মক্কার ন্যায় মদিনাও পবিত্র নগরী। মদিনার পবিত্রতা রাসূলুল্লাহ (ﷺ)স্বয়ং ঘোষণা করেছেন। হাদিসে এসেছে, ‘হে আল্লাহ! ইব্রাহীম মক্কাকে পবিত্র হওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন, আর আমি এই দুই পাহাড়ের মাঝখানের জায়গা (মদিনা) পবিত্র বলে ঘোষণা করছি।’ [1] মদিনা ইসলামের আশ্রয়ের স্থল, রাসূলুল্লাহ (ﷺ)ও তাঁর সাহাবাদের হিজরতের জায়গা। রাসূলুল্লাহ ও তাঁর সাহাবায়ে কেরামের ত্যাগ ও কোরবানির ইতিহাস মিশে আছে মদিনার ধুলো-কণায়। পবিত্র কুরআনের অর্ধেক নাযিল হয়েছে মদিনায়। অধিকাংশ হাদিসের উৎসও মাদানি জীবনের নানা ঘটনা-অনুঘটনা। সে হিসেবে যিয়ারতে মদিনা ইতিহাসের দিকে ফিরে তাকাতে আমাদেরকে সাহায্য করতে পারে। মজবুত করতে পারে আমাদের বিশ্বাসের ভিত। আর হজ্জের সফর যেহেতু মদিনায় যাওয়ার একটা বিরাট সুযোগ এনে দেয়- বিশেষ করে যারা বহির্বিশ্ব থেকে আসে তাদের জন্য- তাই এ সুযোগের সদ্ব্যবহার করাটাই বাঞ্ছনীয়। তবে যিয়ারতে মদিনা যাতে সুন্নত তরিকায় হয় এবং কোনো ক্ষেত্রেই রাসূলুল্লাহ (ﷺ)এর অনুমোদন ও ইজাযতের বাইরে না যায় সে বিষয়টি ভালোভাবে নজরে রাখতে হবে। এ ক্ষেত্রে প্রথম প্রশ্নটি আসবে মদিনা গমনের উদ্দেশ্য নিয়ে।
কবর যিয়ারতের উদ্দেশ্যে কোথাও সফর করা যাবে না, এ মর্মে হাদিসে স্পষ্ট নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। বুখারি ও মুসলিম শরীফে এসেছে,
لا تشدوا الرحال إلا إلى ثلاثة مساجد ، المسجد الحرام ، مسجدي هذا والمسجد الأقصى
-তিনটি মসজিদ ব্যতীত অন্য কোনো স্থানের উদ্দেশ্যে সফর করো না। মসজিদুল হারাম, আমার এই মসজিদ (মসজিদে নববি) ও মসজিদুল আকসা।[2] প্রখ্যাত মুহাদ্দিস শাহ ওয়ালিউল্লাহ দেহলভি (রহ.) উক্ত হাদিসের ব্যাখ্যায় বলেন, জাহেলি যুগের মানুষেরা তাদের নিজস্ব ধারণা মতে বিশেষ-বিশেষ মর্যাদাপূর্ণ স্থানে গিয়ে নানা রকম প্রথা চালু করেছিল। তারা সে সব স্থানের জিয়ারতকে পুণ্যের কাজ মনে করত। মুসলমানরা যাতে উক্ত জাহেলি প্রথার অনুকরণ না করে সেজন্য রাসূলুল্লাহ (ﷺ)কেবল তিনটি মসজিদ ব্যতীত অন্য কোনো স্থানের উদ্দেশ্যে সফর করা নিষেধ করে দিয়েছেন।[3] শুধু তাই নয় বরং কবর কেন্দ্রিক সকল উরস-উৎসব কঠিনভাবে নিষেধ করে দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, ‘এবং আমার কবরকে তোমরা উৎসবে পরিণত করো না।’[4] উৎসবে পরিণত করার অর্থ, কবর-কেন্দ্রিক নানা অনুষ্ঠানের আয়োজন করা যার মধ্যে কবরকে উদ্দেশ্য করে সফর করাও শামিল।
‘তিন মসজিদ ব্যতীত অন্য কোনো জায়গার উদ্দেশ্যে সফর করো না’ এ হাদিসের ওপর ভিত্তি করে অধিকাংশ মুহাক্কিক ওলামাগণ রাসূলুল্লাহ (ﷺ)এর কবর যিয়ারতের উদ্দেশ্যে মদিনায় সফর করাকে অবৈধ বলেছেন। তাঁদের মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য শাহ ওয়ালিউল্লাহ মুহাদ্দিসে দেহলভি, আনোয়ার শাহ কাশ্মীরি, ইমাম ইবনে তাইমিয়াহ, আবু মুহাম্মদ আল জনী, কাজী আয়াজ কাজী হুসাইন প্রমুখ। ফতোয়ায়ে রশীদিয়াতেও একই অভিমত ব্যক্ত হয়েছে।[5] সে হিসেবে মদিনা গমনের উদ্দেশ্য, কবর যিয়ারত হলে, তা শুদ্ধ হবে না। নিয়ত করতে হবে মসজিদে নববি যিয়ারতের। কেননা রাসূলুল্লাহ (ﷺ)মসজিদে নববিতে সালাত আদায় বিষয়ে উৎসাহিত করেছেন। এক হাদিসে এসেছে, ‘আমার এই মসজিদে সালাত অন্য মসজিদে এক হাজার সালাত থেকেও উত্তম। তবে মসজিদুল হারাম ব্যতীত।