১। পানিতে নামা, ডুব দেয়া ও সাঁতার কাটা

রোযা অবস্থায় যা বৈধ

কিছু কাজ আছে, যা রোযা অবস্থায় করা বৈধ নয় বলে অনেকের মনে হতে পারে, অথচ তা রোযাদারের জন্য করা বৈধ। সেই ধরনের কিছু কাজের কথা নিম্নে আলোচনা করা হচ্ছেঃ-

১। পানিতে নামা, ডুব দেয়া ও সাঁতার কাটা

রোযাদারের জন্য পানিতে নামা, ডুব দেওয়া ও সাঁতার কাটা, একাধিক বার গোসল করা, এসির হাওয়াতে বসা এবং কাপড় ভিজিয়ে গায়ে-মাথায় জড়ানো বৈধ। যেমন পিপাসা ও গরমের তাড়নায় মাথায় পানি ঢালা, বরফ বা আইসক্রিম চাপানো দোষাবহ নয়।[1]

মা আয়েশা (রাঃ) বলেন, রোযা রেখে নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লাম)-এর অপবিত্র অবস্থায় ফজর হত। অতঃপর তিনি গোসল করতেন।[2]

আবূ বাক্র বিন আব্দুর রহমান নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লাম)-এর কিছু সাহাবী থেকে বর্ণনা করেন যে, তিনি (সাহাবী) বলেন, আমি আল্লাহর রসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লাম)-কে দেখেছি, তিনি রোযা রেখে পিপাসা অথবা গরমের কারণে নিজ মাথায় পানি ঢেলেছেন।[3]

রোযা রাখা অবস্থায় ইবনে উমার একটি কাপড় ভিজিয়ে নিজের দেহের উপর রেখেছেন।[4]

অবশ্য সাঁতার কেটে খেলা করা মকরূহ। কারণ, তাতে রোযা নষ্ট হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা আছে তাই। কিন্তু যার কাজই হল ডুবরীর অথবা প্রয়োজনের তাকীদে পানিতে বারবার ডুব দিতে হয়, সে ব্যক্তি পেটে পানি পৌঁছনো থেকে সাবধান থাকতে পারলে তার রোযার কোন ক্ষতি হবে না।[5]

[1] (ফুসূলুন ফিস্-সিয়ামি অত্-তারাবীহি অয্-যাকাহ ১৬পৃঃ, তাযকীরু ইবাদির রাহমান, ফীমা অরাদা বিসিয়ামি শাহরি রামাযান ৪৬পৃঃ, ফাতাওয়া ইসলামিয়্যাহ ২/১৩০, ফাসিঃ ৪৭পৃঃ, সাবঊনা মাসআলাহ ফিস্-সিয়াম ৫৮নং)

[2] (বুখারী ১৯২৫, মুসলিম ১১০৯নং)

[3] (আহমাদ ৩/৪৭৫, আবূ দাউদ ২৩৬৫নং, মালেক, মুঅত্তা)

[4] (ইবনে আবী শাইবাহঃ ৯২১২নং)

[5] (৭০ মাসআলাহ ফিস্-সিয়ামঃ ৫৮নং)

দাঁতন করা রোযাদার-অরোযাদার সকলের জন্য এবং দিনের শুরু ও শেষ ভাগে সব সময়কার জন্য সুন্নত। এ ব্যাপারে মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লাম)-এর নির্দেশ ব্যাপক; তিনি বলেন, ‘‘দাঁতন করায় রয়েছে মুখের পবিত্রতা এবং প্রতিপালক আল্লাহর সন্তুষ্টি।[1]

প্রিয় নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লাম) বলেন, ‘‘আমি উম্মতের জন্য কষ্টকর না জানলে তাদেরকে প্রত্যেক নামাযের সময় দাঁতন করতে আদেশ দিতাম।’’[2] অন্য এক বর্ণনায় আছে, ‘‘---তাদেরকে প্রত্যেক ওযূর সময় দাঁতন করতে আদেশ দিতাম।’’[3]

