সফরে মুসাফিরের ৩ অবস্থা হতে পারেঃ- ([1])
১। রোযা তার জন্য কষ্টকর নয়। এমন অবস্থায় রোযা রাখা বা কাযা করার মধ্যে যেটা তার জন্য সহজ ও সুবিধা হবে, সেটাই সে করবে। মহান আল্লাহ বলেন,
(يُرِيْدُ اللهُ بِكُمُ اليُسْرَ وَلاَ يُرِيْدُ بِكُمُ الْعُسْرَ)
অর্থাৎ, আল্লাহ তোমাদের জন্য সহজ চান এবং তিনি তোমাদের জন্য কঠিন কিছু চান না। (কুরআনুল কারীম ২/১৮৫)
হামযাহ বিন আম্র আসলামী মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লাম)-কে সফরে রোযা রাখা প্রসঙ্গে জিজ্ঞাসা করলে উত্তরে তিনি বললেন, ‘‘তোমার ইচ্ছা হলে তুমি রোযা রাখ, আর ইচ্ছা না হলে রেখো না।’’[2]
আবূ সাঈদ খুদরী (রাঃ) বলেন, ‘আমরা আল্লাহর রসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লাম)-এর সাথে ১৭ই রমাযান এক যুদ্ধ-সফরে ছিলাম। আমাদের মধ্যে কারো রোযা ছিল, কারো ছিল না। কিন্তু যার রোযা ছিল সে তার নিন্দা করেনি যার রোযা ছিল না এবং যার রোযা ছিল না সেও তার নিন্দা করেনি যার রোযা ছিল।’ আর এক বর্ণনায় আছে, তাঁরা মনে করতেন যে, যার ক্ষমতা আছে, তার জন্য রোযা রাখা ভাল। আর যার দুর্বলতা আছে তার জন্য রোযা না রাখা ভাল।[3]
কিন্তু যদি উভয় এখতিয়ার সমান হয়; অর্থাৎ, রোযা রাখার উপর কাযা করাকে প্রাধান্য দেওয়ার মত কোন বৈশিষ্ট্য না থাকে এবং রোযা কাযা করার উপর রাখাকে প্রাধান্য দেওয়ার মত কোন বৈশিষ্ট্য না থাকে, তাহলে এমতাবস্থায় নিম্নে উল্লেখিত দলীলের ভিত্তিতে তার জন্য রোযা রাখাই উত্তমঃ-
(ক) এটি হল আল্লাহর রসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লাম)-এর আমল। আবূ দারদা (রাঃ) বলেন, ‘আমরা এক রমাযান মাসের কঠিন গরমের দিন (সফরে) ছিলাম। এমনকি আমাদের কেউ কেউ গরমের কারণে মাথায় হাত রেখেছিল। আর আমাদের মধ্যে আল্লাহর রসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লাম) এবং আব্দুল্লাহ বিন রাওয়াহাহ ছাড়া অন্য কারো রোযা ছিল না।’[4]
(খ) রোযা রাখাতে সত্বর দায়িত্ব পালন হয়। কারণ, পরে কাযা করাতে বিলম্ব হয়। আর রমাযানে রোযা রেখে নিলে আগে আগে ফরয আদায় হয়ে যায়।
(গ) মুসলিমের জন্য রমাযানে রোযা রাখাটাই সাধারণতঃ বেশী সহজ। কেননা, পরে একাকী নতুন করে রোযা রাখার চাইতে লোকেদের সাথে রোযা ও ঈদ করে নেওয়াটাই বেশী সহজ। যেমন এ কথা সকলের নিকট পরীক্ষিত ও বিদিত।
(ঘ) রোযা রাখলে মাহাত্ম্যপূর্ণ সময় পাওয়া যায়; আর তা হল রমাযান। পরন্তু রমাযান হল অন্যান্য মাসের তুলনায় শ্রেষ্ঠতর। যেহেতু সেটাই হল রোযা ওয়াজেব হওয়ার সময়।[5]
২। রোযা তার জন্য কষ্টকর, তবে বেশী নয়। বরং রোযা না রাখাটাই তার জন্য সুবিধা ও আরামদায়ক। এমন অবস্থায় মুসাফিরের রোযা রাখা মকরূহ এবং রোযা না রাখা উত্তম। কারণ, অনুমতি থাকা সত্ত্বেও কষ্ট স্বীকার করার অর্থ হল, মহান আল্লাহর অনুমতিকে উপেক্ষা করা।