[6] অন্য এক হাদিসে এসেছে, ‘আমার এই মসজিদে সালাত অন্য মসজিদে এক হাজার সালাত থেকে উত্তম। তবে মসজিদুল হারাম ব্যতীত। আর মসজিদুল হারামে সালাত অন্য মসজিদে এক লক্ষ সালাতের চেয়েও উত্তম।[7] শুধু এতটুকই নয় বরং মসজিদে নববির একটি অংশ জান্নাতের বাগানসমূহের একটি বাগান বলে ব্যক্ত করেছেন। বুখারি শরীফে এসেছে, ‘আমার ঘর ও মেম্বারের মাঝখানের জায়গা জান্নাতের বাগানসমূহের একটি বাগান।[8] আর আমার মিম্বারটি আমার হাউজের ওপর।’[9] সে হিসেবে মসজিদে নববি যিয়ারতের উদ্দেশ্যে মদিনায় সফর করার নিয়ত করাটাই শরিয়ত-সিদ্ধ।
[2] -হাদিসটি বোখারি ও মুসলিম শরীফে আবু হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণীত ।
[3] - শাহ ওয়ালিউল্লাহ দেহলভি : হুজ্জাতুল্লাহিল বালেগা।
[4] - ولا تجعلوا قبري عيدا (আবু দাউদ : হাদিস নং ১৭৪৬)
[5] - দ্রঃ ফতোয়ায়ে রশিদীয়া : খ: ৩, পৃ: ৩৩
[6] - صلاة في مسجدي هذا خير من ألف صلاة في غيره من المساجد ، إلا المسجد الحرام (মুসলিম: ২৪৭০)
[7] - صلاة في مسجدي هذا أفضل من ألف صلاة فيما سواه إلا المسجد الحرام ، وصلاة في المسجد الحرام أفضل من مأئة ألف صلاة فيما سواه (ইবনে মাজাহ : হাদিস নং ১৩৯৬ )
[8] - বেহেশতের বাগান বলতে কি বুঝায় এর ব্যাখ্যায় কেউ-কেউ বলেছেন যে এখানে আমল করলে বেহেশতের হকদার হওয়া যায়। ইমাম মালেক (রহ.) এর ব্যাখ্যায় বলেছেন যে এ-জায়গাটুকু পরকালে বেহেশতে স্থাপন করা হবে, অথবা এ জায়গাটুকু বর্তমান অবস্থাতেই বেহেশতের একটি বাগান। (ইমাম নববী : কিতাবুল ইযাহ ফি মানাসিকিল হাজ্জি ওয়াল উমরা : পৃ: ৪৫৫)
[9] - ما بين بيتي ومنبري روضة من رياض الجنة ومنبري على حوضي (বোখারি : হাদিস নং ১১২০)
মসজিদে নববি যিয়ারতের নিয়ত করে আপনি মদিনার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হবেন। মদিনায় প্রবেশের সময় মদিনায় ইসলামের যে ইতিহাস বনেছে তা স্মরণ করবেন। মক্কার মতো মদিনাও পবিত্র। তাই মদিনায় গিয়ে যাতে আপনার দ্বারা কোনো বেয়াদবি না হয়, কোনো গুনাহ-পাপে লিপ্ত না হন, সে জন্য আল্লাহর সাহায্য কামনা করুন।
মদিনায় আপনার হোটেল বা বাসায় গিয়ে মালপত্র রেখে সামান্য বিশ্রাম করে নিন। এরপর মসজিদে নববিতে চলে যান। মসজিদে নববিতে যাওয়ার জন্য কোনো এহরাম তালবিয়া নেই। রাসূলুল্লাহ (ﷺ)এর ওপর দরুদ ও সালাত পড়ে-পড়ে যেতে হবে এ ব্যাপারেও কোনো হাদিস নেই। মদিনার গাছপালার ওপর নজর-পড়া-মাত্র অথবা সবুজ গম্বুজের ওপর দৃষ্টি-পড়া-মাত্র সালাত ও সালাম পড়তে হবে এ মর্মেও রাসূলুল্লাহ (ﷺ)ও সাহাবায়ে কেরাম থেকে কোনো আদর্শ নেই। যারা এরূপ করতে বলেছেন তারা একান্তই আবেগতাড়িত হয়ে বলেছেন। উপযুক্ত দলিল ব্যতীত আবেগের যথেচ্ছ প্রয়োগের কারণেই ইসলামি শরিয়ত স্বচ্ছতা হারিয়েছে অনেক ক্ষেত্রেই।
যে কোনো দরজা দিয়ে মসজিদে নববিতে প্রবেশ করতে পারেন। প্রবেশের সময় ডান পা আগে দিন। আল্লাহর নাম স্মরণ করুন। রাসূলুল্লাহ (ﷺ)এর প্রতি দরুদ পাঠ করুন। আল্লাহ যেন আপনার জন্য তাঁর রহমতের সমস্ত দরজা খুলে দেন সে জন্য দোয়া করুন। বলুন -
بِسْمِ اللِه، والصَّلاَةُ وَالسَّلاَمُ عَلَى رَسُوْلِ اللهِ ، اللّهُمَّ اغْفِرْلِي ذُنُوْبِيْ وَافْتَحْ لِيْ أَبْوَابِ رَحْمَتِكَ[1].
