‘রিবা’র আভিধানিক অর্থ : বৃদ্ধি করা। যেমন-আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন-
فَإِذَا أَنْزَلْنَا عَلَيْهَا الْمَاءَ اهْتَزَّتْ وَرَبَتْ
‘অতঃপর যখনই আমি তাতে পানি বর্ষণ করি, তখন তা আন্দোলিত ও স্ফীত (বৃদ্ধি প্রাপ্ত) হয়।’[1] আরও ইরশাদ করেন-
أَنْ تَكُونَ أُمَّةٌ هِيَ أَرْبَىٰ مِنْ أُمَّةٍ
‘একদল অপর দলের চেয়ে বড় হবে।’[2] অর্থাৎ অধিক সংখ্যক। যেমন বলা হয় অমুকে অমুকের চেয়ে বেশি লাভ করেছে।[3]
রিবার আসল অর্থ বৃদ্ধি : তা মূলে নয়তো মূলের বিনিময়ের মাঝে। যেমন এক দিরহামের বিনিময়ে দুই দিরহাম। আবার প্রত্যেক হারাম ও নিষিদ্ধ ব্যবসাকেও রিবা বলা হয়।[4]
রিবার শরয়ি বা পারিভাষিক অর্থ
নির্দিষ্ট কয়েকটি জিনিসে কম-বেশি করা। দুই ধরনের রিবার ক্ষেত্রে এ সংজ্ঞা প্রযোজ্য। যথা- রিবাল-ফযল ও রিবান-নাসিয়া।
[2]. নাহল : ৯২
[3]. মুগনি : ৬/৫১
[4]. শরহুন নাবাবি আলা মুসলিম: ৮/১১, ফাতহুল বারি : ৪/৩১২
ইহুদিরা সেই আদিকাল থেকেই ষড়যন্ত্র ও কূটকৌশল প্রিয় জাতি হিসেবে প্রসিদ্ধ। তারা তাদের কাছে প্রেরিত নবীর বিরুদ্ধে নানা কূটচাল চালত। তাদের সেসব কূটকৌশলের একটি ছিল সুদ খাওয়ার ব্যাপারে কৌশলের আশ্রয় নেয়া। অথচ তাদের নবী এ থেকে তাদের বারণ করেছেন। হারাম ঘোষণা করেছেন সুদ খাওয়া। আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন-
فَبِظُلْمٍ مِنَ الَّذِينَ هَادُوا حَرَّمْنَا عَلَيْهِمْ طَيِّبَاتٍ أُحِلَّتْ لَهُمْ وَبِصَدِّهِمْ عَنْ سَبِيلِ اللَّهِ كَثِيرًا وَأَخْذِهِمُ الرِّبَا وَقَدْ نُهُوا عَنْهُ وَأَكْلِهِمْ أَمْوَالَ النَّاسِ بِالْبَاطِلِ ۚ وَأَعْتَدْنَا لِلْكَافِرِينَ مِنْهُمْ عَذَابًا أَلِيمًا
‘সুতরাং ইয়াহুদীদের যুলুমের কারণে আমি তাদের উপর উত্তম খাবারগুলো হারাম করেছিলাম, যা তাদের জন্য হালাল করা হয়েছিল এবং আল্লাহর রাস্তা থেকে অনেককে তাদের বাধা প্রদানের কারণে। আর তাদের সুদ গ্রহণের কারণে, অথচ তা থেকে তাদেরকে নিষেধ করা হয়েছিল।’[1]
হাফেজ ইবনে কাসির রহ. বলেন, ‘আল্লাহ তাআলা তাদেরকে তথা ইহুদিদের সুদ খেতে নিষেধ করেন, তারপরও তারা সুদ খাওয়া থেকে বিরত থাকেনি। এজন্য তারা নানা কৌশল গ্রহণ করল। বিষয়টিকে সন্দেহের বাতাবরণে ঢেকে ফেলল আর মানুষের সম্পদ খেতে লাগল অবৈধ পন্থায়।’[2]