ইমাম ত্বাবারানী উত্তম সনদ দ্বারা বর্ণনা করেছেন যে, আব্দুর রহমান বিন গুন্ম বলেন, আমি মুআয বিন জাবাল (রাঃ)-কে জিজ্ঞাসা করলাম, ‘আমি কি রোযা অবস্থায় দাঁতন করব?’ উত্তরে তিনি বললেন, ‘হ্যাঁ।’ আমি বললাম, ‘দিনের কোন্ ভাগে?’ তিনি বললেন, ‘সকাল অথবা বিকালে।’ আমি বললাম, ‘লোকে তো রোযার বিকালে দাঁতন করাকে অপছন্দনীয় মনে করে। তারা বলে, আল্লাহর রসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লাম) বলেছেন, ‘‘নিশ্চয়ই রোযাদারের মুখের দুর্গন্ধ আল্লাহর নিকট কস্ত্তরীর সুবাস অপেক্ষা অধিকতর সুগন্ধময়।’’ মুআয (রাঃ) বললেন, ‘সুবহানাল্লাহ! তিনি তাদেরকে দাঁতন করতে আদেশ দিয়েছেন। আর যে জিনিস তিনি পরিষ্কার করতে আদেশ দিয়েছেন, সে জিনিসকে ইচ্ছাকৃতভাবে দুর্গন্ধময় করা উত্তম হতে পারে না। তাতে কোন প্রকারের মঙ্গল নেই; বরং তাতে অমঙ্গলই আছে।’[4]

কিন্তু যদি কোন দাঁতনে বিশেষ স্বাদ থাকে এবং তা তার থুথুকে প্রভাবান্বিত করে, তাহলে তার স্বাদ বা থুথু গিলে নেওয়া উচিৎ নয়।[5] পরন্তু সেই দাঁতন করা থেকে দূরে থাকা উচিৎ, যার দ্রবণশীল উপাদান (ও রস) আছে। যেমন কাঁচা (গাছের ডালের বা শিকড়ের) দাঁতন। তদনুরূপ সেই দাঁতন, যাতে তার নিজস্ব স্বাদ ছাড়া ভিন্ন স্বাদ; যেমন লেবু বা পুদ্বীনা (পেপারমে¦ট্, মেনথল) ইত্যাদির স্বাদ অতিরিক্ত করা হয়েছে এবং যা মুখের ভিতরে গিয়ে দ্রবীভূত হয়ে মুখগহ্বরে ছড়িয়ে পড়ে। আর ইচ্ছা করে তা গিলে ফেলা বৈধ নয়। তবে যদি অনিচ্ছাকৃত কারো গিলা যায়, তাহলে তাতে কোন ক্ষতি হয় না।[6]

পক্ষান্তরে রোযার দিনে দাঁতের মাজন (টুথ পেষ্ট্ বা পাওডার) ব্যবহার না করাই উত্তম। বরং তা রাত্রে এবং ফজরের আগে ব্যবহার করা উচিৎ। কারণ, মাজনের এমন প্রতিক্রিয়া ও সঞ্চার ক্ষমতা আছে, যার ফলে তা গলা ও পাকস্থলীতে নেমে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে। অনুরূপ আশঙ্কার ফলেই মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লাম) লাকীত্ব বিন সাবরাহকে বলেছিলেন, ‘‘(ওযূ করার সময়) তুমি নাকে খুব অতিরঞ্জিতভাবে পানি টেনে নিও। কিন্তু তোমার রোযা থাকলে নয়।’’[7]

বলা বাহুল্য, রোযাদারের জন্য মাজন ব্যবহার না করাই উত্তম। আর এ ব্যাপারে সংকীর্ণতা নেই। কারণ, সে ইফতার করে নেওয়া পর্যন্ত সময় অপেক্ষা করে যদি তা ব্যবহার করে, তাহলে সে এমন এক জিনিস থেকে দূরে থাকতে পারবে, যার দ্বারা তার রোযা নষ্ট হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।[8]

পক্ষান্তরে নেশাদার ও দেহে অবসন্ন আনয়নকারী মাজন; যেমন, গুল-গুরাকু প্রভৃতি; যা ব্যবহারের ফলে মাথা ঘোরে অথবা ব্যবহারকারী জ্ঞানশূন্য হয়ে যায়, তা ব্যবহার করা বৈধ নয়; না রোযা অবস্থায় এবং না অন্য সময়। কারণ, তা মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লাম)-এর এই বাণীর আওতাভুক্ত হতে পারে, যাতে তিনি বলেন, ‘‘প্রত্যেক মাদকতা আনয়নকারী দ্রব্য হারাম।’’[9]

জ্ঞাতব্য যে, দাঁতের মাড়িতে ক্ষত থাকার ফলে অথবা দাঁতন করতে গিয়ে রক্ত বের হলে তা গিলে ফেলা বৈধ নয়; বরং তা বের করে ফেলা জরুরী। অবশ্য যদি তা নিজের ইচ্ছা ও এখতিয়ার ছাড়াই গলায় নেমে যায়, তাহলে তাতে কোন ক্ষতি হবে না।[10]