মসজিদে প্রবেশের পর, বসার পূর্বে, তাহিয়াতুল মাসজিদের দু’ রাকাত সালাত আদায় করুন। হাদিসে এসেছে,
‘إذا دخل أحدكم المسجد، فلا يجلس حتى يصلى ركعتين
-তোমাদের মধ্যে যখন কেউ মসজিদে প্রবেশ করে সে যেন দু’রাকাত সালাত আদায়ের পূর্বে না বসে’[2]। রাওজাতুল জান্নাতে—মসজিদের মেহরাবের কাছে সাদা ও সবুজ কার্পেট বিছানো জায়গা—আদায় করতে পারলে ভালো। কেননা রওজা শরীফ পবিত্রতম একটি জায়গা, জান্নাতের বাগান হিসেবে হাদিসে যার পরিচয় এসেছে। রওজায় জায়গা না পেলে যে কোনো স্থানে তাহিয়্যাতুল মসজিদ আদায় করুন।[3] এরপর লাইন ধরে রাসূলুল্লাহ (ﷺ)এর পবিত্র কবরের দিকে এগিয়ে যান।
[2] - বোখারি : হাদিস নং (৪৪৪) মুসলিম : হাদিস নং (১৬৫৪), হাদিসটির বর্ণনাকারী হলেন, আবু কাতাদা আস্সুলামি । মুসলিম শরীফের আরো একটি হাদিসে এসেছে, ‘ كان رسول الله صلى الله عليه وسلم لا يقدم من سفر إلا نهارا في الضحى فصلى فيه ركعتين ثم جلس فيه - দিনের বেলা নাস্তার সময় ব্যতীত রাসূলুল্লাহ (সাঃ)কোনো সফর থেকে ফিরতেন না। তিনি ফিরে এলে মসজিদ দিয়ে শুরু করতেন। সেখানে তিনি দু’ রাকাত সালাত আদায় করতেন, অতঃপর বসতেন। (মুসলিম: হাদিস নং ১৬৫৯)
[3] - রাওজাতুল জান্নাতে সালাত আদায় করার জন্য ঝগড়া বা হৈচৈ করা মসজিদে নববীর আদব পরিপমীহ গোনাহের কাজ। ওমর (রাঃ), মসজিদে নববীতে আওয়াজ উঁচু করতে দেখে তায়েফবাসী দুই ব্যক্তিকে বলেন, ‘তোমরা মদিনাবাসী হলে আমি তোমাদেরকে শাস্তি দিতাম। তোমরা রাসূলুল্লাহ (সাঃ)এর মসজিদে উঁচ্চ স্বরে কথা বলছ!) (বোখারি)। পবিত্র কোরআনে, রাসূলুল্লাহ (সাঃ)এর আওয়াজের ওপর মুমিনরা যেন তাঁদের আওয়াজ উঁচু না করে, সেমর্মে স্পষ্ট নির্দেশ এসেছে। (দ্রঃ সুরাতুল হুজরাত:২২) উক্ত নির্দেশের আলোকে ক্কারী আবুবকর ইবনুল আরাবী বলেন যে রাসূলুল্লাহর (সাঃ)আদব প্রদর্শন তাঁর ওফাতের পরও জীবদ্দশার ন্যায় ওয়াজিব। তাই কোনো কোনো আলেম বলেন, যে রাসূলুল্লাহ (সাঃ)এর কবরের সামনে বেশি উচ্চ স্মরে সালাম কালাম করা আদবের খেলাফ। (তাফসিরে মায়ারিফুল কোরআন)
- রাসূলুল্লাহ (ﷺ)এর পবিত্র কবরের সামনে এলে আদবের সাথে দাঁড়ান। দাঁড়ানোর সুযোগ না পেলে চলমান অবস্থাতেই রাসূলুল্লাহ (ﷺ)এর প্রতি সালাম পেশ করুন, বলুন—‘السَّلاَمُ عَلَيْكَ أَيَّهَا النَّبِيُّ وَرَحْمَةُ اللهِ وَبَرَكَاتُهُ—আপনার ওপর শান্তি, আল্লাহর রহমত ও বরকতসমূহ বর্ষিত হোক হে আল্লাহর নবী’, রাসূলুল্লাহর গুণাবলির সাথে সংগতিপূর্ণ আরো কিছু শব্দ বাড়িয়ে দেয়া যাবে। বলা যাবে—
السَّلاَمُ عَلَيْكَ يَا خَلِيْلَ اللهِ ، وَأَمِيْنَـــهُ عَلَى وَحْيِهِ ، وَخَيْرَتَه مِنْ خَلْقِه ، أَشْهَدُ أَنَّكَ قَدْ بَلَّغْتَ الرِّسَالَةَ ، وَأَدَّيْتَ الأَمَانَـــــــةَ ، وَنَصَحْتَ الأُمَّـــــــــــــــةَ ، وَجَاهَدْتَ فِيْ اللهِ حَقَّ جِهَادِه .
-আপনার ওপর শান্তি বর্ষিত হোক হে আল্লাহর বন্ধু! তাঁর ওহির বিশ্বস্ত পাত্র, ও তাঁর সৃষ্টির মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ। আমি সাক্ষী দিচ্ছি, আপনি নিশ্চয়ই রেসালত পোঁছিয়ে দিয়েছেন। আমানত আদায় করেছেন। উম্মতকে নসিহত করেছেন। ও জিহাদ করেছেন আল্লাহর বিষয়ে সত্যিকারের জিহাদ)।
- এরপর সামনের দিকে এক গজ পরিমাণ এগিয়ে যান। এখানে আবুবকর সিদ্দীক (রাঃ) এর প্রতি সালাম পেশ করুন। বলুন—
السَّلاَمُ عَلَيْكَ يَا أَبَا بَكْرٍ ، السَّلَامُ عَلَيْكَ يَا خَلِيْفَةَ رَسُوْلِ اللهِ فِيْ أُمَّتِه ، رَضِيَ اللهُ عَنْكَ وَجَزَاكَ عَنْ أُمَّةِ مُحَمَّدٍ خَيْرًا.
-আপনার ওপর শান্তি বর্ষিত হোক হে আবু বকর, আপনার ওপর শান্তি বর্ষিত হোক হে রাসূলুল্লাহর খলিফা তাঁর উম্মতের ভেতর। আল্লাহ আপনার ওপর রাজি হোন। উম্মতে মুহাম্মদির পক্ষ থেকে আল্লাহ আপনাকে উত্তম প্রতিদানে ভূষিত করুন।
- এরপর আরেক গজ সামনে আগান। এখানে ওমর (রাঃ) এর প্রতি সালাম পেশ করুন। বলুন—
ا لسَّلَامُ عَلَيْكَ يَا عُمَرُ، السَّلَامُ عَلَيْكَ يَا أَمِيْرَ المُؤْمِنِيْنَ، رَضِيَ اللهُ عَنْكَ وَ جَزَاكَ عَنْ أُمَّةِ مُحَمَّدٍ خَيْرًا .
