রোযা হল দুই প্রকার; ফরয (বাধ্যতামূলক) ও নফল (অতিরিক্ত)। ফরয রোযা আবার ৩ প্রকার; রমাযানের রোযা, কাফ্ফারার রোযা এবং নযর মানা রোযা।
এক্ষণে রমাযানের রোযা সংক্রান্ত বিভিন্ন মাসায়েল আলোচনা করব।
রমাযানের রোযা আল্লাহর কিতাব, তাঁর রসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লাম)-এর হাদীস ও মুসলিম উম্মাহর ইজমা’ (সর্বসম্মতি) মতে চিরকালের জন্য ফরয।
কুরআন কারীমে মহান আল্লাহ বলেন,
﴿يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا كُتِبَ عَلَيْكُمُ الصِّيَامُ كَمَا كُتِبَ عَلَى الَّذِينَ مِنْ قَبْلِكُمْ لَعَلَّكُمْ تَتَّقُونَ- أَيَّاماً مَعْدُودَاتٍ﴾
‘‘হে ঈমানদারগণ! তোমাদের উপর রোযা ফরয করা হল, যেমন তোমাদের পূর্ববর্তী উম্মতের উপর ফরয করা হয়েছিল। যাতে তোমরা পরহেযগার হতে পার। তা নির্ধারিত কয়েক দিন--।’’(কুরআনুল কারীম ২/১৮৩-১৮৪)
তিনি আরো বলেন,
﴿شَهْرُ رَمَضَانَ الَّذِي أُنْزِلَ فِيهِ الْقُرْآنُ هُدىً لِلنَّاسِ وَبَيِّنَاتٍ مِنَ الْهُدَى وَالْفُرْقَانِ فَمَنْ شَهِدَ مِنْكُمُ الشَّهْرَ فَلْيَصُمْهُ﴾
‘‘রমাযান মাস; যে মাসে মানুষের দিশারী এবং সৎপথের স্পষ্ট নিদর্শন ও সত্যাসত্যের পার্থক্যকারীরূপে কুরআন অবতীর্ণ হয়েছে। অতএব তোমাদের মধ্যে যে কেউ এ মাস পাবে সে যেন এ মাসে রোযা রাখে।’ (কুরআনুল কারীম ২/১৮৫)
হাদীসে মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লাম) বলেন, ‘‘ইসলামের ভিত্তি হল ৫টি কর্ম; আল্লাহ ছাড়া কেউ সত্যিকারে উপাস্য নেই এবং মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লাম) তাঁর রসূল (দূত) -এই কথার সাক্ষ্য দেওয়া, নামায কায়েম করা, যাকাৎ প্রদান করা, রমাযানের রোযা রাখা এবং সামর্থ্য থাকলে কা’বাগৃহের হজ্জ করা।’’[1]
তালহা বিন উবাইদুল্লাহ (রাঃ) বলেন, এক ব্যক্তি নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লাম)-কে জিজ্ঞাসা করল, ‘হে আল্লাহর রসূল! আমার উপর আল্লাহ কি কি রোযা ফরয করেছেন তা আমাকে বলে দিন।’ উত্তরে তিনি বললেন, ‘‘রমাযান মাসের রোযা।’’ লোকটি বলল, ‘এ ছাড়া অন্য কিছু কি আমার কর্তব্য আছে?’ তিনি বললেন, ‘‘না, তবে যদি তুমি নফল রোযা রাখ, তাহলে ভিন্ন কথা।’’[2]
আর মুসলিম উম্মাহ এ বিষয়ে একমত যে, রমাযানের রোযা ফরয। তা ইসলামের অন্যতম রুকন, খুঁটি বা ভিত্তি। এ ফরয হওয়ার কথা সহজ উপায়ে সকলের জানা। সুতরাং যে কেউ তা অস্বীকার করবে সে মুরতাদ্দ্ কাফের। তাকে তওবা করার জন্য আহবান করা হবে। তাতে সে তওবা করলে এবং রোযা ফরয বলে মেনে নিলে উত্তম। নচেৎ, (সরকার) তাকে কাফের অবস্থায় হত্যা করবে।[3]