[1] (আহমাদ, মুসনাদ ৬/৪৭, দারেমী, নাসাঈ ৫নং, ইবনে খুযাইমাহ, সহীহ, বাইহাকী ১/৩৪, ইবনে হিববান, সহীহ, বুখারী (বিনা সনদে), মিশকাতুল মাসাবীহ ৩৮১, ইরওয়াউল গালীল, আলবানী ৬৬নং)

[2] (বুখারী ৮৮৭, মুসলিম ২৫২, সুনানে আরবাআহ; আবূ দাঊদ, তিরমিযী, নাসাঈ ও ইবনে মাজাহ)

[3] (আহমাদ, মুসনাদ ২/৪৬০, ৫১৭, প্রমুখ)

[4] (দ্রঃ ইরওয়াউল গালীল, আলবানী ১/১০৬)

[5] (ইবনে উষাইমীন, ফাসিঃ মুসনিদ ৩৯পৃঃ)

[6] (সাবঊনা মাসআলাহ ফিস্-সিয়াম ৫৪নং)

[7] (আহমাদ, মুসনাদ ৪/৩৩, আবূ দাঊদ ১৪২, তিরমিযী, নাসাঈ, সহীহ ইবনে মাজাহ, আলবানী ৩২৮নং)

[8] (আশ্শারহুল মুমতে’ ৬/৪০৭, ৪৩২, সামানিয়া ওয়া আরবাঊন সুআলান ফিস্-সিয়াম, ইবনে উষাইমীন ৬৩পৃঃ)

[9] (বুখারী, মুসলিম, সুনানে আরবাআহ; আবূ দাঊদ, তিরমিযী, নাসাঈ ও ইবনে মাজাহ, সজাঃ ৪৫৫০নং)

[10] (ইবনে উষাইমীন, ফাসিঃ ৩৯পৃঃ, ৭০ঃ ৫৩নং)
৩। সুরমা লাগানো এবং চোখে ও কানে ওষুধ ব্যবহার

রোযা অবস্থায় সুরমা লাগানো এবং চোখে ও কানে ওষুধ ব্যবহার বৈধ। কিন্তু ব্যবহার করার পর যদি গলায় সুরমা বা ওষুধের স্বাদ অনুভূত হয়, তাহলে (কিছু উলামার নিকট রোযা ভেঙ্গে যাবে এবং সে রোযা) কাযা রেখে নেওয়াই হল পূর্বসতর্কতামূলক কর্ম।[1] কারণ, চোখ ও কান খাদ্য ও পানীয় পেটে যাওয়ার পথ নয় এবং সুরমা বা ওষুধ লাগানোকে খাওয়া বা পান করাও বলা যায় না; না সাধারণ প্রচলিত কথায় এবং না-ই শরয়ী পরিভাষায়। অবশ্য রোযাদার যদি চোখে বা কানে ওষুধ দিনে ব্যবহার না করে রাতে করে, তাহলে সেটাই হবে পূর্বসাবধানতামূলক কর্ম।[2]

আনাস (রাঃ) রোযা থাকা অবস্থায় সুরমা ব্যবহার করতেন।[3]

পক্ষান্তরে রোযা থাকা অবস্থায় নাকে ওষুধ ব্যবহার বৈধ নয়। কারণ, নাকের মাধ্যমে পানাহার পেটে পৌঁছে থাকে। আর এ জন্যই মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লাম) বলেছেন, ‘‘(ওযূ করার সময়) তুমি নাকে খুব অতিরঞ্জিতভাবে পানি টেনে নিও। কিন্তু তোমার রোযা থাকলে নয়।’’[4]

বলা বাহুল্য উক্ত হাদীস এবং অনুরূপ অর্থের অন্যান্য হাদীসের ভিত্তিতেই নাকে ওষুধ ব্যবহার করার পর যদি গলাতে তার স্বাদ অনুভূত হয়, তাহলে রোযা নষ্ট হয়ে যাবে এবং সে রোযা কাযা করতে হবে।[5]

[1] (ইবনে বায, ফাতাওয়া মুহিম্মাহ, তাতাআল্লাকু বিস্সিয়াম, ইবনে বায ২৮পৃঃ)