-আপনার ওপর শান্তি বর্ষিত হোক হে ওমর, আপনার ওপর শান্তি বর্ষিত হোক হে আমিরুল মুমিনিন। আল্লাহ আপনার ওপর রাজি হোন। উম্মতে মুহাম্মদির পক্ষ থেকে আপনাকে উত্তম প্রতিদানে ভূষিত করুন।
এরপর বাইরে চলে আসুন। কেবলামুখী হয়ে বা কবরের দিকে মুখ করে দোয়া করবেন না। ইমাম মালেক (রহ.) বলেন, ‘কবরের কাছে দোয়া করতে দাঁড়ানো আমি শুদ্ধ মনে করি না। তবে সালাম দেবে, ও চলে যাবে যেমনটি করতেন ইবনে ওমর (রাঃ)। ইমাম ইবনুল জাওযি বলেন, ‘দোয়া করতে কবরে যাওয়া মাকরুহ। ইমাম ইবনে তাইমিয়াহ একই মন্তব্য ব্যক্ত করে বলেন, ‘দোয়ার উদ্দেশ্যে কবরে যাওয়া মাকরুহ। দোয়ার জন্য কবরের কাছে দাঁড়ানোও মাকরুহ।[1] তাই রাসূলুল্লাহ (ﷺ)ও তাঁর সাথীদ্বয়ের (রাঃ) কবরের কাছে দীর্ঘক্ষণ দাঁড়ানো ও নিজের জন্য দোয়া করা উচিৎ নয়। সাহাবায়ে কেরামের মধ্যে কেউই কবরের কাছে দাঁড়িয়ে নিজের জন্য দোয়া করতেন বলে ইতিহাসে নেই। সাহাবাগণ, বরং, মসজিদে নববির যে কোনো জায়গায় দোয়া করতেন। রাসূলুল্লাহ (ﷺ)এর হুজরা মুবারকের কাছে এসেও তাঁরা দোয়া করতেন না।
ইমাম মালেক (রহ.) মদিনাবাসীদের জন্য, যতবার মসজিদে প্রবেশ করবে ততবার, রাসূলুল্লাহ (ﷺ)এর কবরে আসা ভালো মনে করতেন না। কেননা সালাফে-সালেহীনদের কেউই এরূপ করতেন না। তাঁরা বরং মসজিদে নববিতে আসতেন। আবুবকর, ওমর, উসমান ও আলী (রাদি আল্লাহু আনহুম) এর পেছনে সালাত আদায় করতেন। সালাতের মধ্যেই রাসূলুল্লাহর প্রতি সালাম পেশ করতেন। বলতেন, السَّلاَمُ عَلَيْكَ أَيَّهَا النَّبِيُّ وَرَحْمَةُ اللهِ وَبَرَكَاتُهُ সালাত শেষে হয়তো বসতেন অথবা বের হয়ে চলে যেতেন। সালাম পেশ করার জন্য রাসূলুল্লাহ (ﷺ)এর কবরে আসতেন না। কেননা তাঁরা জানতেন যে সালাতের মধ্যে যে দরুদ ও সালাম পেশ করা হল তা অধিক উত্তম ও পূর্ণাঙ্গ। [2]
সাহাবাগণ যখন নিজের অভাব অনটনের জন্য আল্লাহর কাছে দোয়া করতে চাইতেন, কেবলামুখী হয়ে মসজিদের ভেতর দোয়া করতেন। যেমনটি করতেন রাসূলুল্লাহ (ﷺ)এর জীবিত থাকা কালে। দোয়া করার জন্য হুজরা মুবারকের কাছে যেতেন না, কবরেও প্রবেশ করতেন না। সাহাবাগণ দূরদূরান্ত থেকে খুলাফায়ে রাশেদিনদের সাথে দেখা করতে এলে মসজিদে নববিতে সালাত আদায় করতেন। সালাতের ভেতর রাসূলুল্লাহ (ﷺ)এর প্রতি দরুদ ও সালাম পেশ করতেন। মসজিদে প্রবেশ ও মসজিদ বের হওয়ার সময়ও সালাত ও সালাম পেশ করতেন, বলতেন,
بِسْمِ اللِه، والصَّلاَةُ وَالسَّلاَمُ عَلَى رَسُوْلِ اللهِ .
কবরের কাছে এসে সাধারণত সালাম পেশ করতেন না। কেননা এরূপ করতে রাসূলুল্লাহ (ﷺ)নির্দেশ করেননি। হাঁ, ইবনে উমর (রাঃ) সফর থেকে ফিরে এলে রাসূলুল্লাহ (ﷺ)ও তাঁর সাথি-দ্বয়ের কবরে এসে সালাম পেশ করতেন। তবে অন্যান্য সাহাবা এরূপ করতেন না।
[2] - আল ফাতাওয়া : ২৭/৩৮৬
রাসূলুল্লাহ (ﷺ)এর পবিত্র কবর হুজরা শরীফের অভ্যন্তরে অবস্থিত। তাই কবরের দেয়াল ছুঁয়ে বরকত নেয়ার জজবা অনেকের মধ্যে থাকলেও তা বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয় না। আসলে এ ধরনের জজবা-বাসনা থাকাই উচিৎ না। কেননা কবরের চার পাশে তাওয়াফ, কবর ছুঁয়ে বরকত নেয়া ইত্যাদি শরিয়তে অনুমোদিত নয়। রাসূলুল্লাহ (ﷺ)কঠিনভাবে নিষেধ করেছেন যে তাঁর কবরকে যেন পূজ্য মূর্তিতে রূপান্তরিত করা না হয়।