[2] (বুখারী, ১৮৯১, মুসলিম)
[3] (ফিকহুস সুন্নাহ ১/৩৮৩, ফুসূল ৪-৫পৃঃ)
রমাযান শব্দটি ‘রম্য’ ধাতু থেকে উৎপত্তি। এর মানে হল কঠিন গরম, জ্বালিয়ে দেওয়া। চান্দ্র মাসগুলোর যখন প্রাচীন নাম বাদ দিয়ে আরবী ভাষায় নতুন নাম দেওয়া হয়, তখন রমাযান মাসটি পরে কঠিন গরমের সময়। আর তাকেই ভিত্তি করে তার ‘রামাযান’ নামকরণ করা হয়। অবশ্য রমাযান মাসের রোযা ফরয হওয়ার পর তার নাম সার্থক হয়। যেহেতু উক্ত মাসে ক্ষুৎপিপাসায় রোযাদারের পেট জ্বলে থাকে।
রমাযানের মাসের একাধিক এমন বৈশিষ্ট্য রয়েছে, যা অন্যান্য মাসে নেই। যেমনঃ-
১। এই মাসের নাম কুরআন মাজীদে উল্লেখিত হয়েছে। (দ্রষ্টব্য কুরআনুল কারীম ২/১৮৫)
পক্ষান্তরে অন্য মাসের নাম উল্লেখ করা হয়নি।
২। এই মাস আসার সময় মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লাম) তাঁর সাহাবাগণকে সুসংবাদ দিতেন।
৩। রমাযান হল বর্কতময় পবিত্র মাস। এ মাসে বর্কত অবতীর্ণ হয়।
৪। মহান আল্লাহ এই মাসের রোযা ফরয করেছেন।
৫। এই মাসে জান্নাতের দ্বারসমূহ উন্মুক্ত করা হয় এবং একটা দ্বারও বন্ধ থাকে না।
৬। এই মাসে রহমতের সকল দরজা খুলে দেওয়া হয়।[1]
৭। এই মাসে জাহান্নামের দ্বারসমূহ রুদ্ধ করা হয় এবং একটা দ্বারও খোলা থাকে না।
উল্লেখ্য যে, বেহেশ্তের সকল দরজা খুলে দেওয়ার কারণ হল, যাতে করে আমলকারী তা শুনে আমলে আগ্রহ ও উৎসাহ পায় এবং তাতে প্রবেশ করার জন্য প্রস্ত্ততি গ্রহণ করে। আর দোযখের সকল দরজা বন্ধ করার কারণ হল, যাতে আমলকারী এই মাসে পাপে লিপ্ত না হয় এবং তাতে প্রবেশ না করে বসে। এর অর্থ এই নয় যে, যে ব্যক্তি রমাযান মাসে মারা যাবে সে বিনা হিসাবে সোজা বেহেশ্তে যাবে।[2]
৮। উচ্ছৃঙ্খল শয়তান দলকে এই মাসে বন্দী করে রাখা হয়।[3] অর্থাৎ, তাদেরকে শিকল ও বেড়ি দিয়ে বেঁধে আটকে রাখা হয়। ফলে তারা রমাযানে সেই পাপাচরণ ঘটাতে সক্ষম হয় না, যতটা অন্য মাসে সক্ষম হয়। এ জন্য দেখা যায় যে, অন্যান্য মাসের তুলনায় এই মাসে শয়তানের কুমন্ত্রণা, চক্রান্ত এবং মানুষকে বিভ্রান্ত করার কাজ কম ঘটে থাকে। বরং শয়তান রমাযান মাসকে ভয় করে, যেমন ভয় করে আযান ও ইকামতকে এবং তার শব্দ শুনে পাদতে পাদতে পলায়ন করে।
