মক্কার ন্যায় মদিনাও পবিত্র নগরী। মদিনার পবিত্রতা রাসূলুল্লাহ (ﷺ)স্বয়ং ঘোষণা করেছেন। হাদিসে এসেছে, ‘হে আল্লাহ! ইব্রাহীম মক্কাকে পবিত্র হওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন, আর আমি এই দুই পাহাড়ের মাঝখানের জায়গা (মদিনা) পবিত্র বলে ঘোষণা করছি।’ [1] মদিনা ইসলামের আশ্রয়ের স্থল, রাসূলুল্লাহ (ﷺ)ও তাঁর সাহাবাদের হিজরতের জায়গা। রাসূলুল্লাহ ও তাঁর সাহাবায়ে কেরামের ত্যাগ ও কোরবানির ইতিহাস মিশে আছে মদিনার ধুলো-কণায়। পবিত্র কুরআনের অর্ধেক নাযিল হয়েছে মদিনায়। অধিকাংশ হাদিসের উৎসও মাদানি জীবনের নানা ঘটনা-অনুঘটনা। সে হিসেবে যিয়ারতে মদিনা ইতিহাসের দিকে ফিরে তাকাতে আমাদেরকে সাহায্য করতে পারে। মজবুত করতে পারে আমাদের বিশ্বাসের ভিত। আর হজ্জের সফর যেহেতু মদিনায় যাওয়ার একটা বিরাট সুযোগ এনে দেয়- বিশেষ করে যারা বহির্বিশ্ব থেকে আসে তাদের জন্য- তাই এ সুযোগের সদ্ব্যবহার করাটাই বাঞ্ছনীয়। তবে যিয়ারতে মদিনা যাতে সুন্নত তরিকায় হয় এবং কোনো ক্ষেত্রেই রাসূলুল্লাহ (ﷺ)এর অনুমোদন ও ইজাযতের বাইরে না যায় সে বিষয়টি ভালোভাবে নজরে রাখতে হবে। এ ক্ষেত্রে প্রথম প্রশ্নটি আসবে মদিনা গমনের উদ্দেশ্য নিয়ে।
কবর যিয়ারতের উদ্দেশ্যে কোথাও সফর করা যাবে না, এ মর্মে হাদিসে স্পষ্ট নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। বুখারি ও মুসলিম শরীফে এসেছে,
لا تشدوا الرحال إلا إلى ثلاثة مساجد ، المسجد الحرام ، مسجدي هذا والمسجد الأقصى
-তিনটি মসজিদ ব্যতীত অন্য কোনো স্থানের উদ্দেশ্যে সফর করো না। মসজিদুল হারাম, আমার এই মসজিদ (মসজিদে নববি) ও মসজিদুল আকসা।[2] প্রখ্যাত মুহাদ্দিস শাহ ওয়ালিউল্লাহ দেহলভি (রহ.) উক্ত হাদিসের ব্যাখ্যায় বলেন, জাহেলি যুগের মানুষেরা তাদের নিজস্ব ধারণা মতে বিশেষ-বিশেষ মর্যাদাপূর্ণ স্থানে গিয়ে নানা রকম প্রথা চালু করেছিল। তারা সে সব স্থানের জিয়ারতকে পুণ্যের কাজ মনে করত। মুসলমানরা যাতে উক্ত জাহেলি প্রথার অনুকরণ না করে সেজন্য রাসূলুল্লাহ (ﷺ)কেবল তিনটি মসজিদ ব্যতীত অন্য কোনো স্থানের উদ্দেশ্যে সফর করা নিষেধ করে দিয়েছেন।[3] শুধু তাই নয় বরং কবর কেন্দ্রিক সকল উরস-উৎসব কঠিনভাবে নিষেধ করে দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, ‘এবং আমার কবরকে তোমরা উৎসবে পরিণত করো না।’[4] উৎসবে পরিণত করার অর্থ, কবর-কেন্দ্রিক নানা অনুষ্ঠানের আয়োজন করা যার মধ্যে কবরকে উদ্দেশ্য করে সফর করাও শামিল।