[2] (আশ্শারহুল মুমতে’ ৬/৩৮২, সঊদী স্থায়ী উলামা কমিটি, ফাসিঃ মুসনিদ ৪৪পৃঃ, ফাতাওয়া ইসলামিয়্যাহ ২/১২৯)

[3] (সহীহ আবূ দাঊদ ২০৮২নং)

[4] (আহমাদ, মুসনাদ ৪/৩৩, আবূ দাঊদ ১৪২, তিরমিযী, নাসাঈ, সহীহ ইবনে মাজাহ, আলবানী ৩২৮নং)

[5] (ইবনে বায, ফাতাওয়া মুহিম্মাহ, তাতাআল্লাকু বিস্সিয়াম ২৮পৃঃ)

রোযাদারের জ্বর হলে তার জন্য পায়খানা-দ্বারে ওষুধ (সাপোজিটরি) রাখা যায়। তদনুরূপ জ্বর মাপা বা অন্য কোন পরীক্ষার জন্য মল-দ্বারে কোন যন্ত্র ব্যবহার করা দোষাবহ বা রোযার পক্ষে ক্ষতিকর নয়। কারণ, এ কাজকে খাওয়া বা পান করা কিছুই বলা হয় না। (এবং পায়খানা-দ্বার পানাহারের পথও নয়।)[1]

[1] (আশ্শারহুল মুমতে’ ৬/৩৮১)
৫। পেটে (এন্ডোসকপি মেশিন) নল সঞ্চালন

পেটের ভিতর কোন পরীক্ষার জন্য (এন্ডোসকপি মেশিন) নল বা স্টমাক টিউব সঞ্চালন করার ফলে রোযার কোন ক্ষতি হয় না। তবে হ্যাঁ, যদি পাইপের সাথে কোন (তৈলাক্ত) পদার্থ থাকে এবং তা তার সাথে পেটে গিয়ে পৌঁছে, তাহলে তাতে রোযা নষ্ট হয়ে যাবে। অতএব একান্ত প্রয়োজন ছাড়া এ কাজ ফরয বা ওয়াজেব রোযায় করা বৈধ নয়।[1]

[1] (আশ্শারহুল মুমতে’ ৬/৩৮৩-৩৮৪)
৬। বাহ্যিক শরীরে তেল, মলম, পাওডার বা ক্রিম ব্যবহার

বাহ্যিক শরীরের চামড়ায় পাওডার বা মলম ব্যবহার করা রোযাদারের জন্য বৈধ। কারণ, তা পেটে পৌঁছে না।

তদনুরূপ প্রয়োজনে ত্বককে নরম রাখার জন্য কোন তেল, ভ্যাসলিন বা ক্রিম ব্যবহার করাও রোযা অবস্থায় অবৈধ নয়। কারণ, এ সব কিছু কেবল চামড়ার বাহিরের অংশ নরম করে থাকে এবং শরীরের ভিতরে প্রবেশ করে না। পরন্তু যদিও লোমকূপে তা প্রবেশ হওয়ার কথা ধরেই নেওয়া যায়, তবুও তাতে রোযা নষ্ট হবে না।[1]

তদনুরূপ রোযা অবস্থায় মহিলাদের জন্য হাতে মেহেন্দী, পায়ে আলতা অথবা চুলে (কালো ছাড়া অন্য রঙের) কলফ ব্যবহার বৈধ। এ সবে রোযা বা রোযাদারের উপর কোন (মন্দ) প্রভাব ফেলে না।[2]

[1] (ইবনে জিবরীন, ফাতাওয়া ইসলামিয়্যাহ ২/১২৭, ফাসিঃ মুসনিদ ৪১পৃঃ)

[2] (ফাসিঃ মুসনিদ ৪৫পৃঃ, ফাতাওয়া ইসলামিয়্যাহ ২/১২৭)
৭। স্বামী-স্ত্রীর আপোষের চুম্বন ও প্রেমকেলি

যে রোযাদার স্বামী-স্ত্রী মিলনে ধৈর্য রাখতে পারে; অর্থাৎ সঙ্গম বা বীর্যপাত ঘটে যাওয়ার আশঙ্কা না করে, তাদের জন্য আপোসে চুম্বন ও প্রেমকেলি বা কোলাকুলি করা বৈধ এবং তা তাদের জন্য মকরূহ নয়। কারণ, মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লাম) রোযা রাখা অবস্থায় স্ত্রী-চুম্বন করতেন এবং রোযা অবস্থায় প্রেমকেলিও করতেন। আর তিনি ছিলেন যৌন ব্যাপারে বড় সংযমী।[1] অন্য এক বর্ণনায় আছে যে, আল্লাহর রসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লাম) স্ত্রী-চুম্বন করতেন রমাযানে রোযা রাখা অবস্থায়;[2] রোযার মাসে।[3]

