ফজরের সালাত আদায় না করা পর্যন্ত মুযদালিফায় থাকতে হবে। ফজরের সালাত শেষে তাসবীহ-তাহলীল ও দোয়ার পালা। আকাশ ফর্সা হয়ে গেলে সূর্য উঠার আগেই মিনায় রওয়ানা দেবেন। প্রচন্ড ভীড়ের কারণে ট্রাফিক জামের দরুন বাসের অপেক্ষা না করে পায়ে হেঁটে রওয়ানা দেয়াই ভাল।
এটা ওয়াজিব। এটা করতেই হবে।
(১) বিলম্ব হলেও মুযদালিফায় পৌঁছে মাগরিব-এশা পড়তে হবে, এর আগে নয়। তবে এ দুই নামাযকে বিলম্ব করতে করতে অর্ধ রাত্রির পরে নিয়ে যাওয়া জায়েয হবে না। তবে ওযর থাকলে জায়েয।
(২) তারতীব ঠিক রেখে সালাত আদায় করবেন। অর্থাৎ প্রথম তিন রাক‘আত মাগরিবের ফরজ এবং এর সাথে সাথে দুই রাক‘আত এশার ফরজ আদায় করবেন, বিতর পড়বেন, ফজরের সুন্নাতও বাদ দেবেন না।
(৩) এ দুই ওয়াক্ত সালাতের জন্য মাত্র একবার আযান দেবেন। কিন্তু ইকামত দুই বারই দিতে হবে।
(৪) কোন নফল-সুন্নাত নামায নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মুযদালিফায় পড়েননি। আপনিও পড়বেন না।
(৫) সালাত আদায় শেষ হওয়া মাত্র ঘুমিয়ে পড়বেন যাতে পরবর্তী দিনের কার্যাবলী সক্রিয়ভাবে সম্পন্ন করা যায়।
(৬) ঐ দিনের ফজর অন্ধকার থাকতেই আউয়াল ওয়াক্তে পড়ে নেবেন। দুই রাকাত ফরজের সাথে দুই রাকাত সুন্নতও পড়বেন। এরপর ‘‘মাশআরুল হারাম’’-এর নিকটবর্তী কিবলামুখী দাঁড়িয়ে হাত উঠিয়ে দোয়া-মুনাজাত করতে থাকবেন। এখানে আসতে না পারলে অসুবিধা নেই। মুযদালিফার যে কোন স্থানে দাঁড়িয়ে দোয়া করতে পারবেন।
‘‘মাশআরুল হারাম’’ একটি পাহাড়ের নাম। এটি মুযদালিফায় অবস্থিত। এখানে একটি মসজিদও আছে। এখানে হাজীদের যা করণীয় তা হলঃ
(১) মাশআরুল হারামের নিকট কিবলামুখী হয়ে দাঁড়ানো,
(২) তাকবীর বলা,
(৩) তাসবীহ-তাহলীল পড়া অর্থাৎ ‘সুবহানাল্লাহ’, ‘আলহাম্দু লিল্লাহ’ এবং ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু’ পড়া।
(৪) যিকর করা এবং
(৫) প্রাণ খুলে আল্লাহ তা‘আলার কাছে দোয়া করা,
(৬) খুশু-খুযু ও বিনম্র হয়ে মাবুদের কাছে আপনার যা চাওয়ার আছে তা চেয়ে নেবেন। বিশেষ করে আপনার মাতা-পিতা, স্ত্রী, পুত্র-সন্তানাদি ও আপনজন-আত্মীয়স্বজনের জন্যও দোয়া করবেন।
(৭) দোয়ার সময় দু’ হাত উঠিয়ে মুনাজাত করা মুস্তাহাব।
এভাবে ফজরের নামাযের পর থেকে আকাশ ফর্সা হওয়া পর্যন্ত দোয়া করতে থাকা মুস্তাহাব। ভীড়ের কারণে ‘‘মাশআরুল হারাম’’-এর কাছে যেতে না পারলে মুযদালিফার যে কোন স্থানে দাঁড়িয়ে এভাবে দোয়া করবেন।