‘তিন মসজিদ ব্যতীত অন্য কোনো জায়গার উদ্দেশ্যে সফর করো না’ এ হাদিসের ওপর ভিত্তি করে অধিকাংশ মুহাক্কিক ওলামাগণ রাসূলুল্লাহ (ﷺ)এর কবর যিয়ারতের উদ্দেশ্যে মদিনায় সফর করাকে অবৈধ বলেছেন। তাঁদের মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য শাহ ওয়ালিউল্লাহ মুহাদ্দিসে দেহলভি, আনোয়ার শাহ কাশ্মীরি, ইমাম ইবনে তাইমিয়াহ, আবু মুহাম্মদ আল জনী, কাজী আয়াজ কাজী হুসাইন প্রমুখ। ফতোয়ায়ে রশীদিয়াতেও একই অভিমত ব্যক্ত হয়েছে।[5] সে হিসেবে মদিনা গমনের উদ্দেশ্য, কবর যিয়ারত হলে, তা শুদ্ধ হবে না। নিয়ত করতে হবে মসজিদে নববি যিয়ারতের। কেননা রাসূলুল্লাহ (ﷺ)মসজিদে নববিতে সালাত আদায় বিষয়ে উৎসাহিত করেছেন। এক হাদিসে এসেছে, ‘আমার এই মসজিদে সালাত অন্য মসজিদে এক হাজার সালাত থেকেও উত্তম। তবে মসজিদুল হারাম ব্যতীত।[6] অন্য এক হাদিসে এসেছে, ‘আমার এই মসজিদে সালাত অন্য মসজিদে এক হাজার সালাত থেকে উত্তম। তবে মসজিদুল হারাম ব্যতীত। আর মসজিদুল হারামে সালাত অন্য মসজিদে এক লক্ষ সালাতের চেয়েও উত্তম।[7] শুধু এতটুকই নয় বরং মসজিদে নববির একটি অংশ জান্নাতের বাগানসমূহের একটি বাগান বলে ব্যক্ত করেছেন। বুখারি শরীফে এসেছে, ‘আমার ঘর ও মেম্বারের মাঝখানের জায়গা জান্নাতের বাগানসমূহের একটি বাগান।[8] আর আমার মিম্বারটি আমার হাউজের ওপর।’[9] সে হিসেবে মসজিদে নববি যিয়ারতের উদ্দেশ্যে মদিনায় সফর করার নিয়ত করাটাই শরিয়ত-সিদ্ধ।
[2] -হাদিসটি বোখারি ও মুসলিম শরীফে আবু হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণীত ।
[3] - শাহ ওয়ালিউল্লাহ দেহলভি : হুজ্জাতুল্লাহিল বালেগা।
[4] - ولا تجعلوا قبري عيدا (আবু দাউদ : হাদিস নং ১৭৪৬)
[5] - দ্রঃ ফতোয়ায়ে রশিদীয়া : খ: ৩, পৃ: ৩৩
[6] - صلاة في مسجدي هذا خير من ألف صلاة في غيره من المساجد ، إلا المسجد الحرام (মুসলিম: ২৪৭০)
[7] - صلاة في مسجدي هذا أفضل من ألف صلاة فيما سواه إلا المسجد الحرام ، وصلاة في المسجد الحرام أفضل من مأئة ألف صلاة فيما سواه (ইবনে মাজাহ : হাদিস নং ১৩৯৬ )
[8] - বেহেশতের বাগান বলতে কি বুঝায় এর ব্যাখ্যায় কেউ-কেউ বলেছেন যে এখানে আমল করলে বেহেশতের হকদার হওয়া যায়। ইমাম মালেক (রহ.) এর ব্যাখ্যায় বলেছেন যে এ-জায়গাটুকু পরকালে বেহেশতে স্থাপন করা হবে, অথবা এ জায়গাটুকু বর্তমান অবস্থাতেই বেহেশতের একটি বাগান। (ইমাম নববী : কিতাবুল ইযাহ ফি মানাসিকিল হাজ্জি ওয়াল উমরা : পৃ: ৪৫৫)
[9] - ما بين بيتي ومنبري روضة من رياض الجنة ومنبري على حوضي (বোখারি : হাদিস নং ১১২০)