আর এক বর্ণনায় আছে, আয়েশা (রাঃ) বলেন, ‘আল্লাহর রসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লাম) আমাকে চুম্বন দিতেন। আর সে সময় আমরা উভয়ে রোযা অবস্থায় থাকতাম।’[4]

উম্মে সালামাহ (রাঃ) বলেন, তিনি তাঁর সাথেও অনুরূপ করতেন।[5] আর তদ্রূপ বলেন হাফসা (রাঃ)ও।[6]

উমার (রাঃ) বলেন, একদা স্ত্রীকে খুশী করতে গিয়ে রোযা অবস্থায় আমি তাকে চুম্বন দিয়ে ফেললাম। অতঃপর নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লাম)-এর নিকট উপস্থিত হয়ে বললাম, ‘আজ আমি একটি বিরাট ভুল করে ফেলেছি; রোযা অবস্থায় স্ত্রী-চুম্বন করে ফেলেছি।’ আল্লাহর রসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লাম) বললেন, ‘‘যদি রোযা রেখে পানি দ্বারা কুল্লি করতে, তাহলে তাতে তোমার অভিমত কি?’’ আমি বললাম, ‘তাতে কোন ক্ষতি নেই।’ মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লাম) বললেন, ‘‘তাহলে ভুল কিসের?’’[7]

পক্ষান্তরে রোযাদার যদি আশঙ্কা করে যে, প্রেমকেলি বা চুম্বনের ফলে তার বীর্যপাত ঘটে যেতে পারে অথবা (স্বামী-স্ত্রী) উভয়ের উত্তেজনার ফলে সহসায় মিলন ঘটে যেতে পারে, কারণ সে সময় সে হয়তো তাদের উদগ্র কাম-লালসাকে সংযত করতে পারবে না, তাহলে সে কাজ তাদের জন্য হারাম। আর তা হারাম এই জন্য যে, যাতে পাপের ছিদ্রপথ বন্ধ থাকে এবং তাদের রোযা নষ্ট হওয়া থেকে রক্ষা পায়।

এ ক্ষেত্রে বৃদ্ধ ও যুবকের মাঝে কোন পার্থক্য নেই; যদি উভয়ের কামশক্তি এক পর্যায়ের হয়। সুতরাং দেখার বিষয় হল, কাম উত্তেজনা সৃষ্টি এবং বীর্যস্খলনের আশঙ্কা। অতএব সে কাজ যদি যুবক বা কামশক্তিসম্পন্ন বৃদ্ধের উত্তেজনা সৃষ্টি করে, তাহলে তা উভয়ের জন্য মকরূহ। আর যদি তা না করে তাহলে তা বৃদ্ধ, যৌন-দুর্বল এবং সংযমী যুবকের জন্য মকরূহ নয়। পক্ষান্তরে উভয়ের মাঝে পার্থক্য করার ব্যাপারে যে হাদীস বর্ণিত হয়েছে[8] তা আসলে কামশক্তি বেশী থাকা ও না থাকার কারণে। যেহেতু সাধারণতঃ বৃদ্ধ যৌন ব্যাপারে শান্ত হয়ে থাকে। পক্ষান্তরে যুবক তার বিপরীত।

ফলকথা, সকল শ্রেণীর দম্পতির জন্য উত্তম হল রোযা রেখে প্রেমকেলি, কোলাকুলি ও চুম্বন বিনিময় প্রভৃতি যৌনাচারের ভূমিকা পরিহার করা। কারণ, যে গরু সবুজ ফসল-জমির আশেপাশে চরে, আশঙ্কা থাকে যে, সে কিছু পরে ফসল খেতে শুরু করে দেবে। সুতরাং স্বামী যদি ইফতার করা অবধি ধৈর্য ধারণ করে, তাহলে সেটাই হল সর্বোত্তম। আর রাত্রি তো অতি নিকটে এবং তাতো যথেষ্ট লম্বা। অল্-হামদু লিল্লাহ। মহান আল্লাহ বলেন, ‘‘রোযার রাতে তোমাদের জন্য স্ত্রী-সম্ভোগ হালাল করা হয়েছে।’’ (কুরআনুল কারীম ২/১৮৭)

