এই অধ্যায়ে আমরা শরীয়তের সকল আইন-কানুনের বিবরণ দিবোনা; বরং নাবী (ﷺ) এর কতিপয় নির্দিষ্ট বিচার-ফয়সালার কথা তুলে ধরব। যদিও নাবী (ﷺ) এর খাস (নির্দিষ্ট) ফয়সালাগুলোও আম (সাধারণ) ফয়সালার পর্যায়েই গণ্য করা হয়। তাই আমরা এখানে কেবল সে সব হুকুম-আহকামের কথাই বলব, যার মাধ্যমে নাবী (ﷺ) বিবাদমান লোকদের মধ্যে ফয়সালা করেছেন। সেগুলোর সাথে আমরা কিছু কিছু মৌলিক হুকুম-আহকামের কথাও উল্লেখ করব।
নাবী (ﷺ) হতে প্রমাণিত আছে যে, তিনি অভিযুক্তকে বন্ধী করে রেখেছেন। আমর বিন শুআইব তার পিতার সূত্রে দাদার বরাত দিয়ে বর্ণনা করেন যে, এক ব্যক্তি জেনে-বুঝে এবং ইচ্ছাকৃত তার ক্রীতদাসকে হত্যা করে ফেলল। নাবী (ﷺ) তখন খুনীকে একশ দুর্রা লাগিয়েছেন এবং এক বছর দেশান্তর করেছেন। সেই সাথে একটি গোলাম (ক্রীতদাস) মুক্ত করার হুকুম দিয়েছেন। কিন্তু গোলাম হত্যার বিনিময়ে তাকে কিসাস স্বরূপ হত্যা করেন নি।
ইমাম আহমাদ বিন হাম্বাল (রহঃ) আনাস (রাঃ) এর সূত্রে সামুরা (রাঃ) হতে মারফু সূত্রে বর্ণনা করেন, যে ব্যক্তি তার দাসকে হত্যা করবে, আমরা তাকেও হত্যা করব। এই বর্ণনাটি যদি সহীহ সূত্রে বর্ণিত হয়ে থাকে তাহলে আমরা বলব যে, বিশেষ প্রয়োজনে এবং তা’যীর (শাস্তি) হিসাবে এই বিধান প্রয়োগ হবে।
তিনি এক ব্যক্তিকে হুকুম দিয়েছিলেন যে, সে যেন তার কর্জদারকে আটকিয়ে রাখে। ইমাম আবু দাউদ (রহঃ) এই হাদীসটি বর্ণনা করেছেন।
আবু উবাইদ বর্ণনা করেন, নাবী (ﷺ) অন্যায়ভাবে (অস্ত্র দিয়ে) হত্যাকারীকে হত্যা করার এবং (বেঁধে রেখে) হত্যাকারীকে মৃত্যু পর্যন্ত বেঁধে রাখার আদেশ দিয়েছেন।
মুহাদ্দিছ আব্দুর রাজ্জাক স্বীয় মুসান্নাফে আলী (রাঃ) হতে বর্ণনা করে বলেন- অন্যায়ভাবে বেঁধে রেখে হত্যাকারীকে মৃত্যু পর্যন্ত বেঁধে রাখা হবে। নাবী (ﷺ) উরায়না গোত্রের লোকদের হাত-পা কেটে ফেলা এবং তাদের চোখে লোহার কাঠি গরম করে ঢুকিয়ে চোখ উপড়ে ফেলার ফয়সালা করেছিলেন। কেননা তারাও এভাবে রাখালকে হত্যা করেছিল। অতঃপর তাদেরকে মৃত্যু পর্যন্ত এভাবে ফেলে রাখলেন। তারা ক্ষুধায় ও পিপাসায় কাতর হয়ে মারা গেল। কারণ তারা রাখালের সাথে এরূপ আচরণই করেছিল।