কিন্তু আমরা এ মাসেও যে পাপাচরণ ও শয়তানী কর্মকান্ড ঘটতে দেখে থাকি তা উক্ত কথার বিরোধী নয়। কারণ, পাপ কেবল শয়তানই ঘটায় না। বরং মন্দপ্রবণ মানুষের মনও এমনিতেই পাপ করে থাকে। যে মন শয়তানের কুমন্ত্রণা সত্বর গ্রহণ করে থাকে এবং শয়তানের তাসীর কম বা বন্ধ হয়ে গেলেও সেই মন নিজেই পাপ সৃষ্টি করে। এটি হল মানুষের ‘নাফ্সে আম্মারাহ।’ যে নাফ্স বা মন শয়তানের প্রতিনিধিত্ব করে এবং সেই পাপাচরণ ঘটিয়ে থাকে। নাঊযু বিল্লাহি মিন যালিক।[4]
৯। রমাযান মাসে আসমানের দরজাসমূহ উন্মুক্ত করা হয়।[5]
১০। এই মাসে দুআ কবুল হয়। মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লাম) বলেন, ‘‘(রমাযান মাসের) প্রত্যেক রাতে ও দিনে প্রত্যেক মুসলিমের দুআ কবুল করা হয়।’’[6]
১১। এই মাসে রয়েছে এমন একটি রাত্রি, যা হাজার মাস অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ। যে ব্যক্তি এই রাতের মঙ্গল থেকে বঞ্চিত হয়, সে আসলে সকল মঙ্গল থেকে বঞ্চিত। আর একান্ত বঞ্চিত ব্যক্তি ছাড়া সে মঙ্গল থেকে কেউ বঞ্চিত হয় না।[7]
১২। এই মাসের প্রত্যেক রাত্রে একজন আহবানকারী (ফিরিশ্তা) আহবান করে বলেন, ‘ওহে কল্যাণকামী! তুমি অগ্রসর হও। আর ওহে মন্দকামী! তুমি ক্ষান্ত হও।’
১৩। এই মাসের প্রত্যেক রাত্রে মহান আল্লাহ দোযখ থেকে মুসলিম মুক্ত করে থাকেন।[8]
১৪। রমাযান মাস হল সবর ও ধৈর্যের মাস। যেহেতু রোযা ছাড়া অন্য ইবাদতে সেইরূপ ধৈর্যের পরীক্ষা দিতে হয় না। মুসলিম এই মাসে পূর্ণ ৩০ বা ২৯টি দিনই পানাহার, স্ত্রী-মিলন এবং অন্যান্য রোযাবিরোধী সকল কর্ম থেকে ধৈর্যের সাথে বিরত থাকে। তাই মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লাম) এই মাসকে ‘ধৈর্যের মাস’ বলে অভিহিত করেছেন।[9] আর তিনি বলেছেন, ‘‘ধৈর্যের (রমাযান) মাসে রোযা আর প্রত্যেক মাসের তিনটি রোযা অন্তরের বিদ্বেষ ও খট্কা দূর করে দেয়।’’[10]
১৫। রমাযান হল কুরআনের মাস। কুরআন পঠন-পাঠন ও তেলাঅতের মাস। প্রশংসার অধিকারী বিজ্ঞানময় আল্লাহর তরফ থেকে কুরআন অবতীর্ণ হওয়ার মাস। এই মাসে কুরআন ‘লাওহে মাহফূয’ থেকে দুনিয়ার আসমানের প্রতি অবতীর্ণ হয়, অথবা কুরআন অবতীর্ণ হতে শুরু হয় এই পবিত্র মাসে। মহান আল্লাহ বলেন,
﴿شَهْرُ رَمَضَانَ الَّذِي أُنْزِلَ فِيهِ الْقُرْآنُ هُدىً لِلنَّاسِ وَبَيِّنَاتٍ مِنَ الْهُدَى وَالْفُرْقَانِ فَمَنْ شَهِدَ مِنْكُمُ الشَّهْرَ فَلْيَصُمْهُ﴾
‘‘রমাযান মাস; যে মাসে মানুষের দিশারী এবং সৎপথের স্পষ্ট নিদর্শন ও সত্যাসত্যের পার্থক্যকারীরূপে কুরআন অবতীর্ণ হয়েছে। অতএব তোমাদের মধ্যে যে কেউ এ মাস পাবে সে যেন এ মাসে রোযা রাখে।’’
(কুরআনুল কারীম ২/১৮৫)