[1] আর স্পর্শ ও চুম্বন করার বিধান তো কেবল হাজরে আসওয়াদের বৈশিষ্ট্য। পবিত্র কাবার রুকনে য়ামেনিও স্পর্শ করার বিধান রয়েছে। এছাড়া অন্য কোনো জায়গা, এমনকী পবিত্র কাবার অন্য কোনো অংশ স্পর্শ করে বরকত নেয়ারও বিধান নেই। মুআবিয়া (রাঃ) একদা হজ্জ করার সময় রুকনে শামি ও রুকনে গারবি অর্থাৎ কাবা শরীফের উত্তর পাশের দুই কোণ স্পর্শ করলেন। ইবনে আব্বাস (রাঃ) বিরোধিতা করলেন। এরূপ করা রাসূলুল্লাহ (ﷺ)এর বিধানে নেই, স্পষ্ট করে তিনি মুআবিয়া (রাঃ) কে বুঝিয়ে দিলেন। মুআবিয়া খলিফা থাকা সত্ত্বেও ইবনে আব্বাস (রাঃ) এর কথা মেনে নিলেন। হাজরে আসওয়াদ ও রুকনে য়ামেনি ব্যতীত যদি পবিত্র কাবার অন্য কোনো অংশ স্পর্শ করা শরিয়ত বহির্ভূত কাজ হয়ে থাকে তবে অন্য কোনো জায়গা ছুঁয়ে বরকত নিতে যাওয়া যে বড়ো বেদআত, এতে কোনো সন্দেহ নেই। তাই কবরে ঘর্ষণ মর্দন, গন্ডদেশ ও বক্ষ লাগিয়ে বরকত নেয়ার ইচ্ছা করা হকপন্থী সকল মুসলমানদের কাছে অবৈধ। বরং এটা একপ্রকার শিরক।[2] পবিত্র কাবার অনুমোদিত অংশ ব্যতীত অন্য কোনো অংশ মাসেহ করা, ছোঁয়া যদি পুণ্যের কাজ না হয়ে থাকে তাহলে হুজরার দরজা জানালা স্পর্শ করে কী কোনো পুণ্যের আশা করা যেতে পারে?। হুজরার দেয়াল ও দরজা-জানালা তো নির্মিত হয়েছে বহু পরে। রাসূলের মহববত কবরের দরজা-জানালা স্পর্শ করে নয় বরং যথার্থভাবে রাসূলের আনুগত্য-ইত্তেবার মাধ্যমেই প্রকাশ করতে হয় রাসূলুল্লাহর মহববত ও তাজিম।
বিপদমুক্তি অথবা কল্যাণ সাধনের উদ্দেশ্যে রাসূলুল্লাহ (ﷺ)এর কাছে প্রার্থনা করা যাবে না। বলা যাবে না যে হে আল্লাহর রাসূল আমাকে অমুক বিপদ থেকে মুক্ত করুন। অথবা আর্থিক স্বচ্ছলতা দান করুন। কেননা এজাতীয় কাজ করা শিরক। এজাতীয় দোয়া কেবল আল্লাহ রাববুল আলামিনকে খেতাব করেই করতে হয়। এরশাদ হয়েছে—
وَقَالَ رَبُّكُمْ ادْعُونِي أَسْتَجِبْ لَكُمْ إِنَّ الَّذِينَ يَسْتَكْبِرُونَ عَنْ عِبَادَتِي سَيَدْخُلُونَ جَهَنَّمَ دَاخِرِينَ
-এবং তোমাদের প্রতিপালক বললেন, আমাকে ডাকো আমি তোমাদের ডাকে সাড়া দেব। নিশ্চয় যারা আমার ইবাদতের প্রতি দম্ভ প্রদর্শন করে তারা প্রবেশ করবে জাহান্নামে, অপদস্ত হয়ে।[3] অন্য এক জায়গায় এরশাদ হয়েছে, ‘قُلْ لَا أَمْلِكُ لِنَفْسِي ضَرًّا وَلَا نَفْعًا إِلَّا مَا شَاءَ اللَّهُ -বলুন আমি আমার নিজের কোনো অকল্যাণের বা কল্যাণের মালিক নই, তবে আল্লাহ যা চান।[4] রাসূলুল্লাহ (ﷺ)যখন নিজের কল্যাণের-অকল্যাণের মালিক নিজে নন, তাহলে তিনি অন্যদের কল্যাণ-অকল্যাণ কীভাবে সাধন করতে পারেন। এ কথাটাই অন্য একটি আয়াতে স্পষ্টভাবে বর্ণিত হয়েছে, আয়াতটি হল— قُلْ إِنِّي لَا أَمْلِكُ لَكُمْ ضَرًّا وَلَا رَشَدًا-বলুন, আমি তোমাদের কোনো ক্ষতি বা কল্যাণের মালিক নই।[5] আয়েশা (রাঃ) থেকে বর্ণিত একটি হাদিসে এসেছে, তিনি বলেন, যখন ‘ وَأَنْذِرْ عَشِيرَتَكَ الْأَقْرَبِينَ -আপনি আপনার সগোত্রীয় নিকট ব্যক্তিদেরকে ভয় দেখান[6], তখন রাসূলুল্লাহ (ﷺ)দাঁড়িয়ে বললেন, ‘হে ফাতেমা বিনতে মুহাম্মদ, হে সাফিইয়া বিনতে আব্দুল মুত্তালিব, হে আব্দুল মুত্তালিবের সন্তানরা, আল্লাহর পক্ষ থেকে আমি তোমাদের জন্য কোনো কিছুরই মালিক নই। আমার সম্পদ থেকে তোমাদের যা ইচ্ছা চাও।
গুনাহ মাফ করানোর জন্য রাসূলুল্লাহ (ﷺ)কে আল্লাহর কাছে দোয়া করতে বলাও ঠিক নয়। কেননা রাসূলুল্লাহ (স) এর ওফাতের পূর্বে এরূপ করা যেতো কিন্তু ওফাতের পর এ ধরনের কোনো অবকাশ নেই। মৃত্যুর পর মানুষের সকল কাজ রহিত হয়ে যাওয়ার ব্যাপারে একটি স্পষ্ট হাদিস রয়েছে।[7] সূরা নিসার ৬৪ নম্বর আয়াত যেখানে আল্লাহ পাক বলেছেন—
وَلَوْ أَنَّهُمْ إِذْ ظَلَمُوا أَنفُسَهُمْ جَاءُوكَ فَاسْتَغْفَرُوا اللَّهَ وَاسْتَغْفَرَ لَهُمْ الرَّسُولُ َوَجَدُوا اللَّهَ تَوَّابًا رَحِيمًا
অর্থ : এবং যদি তারা স্বীয় জীবনের উপর অত্যাচর করার পর তোমার নিকট আগমন করত, তৎপর আল্লাহর নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করত, আর রাসূলও তাদের জন্য আল্লাহর নিকট ক্ষমা চাইত, তবে নিশ্চয় তারা আল্লাহকে তওবা কবুলকারী, করুনাময় প্রাপ্ত হত।[8]