সহীহ মুসলিমে বর্ণিত হয়েছে, এক লোক অন্য লোকের বিরুদ্ধে অভিযোগ করল যে, সে তার ভাইকে হত্যা করেছে। অপরাধীকে পাকড়াও করা হলে সে অপরাধ স্বীকার করল। নাবী (ﷺ) তাকে নিহত ব্যক্তির ভাইয়ের কাছে হাওলা করে দিলেন। সে হত্যাকারীকে ধরে নিয়ে যাচ্ছিল। নাবী (ﷺ) তখন বললেন- সে যদি এই লোকটিকে (হত্যাকারীকে) হত্যা করে, তাহলে সেও অনুরূপ হবে। এই কথা শুনে সে ফেরত এসে বলল- আমি তো আপনার হুকুমেই তাকে পাকড়াও করেছি। নাবী (ﷺ) তখন বললেন- তুমি কি চাও না যে, সে তার ও তোমার ভাইয়ের গুনাহ্-এর বোঝাসহ আল্লাহর দরবারে হাজির হোক? সে বলল- হ্যাঁ অবশ্যই চাই। অতঃপর সে তাকে ছেড়ে দিল।[1]
নাবী (ﷺ) এর পবিত্র মুখের বাণীঃ সে যদি এই লোকটিকে (হত্যাকারীকে) হত্যা করে, তাহলে সেও হত্যাকারীর অনুরূপ হবে। এই কথার ব্যাখ্যায় আলেমদের দু’টি কথা রয়েছে। (১) হত্যাকারী থেকে যখন কিসাস নেওয়া হবে, তখন হত্যাকারীর সকল গুনাহ্ মা’ফ হয়ে যাবে। তাই হত্যাকারী এবং কিসাস গ্রহণকারী এক রকম হয়ে যাবে। এরূপ নয় যে, কিসাস নেওয়ার পূর্বে হত্যাকারী যেমন গুনাহ্গার ছিল, কিসাস গ্রহণকারীও অনুরূপ গুনাহ্গার হবে। এতে কিসাস নেওয়ার বদলে ক্ষমা করে দেয়ার প্রতি উৎসাহ প্রদান করা হয়েছে। (২) হত্যাকারী যদি তার ভাইকে ইচ্ছাকৃত হত্যা না করে থাকে, তাহলে এই অবস্থায় হত্যাকারীকে কিসাস স্বরূপ হত্যা করা হলে বাড়াবাড়ির ক্ষেত্রে উভয়েই সমান হবে। হত্যাকারী অন্যায়ভাবে হত্যা করে বাড়াবাড়ি করেছে আর প্রতিশোধ গ্রহণকারী এই কারণে বাড়াবাড়ি করার অপরাধে অপরাধী হবে যে, সে একজন অনিচ্ছাকৃত হত্যাকারীকে হত্যা করে ফেলেছে।
এ ব্যাপারে ইমাম আহমাদ বিন হাম্বাল (রহঃ) আবু হুরায়রা (রাঃ) হতে মারফু সূত্রে যে হাদীসটি বর্ণনা করেছেন, তা এই ব্যাখ্যার উপরই প্রমাণ বহন করে। হাদীসটিতে রয়েছে, হে আল্লাহর রসূল! আমি তাকে হত্যার ইচ্ছা করিনি। রসূল (ﷺ) তখন নিহত ব্যক্তির ওয়ারিছকে বললেন- সে যদি সত্যবাদী হয়ে থাকে, তারপরও যদি তুমি তাকে হত্যা কর, তাহলে তুমি জাহান্নামে প্রবেশ করবে। এই কথা শুনে সে তাকে ছেড়ে দিল।
এক ইহুদী একটি বালিকার মাথাকে দু’টি পাথরের মাঝখানে রেখে চাপ দিয়ে হত্যা করেছিল। নাবী (ﷺ) তার ব্যাপারে এই হুকুম দিয়েছিলেন যে, একই পদ্ধতি সেই ইহুদীর মাথা দু’টি পাথরের মাঝখানে রেখে চাপা দিয়ে ভেঙ্গে ফেলা হবে।
এই ঘটনায় দলীল পাওয়া যায় যে, কোন পুরুষ যদি কোন মহিলাকে হত্যা করে, তাহলে সেই হত্যাকারী পুরুষকেও হত্যা করা হবে। আরও জানা গেল যে, অপরাধীর সাথেও সে রূপ আচরণই করা হবে, যে রূপ সে করেছিল।