ইহুদিরা সুদ হারাম ঘোষণাকারী বক্তব্যকেই বিকৃত করল। তারা সে বক্তব্যের ব্যাখ্যা দাঁড় করাল এভাবে, ইহুদিদের পরস্পরের মাঝে সুদ খাওয়া নিষেধ, তবে অন্য ধর্মের লোকদের সঙ্গে ইহুদিদের সুদী কারবার করতে কোনো বারণ নেই। রাব নামক এক ইহুদি যাজক বলে, যখন কোনো খৃস্টানের দরকার পড়বে দিরহামের, ইহুদির উচিৎ হবে সর্বদিক থেকে এ সুযোগে তার ওপর প্রভাব বিস্তার করা। তাকে আটকে ফেলা ব্যাপক লাভের বেড়াজালে। যাতে সে সম্পূর্ণভাবে পর্যুদস্ত হয়। এবং তার সম্পদের মালিকানা খর্ব হয় কিংবা তার সম্পদ এবং ঋণ সমান্তরাল হয়ে যায়। এভাবে ইহুদি খৃষ্টান ব্যক্তির ওপর কর্তৃত্ব লাভ করবে অতপর বিচারকের সহযোগিতায় তার সম্পদের অধিকার কেড়ে নিতে সক্ষম হবে।[3]
সুতরাং আল্লাহর বাণীর আলোকে স্পষ্ট হয়ে গেল যে, তিনি তাওরাত গ্রন্থেই ইহুদিদের ওপর সুদ হারাম করেছেন। তারা আল্লাহর নিষেধাজ্ঞা অমান্য করেছে এবং কূটকৌশলের আশ্রয় নিয়ে তাঁর বাণীর বিকৃতি সাধন করেছে। তারা মনগড়া ব্যাখ্যা স্থির করেছে যে, হারাম শুধু ইহুদিদের পরস্পরের মাঝে সুদী লেনদেন করা অন্যথায় অন্য ধর্মের লোকদের সঙ্গে সুদী কারবার করা হারাম নয়। এ জন্যই আল্লাহ তাআলা কুরআন মাজিদে তাদের ভৎর্সনা করেছেন। যেমনটি জানা গেল উপরের আয়াত থেকে।
[2]. তাফসিরে ইবনে কাসির: ১/৫৮৪
[3]. উমর বিন সুলাইমান আল আশকার, সুদ ও মানব সমাজের ওপর তার কুপ্রভাব: ৩১
জাহিলি যুগে সুদের ব্যাপক প্রসার ঘটেছিল। এমনকি তারা তাদের ধারণা মতে এটাকে বিশাল লাভ হিসেবে গণ্য করত। ইমাম তাবারি রহ. তদীয় তাফসির গ্রন্থে ইমাম মুজাহিদ থেকে বর্ণনা করেন, জাহিলি যুগে তারা এমন ছিল যে, কারও ওপর কারও ঋণ থাকলে সে বলত, ‘আমি তোমার পাওনা অর্থ আরও পরে শোধ করব, বিনিময়ে এ পরিমাণ অর্থ পাবে। এতে সে সম্মত হয়ে যেত।[1]
জাহিলি যুগের লোকদের অভ্যাস ছিল, ঋণ পরিশোধের মেয়াদ উত্তীর্ণ হলে ঋণদাতা ঋণগ্রহীতাকে জিজ্ঞেস করত, তুমি কি এখন ঋণ পরিশোধ করবে নাকি বেশি দেয়ার শর্তে আরও সময় নেবে ? ঋণ পরিশোধ না করলে তার ওপর বৃদ্ধির হার ধার্য করে দিত। আর ঠিক করে দিত নতুন মেয়াদ।
জাহিলি যুগে চক্রবৃদ্ধি সুদ যেমন ছিল নগদ অর্থে, গবাদি পশুর ওপরও তেমনি প্রচলিত ছিল বাৎসরিক সুদ। যদি কারও কাছে কারও ঋণের অতিরিক্ত পাওনা থাকত সে মেয়াদ পূর্ণ হওয়া মাত্র তার কাছে এসে বলত, ‘তুমি কি ঋণ শোধ করে দিবে নাকি অতিরিক্তসহ পরে দেবে ? যদি সে দিতে পারত দিয়ে দিত; নয়তো সে তার কাছে সেই উট দিত যা তার পাওনা