-এ আয়তের সম্পর্ক রাসূলুল্লাহর জীবদ্দশার সাথে। এ আয়াতের মধ্যে রাসূলুল্লাহর মৃত্যুর পরও গুনাহ মাফ করানোর জন্য আল্লাহর কাছে ইস্তিগফার করতে তাঁর কাছে আর্জি পেশ করার কথা উল্লেখ নেই। আরবি ভাষার ব্যবহার রীতি অনুযায়ী এখানে إذا ব্যবহার করলে ভবিষ্যৎ কালেও এ প্রক্রিয়াটি কার্যকর থাকত। কিন্তু এখানে إذا ব্যবহার না করে إذ ব্যবহার করায় প্রক্রিয়াটি অতীতকালের জন্য নির্দিষ্ট হয়ে গিয়েছে। এর অর্থ, অতীতে, রাসূলুল্লাহ (ﷺ)এর জীবদ্দশায়, অন্যায় করে যদি কেউ আল্লাহর কাছে গুনাহ মাফ চায়, এবং রাসূলুল্লাহও তাদের জন্য গুনাহ মাফ চান, তাহলে তারা নিশ্চয়ই আল্লাহকে তাওবা গ্রহণকারী ও দয়াময় পাবে।
নারীর কবর যিয়ারত নিয়ে বিতর্ক আছে। এক হাদিসে কবর যিয়ারতকারী নারীর প্রতি রাসূলুল্লাহ (ﷺ)অভিসম্পাত করেছেন। এই হাদিসের ওপর ভিত্তি করে ইসলামি শরিয়তজ্ঞ ওলামাদের একদল নারীর কবর যিয়ারত, হোক তা রাসূলুল্লাহর কবর, অবৈধ বলেছেন। অপর পক্ষে অন্যদল বলেছেন বৈধ। তাদের মতে কবর যিয়ারত, পূর্বে, নারী-পুরুষ উভয়ের জন্যই অবৈধ ছিল। পরবর্তীতে নিষেধাজ্ঞা উঠিয়ে নিয়ে যিয়ারতের অনুমতি দেন রাসূলুল্লাহ (ﷺ)।[9] এ অনুমতি নারী-পুরুষ উভয়ের জন্যই ছিল বলে দাবি করেন তারা। বিতর্ক থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য উচিৎ হবে নারীদের কবর যিয়ারতে না যাওয়া। বিশেষ করে বর্তমান-যুগের সার্বিক পরিবেশ নারীর পক্ষে সহায়ক নয়। বরং ফিতনা ও অনিরাপত্তার আশঙ্কা দিন দিন আরো প্রকট আকার ধারণ করছে। তাই নারীদেরকে করব যিয়ারত হতে নিরুৎসাহিত করাই হবে উত্তম। আর অনুমতি প্রদানের হাদিসে নারীদেরকে শামিল করা হয়েছে কি-না, তার পক্ষে কোনো স্পষ্ট প্রমাণ নেই। কেননা নারীদের প্রতি নিষেধাজ্ঞা ‘লানত’ শব্দ দিয়ে এসেছিল।
তবে কি নারীরা রাসূলুল্লাহ (ﷺ)এর প্রতি সালাম পেশ করবে না? হাঁ, অবশ্যই করবে। তবে তা কবরে গিয়ে নয়। যে কোনো জায়গা থেকেই করা যায়। হাদিসে এসেছে, ‘তোমাদের ঘর-বাড়ি কবরে পরিণত করো না। আর আমার কবরকে উৎসবে পরিণত করো না। আমার জন্য তোমরা দরুদ পাঠ করো। তোমাদের দরুদ আমার কাছে পৌঁছে, তোমরা যেখানেই থাকো না কেন।[10]
[2] - ইবনে কুদামা : আল মুগনি, ৩/৫৫৯
[3] - সূরা গাফের : ৬০
[4] - সূরাতুল আরাফ : ১৮৮
[5] - সূরা আল জিন্ন : ২১
[6] - শুয়ারা : ২১৪
[7] - إذا مات ابن آدم انقطع عمله (মুসলিম : ৪২২৩ )
[8] নিসা : আয়াত : ৬৪
[9] - كنت نهيتكم عن زيارة القبور ، فزوروها فإنها تزهد في الدنيا و تذكر بالآخرة . (ইবনে মাজাহ : ১৫৬০)
[10] - عن أبي هريرة قال قال رسول الله صلى اللهم عليه وسلم لا تجعلوا بيوتكم قبورا ولا تجعلوا قبري عيدا وصلوا علي فإن صلاتكم تبلغني حيث كنتم (আবু দাউদ : হাদিস নং ১৭৪৬
জান্নাতুল বাকি—আরবিতে বাকিউল গারকাদ—পবিত্র মদিনার একটি কবরস্থান যেখানে, ইমাম মালিক (রহ.) এর কথা মতে, প্রায় দশ হাজার সাহাবা কবরস্থ আছেন। আহলে বাইতের অধিকাংশ সদস্য, আব্বাস ইবনে আব্দুল মুত্তালিব, উসমান ইবনে মাজউন, আকীল ইবনে আবি তালিব ও খাদিজা (রাঃ) ও মায়মুনা (রাঃ) ব্যতীত রাসূলুল্লাহ (ﷺ)এর অন্যান্য স্ত্রীগণ, আব্দুর রহমান, সা’দ ইবনে আবি ওয়াক্কাস প্রমুখ জলিলুল কদর সাহাবা (রাদিয়াল্লাহু আনহুম) বাকিতে কবরস্থ আছেন। সে হিসেবে তাদেরকে সালাম দেয়া ও তাদের জন্য ইস্তিগফার ও দোয়া করার উদ্দেশ্যে জান্নাতুল বাকিতে যাওয়া শরিয়তসম্মত।
বাকি’তে সমাহিত মুমিনগণের প্রতি সালাম দেয়ার সুন্নত তরিকা হলো অনির্দিষ্টভাবে সবাইকে একসাথে সালাম দেয়া ও তাদের জন্য দোয়া করা। রাসূলুল্লাহ (ﷺ)আহলে বাকি’র যিয়ারতকালে বলতেন।
السَّلَامُ عَلَيْكُمْ دَارَ قَوْمٍ مُؤْمِنِيْنَ، وَإِنَّا إِنْ شَاءَ اللهُ بِكُمْ لاَحِقُوْنَ، اللَّهُمَّ اغْفِرْ لِأَهْلِ بَقِيْعِ الغَرْقَدِ.