এতে আরও প্রমাণ রয়েছে যে, বিশ্বাসঘাতকতা করে যেই হত্যাকান্ড ঘটানো হয়, তাতে কিসাস নেওয়ার জন্য নিহত ব্যক্তির ওয়ারিছের অনুমতির প্রয়োজন নেই। কেননা নাবী (ﷺ) এই নিহত বালিকার ওয়ারিছদের কাছে হত্যাকারী ইহুদীকে সোপর্দ করে দেন নি। তিনি এটিও বলেন নি যে, তোমরা ইচ্ছা করলে তাকে হত্যা কর আর ইচ্ছা করলে তাকে ছেড়ে দাও; বরং তাকে সরসূরি হত্যা করার আদেশ দিয়েছেন। এটিই ইমাম মালেক (রহঃ) এর মাজহাব। শাইখুল ইসলাম ইমাম ইবনে তাইমীয়া (রহঃ) এ মতকেই সমর্থন করেছেন। যারা বলে অঙ্গিকার ভঙ্গ করার কারণে নাবী (ﷺ) তাকে এইভাবে হত্যার আদেশ দিয়েছিলেন, তাদের কথা ঠিক নয়। কেননা অঙ্গিকার ভঙ্গকারীর শাস্তি হচ্ছে তলোয়ার দিয়ে তার মাথা উড়িয়ে দেয়া; দুই পাথরের মাঝখানে মাথা রেখে ভেঙ্গে ফেলা নয়।
এক মহিলা অন্য এক মহিলার উপর পাথর নিক্ষেপ করার কারণে মহিলাটি মারা গেল। মৃত মহিলাটির পেটে সন্তান ছিল। সন্তানটিও মারা গেল। এই ক্ষেত্রে নাবী (ﷺ) ফয়সালা করলেন যে, নিহত শিশু সন্তানের বদলে একটি দাস বা দাসী প্রদান করতে হবে এবং নিহত মহিলার দিয়ত পরিশোধ করবে হত্যাকারীনীর আসাবাগণ (রক্ত সম্পর্কীয় আত্মীয়গণ।
সহীহ বুখারীতে বর্ণিত হয়েছে যে, এক মহিলার পেটের বাচ্চা নিহত করার বদলে একটি দাস বা দাসী প্রদান করার ফয়সালা করেছেন। অতঃপর যেই মহিলার বিরুদ্ধে নাবী (ﷺ) ফয়সালা করেছিলেন, সেই মহিলাটি মৃত্যু বরণ করল। এইবার তিনি ফয়সালা দিলেন যে, তার মিরাছ (পরিত্যক্ত সম্পদ) পাবে তার স্বামী ও সন্তানেরা। আর দিয়ত আদায় করবে তার ওয়ারিছগণ।[2]
এই ঘটনা থেকে প্রমাণিত হল যে, কত্লে শিবহে আম্দ অর্থাৎ যেই হত্যা সম্পূর্ণ ইচ্ছাতে হয়নি; বরং যাতে ইচ্ছাকৃত হত্যার সামঞ্জস্য রয়েছে, তাতে কিসাস নেই। আর এ ক্ষেত্রে হত্যাকারীনী মহিলার আসাবাগণ (হত্যাকারীর পুরুষ আত্মীয়গণ) নিহত শিশুর দিয়ত পরিশোধ করবে। তবে মহিলার স্বামী ও সন্তানদের উপর দিয়ত পরিশোধের দায় বর্তাবেনা।
এক ব্যক্তি তার পিতার স্ত্রীকে (সৎ মাকে) বিবাহ করলে তিনি তাকে হত্যা করার এবং তার সমস্ত মাল বাজেয়াপ্ত করার হুকুম দিয়েছিলেন। এটিই ইমাম আহমাদ বিন হাম্বালের মাজহাব এবং এটিই সঠিক। বাকী তিন ইমাম বলেন- যেনার শাস্তিই হচ্ছে তার শাস্তি। ইমাম ইবনুল কাইয়্যিম (রহঃ) বলেন- রসূল (ﷺ)-এর ফয়সালাই অনুসরণের অধিক হকদার এবং অধিক উত্তম।
যে ব্যক্তি বিনা অনুমতিতে কারও ঘরে উঁকি দিয়ে তাকিয়ে দেখবে, তার চোখে পাথর নিক্ষেপ করে কিংবা কাঠি দিয়ে চোখ ফুঁড়ে দেয়, তাহলে তার কোন কিসাস নেই।
নাবী (ﷺ) হতে সহীহ সূত্রে বর্ণিত হয়েছে যে, জনৈক দাসী নাবী (ﷺ) কে গালি দিত। এতে রসূান্বিত হয়ে তাঁর এক আযাদকৃত গোলাম সেই দাসীকে হত্যা করে ফেললে তিনি নিহত দাসীর রক্তকে মূল্যহীন হওয়ার ফয়সালা দিয়েছেন।