আবার সফরে কখনো রোযা না রাখাটা উত্তম ও অধিক সওয়াব লাভের কারণ হতে পারে; যদি মুসাফির কোন কর্ম-দায়িত্ব পালন করে তাহলে। আনাস (রাঃ) বলেন, আল্লাহর রসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লাম) (সাহাবা সহ) এক সফরে ছিলেন। তাঁদের কিছু লোক রোযা রাখল এবং কিছু রাখল না। যারা রোযা রাখেনি তারা বুদ্ধি করে রোযা ভাঙ্গল এবং কাজ করল। আর যারা রোযা রেখেছিল তারা কিছু কাজ করতে দুর্বল হয়ে পড়ল। তা দেখে তিনি বললেন, ‘‘আজ যারা রোযা রাখেনি তারাই সওয়াব কামিয়ে নিল।’’[6]
৩। অসহ্য গরম, খারাপ বা দূরবর্তী রাস্তা অথবা অবিশ্রাম পথ চলার কারণে রোযা তার জন্য অত্যন্ত কষ্টকর হয়। এ অবস্থায় তার জন্য রোযা রাখা হারাম। কারণ, মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লাম) মক্কা-বিজয় অভিযানে রোযা রেখেছিলেন। কিন্তু তাঁর কাছে খবর এল যে, লোকেরাও রোযা রেখেছে, আর এর ফলে তারা কষ্ট ভুগছে এবং তিনি কি করছেন তা জানার অপেক্ষা করছে। সুতরাং আসরের পর তিনি এক পাত্র পানি আনিয়ে পান করলেন। লোকেরা এ দৃশ্য তাকিয়ে দেখতে লাগল। তাঁকে বলা হল, কিছু লোক রোযা অবস্থায় আছে। তিনি বললেন, ‘‘তারা নাফরমান, তারা অবাধ্য।’’[7]
জাবের (রাঃ) বলেন, একদা আল্লাহর রসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লাম) এক সফরে ছিলেন। তিনি দেখলেন লোকেরা একটি লোককে ঘিরে জমা হয়েছে এবং লোকটির উপর ছায়া করা হয়েছে। তিনি বললেন, ‘‘কি হয়েছে ওর?’’ লোকেরা বলল, ‘লোকটি রোযা রেখেছে।’ তিনি বললেন, ‘‘সফরে তোমাদের রোযা রাখা ভাল কাজ নয়।’’[8]
কখনো কোন ইমারজেন্সী কারণে রোযা ভাঙ্গা ওয়াজেবও হতে পারে। যেমন আবূ সাঈদ খুদরী (রাঃ) বলেন, আমরা রোযা রাখা অবস্থায় আল্লাহর রসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লাম)-এর সাথে মক্কা সফর করলাম। এক মঞ্জিলে নেমে তিনি বললেন, ‘‘তোমরা এখন শত্রুর সম্মুখীন হয়েছ, আর রোযা না রাখাতে তোমাদের শক্তি বেশী হবে।’’ এ কথার ফলে রোযা না রাখাতে অনুমতি হল। তখন আমাদের মধ্যে কেউ রোযা বাকী রাখল, কেউ ভেঙ্গে ফেলল। অতঃপর আমরা আর এক মঞ্জিলে অবতরণ করলাম। সেখানে তিনি বললেন, ‘‘সকালে তোমাদের শত্রুদের সাথে সাক্ষাৎ হবে। আর রোযা না রাখাতে তোমাদের ক্ষমতা বেশী থাকবে। অতএব তোমরা রোযা ভেঙ্গে দাও।’’ এক্ষণে তা বাধ্যতামূলক ছিল। ফলে আমরা সকলে রোযা ভেঙ্গে দিলাম।
আবূ সাঈদ (রাঃ) আরো বলেন, কিন্তু এর পরে আমরা আল্লাহর রসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লাম)-এর সাথে সফরে রোযা রাখতাম।[9]
- মাসআলাঃ