চুম্বনের ক্ষেত্রে চুম্বন গালে হোক অথবা ঠোঁটে উভয় অবস্থাই সমান। তদনুরূপ সঙ্গমের সকল প্রকার ভূমিকা ও শৃঙ্গারাচার; সকাম স্পর্শ, ঘর্ষণ, দংশন, মর্দন, প্রচাপন, আলিঙ্গন প্রভৃতির মানও চুম্বনের মতই। এ সবের মাঝে কোন পার্থক্য নেই। আর এ সব করতে গিয়ে যদি কারো মযী (বা উত্তেজনার সময় আঠালো তরল পানি) নিঃসৃত হয়, তাহলে তাতে রোযার কোন ক্ষতি হয় না।[9]

জ্ঞাতব্য যে, জিভ চোষার ফলে একে অন্যের জিহবারস গিলে ফেললে রোযা ভেঙ্গে যাবে। যেমন স্তনবৃন্ত চোষণের ফলে মুখে দুগ্ধ এসে গলায় নেমে গেলেও রোযা ভেঙ্গে যাবে।

স্ত্রীর দেহাঙ্গের যে কোন অংশ দেখা রোযাদার স্বামীর জন্যও বৈধ। অবশ্য একবার দেখার ফলেই চরম উত্তেজিত হয়ে কারো মযী বা বীর্যপাত ঘটলে কোন ক্ষতি হবে না।[10] কারণ, অবৈধ নজরবাজীর ব্যাপারে মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লাম) বলেন, ‘‘প্রথম দৃষ্টি তোমার জন্য বৈধ। কিন্তু দ্বিতীয় দৃষ্টি বৈধ নয়।’’[11] তাছাড়া দ্রুতপতনগ্রস্ত এমন দুর্বল স্বামীর এমন ওযর গ্রহণযোগ্য।

পক্ষান্তরে কেউ বারবার দেখার ফলে মযী নির্গত করলে রোযার কোন ক্ষতি হয় না। কিন্তু বারবার দেখার ফলে বীর্যপাত করে ফেললে রোযা নষ্ট হয়ে যাবে।

অবশ্য স্ত্রী-দেহ নিয়ে কল্পনা করার ফলে কারো মযী বা বীর্যপাত হলে রোযা নষ্ট হয় না। যেহেতু মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লাম)-এর ব্যাপক নির্দেশ এ কথার প্রতি ইঙ্গিত করে। তিনি বলেন, ‘‘নিশ্চয় আল্লাহ আমার উম্মতের মনের কল্পনা উপেক্ষা করেন, যতক্ষণ কেউ তা কাজে পরিণত অথবা কথায় প্রকাশ না করে।’’[12]

[1] (বুখারী ১৯২৭, মুসলিম ১১০৬, আবূ দাঊদ ২৩৮২, তিরমিযী ৭২৯, ইবনে আবী শাইবাহ, মুসান্নাফ ৯৩৯২নং)

[2] (মুসলিম ১১০৬নং)

[3] (আবূ দাঊদ ২৩৮৩, ইবনে আবী শাইবাহ, মুসান্নাফ ৯৩৯০নং)

[4] (আবূ দাঊদ ২৩৮৪, ইবনে আবী শাইবাহ, মুসান্নাফ ৯৩৯৭নং)

[5] (মুসলিম ১১০৮নং)

[6] (মুসলিম ১১০৭নং)

[7] (আহমাদ, মুসনাদ ১/২১, ৫২, সহীহ আবূ দাঊদ ২০৮৯, দারেমী, সুনান ১৬৭৫, ইবনে আবী শাইবাহ, মুসান্নাফ ৯৪০৬নং)

[8] (সহীহ আবূ দাঊদ ২০৯০নং)

[9] (আশ্শারহুল মুমতে’ ৬/৩৯০, ৪৩২-৪৩৩, ফাসিঃ ৪৮পৃঃ, তাসিঃ ৪৩-৪৪পৃঃ)

[10] (বুখারী ১৯২৭নং দ্রঃ)

[11] (আবূ দাঊদ ২১৪৯, তিরমিযী ২৭৭৮, সহীহ আবূ দাঊদ ১৮৮১নং)

[12] (বুখারী ২৫২৮, মুসলিম ১২৭, দ্রঃ আশ্শারহুল মুমতে’ ৬/৩৯০-৩৯১)

