্রয় এই যে, বিক্রেতা কোন জিনিসকে বিক্রয় করার জন্য পেশ করে। বিক্রেতা ও ক্রেতার মাঝে সেই জিনিসের দাম কত তা নির্দিষ্ট ও নিষ্পত্তি হয়। অতঃপর সেই দাম বা মূল্যের বিনিময়ে ক্রেতা সেই জিনিসটাকে বিক্রেতার নিকট থেকে গ্রহণ করে।
পক্ষান্তরে সুদ এই যে, কোন ব্যক্তি তার মূলধন কোন অপর এক ব্যক্তিকে ধার দেয় এবং এই শর্ত আরোপ করে যে, ‘এত সময়ের মধ্যে আসলের উপর এত টাকা বেশী নেব।’ আসল টাকা ছাড়া এ বাড়তি টাকার নামই হল সুদ। যা কোন জিনিসের মূল্য নয় বরং তা হল কেবল (ঋণ গ্রহীতাকে তার ঋণ পরিশোধে) কিছু সময় ও অবকাশ দেওয়ার বিনিময়।
অতএব ব্যবসা এবং সুদ এই উভয় প্রকার লেন-দেন নিয়ে একটু চিন্তা-ভাবনার পর নিম্নোক্ত পার্থক্য পরিদৃষ্ট হয়ঃ-
১- ব্যবসায় ক্রেতা ও বিক্রেতা উভয়েরই মুনাফা বিনিময় সমানভাবে হয়ে থাকে; কারণ ক্রেতা এ ক্রীত বস্ত্ত বিক্রেতার নিকট থেকে ক্রয় করে তার দ্বারা উপকৃত হয়। এবং বিক্রেতাও তার সেই শ্রম, বুদ্ধি এবং সময়ের মূল্য গ্রহণ করে; যা সে ক্রেতার জন্য এ জিনিস প্রস্ত্তত ও সরবরাহ করার পথে ব্যয় করেছে।
পক্ষান্তরে সুদী কারবারে দুই পক্ষের মুনাফা বিনিময় সমানভাবে হয় না। সুদগ্রহীতা তো এক নির্দিষ্ট পরিমাণে অর্থ নিয়ে নেয়; ফলে সে নিশ্চিতরূপে উপকৃত হয়। কিন্তু সুদদাতার জন্য কেবল (ঋণ পরিশোধে) অবকাশ মিলে; যাতে সে উপকৃত হয় কি না তা অনিশ্চিত। কারণ ঋণ গ্রহীতা যদি ব্যক্তিগত প্রয়োজন বা অভাব মিটাবার উদ্দেশ্যে ঋণ গ্রহণ করে থাকে তবে নিঃসন্দেহে এ অবকাশ অপকারী। আর যদি সে ব্যবসা করার জন্য নিয়ে থাকে, তাহলে অবকাশে যেমন তার উপকার বা লাভ হওয়ার সম্ভাবনা আছে তেমনি আছে অপকার বা ক্ষতি হওয়ারও আশঙ্কা। কিন্তু ঋণদাতা সর্বাবস্থায় তার মুনাফার (সুদের) একটা নির্দিষ্ট অংশ গ্রহণ করে থাকে; তাতে ঋণগ্রহীতার কারবারে লাভ হোক চাই না হোক। সুতরাং এ কথা স্পষ্ট হল যে, সুদী কারবার কেবল একপক্ষের লাভ এবং অপর পক্ষের ক্ষতি, অথবা একপক্ষের নিশ্চিত ও নির্দিষ্ট লাভ এবং অপর পক্ষের অনিশ্চিত ও অনির্দিষ্ট লাভের মাধ্যমেই হয়ে থাকে।
২- ক্রয়-বিক্রয় বা ব্যবসার ক্ষেত্রে বিক্রেতা ক্রেতার নিকট থেকে যত পরিমাণেই লাভ গ্রহণ করুক না কেন, গ্রহণ করে সে মাত্র একবার। পক্ষান্তরে সুদী কারবারে অর্থ লগ্নিকারী তার অর্থের উপর ধারাবাহিকভাবে বারংবার মুনাফা বা সূদ গ্রহণ করতে থাকে এবং সময়ের গতি (লমবা হয়ে) বাড়ার সাথে সাথে তার সুদের অঙ্কও বৃদ্ধি পেয়ে থাকে। ঋণগ্রহীতা এ অর্থ দ্বারা যতই উপকৃত হোক না কেন, তার এ উপকার এক নির্দিষ্ট সীমা পর্যন্ত সীমাবদ্ধ। কিন্তু এর বিপরীত পক্ষে ঋণদাতা যে উপকার ও লাভ অর্জন করে থাকে, তার কোন নির্দিষ্ট সীমা নেই।
৩- ক্রয়-বিক্রয় বা ব্যবসায় পণ্য-দ্রব্য ও তার মূল্য বিনিময় হওয়ার সাথে সাথেই আদান-প্রদানের ব্যাপার শেষ হয়ে যায়। এর পরে ক্রেতা স্বাচ্ছন্দ্য লাভ করে এবং বিক্রেতাকে কোন জিনিস ফেরৎ দিতে (বা নতুন ভাবে দিতে) হয় না। পক্ষান্তরে সুদী কারবারে ঋণগ্রহীতা টাকা নিয়ে খরচ করে ফেলে। অতঃপর সেই খরচ-করা টাকা যোগাড় করে বাড়তি সুদ-সহ ফেরৎ দিতে হয়।
৪- ক্রয়-বিক্রয়ের ব্যাপারে মানুষ নিজের মেহনত ও বুদ্ধি ব্যয় করে এবং তারই পারিশ্রমিক গ্রহণ করে। পক্ষান্তরে সুদী কারবারে সুদখোর কেবলমাত্র তার প্রয়োজনের অতিরিক্ত মাল দিয়ে বিনা মেহনত ও কষ্টে অপরের কামাই ও উপার্জনে অংশীদার হয়ে বসে।
এছাড়া সুদ মানুষের মাঝে কার্পণ্য, স্বার্থপরতা, নির্মমতা, নিষ্ঠুরতা, নির্দয়তা, অর্থলোলুপতা ও ধনপূজার মত প্রভৃতি গুণ সৃষ্টি করে। দুই জাতির মধ্যে শত্রুতা ও বিদ্বেষ আনয়ন করে। জাতির ব্যক্তিবর্গের মাঝে সহানুভূতি ও পরস্পরকে সহায়তা করার নৈতিক সম্পর্ক নিশ্চিহ্ন করে ফেলে। সমাজের ধন-দৌলতের স্বাধীন আবর্তনকে ব্যাহত করে, বরং এ ধন-সম্পদের গতিমুখ নির্ধনদের নিকট থেকে ধনপতিদের দিকে ফিরিয়ে দেয়। যার ফলশ্রুতিতে জনসাধারণের মালধন গুটিয়ে কেবল একশ্রেণীর নিকট গিয়ে একত্রিত ও স্ত্তপীকৃত হতে থাকে। পরিশেষে তা পুরো সমাজেরই ধ্বংস ও বরবাদের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। আর এসব তিক্ত-অভিজ্ঞতার কথা জীবন-জীবিকা ও অর্থনীতি বিষয়ে দূরদর্শীদের নিকট অবশ্যই অবিদিত নয়। সুদের এ সকল মন্দ প্রভাব ও প্রতিক্রিয়া নিশ্চয়ই অনস্বীকার্য।