আর কেবল কুরআনই নয়; বরং অন্যান্য আসমানী গ্রন্থসমূহও অবতীর্ণ হয়েছে এই বর্কতময় মাসেই। ‘‘ইবরাহীমের সহীফাসমূহ অবতীর্ণ হয়েছে রমাযান মাসের প্রথম রাতে, তাওরাত অবতীর্ণ হয়েছে রমাযানের সপ্তম রাতে, ইঞ্জীল অবতীর্ণ হয়েছে রমাযানের ১৪তম রাতে, যাবূর অবতীর্ণ হয়েছে রমাযানের ১৯শের রাতে এবং কুরআন অবতীর্ণ হয়েছে রমাযানের ২৫শের রাতে।’’[11]
১৬। রমাযান মাসে বিস্ময়কর বড় বড় বিজয় দানের মাধ্যমে মহান আল্লাহ ইসলামকে সাহায্য করেছেন, মুসলিমদেরকে মর্যাদা দিয়েছেন। এই মাসেই বদর যুদ্ধে বদর প্রান্তরে মুসলিমদের আধ্যাত্মিক শক্তিমত্তা, ঈমানী ভিত্তির সুদৃঢ়তা এবং প্রতীতির অবিচলতা প্রকাশ পায়। আল্লাহ তাআলা এই দিনে তাঁদেরকে সাহায্য করেন এবং শত্রুর উপর বিজয়ী করেন।
অষ্টম হিজরীর রমাযান মাসে মক্কা বিজয়ের মাধ্যমে আল্লাহ তাঁদেরকে সাহায্য করেন। যার পর মুসলিমরা স্থিতিশীলতা পেলেন এবং ইসলাম পূর্ণরূপে প্রতিষ্ঠা লাভ করল।[12]
১৭। রমাযান মাসে কোন কোন আমলের বহুগুণ সওয়াব লাভ হয়। এ মাসে উমরাহ আদায় আল্লাহর রসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লাম)-এর সাথে হজ্জ করার সমান।[13]
পক্ষান্তরে এ মাসের রোযা রাখার সওয়াব প্রসঙ্গে মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লাম) বলেন,
(ক) ‘‘যে ব্যক্তি ঈমান ও বিÇবাসের সাথে এবং সওয়াবের আশা রেখে রমাযানের রোযা রাখবে তারও পূর্বেকার পাপরাশি মাফ হয়ে যাবে।’’[14]
(খ) ‘‘পাঁচ ওয়াক্ত নামায, এক জুমআহ হতে অপর জুমআহ পর্যন্ত ও এক রমাযান অপর রমাযান পর্যন্ত উভয়ের মধ্যবর্তীকালের সংঘটিত পাপরাশিকে মোচন করে দেয়; যদি কাবীরা গোনাহ থেকে দূরে থাকা হয় তবে।’’[15]
(গ) এক ব্যক্তি মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লাম)-এর কাছে হাজির হয়ে আরজ করল, ‘হে আল্লাহর রসূল! আপনার অভিমত কি? যদি আমি সাক্ষ্য দিই যে, আল্লাহ ছাড়া কোন সত্য উপাস্য নেই এবং আপনি আল্লাহর রসূল, পাঁচ-ওয়াক্ত নামায পড়ি, যাকাত আদায় করি এবং রমাযানের রোযা পালন করি, তাহলে আমি কাদের দলভুক্ত হব?’ উত্তরে মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লাম) বললেন, ‘‘তুমি সিদ্দীক ও শহীদগণের দলভুক্ত হবে।’’[16]
[2] (ফাসিঃ ২২পৃঃ)
[3] (বুখারী ১৮০, মুসলিম ১০৭৯নং)
[4] (দুরুসু রামাযান অকাফাত লিস্-সায়েমীন ২১পৃঃ)
[5] (বুখারী ১৮৯৯, আহমাদ, মুসনাদ, নাসাঈ, সিলসিলাহ সহীহাহ, আলবানী ১৮৬৮নং)
[6] (বাযযার, সহীহ তারগীব, আলবানী ৯৮৮নং)
[7] (সহীহ ইবনে মাজাহ, আলবানী ১৩৩৩, সহীহুল জামেইস সাগীর, আলবানী ৩৫১৯নং)