রোযা অবস্থায় কোন যন্ত্র দ্বারা অথবা যন্ত্র ছাড়াই, পা থেকে অথবা মাথার কোন শিরা থেকে, মুখে করে চুষে অথবা যে কোন প্রকারে দেহ থেকে দূষিত রক্ত বের করলে রোযা নষ্ট হবে কি না, সে নিয়ে উলামাদের মাঝে মতভেদ রয়েছে। যেহেতু মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লাম) কর্তৃক উভয় শ্রেণীর বর্ণনা মজুদ রয়েছে। তিনি বলেন, ‘‘দেহ থেকে দূষিত রক্ত যে বের করে তার এবং যার বের করা হয় তারও রোযা নষ্ট হয়ে যায়।’’[1] এ কথাও বর্ণিত আছে যে, তিনি রোযা অবস্থায় নিজ দেহ থেকে দূষিত রক্ত বের করেছেন।[2] আর তিনি বলেছেন, ‘‘যে (অনিচ্ছাকৃত) বমি করে, যার স্বপ্নদোষ হয় এবং যে দেহ থেকে দূষিত রক্ত বের করে, তার রোযা নষ্ট হয় না।’’[3]

পরস্পর বিরোধী উক্ত সকল বর্ণনা দেখে কিছু উলামা মনে করেন যে, দেহ থেকে দূষিত রক্ত বের করলে রোযা নষ্ট হয়ে যাওয়ার হাদীস আজও নাসেখ (কার্যকর) এবং এর বিরোধী সকল হাদীস মনসূখ (রহিত)। পক্ষান্তরে অন্যান্য কিছু সত্য-সন্ধানী গবেষক উলামা মনে করেন যে, বরং প্রথম হাদীসটাই মনসূখ।

দেহ থেকে দূষিত রক্ত বের করলে রোযা নষ্ট হয়ে যাওয়ার হাদীস যে মনসূখ (রহিত) সে ব্যাপারে সাক্ষ্য বহন করে আনাস (রাঃ)-এর হাদীস। তিনি বলেন, ‘শুরু শুরু রোযাদারের জন্য দেহ থেকে দূষিত রক্ত বের করা মকরূহ ছিল। একদা জা’ফর বিন আবী তালেব রোযা অবস্থায় দেহ থেকে দূষিত রক্ত বের করলেন। তা দেখে তিনি বললেন, ‘‘এদের উভয়ের রোযা নষ্ট।’’ অতঃপর পরবর্তীকালে তিনি রোযাদারের জন্য দেহ থেকে দূষিত রক্ত বের করার অনুমতি দিলেন।’ আর সবয়ং আনাস রোযা অবস্থায় দেহ থেকে দূষিত রক্ত বের করতেন।[4]

একদা তাঁকে প্রশ্ন করা হল, ‘আপনারা আল্লাহর রসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লাম)-এর যুগে কি রোযা অবস্থায় দেহ থেকে দূষিত রক্ত বের করাকে মকরূহ মনে করতেন?’ উত্তরে তিনি বললেন, ‘না। অবশ্য দুর্বল হয়ে পড়ার আশঙ্কা করলে মকরূহ মনে করা হত।’[5]

তদনুরূপ আবূ সাঈদ খুদরী (রাঃ) বলেন, ‘আল্লাহর রসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লাম) রোযাদারকে স্ত্রী-চুম্বন ও দেহ থেকে দূষিত রক্ত বের করার ব্যাপারে অনুমতি দিয়েছেন।’[6]

ইবনে আববাস (রাঃ) বলেন, ‘(পেটের ভিতরে) কিছু প্রবেশ করলে রোযা ভাঙ্গে, কিছু বাহির হলে নয়।’[7]

উপরোক্ত কিছু বর্ণনায় ‘অনুমতি’ দেওয়ার অর্থই হল যে, প্রথমে সে কাজ অবৈধ ছিল এবং পরে তা বৈধ ঘোষণা করা হয়েছে। অতএব সঠিক মত এই যে, দেহ থেকে দূষিত রক্ত বের করলে কারো রোযা নষ্ট হবে না; যে বের করাবে তার এবং যে বের করে দেবে তারও নয়।[8]

