মুযদালিফায় পৌঁছার পর প্রথম কাজ হল মাগরিব ও এশা এক সাথে আদায় করা। মাগরিব ও এশা উভয়টা এক আজান ও দুই একামতে আদায় করতে হবে।[1] আজান দেয়ার পর একামত দিয়ে প্রথমে মাগরিবের তিন রাকা’ত সালাত আদায় করতে হবে। এরপর সুন্নত নফল না পড়েই এশার উদ্দেশ্যে একামত দিয়ে এশার দু’রাকা’ত কসর সালাত আদায় করতে হবে। ফরজ আদায়ের পর বেতরের সালাতও আদায় করতে হবে। মাগরিবের সালাত মুযদালিফায় পৌঁছার সাথে সাথেই আদায় করা উচিৎ। গাড়ি থেকে মাল-সামানা নামানোর প্রয়োজন হলে মাগরিবের সালাত পড়ে তারপর গিয়ে নামাবেন। রাসূলুল্লাহ (ﷺ)বিদায় হজ্জের সময় মাগরিবের সালাত আদায় করে তারপর যার যার উট যেখানে অবস্থান করবে সেখানে বসিয়েছেন। এরপর এশার সালাত আদায় করেছেন।[2]
খেয়াল রাখতে হবে যে মুযদালিফায় পৌঁছার পর যদি এশার সালাতের সময় না হয় তবে অপেক্ষা করতে হবে। কেননা, এক বর্ণনা অনুসারে, মুযদালেফার রাতে মাগরিবের সময় পরিবর্তন করে এশার ওয়াক্তে নিয়ে নেওয়া হয়েছে।[3] মাগরিবের সালাতের পর কোনো সুন্নত বা জিকির নেই। তবে এশার পর বেতরের তিন রাকাত সালাত আদায় করতে হবে। সালাত আদায়ের পর অন্য কোনো কাজ নেই। কেননা রাসূলুল্লাহ (ﷺ)বিদায় হজ্জের সময় সুবহে সাদেক পর্যন্ত শুয়ে আরাম করেছেন।[4] যেহেতু ১০ জিলহজ্জ হাজি সাহেবকে অনেক পরিশ্রম করতে হবে তাই রাসূলুল্লাহ (ﷺ)মুযদালেফার রাতে আরাম করার বিধান রেখেছেন। তাই যারা বলেন যে, মুযদালেফার রাত ঈদের রাত, যা ইবাদত-বন্দেগির মাধ্যমে কাটিয়ে দেয়া উচিৎ, তাদের কথা রাসূলুল্লাহ (ﷺ)এর সুন্নত মোতাবেক না হওয়ায় আমলযোগ্য নয়।
তবে এক ফাঁকে কঙ্কর কুড়িয়ে নিতে পারেন। কেননা মিনায় গিয়ে কঙ্কর খুঁজে পাওয়া রীতিমতো কষ্টের ব্যাপার। তবে মুযদালেফা থেকেই কঙ্কর নিতে হবে এ ধারণা ঠিক নয়।[5] মটরশুঁটির আকারের কঙ্কর নেবেন যা আঙুল দিয়ে নিক্ষেপ করা যায়।[6] ৭০ টি কঙ্কর কুড়াবেন। কঙ্কর পানি দিয়ে ধুইতে হবে এমন কোনো বিধান নেই। কেননা রাসূলুল্লাহ (ﷺ)কঙ্কর ধুয়েছেন বলে কোনো হাদিসে পাওয়া যায় না।