[8] (আহমাদ, মুসনাদ ৪/৩১২, ৫/৪১১, নাসাঈ, সহীহ ইবনে মাজাহ, আলবানী ১৩৩১নং)
[9] (সহীহুল জামেইস সাগীর, আলবানী ৩৮০৩নং)
[10] (বায্যার, ত্বাবারানী, মু’জাম, ইবনে হিববান, সহীহ, সহীহুল জামেইস সাগীর, আলবানী ৩৮০৪নং)
[11] (আহমাদ, মুসনাদ, ত্বাবারানী, মু’জাম, সহীহুল জামেইস সাগীর, আলবানী ১৪৯৭, সিলসিলাহ সহীহাহ, আলবানী ১৫৭৫নং)
[12] (সাওমু রামাযান ৮-১৩পৃঃ)
[13] (বুখারী ১৮৬৩, মুসলিম ১২৫৬, আবূ দাঊদ, তিরমিযী, ইবনে মাজাহ, দারেমী, সুনান)
[14] (বুখারী ৩৮, ১৯০৮, মুসলিম ৭৬০, আবূ দাঊদ, নাসাঈ, ইবনে মাজাহ)
[15] (আহমাদ, মুসনাদ ২/৩৫৯, ৪০০, ৪১৪, মুসলিম ২৩৩নং)
[16] (বায্যার, ইবনে খুযাইমাহ, সহীহ, ইবনে হিববান, সহীহ, সহীহ তারগীব, আলবানী ৯৮৯নং)
যে ব্যক্তি বিনা ওজরে রমাযানের রোযা ত্যাগ করে সে ব্যক্তির দুটি কারণ হতে পারে; হয় সে তা ফরয বলে অস্বীকার করছে এবং তাকে একটি ইবাদত বলে স্বীকৃতি দিচ্ছে না, (নাঊযু বিল্লাহি মিন যালিক।) আর না হয় সে আলসেমি করে তা রাখছে না।
সুতরাং যদি সে রোযা ফরয বলে অস্বীকার করে ও বলে যে, রোযা শরীয়তে ফরয নয়, তাহলে সে কাফের ও মুরতাদ্দ্; যেমন এ কথা পূর্বে বলা হয়েছে। কারণ, সে দ্বীনের সর্ববাদিসম্মত এমন একটি ব্যাপারকে অস্বীকার করে যা আম-খাস সকলের পক্ষে জানা সহজ এবং যা ইসলামের একটি রুকন।
আর তার এই মুরতাদ্দ্ হওয়ার ফলে একজন মুরতাদ্দের মাল ও পরিবারের ব্যাপারে যা বিধান আছে তা কার্যকর হবে। সরকারের কাছে সে হত্যাযোগ্য অপরাধী বলে গণ্য হবে। তার গোসল-কাফন ও জানাযা হবে না এবং মুসলিমদের গোরস্থানে তাকে দাফন করাও যাবে না। অবশ্য যদি কেউ নওমুসলিম হওয়ার ফলে অথবা ইসলামী পরিবেশ ও উলামা থেকে দূরে থাকার ফলে এ ধরনের কথা বলে থাকে, তাহলে তার কথা ভিন্ন।
পক্ষান্তরে যদি কেউ আলসেমি করে রোযা না রাখে, তাহলে ভয়ানক কঠিন শাস্তি তার জন্য অপেক্ষা করছে।
আবূ উমামাহ বাহেলী (রাঃ) কর্তৃক বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি শুনেছি আল্লাহর রসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লাম) বলেছেন যে, ‘‘একদা আমি ঘুমিয়ে ছিলাম; এমন সময় (স্বপ্নে) আমার নিকট দুই ব্যক্তি উপস্থিত হলেন। তাঁরা আমার উভয় বাহুর ঊর্ধ্বাংশে ধরে আমাকে এক দুর্গম পাহাড়ের নিকট উপস্থিত করলেন এবং বললেন, ‘আপনি এই পাহাড়ে চড়ুন।’ আমি বললাম, ‘এ পাহাড়ে চড়তে আমি অক্ষম।’ তাঁরা বললেন, ‘আমরা আপনার জন্য চড়া সহজ করে দেব।’ সুতরাং আমি চড়ে গেলাম। অবশেষে যখন পাহাড়ের চূড়ায় গিয়ে পৌঁছলাম তখন বেশ কিছু চিৎকার-ধ্বনি শুনতে পেলাম। আমি জিজ্ঞাসা করলাম ‘এ চিৎকার-ধ্বনি কাদের?’ তাঁরা বললেন, ‘এ হল জাহান্নামবাসীদের চীৎকার-ধ্বনি।’ পুনরায় তাঁরা আমাকে নিয়ে চলতে লাগলেন। হঠাৎ দেখলাম একদল লোক তাদের পায়ের গোড়ালির উপর মোটা শিরায় (বাঁধা অবস্থায়) লটকানো আছে, তাদের কশগুলো কেটে ও ছিঁড়ে আছে এবং কশ বেয়ে রক্তও ঝরছে। নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লাম) বলেন, আমি বললাম, ‘ওরা কারা?’ তাঁরা বললেন, ‘ওরা হল তারা; যারা সময় হওয়ার পূর্বে-পূর্বেই ইফতার করে নিত---।’’[1]
‘ওরা হল তারা; যারা সময় হওয়ার পূর্বে-পূর্বেই ইফতার করে নিত---।’ রোযা রাখার পরেও তাদের যদি ঐ অবস্থা হয়, তাহলে যারা পূর্ণ দিন মূলেই রোযা রাখে না, তাদের অবস্থা এবং যারা পূর্ণ মাসই রোযা রাখে না, তাদের অবস্থা যে কত করুণ, কত সঙ্গিন তা অনুমেয়!
মুস্তাফা মুহাম্মাদ আম্মারাহ তাঁর তারগীবের টীকায়[2] বলেন, ‘উক্ত হাদীসের ভাবার্থ এই যে, মহান আল্লাহ তাঁর নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লাম)-কে রোযা ভঙ্গকারীদের আযাব সম্বন্ধে ওয়াকেফহাল করেছেন। তিনি দেখেছেন, তাদের সেই দুরবস্থা; তাদের আকার-আকৃতি ছিল বড় মর্মান্তিক ও নিকৃষ্ট। কঠিন যন্ত্রণায় তারা কুকুর ও নেকড়ের মত চিৎকার করছে। তারা সাহায্য প্রার্থনা করছে অথচ কোন সাহায্যকারী নেই। তাদের পায়ের শেষ প্রান্তে (গোড়ালির উপর মোটা শিরায়) জাহান্নামের আঁকুশি দিয়ে কসাইখানার যবাই করা ছাগলের মত তাদেরকে নিম্নমুখে ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে। আর তাদের কশ বেয়ে মুখভর্তি রক্ত ঝরছে! আশা করি নাফরমান বেরোযাদার মুসলিম সম্প্রদায় এই আযাবের কথা জেনে আল্লাহর নিকট তওবা করবে এবং তাঁর সেই আযাবকে ভয় করে যথানিয়মে রোযা পালন করবে।’
ইমাম যাহাবী (রঃ) বলেন, ‘মুমিনদের নিকটে এ কথা স্থির-সিদ্ধান্ত যে, যে ব্যক্তি কোন রোগ ও ওজর না থাকা সত্ত্বেও রমাযানের রোযা ত্যাগ করে, সে ব্যক্তি একজন ব্যভিচারী ও মদ্যপায়ী থেকেও নিকৃষ্ট। বরং মুসলিমরা তার ইসলামে সন্দেহ পোষণ করে এবং ধারণা করে যে, সে একজন নাস্তিক ও নৈতিক শৈথিল্যপূর্ণ মানুষ।[3]
[2] (২/১০৯)
[3] (মাজমূ’ ফাতাওয়া, ইবনে তাইমিয়্যাহ ২৫/২২৫, আল-কাবায়ের, যাহাবী ৪৯পৃঃ, ফিকহুস সুন্নাহ ১/৩৮৪, ফাইযুর রাহীমির রাহমান, ফী আহকামি অমাওয়াইযি রামাযান, আব্দুল্লাহ ত্বাইয়ার ২০-২১পৃঃ, তাওজীহাতুন অফাওয়াএদ লিসসা-য়েমীনা অসসায়েমাত ৭৪পৃঃ)