-‘আপনাদের ওপর শান্তি বর্ষিত হোক, মুমিন সম্প্রদায়ের আবাস স্থল। আমরা আপনাদের সাথে যুক্ত হব ইনশাআল্লাহ। হে আল্লাহ আপনি আহলে বাকিদেরকে মাফ করে দিন।’
বুরায়দা (রাঃ) এর বর্ণিত এক হাদিসে এসেছে, ‘কবর যিয়ারতে গেলে রাসূলুল্লাহ (ﷺ)তাদেরকে শিখাতেন। তাদের মধ্যে থেকে একজন বলতেন :
السَّلَامُ عَلَيْكُمْ أَهْلَ الدِّيَارِ مِنَ المُؤْمِنِيْنَ وَالمُسْلِمِيْنَ ، وَإِنَّا إِنْ شَاءَ اللهُ لَلَاحِقُوْنَ ، أَسْأَلُ اللهَ لَنَا وَلَكُمْ العَافِيَةَ.
-আপনাদের প্রতি শান্তি বর্ষিত হোক হে অত্র জায়গায় বসবাসকারী মুমিন-মুসলিমগণ। আমরা (আপনাদের সাথে) যুক্ত হব, ইনশাআল্লাহ। আমাদের জন্য ও আপনাদের জন্য আল্লাহর দরবারে পরিত্রাণ কামনা করি।[1]
উল্লেখিত হাদিসসমূহে বাকিতে সমাহিত মুমিনগণকে সালাম দেয়ার পদ্ধতি অত্যন্ত স্পষ্ট। এর অতিরিক্ত কিছু করতে যাওয়া সুন্নতের খেলাফ; যেমন প্রত্যেকের কবরে ভিন্ন ভিন্নভাবে সালাম দেয়া- জায়েয থাকলেও- রাসূলুল্লাহ (ﷺ)ও সাহাবাদের আমলে এর কোনো উদাহরণ খুঁজে পাওয়া যায় না।
অনুরূপভাবে বাকি’র কবরস্থানে গিয়ে নিজের জন্য দোয়া করারও কোনো উদাহরণ রাসূলুল্লাহ (ﷺ)ও তাঁর সাহাবাদের জীবনে খুঁজে পাওয়া যায় না। কবরের কাছে গিয়ে দোয়া করা বরং শরিয়ত বহির্ভূত একটি কাজ যা সালাফে সালেহীনদের কেউ করেননি। কবরবাসীদের ওসিলা বানিয়ে দোয়া করা—অর্থাৎ এরূপ বলা যে হে আল্লাহ জান্নাতুল বাকিতে শায়িত বুজুর্গ ব্যক্তিদের উসিলায় আমাকে ক্ষমা করে দাও-মারাত্মক ধরনের অপরাধ। তাই বাকিতে আবেগতাড়িত হয়ে কখনো এরূপ করবেন না। যেটুকুর অনুমতি হাদিসে আছে সে-টুকু করেই ক্ষান্ত হবেন। এতেই কল্যাণ ও বরকত রয়েছে।
একমাত্র আল্লাহকে রাজি-খুশি করার জন্য তাকওয়ার ভিত্তিতে নির্মিত হয়েছে মসজিদে কোবা। পবিত্র মদিনায় হিজরতের পর রাসূলুল্লাহ (ﷺ)কর্তৃক নির্মিত প্রথম মসজিদ, মসজিদে কোবা। আল্লাহ পাক স্বয়ং এ মসজিদের পক্ষে সাক্ষী দিয়েছেন ও এতে যারা সালাত আদায় করতেন তাদের প্রশংসা করেছেন। এরশাদ হয়েছে—
لَمَسْجِدٌ أُسِّسَ عَلَى التَّقْوَى مِنْ أَوَّلِ يَوْمٍ أَحَقُّ أَنْ تَقُومَ فِيهِ فِيهِ رِجَالٌ يُحِبُّونَ أَنْ يَتَطَهَّرُوا وَاللَّهُ يُحِبُّ الْمُطَّهِّرِينَ.
-নিশ্চয়ই একটি মসজিদ যা তাকওয়ার উপর প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, প্রথম দিন থেকেই, অধিক হকদার যে আপনি তাতে (সালাত আদায় করতে) দাঁড়াবেন। এতে রয়েছে এমন ব্যক্তিগণ যারা পবিত্রতা অর্জনকে পছন্দ করে। আর আল্লাহ পবিত্রতা অর্জনকারীদেরকে পছন্দ করেন।[1] আয়েশা থেকে বর্ণিত এক হাদিসে এসেছে, তিনি বলেন, ‘রাসূলুল্লাহ (ﷺ)বনি আমর ইবনে আওফ গোত্রে দশ দিনের অধিক সময় অতিবাহিত করলেন। তিনি তাকওয়ার ওপর প্রতিষ্ঠিত মসজিদটি নির্মাণ করলেন, ও তাতে সালাত আদায় করলেন। অতঃপর তিনি আরোহণের জন্তুতে উঠে বসলেন। তিনি চলতে লাগলেন, লোকজনও তাঁর সাথে চলতে লাগল। একসময় উট মসজিদে নববির কাছে বসে পড়ল।[2] আব্দুল্লাহ ইবনে ওমর (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, ‘নবী (ﷺ)প্রতি শনিবার, পায়ে হেঁটে অথবা বাহনে চড়ে, মসজিদে কোবায় আসতেন।[3] রাসূলুল্লাহ (ﷺ)এর অনুসরণে ইবনে ওমর নিজেও অনুরূপ করতেন। অন্য এক হাদিসে এসেছে, রাসূলুল্লাহ (ﷺ)বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি তার বাড়িতে পবিত্রতা অর্জন করল, অতঃপর মসজিদে কোবায় এল, এবং তাতে সালাত আদায় করল, এতে তার উমরার মতো ছোয়াব হল।[4] উমামা থেকে বর্ণিত এক হাদিসে এসেছে, রাসূলুল্লাহ (ﷺ)বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি বের হয়ে এই মসজিদে এল, ও তাতে সালাত আদায় করল, সে এক উমরার সমপরিমাণ ছোয়াব পেল।’[5]
[2] - فلبث رسول الله صلى الله عليه وسلم في بني عمرو بن عوف بضع عشرة ليلة وأسس المسجد الذي أسس على التقوى ، وصلى فيه رسول الله صلى الله عليه وسلم ، ثم ركب راحلته فسار يمشي معه الناس حتى بركت عند مسجد رسول الله (বোখারি : হাদিস নং ৩৯০৬)
[3] - বোখারি : হাদিস নং ১১৯৩
[4] - ইবনে মাজাহ : ১৪০২
[5] - من خرج حتى يأتي هذا المسجد مسجد قباء ، فصلى فيه كان له عدل عمرة (নাসায়ী : ২/৩৭)
মসজিদে কোবায় গিয়ে প্রবেশের সময় ডান পা আগে দেবেন। মসজিদে প্রবেশের দোয়া পড়বেন-
بِسْمِ اللِه، والصَّلاَةُ وَالسَّلاَمُ عَلَى رَسُوْلِ اللهِ ، اللّهُمَّ اغْفِرْلِي ذُنُوْبِيْ وَافْتَحْ لِيْ أَبْوَابِ رَحْمَتِكَ [1].