মুযদালিফায় থাকাবস্থায় সুবহে সাদেক উদিত হলে আওয়াল ওয়াক্তে ফজরের সালাত আদায় করে কেবলামুখী হয়ে হাত উঠিয়ে দোয়ায় মশগুল হবেন। রাসূলুল্লাহ (ﷺ)অবশ্য ফজরের সালাত আদায়ের পর ‘কুযা’ পাহাড়ের পাদদেশে গিয়ে উপস্থিত হতেন ও উকুফ করতেন। এ স্থানটি বর্তমানে মাশআরুল হারাম মসজিদের সম্মুখ ভাগে অবস্থিত। এ মসজিদটি মুযদালেফার ৫ নং রোডের পাশে অবস্থিত, এবং ১২ হাজার মুসল্লি ধারণ ক্ষমতা রাখে। মসজিদটির পশ্চাৎ ভাগে ৩২ মিটার উঁচু দু’টি মিনারা রয়েছে অনেক দূর থেকেই যা স্পষ্ট দেখা যায়। এ মসজিদের এখানে রাসূলুল্লাহ (ﷺ)উকুফ করেছেন এবং বলেছেন আমি এখানে উকুফ করলাম তবে মুযদালেফা পুরোটাই উকুফের স্থান।[7] সম্ভব হলে উক্ত মসজিদের কাছে গিয়ে উকুফ করা ভাল।
উক্ত মসজিদের কাছে গিয়েই হোক বা যেখানে অবস্থান করছেন সেখানেই হোক ফজরের সালাত আদায়ের পর দোয়ায় মশগুল হবেন ও খুব ফরসা হওয়া পর্যন্ত দোয়া ও জিকির চালিয়ে যাবেন। এরপর সূর্যোদয়ের আগেই মিনার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হবেন।[8]
দুর্বল ব্যক্তিদের জন্য মধ্যরাতের পর চাঁদ ডুবে গেলে মুযদালেফা থেকে প্রস্থান করার অনুমতি আছে। ইবনে ওমর (রাঃ) তাঁর পরিবারের মধ্যে যারা দুর্বল তাদেরকে এগিয়ে দিতেন। রাতের বেলায় তারা মুযদালিফায় মাশআরুল হারামের নিকট উকুফ করতেন। তাদের ইচ্ছা অনুযায়ী আল্লাহর জিকির করতেন। তারা ইমামের উকুফ ও প্রস্থানের পূর্বেই মুযদালেফা থেকে ফিরে যেতেন। তাদের মধ্যে কেউ ফজরের সালাতের সময় মিনায় গিয়ে পৌঁছাতেন। কেউ পৌঁছাতেন তারও পর। তারা যখন মিনায় পৌঁছাতেন কঙ্কর নিক্ষেপ করতেন। ইবনে ওমর (রাঃ) বলতেন: রাসূলুল্লাহ (ﷺ)এদের ব্যাপারে অনুমতি দিয়েছেন।[9] মুযদালিফায় উকুফ করা ওয়াজিব। পবিত্র কুরআনে এসেছে—
‘فَإِذَا أَفَضْتُمْ مِنْ عَرَفَاتٍ فَاذْكُرُوا اللَّهَ عِنْدَ الْمَشْعَرِ الْحَرَامِ وَاذْكُرُوهُ كَمَا هَدَاكُمْ وَإِنْ كُنتُمْ مِنْ قَبْلِهِ لَمِنْ الضَّالِّينَ
-তোমরা যখন আরাফা হতে প্রত্যাবর্তন করবে, মাশআরুল হারামের নিকট পৌঁছে আল্লাহকে স্মরণ করবে, এবং তিনি যেভাবে নির্দেশ দিয়েছেন ঠিক সেভাবে তাঁকে স্মরণ করবে। যদিও তোমরা ইতিপূর্বে বিভ্রান্তদের অন্তর্ভুক্ত ছিলে।[10] রাসূলুল্লাহ (ﷺ)মুযদালিফায় উকুফ করেছেন। সূর্যোদয়ের পূর্বে তিনি মুযদালেফা ত্যাগ করেছেন। তাই আমাদেরও উচিৎ রাসূলুল্লাহ (ﷺ)যেভাবে মুযদালিফায় রাতযাপন করেছেন, উকুফ করেছেন, ঠিক একই রূপে রাতযাপন ও উকুফ করা।