হ্যাঁ, দুর্বল নারী ও শিশু এবং অক্ষম ব্যক্তিদের জন্য অর্ধ রাত্রির পর মুযদালিফা থেকে মিনায় চলে যাওয়া জায়েয হবে। দুর্বল ও অসুস্থদের সাহায্যার্থে তাদের সাথে সুস্থ অভিভাবকরাও যেতে পারবে। এরূপ ওযর ছাড়া মুযদালিফায় ফজর আদায় না করে কারো মিনায় চলে যাওয়া ঠিক হবে না। চলে গেলে দম দিতে হবে।
‘‘মাশআরুল হারাম’’ থেকে মিনায় যাবার সময় কংকর সংগ্রহ করা যায়।
সুন্নাত হলো প্রথম দিনের ৭টি কংকর মাশআরুল হারাম থেকে রওয়ানা দেয়ার পর মুযদালিফা থেকেই কুড়াবেন। এখান থেকে এর বেশী নয়। আর বাকী ৩ দিনের প্রত্যেক দিনের ২১টি করে কংকর মিনা থেকেই কুড়ানো যায়। এটাই সর্বোত্তম পদ্ধতি। তবে হারামের মধ্যবর্তী যে কোন স্থান থেকেই কংকর কুড়ানো জায়েয আছে।
উঃ- চলার সময় বেশী বেশী লাববাইকা অর্থাৎ তালবিয়াহ ও আল্লাহু আকবার পড়তে থাকবেন। ওয়াদি মুহাস্সির (وادي محسر) নামক স্থানে পৌঁছলে সামান্য দ্রুত গতিতে হাঁটা মুস্তাহাব, যদি অন্য মানুষকে কষ্ট দেয়া ছাড়া এটি করা যায়, তবেই তা করবেন। ‘‘ওয়াদী মুহাস্সির’’ নামক জায়গাটি মুযদালিফা ও মিনার মধ্যবর্তী একটি উপত্যকার নাম। উল্লেখ্য যে, বড় জামারায় পৌঁছা মাত্র তালবিয়া পাঠ বন্ধ করে দেবেন।
আরাফার ময়দান থেকে মুযদালিফায় ফিরে আসার মুহুর্তটি বেশ কঠিন। সূর্যাস্তের পর পরই ত্রিশ/চল্লিশ লক্ষ লোক এক সময়ে একযোগে আরাফা থেকে মুযদালিফায় রওয়ানা দেয়। বাসের ব্যবস্থা পর্যাপ্ত থাকলেও রাস্তাতো সীমিত। পাহাড়ী উপত্যকা বেয়ে তিন/চার মিলিয়ন মানুষের লক্ষাধিক বাস গাড়ী একসাথে চললে ট্রাফিকজ্যাম কতটা কঠিন হতে পারে তা সহজেই অনুমেয়। মাঝে মধ্যে গাড়ীগুলো এমনভাবে থেমে থাকে মনে হয় যেন আর চলবে না। তাছাড়া বেশির ভাগ ড্রাইভার বিদেশী ও নতুন। রাস্তাঘাট ভাল চেনে না, কথা বলে আরবীতে, আমরা তা বুঝিনা। ‘‘সব রাস্তা বন্ধ, গাড়ী আর চলবে না।’’ -এ কথা বলে কখনো কখনো আবার গাড়ী থেকে হাজী সাহেবদেরকে নামিয়ে দেয়। আরাফা থেকে মুযদালিফার দূরত্ব মাত্র ৬/৭ কিলোমিটার হলেও কিছু গাড়ী ফজরের আগে মুযদালিফায় পৌঁছতেই পারে না। তাছাড়া মুযদালিফা এসে গেছে ধারণা করে কিছু লোক দেখাদেখি মাঝপথে মাগরিব এশা পড়ে ও রাত্রি যাপন করে। অবশেষে ফজর বাদ মুযদালিফার সীমানায় এসে সাইনবোর্ড দেখে তাদের ভুল বুঝতে পেরে আক্ষেপ করে। এভাবে হজ্জের একটি গুরুত্বপূর্ণ ওয়াজিব ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে যায় অনেক হাজীর। অতি বৃদ্ধ, দুর্বল ও রোগী