একদল ইহুদী যখন নাবী (ﷺ) কে গালি ও কষ্ট দিয়েছিল, তখন তিনি তাদের সকলকে হত্যা করার হুকুম দিয়েছিলেন।
এক লোক আবু বারযা (রাঃ) কে গালি দেয়ার কারণে তিনি যখন গালি দাতাকে হত্যা করতে চাইলেন, তখন আবু বকর (রাঃ) বললেন- রসূল (ﷺ) এর পর আর কারও জন্য গালি দাতাকে হত্যা করা বৈধ নয়। এ বিষয়ে সহীহ, হাসান ও মাশহুর মিলে দশাধিক হাদীস বর্ণিত হয়েছে। মুজাহিদ (রহঃ) আব্দুল্লাহ্ ইবনে আববাস (রাঃ) হতে বর্ণনা করে বলেন- যেই মুসলিম আল্লাহ্ অথবা আল্লাহর কোন নাবী-রসূলকে গালি দিল, সে আল্লাহর রসূলকে অস্বীকার করল। গালি দাতা মুরতাদ হিসাবে গণ্য হবে। তাকে তাওবা করতে বলা হবে। তাওবা করে ফিরে আসলে তো ভাল। অন্যথায় তাকে হত্যা করতে হবে।
সহীহ বুখারী ও সহীহ মুসলিমে বর্ণিত হয়েছে, নাবী (ﷺ) এর জন্য বিষ মিশ্রিত খাদ্য পেশকারী মহিলাকে তিনি ক্ষমা করে দিয়েছেন। যে তাঁকে যাদু করেছিল, তাকেও তিনি হত্যা করেন নি। উমার, হাফসা এবং জুন্দুব (রাঃ) হতে যাদুকরকে হত্যা করার কথা বর্ণিত হয়েছে। নাবী (ﷺ) হতে সহীহ সূত্রে এও বর্ণিত হয়েছে যে, তিনি যুদ্ধবন্দীদের কাউকে হত্যা করেছেন আবার কাউকে ফিদয়া তথা মুক্তিপন গ্রহণ করে ছেড়ে দিয়েছেন। আবার কাউকে মুক্তিপন গ্রহণ না করেই ছেড়ে দিয়েছেন। আবার কখনও কখনও কতককে ক্রীতদাসে পরিণত করেছেন। তবে তিনি কোন প্রাপ্ত বয়স্ক লোককে গোলাম বানিয়েছেন বলে প্রমাণিত হয়নি। এ সমস্ত হুকুম-আহকামের কোনটিই রহিত হয়নি। মুসলমানদের শাসক প্রয়োজন অনুপাতে এগুলো প্রয়োগ করবেন।
ইহুদীদের সাথে নাবী একাধিক ফয়সালা করেছেন। মদ্বীনায় আগমণ করেই তিনি তাদের সাথে চুক্তি করেছেন। এর পর বনু কায়নুকার লোকেরা তাঁর সাথে যুদ্ধ করল। এই যুদ্ধে নাবী (ﷺ) জয়লাভ করলেন এবং তাদেরকে দয়া বশতঃ ক্ষমা করে দিলেন। অতঃপর বনু নযীরের লোকেরা যুদ্ধ করলে তাদেরকে দেশান্তর করলেন। অতঃপর বনী কুরায়যার ইহুদীরা অঙ্গিকার ভঙ্গ ও যুদ্ধ করলে তিনি তাদের সকলকে হত্যা করলেন। পরিশেষে খায়বারের ইহুদীরা রসূল (ﷺ) এর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করলে তিনি তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে জয়লাভ করলেন। তিনি খায়বার বাসীদেরকে সেখানে বসবাস করার অনুমতি দিয়েছেন এবং কতিপয় লোককে হত্যা করার ফয়সালা দিয়েছেন।
[2] . বুখারী, অধ্যায়ঃ কিতাবুত দিয়াত।