[2] - বোখারি : ১৫৬০, মুসলিম : ২২৫৬
[3] - إن هاتين الصلاتين قد حولتا عن وقتهما في هذا المكان - (বোখারি)
[4] - أن النبي صلى الله عليه وسلم أتى المزدلفة فصلى بها المغرب والعشاء بأذان واحد وإقامتين ، ولم يسبح بينهما شيئا ، ثم اضطجع حتى طلع الفجر - নবী (সাঃ)মুযদালিফায় এলেন, সেখানে তিনি মাগরিব ও এশা এক আযান ও দুই একামতসহ আদায় করলেন। এ দুয়ের মাঝে কোনো তাসবীহ পড়লেন না । অতঃপর শুয়ে গেলেন এ পর্যন্ত যে ফজর (সুবহে সাদেক) উদিত হল। (মুসলিম)
[5] - রাসূলুল্লাহ (সাঃ)কোন জায়গা থেকে কংকর নিয়েছিলেন তা স্পষ্ট নয়। কারও কারও মতে তিনি জামারাত এর কাছ থেকে কংকর নিয়েছিলেন (দ্রঃ মুহাম্মদ বিন সালেহ আল উসাইমিন: মানাসিকুল হাজ্জ ওয়াল ওমরা, পৃ: ১৩০) তবে মুযদালিফা থেকে যে নেননি তা একটি হাদিস থেকে স্পষ্ট। হাদিসটিতে ইবনে আববাস (রাঃ) বলেন যে রাসূলূল্লাহ (সাঃ)আমাকে আকাবা দিবসের - ১০ যিলহজ্জ-সকালে সোওয়ারের ওপর থাকাবস্থায় বললেন, ‘নাও , আমার জন্য কংকর কুড়াও (আহমদ) ১০ যিলহজ্জ সকালে তিনি অবশ্যই মুযদালিফায় ছিলেন না। তবে সাহাবী ইবনে ওমর (রাঃ) মুযদালিফা থেকে কঙ্কর কুড়িয়ে নিতেন বলে একটি বর্ণনায় এসেছে (দেখুন : সাইয়িদ সাবেক : ফিকহুস্সুন্নাহ, খন্ড : ১, পৃ: ৭২৯ ) সে হিসেবে মুযদালিফা থেকে কঙ্কর নেওয়ায় কোনো সমস্যা নেই তবে তা জরুরি মনে না করা ও মুযদালিফার কঙ্করের বিশেষ কোন গুণ আছে, এ ধরনের কোনো ধারণা পোষণ না করা।
[6] - আলাবানী : সহিহুন্নাসায়ী : ২/২৪০
[7] - মুসলিম : ২/৮৯৩
[8] - জাবের (রাঃ) থেকে বর্ণীত হাদিসে এসেছে—
أنه صلى الله عليه وسلم لما أتى المزدلفة ، صلى المغرب والعشاء ، ثم اضطجع حتى طلع الفجر ، ثم ركب القصواء ، حتى أتى المشعر الحرام ، ولم يزل واقفا ، حتى أسفر جدا ثم دفع قبل طلوع الشمس
[9] - كان عبدالله بن عمر رضي اللهم عنهما يقدم ضعفة أهله فيقفون عند المشعر الحرام بالمزدلفة بليل فيذكرون الله ما بدا لهم ثم يرجعون قبل أن يقف الإمام وقبل أن يدفع فمنهم من يقدم منى لصلاة الفجر ومنهم من يقدم بعد ذلك فإذا قدموا رموا الجمرة وكان ابن عمر رضي اللهم عنهما يقول أرخص في أولئك رسول الله صلى اللهم عليه وسلم (বোখারি : হাদিস নং ১৫৬৪)
[10] - সূরা আল বাকারা : ১৯৮