না হলে এ জন্য সহজ হল আরাফা থেকে পায়ে হেঁটে মুযদালিফায় আসা। সেজন্য মাদুর ও ছোট এক/দুটা হালকা বিছানা পত্র ছাড়া ভারী কোন লাগেজ আরাফায় না নেয়াই ভাল। শুধু হাঁটার জন্য আলাদা পথ রয়েছে, যা সমতল ও পীচ ঢালা। এ পথে কোন যানবাহন ঢুকেনা। তাই হাঁটতে বেশ আরাম। রাস্তায় পর্যাপ্ত বাতি থাকে। মেঘবৃষ্টি সাধারণতঃ হয় না। আবহাওয়া থাকে ভাল। সকলেই একযোগে একমুখী চলা। সবার মুখে একই তালবিয়া ‘‘লাববাইক আল্লাহুম্মা লাববাইক...’’ প্রয়োজনে রাস্তার পাশে কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে আবার হাঁটতে পারেন। দলবদ্ধ হয়ে পথ চললে ভাল হয়। ভীড়ের কারণে এ সময় কিছু লোক হারিয়েও যায়। সে জন্য খুব সতর্ক থাকবেন। সাথে শিশু ও নারী থাকলে আরো সাবধান থাকবেন।’’ নতুবা নারী-শিশুদেরকে বাসেই আনবেন। মুযদালিফার সীমানায় পৌঁছলে সাইনবোর্ড দেখতে পাবেন। যেখানে লেখা আছে-
Muzdalifa Starts Here |
(অর্থাৎ মুযদালিফা এখান থেকে শুরু)
আর এ এলাকা শেষ হলে দেখতে পাবেন সীমানা চিহ্নত
আরেকটি সাইনবোর্ড যেখানে লেখা পাবেন,
Muzdalifa Ends Here |
(অর্থাৎ মুযদালিফা এখানে শেষ)
দিন দিন হাজীদের সংখ্যা বেড়ে যাওয়ায় এখানে শোয়ার যায়গা পর্যাপ্ত পাওয়া যায় না। সমতল বা ঢালু যাই পান একটা সুবিধাজনক স্থান বাছাই করে কয়েকজনে মিলে জামায়াতের সাথে মাগরিব-এশার সালাত আদায় করে নেবেন। সারা রাত প্রতিটি টয়লেটের সামনে ১০/১২ জনের দীর্ঘ লাইন লেগেই থাকে। এজন্য পানি কম খাওয়া ভাল। শোয়ার জন্য এটা কোন আরাম দায়ক স্থান নয়। এটা ইবাদতের স্থান। গুনাহ মাফ করিয়ে নেয়ার স্থান। বালু কণা আর পাথরের টুকরা যাই থাকুক এরই উপর একটি মাদুর বিছিয়ে খোলা আকাশের নীচে শুয়ে পড়বেন। ভুলে যাবেন নিজের অর্থবিত্ত ও পদমর্যাদার গৌরব। ধনী গরীব মিলে মিশে সকলেই একসাথে একাকার হয়ে যাবেন। আপনার নিবেদন শুধু একটাই ‘‘হে আল্লাহ আমাকে তুমি মাফ করে দাও।’’
ভোরে মুযদালিফা থেকে পায়ে হেঁটে মিনায় পৌঁছতে হবে। গাড়ীতে যাওয়ার সুযোগ হয় না বললেই চলে। কারণ মানুষের ঢলের কারণে গাড়ী চলা দুরূহ হয়ে পড়ে। সেদিনের দীর্ঘ হাঁটা, ক্লান্তি ও সঙ্গী সাথী থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে হারিয়ে যাওয়ার সম্ভাব্য সমস্যা, ইত্যকার যাবতীয় কষ্ট বরণ করে নেয়ার জন্য মানসিকভাবে প্রস্ত্তত থাকুন। কত নম্বর খুঁটির নিকটে মিনায় আপনার তাঁবু তা আগে থেকেই জেনে রাখুন। কারণ এখান থেকে হারিয়ে গেলে জনরাশির মহাস্রোতে আপনাকে খুঁজে বের করা খুব কঠিন। মিনায় তাঁবুতে পৌঁছে নাস্তা খেয়ে একটু বিশ্রাম করে কয়েকজনকে সাথে নিয়ে পরে কংকর নিক্ষেপ করতে যেতে পারেন। এর পূর্বে কংকর নিক্ষেপের মাসআলাগুলো আবার একটু পড়ে নিন।