রোযা রেখে স্বামী-স্ত্রী এক সাথে সফর করে সফরে দিনের বেলায় সঙ্গমে লিপ্ত হয়ে পড়লে কোন ক্ষতি নেই। কারণ, মুসাফিরের জন্য রোযা ভাঙ্গা বৈধ। অতএব সে কিছু খেয়ে, অথবা পান করে অথবা সঙ্গম করে রোযা ভাঙ্গতে পারে। এ সব কিছুই তার জন্য হালাল। বলা বাহুল্য, ঐ রোযা কাযা করা ছাড়া তার জন্য অন্য কিছু ওয়াজেব নয়।[10]
- মাসআলাঃ
দিন থাকতে মুসাফির ঘরে ফিরে এলে এবং অনুরূপ সেই সকল ওযর-ওয়ালা মানুষ যাদের যে ওযরের কারণে রোযা ভাঙ্গা বৈধ ছিল তাদের সেই ওযর দূর হলে দিনের বাকী অংশটা পানাহার ইত্যাদি থেকে বিরত থাকবে কি না - এ বিষয়ে উলামাদের মাঝে মতভেদ রয়েছে।
কিছু উলামা মনে করেন, ওয়াজেব হওয়ার কারণ নতুনভাবে দেখা দিলে রোযা ভঙ্গকারী জিনিস থেকে বিরত থাকা ওয়াজেব। আর সেই দিনের রোযা কাযা করা ওয়াজেব নয়। যেমন রোযার দিনে কোন কাফের মুসলিম হলে, নাবালক সাবালক হলে অথবা পাগল সুস্থ হলে, সে বাকী দিন পানাহার ইত্যাদি থেকে বিরত থাকবে এবং তাকে ঐ দিনটি কাযা করতে হবে না।
পক্ষান্তরে যে ব্যক্তি কোন প্রতিবন্ধকতার ফলে রোযা রাখেনি তার সে প্রতিবন্ধকতা দিনের মধ্যে দূর হলে তাকে বাকী দিন পানাহার ইত্যাদি থেকে বিরত থাকা ওয়াজেব নয়; অবশ্য ঐ দিনের রোযা কাযা ওয়াজেব। যেমন দিন থাকতে নিফাস বা ঋতুমতী মহিলা পবিত্রা হলে, মুসাফির রোযা না রেখে ঘরে ফিরলে, রোগী সুস্থ হলে এবং নিরপরাধ প্রাণ উদ্ধারের উদ্দেশ্যে যে রোযা ভেঙ্গেছিল তার সে কাজ শেষ হলে বাকী দিন পানাহার ইত্যাদি থেকে বিরত থাকা ওয়াজেব নয়। কিন্তু ঐ দিনের কাযা অবশ্যই ওয়াজেব।[11]
আব্দুল্লাহ বিন মাসঊদ (রাঃ) বলেন, ‘যে ব্যক্তি দিনের প্রথম ভাগে রোযা রাখেনি, তার উচিৎ দিনের শেষভাগে রোযা না রাখা। (পানাহার ইত্যাদি থেকে বিরত না হওয়া।)’[12]
অন্য দিকে অপর কিছু উলামা মনে করেন, উপর্যুক্ত সকল প্রকার লোকের জন্য বাকী দিন পানাহার ইত্যাদি থেকে বিরত থাকা ওয়াজেব।[13] অবশ্য উত্তম ও পূর্বসতর্কতামূলক কাজ এই যে, ঐ শ্রেণীর সকল লোকই রমাযান মাসের মর্যাদার কথা খেয়াল রেখে এবং উক্ত মতভেদ থেকে দূরে থেকে বাকী দিনটি পানাহার ইত্যাদি থেকে বিরত থাকবে।[14]
[2] (বুখারী ১৯৪৩, মুসলিম ১১২১নং)
[3] (মুসলিম ১১১৬নং)
[4] (বুখারী ১৯৪৫, মুসলিম ১১২২নং)
[5] (আশ্শারহুল মুমতে’ ৬/৩৫৬)
[6] (বুখারী ২৮৯০, মুসলিম ১১১৯নং, আর হাদীসের শব্দাবলী তাঁরই, নাসাঈ)
[7] (মুসলিম ১১১৪নং)
[8] (বুখারী ১৯৪৬, মুসলিম ১১১৫নং এবং শব্দাবলী তাঁরই)
[9] (মুসলিম ১১২০নং)
[10] (আশ্শারহুল মুমতে’ ৬/৩৫৯, ইবনে জিবরীন ফাসিঃ জিরাইসী ১২পৃঃ)
[11] (আশ্শারহুল মুমতে’ ৪/৫৪০-৫৪১, ৬/৩৪৭, ৩৬৩, ৪২০)
[12] (ইবনে আবী শাইবাহ, মুসান্নাফ ৯৩৪৩নং)
[13] (ইবনে জিবরীন ফাসিঃ মুসনিদ ৭৪পৃঃ)
[14] (আহকামুস সাওমি অল-ই’তিকাফ, আবূ সারী মঃ আব্দুল হাদী ৬৪পৃঃ, সাবঊনা মাসআলাহ ফিস্-সিয়াম ২৩নং)