বলা বাহুল্য, যদিও সঠিক মত এই যে, রোযা অবস্থায় দেহ থেকে দূষিত রক্ত বের করলে রোযা নষ্ট হবে না, তবুও উত্তম ও পূর্বসতর্কতামূলক আমল এই যে, রোযাদার তা বর্জন করবে। এর ফলে সে মতভেদের বেড়াজাল থেকে নিষ্কৃতি পাবে, খুন বের করার পর সে দৈহিক দুর্বলতার শিকার হবে না এবং যে ব্যক্তি মুখে টেনে খুন বের করে সে ব্যক্তির গলায় কিছু রক্ত চলে গিয়ে তারও রোযা নষ্ট না হয়ে যায়। অবশ্য একান্ত তা করার দরকার হলে দিনে না করে রাত্রে করবে। আর সেটাই হবে উভয়ের জন্য উত্তম।[9]৫৬নং)

[1] (আহমাদ, মুসনাদ, আবূ দাঊদ ২৩৬৭, ইবনে মাজাহ ১৬৮০, দারেমী, সুনান ১৬৮১-১৬৮২, ইবনে খুযাইমাহ, সহীহ ১৯৬২-১৯৬৩নং, ইবনে হিববান, সহীহ, হাকেম, মুস্তাদ্রাক ১/৪২৭, বাইহাকী ৪/২৬৫, প্রমুখ)

[2] (বুখারী ১৯৩৮-১৯৩৯, আবূ দাউদ ২৩৭২, তিরমিযী, ইবনে আবী শাইবাহ, মুসান্নাফ, বাইহাকী ৪/২৬৩)

[3] (আবূ দাঊদ, সহীহুল জামেইস সাগীর, আলবানী ৭৭৪২নং)

[4] (দারাকুত্বনী, সুনান ২৩৯নং, বাইহাকী ৪/২৬৮)

[5] (বুখারী : ১৯৪০নং)

[6] (ত্ববারানী, দারাকুত্বনী, ইরওয়াউল গালীল ৪/৭৪)

[7] (ইবনু আবী শাইবাহ ৯৩১৯নং, ইরওয়াউল গালীল ৪/৭৫)

[8] (দ্রঃ মুহাল্লা ৬/২০৪-২০৫, ইরওয়াউল গালীল ৪/৭৪)

[9] (দ্রঃ আহকামুস সাওমি অল-ই’তিকাফ, আবূ সারী মঃ আব্দুল হাদী ১৩৬পৃঃ, সাবঊনা মাসআলাহ ফিস্-সিয়াম, মুহাম্মাদ বিন সালেহ আল-মুনাজ্জিদ
৯। নাক অথবা কোন কাটা-ফাটা থেকে রক্ত বের হওয়া

দেহের কোন কাটা-ফাটা অঙ্গ থেকে রক্ত পড়লে রোযা নষ্ট হয় না। বরং তা দেহ থেকে দূষিত রক্ত বের করার মতই। অনুরূপ নাক থেকে রক্ত পড়লেও রোযা নষ্ট নয়। কারণ, তাতে মানুষের কোন এখতিয়ার থাকে না। আর ইচ্ছা করে বের করলে তাও দেহ থেকে দূষিত রক্ত বের করার মত।[1] তদনুরূপ মাথায় বা দেহের অন্য কোন জায়গায় পাথর বা অন্য কিছুর আঘাত লেগে রক্ত ঝরলে রোযা নষ্ট হয় না।[2]

[1] (দ্রঃ আহকামুস সাওম ১৩৬-১৩৮পৃঃ)

[2] (মাজাল্লাতুল বুহূসিল ইসলামিয়্যাহ ৩০/১২৬)

পরীক্ষার জন্য কিছু রক্ত দেওয়া রোযাদারের জন্য বৈধ। এতে তার রোযার কোন ক্ষতি হয় না।[1]

তদনুরূপ কোন রোগীর প্রাণ বাঁচানোর উদ্দেশ্যে রক্তদান করাও বৈধ এবং তা দেহ থেকে দূষিত রক্ত বের করার মতই। এতেও রোযার কোন ক্ষতি হয় না।[2]

[1] (রিসালাতানি মু’জাযাতানি ফিয যাকাতি অস্সিয়াম ২৪পৃঃ, ফাসিঃ মুসনিদ ৫৩পৃঃ, ফাতাওয়া মুহিম্মাহ, তাতাআল্লাকু বিস্সিয়াম ৩৪পৃঃ)

[2] (দ্রঃ আহকামুস সাওমি অল-ই’তিকাফ, আবূ সারী মঃ আব্দুল হাদী ১৩৮পৃঃ)
দেখানো হচ্ছেঃ থেকে ১০ পর্যন্ত, সর্বমোট ২৫ টি রেকর্ডের মধ্য থেকে পাতা নাম্বারঃ 1 2 3 পরের পাতা »