মসজিদে প্রবেশ করে দু’রাকাত নফল সালাত আদায় করবেন। এ সালাতের আলাদা কোনো নিয়ত নেই। কেবল মনে মনে স্থির করবেন, আমি দু’রাকাত নফল সালাত আদায় করছি। সালাত শেষ হলে মসজিদ হতে বের হওয়ার দোয়া পড়ে বাঁ পা আগে দিয়ে বের হয়ে যাবেন। এখানে অন্য কোনো আমল নেই।
হিজরি দ্বিতীয় সালে উহুদযুদ্ধে যারা শহীদ হয়েছেন হামযা (রাঃ) সহ তাঁদের অনেকেই উহুদ প্রান্তরেই শায়িত আছেন। তাদের কবর যিয়ারত করা শরিয়তসম্মত। যিয়ারতের উদ্দেশ্য তাঁদের জন্য দোয়া করা, তাঁদের জন্য আল্লাহর রহমত কামনা করা। জান্নাতুল বাকি যিয়ারতের সময় যে দোয়া পড়তে হয় সে দোয়া পড়েই যিয়ারত করবেন। যে কোনো দিন শুহাদায়ে উহুদের যিয়ারত করা যেতে পারে। বৃহস্পতিবার অথবা শুক্রবার নির্দিষ্ট করার বিষয়ে কোনো প্রমাণ নেই।
উল্লেখিত জায়গাসমূহ ব্যতীত অন্যান্য জায়গা যিয়ারতের কোনো বিধান নেই। সুন্নত অথবা মুস্তাহাব মনে করে যদি কেউ সেসব জায়গা যিয়ারত করতে যায় তবে শরিয়তের দৃষ্টিতে তা বেদআত হবে। হাঁ যদি কেবলই দেখার উদ্দেশ্য হয়, ছোয়াব ইবাদত ও বরকত অর্জনের কোনো নিয়ত না থাকে, তবে কোনো অসুবিধা নেই। মদিনার কিছু কূপ রয়েছে যেগুলোর পানি তাবারুক হিসেবে নিয়ে আসার ব্যাপারে যে একটি কথা আছে তারও কোনো ভিত্তি নেই। কেননা সাহাবায়ে কেরামের কেউই দূরদূরান্তে যাওয়ার সময় কোনো পানি সঙ্গে করে নিয়ে গিয়েছেন বলে কোনো প্রমাণ নেই। নিরাময়ের মাটিও সঙ্গে নেয়ার কোনো প্রমাণ নেই।
বাড়ি প্রত্যাবর্তনের সময় রাসূলুল্লাহ (ﷺ)এর সুন্নতের যথাযথ পায়রবি করার প্রতিজ্ঞা নিয়ে, রাসূলুল্লাহ (ﷺ)যে দ্বীনকে স্বচ্ছ-শুভ্র আকারে রেখে গেছেন তা প্রচার ও প্রসারে সর্বশক্তি প্রয়োগের মনোবৃত্তি নিয়ে, কখনো কোনো কাজে যেন সুন্নতে রাসূল পরিত্যাগ না হয় সে ধরনের মানসিকতা নিয়ে মদিনা থেকে দেশে ফিরে আসবেন। দেশে ফেরার পূর্বে মসজিদে নববিতে দু’রাকাত বিদায়ি সালাত আদায় করা শরিয়তসম্মত নয়। হাদিসে ও সাহাবায়ে কেরামের কর্মে এ ধরনের কোনো সালাত পাওয়া যায় না। বিদায়ি যিয়ারত বলতেও কোনো কিছু নেই। বিদায়ের পূর্বে রওজা মুবারকে উপস্থিত হয়ে সালাম নিবেদন করে দ্বীন-দুনিয়ার প্রয়োজনের জন্য, হজ্জ ও যিয়ারত কবুল এবং নিরাপদে দেশে ফেরার জন্য দোয়া করার ব্যাপারে কোনো কোনো বইয়ে যে পরামর্শ আছে তারও কোনো ভিত্তি নেই।
সফর থেকে ফেরার পর নিজ মহল্লা বা শহর দৃষ্টিগোচর হলে,
آئِبُوْنَ، تَائِبُوْنَ، عَابِدُوْنَ، لِرَبِّنَا حَامِدُوْنَ.
-প্রত্যাবর্তনকারী, তওবাকারী, ইবাদতকারী ও আমাদের প্রভুর প্রশংসাকারী—এই দোয়া পড়বেন।[1] মহল্লার মসজিদে প্রবেশ করে দু’রাকাত সালাত আদায় করবেন।[2]
[2] -أن رسول الله كان إذا قدم من سفر بدأ بالمسجد فركع فيه ركعتين - রাসূলুল্লাহ (স) যখন সফর থেকে ফিরে আসতেন, তিনি মসজিদ দিয়ে শুরু করতেন, তিনি সেখানে দু’রাকাত সালাত আদায় করতেন (মুসলিম: হাদিস নং ২৭৬৯)