উটের চেয়ে এক বছরের বড়। যদি তার পাওনা হত বিনতে মাখায বা এক বছরের উট সে দিত বিনতে লাবুন বা দুই বছরের উট। অতপর তার কাছে দ্বিতীয় বছর পাওনা চাইতে আসলে না দিতে পেরে হিক্কা দিত তৃতীয় বছরে। এ মেয়াদ শেষ হলে সে এলে তাকে জিযআ বা চার বছরের উট দিত। এভাবে ওপরে উঠতে উঠতে ঋণদাতা বিপুল সম্পত্তির মালিক হয়ে যেত। অষ্টম বছরে তার কাছে এলে যখন সে তাও পরিশোধ না করতে পারত পরের বছর তাকে দ্বিগুণ দিত। সে বছর না দিতে পারলে তারও দ্বিগুণ দিত। যখন একশতটি হত তখন দুইশতটি দিতে হত। এ বছর দিতে না পারলে পরের বছর তাকে চারশ’টি দিতে হত। আল্লাহ তাআলা এদের কথাই বলেছেন কুরআনে কারিমে- ‘হে মুমিনগণ, তোমরা সুদ খাবে না বহুগুণ বৃদ্ধি করে। আর তোমরা আল্লাহকে ভয় কর, যাতে তোমরা সফল হও।’[2]
সুতরাং জানা গেল জাহিলি যুগে সুদকে ওই সব লাভের মধ্যে গণ্য করা হত সম্পদের মালিক যা ভোগ করে। এ ব্যাপারে সে অন্য ভাইয়ের প্রতি লক্ষ্য করে না যে, সে লাভবান হল নাকি ক্ষতিগ্রস্ত ? সে গরিব হয়ে গেল নাকি ধনী ? দৃষ্টি শুধু এক দিকেই থাকে- বিপুল সম্পদের মালিক হওয়া। এতে অন্য কেউ ধ্বংসের মুখে পড়লেও তা দেখার বিষয় নয়। তারা এমন করত তাদের অমানবিক আচরণ এবং নষ্ট চরিত্র বলেই। তাদেরকে যে চরিত্র দিয়ে পাঠানো হয়েছে তা বিকৃত হওয়ার ফলেই। এ জন্যই তাদের সমাজে কুকর্ম ও বিশৃঙ্খলা ছড়িয়ে পড়েছিল। ছিল না সেখানে অন্যের সম্মান। ছোটরা বড়দের সম্মান দিত না। বড়রাও ছোটদের স্নেহ করত না। ধনীরাও দেখাত না গরিবদের প্রতি কোনো মমতা। সমাজের সবাই ছিল অনাচার ও হট্টগোলে দিশেহারা। আর সবচে’ আফসোসের বিষয় হলো, এ সুদ শুধু জাহিলি যুগেই সীমাবদ্ধ থাকে নি বরং ইসলামি সমাজ বলে দাবিদার পরিমন্ডলেও তা ঢুকে পড়েছে অনায়াসে- যারা দাবি করে যে তারা আল্লাহর জমিনে আল্লাহর আইন প্রতিষ্ঠা করেছে ! এ জন্য প্রতিটি মুসলমানের কর্তব্য আল্লাহর নির্দেশ পালন করা এবং সত্যিকারার্থেই তাঁর আইন প্রতিষ্ঠায় সক্রিয় হওয়া। তবে যারা মুসলমান হিসেবে দাবি করার পরও সুদী কারবার করেন তাদেরকে বিনীত উপদেশ দান ও এ বিশাল অপরাধ থেকে সতর্ক করার সঙ্গে সঙ্গে এও বলব যে, চিন্তা করে দেখুন আপনারা কি প্রাক কুরআন নাজিল যুগে ফিরে যাননি ? প্রত্যাবর্তন করেননি কি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর আগমন পূর্ব কালের সেই নির্দয় অসভ্য সমাজে ?
[2]. আলে ইমরান : ১৩০