আরাফা দিবসের মূল আমল দোয়া। দোয়ার কিছু আদব ও কায়দা-কানুন আছে যেগুলোর অনুসরণ দোয়া কবুলে সহায়ক হতে পারে। নীচে দোয়ার কিছু আদব উল্লেখ করা হল।

  1. শুদ্ধ নিয়ত: অর্থাৎ দোয়া আরম্ভের সময় মনে মনে নিয়ত করবেন যে আপনি একটি মহৎ ইবাদত বাস্তবায়ন করতে যাচ্ছেন। কেননা ‘দোয়াই ইবাদত’ বলে হাদিসে এসেছে।[1] মনে মনে এ ধরনের ভাবও উদ্রেক করবেন যে একমাত্র আল্লাহই সমস্ত হাজত পুরা করতে পারেন। হাজত-প্রয়োজন পুরা করা অন্য কারো পক্ষে সম্ভব নয়।
  2. ওজু অবস্থায় দোয়া করা। কেননা ওজু ব্যতীত দোয়া করা জায়েয হলেও যেহেতু দোয়া একটি ইবাদত তাই ওজু অবস্থায় করাই উত্তম।
  3. হাতের তালু চেহারার দিকে ফিরিয়ে দোয়া করা। হাদিসে এসেছে, ‘আল্লাহর কাছে তোমরা যখন সওয়াল করবে, হাতের তালু দিয়ে সওয়াল করবে। হাতের পিঠ দিয়ে নয়।[2] রাসূলুল্লাহ (ﷺ)দোয়া করার সময় হাতের তালু চেহারার দিকে রাখতেন।[3] প্রয়োজন ও হাজত প্রকাশের এটাই হল সর্বোত্তম ধরন, যাতে একজন অভাবী ব্যক্তি পাবার আশায় দাতার দিকে বিনয়াবনত হয়ে হাত বাড়িয়ে রাখে।
  4. হাত এতটুকু উঁচুতে ওঠাবেন যাতে বগলের নীচ দেখা যায়। হাদিসে এসেছে, ‘যে ব্যক্তি তার হাত এতটুকু উঠায় যে, তার বগলের নীচ দৃশ্যমান হয়ে উঠে এবং আল্লাহর কাছে আর্জি পেশ করে, আল্লাহ তার আর্জি পূরণ করেন।[4]
  5. আল্লাহর প্রশংসা ও গুণ বর্ণনার মাধ্যমে দোয়া শুরু করা। রাসূলুল্লাহ (স) অধিকাংশ সময় এভাবেই দোয়া করতেন। এমনকী কেয়ামতের ময়দানে আরশের কাছে সিজদায় রত হয়ে তিনি দীর্ঘক্ষণ আল্লাহর প্রশংসা ও গুণ বয়ান করবেন, এরপর আল্লাহ তাঁকে সওয়াল করার অনুমতি দেবেন, ও বলবেন, হে মুহাম্মদ! মাথা উঠাও, বল, তোমার কথা শোনা হবে। সওয়াল কর দেয়া হবে। শাফায়াত করো, তোমার শাফায়াত মঞ্জুর করা হবে। [5]
  6. নবী (স) এর প্রতি দরুদ পাঠ করা। কেননা দরুদ ব্যতীত দোয়া ঝুলন্ত অবস্থায় থাকে। হাদিসে এসেছে, ‘প্রত্যেক দোয়া নবী (স) প্রতি দরুদ না পড়া পর্যন্ত বাধাপ্রাপ্ত অবস্থায় থাকে।[6]
  7. প্রথমে নিজেকে দিয়ে শুরু করা। পবিত্র কুরআনে এর কিছু উদাহরণ এসেছে, যেমন; رَبِّ اغْفِرْ لِي وَلِوَالِدَيَّ - হে আমার প্রতিপালক! আমাকে ক্ষমা করুন ও আমার মাতাপিতাকে।[7] قَالَ رَبِّ اغْفِرْ لِي وَلِأَخِي - সে বলল, হে আমার প্রতিপালক আমাকে ক্ষমা করুন ও আমার ভাইকে।[8]

رَبَّنَا اغْفِرْ لَنَا وَلِإِخْوَانِنَا الَّذِينَ سَبَقُونَا بِالْإِيمَانِ

- হে আমাদের প্রতিপালক! আমাদেরকে ক্ষমা করুন ও আমাদের ভাইদেরকে যারা আমাদের পূর্বে ঈমান অবস্থায় অতিবাহিত হয়েছেন।[9] রাসূলুল্লাহ (ﷺ)ও কারো জন্য দোয়া করলে প্রথমে নিজেকে দিয়ে শুরু করতেন। [10]

  1. দোয়া করার সময় কোনো ইতস্তত না করা। এরূপ না বলা যে হে আল্লাহ তুমার যদি ইচ্ছা হয় তাহলে দোয়া কবুল করো। যদি ইচ্ছা হয় তবে রহম করো। যদি ইচ্ছা হয় আমাকে রিজিক দাও। বরং দৃঢ়-প্রত্যয়ী হয়ে দোয়া করা। [11]
  2. মন-মস্তিষ্ক জমিয়ে হৃদয়ের অন্তস্থল থেকে দোয়া করা। কেবল মুখে মুখে শব্দ উচ্চারণ করে না যাওয়া। হাদিসে এসেছে, ‘দোয়া কবুল হবে এই একীন নিয়ে আল্লাহর কাছে চাও। জেনে রাখো, আল্লাহ নিশ্চয়ই এমন দোয়া কবুল করেন না যা গাফেল ও উদাসীন হৃদয় থেকে বের হয়।[12]
  3. একীনের সাথে দোয়া করা। কেননা আল্লাহ পাক দোয়া কবুল করার ওয়াদা করেছেন, এরশাদ হয়েছে,

وَإِذَا سَأَلَكَ عِبَادِي عَنِّي فَإِنِّي قَرِيبٌ أُجِيبُ دَعْوَةَ الدَّاعِي إِذَا دَعَانِ .

- যখন আমার বান্দারা আমার সম্পর্কে তোমাকে জিজ্ঞাসা করে, বল, যে আমি নিকটেই। আহবানকারীর আহবানে আমি সাড়া দেই যখন সে আহবান করে।[13] ওপরে বর্ণিত হাদিসেও উল্লেখ হয়েছে যে, ‘তোমরা কবুল হওয়ার একীন নিয়ে আল্লাহর কাছে দোয়া করো।’ [14]

  1. দোয়ার সময় সীমা লঙ্ঘন না করা। অর্থাৎ অতিরঞ্জিত আকারে দোয়া না করা। সা’দ (র) তাঁর এক ছেলেকে এই বলে দোয়া করতে শুনলেন যে, হে আল্লাহ আমি তোমার কাছে জান্নাত চাচ্ছি। জান্নাতের সকল নেয়ামত চাচ্ছি। ও.. ও..। আমি তোমার কাছে জাহান্নাম থেকে পানাহ চাচ্ছি। জাহান্নামের শেকল ও বেড়ি সমূহ থেকে পানাহ চাচ্ছি। ও.. ও। সা’দ বলেন, হে বৎস! আমি রাসূলুল্লাহ (ﷺ)কে বলতে শুনেছি: এমন সম্প্রদায় আসবে যারা তাদের দোয়ায় সীমা-লঙ্ঘন করবে।[15] সাবধান তুমি তাদের দলভুক্ত হবে না। তোমাকে যদি জান্নাত দেয়া হয় তাহলে এর মধ্যে যা কিছু আছে সবকিছু সমেত দেয়া হবে। আর যদি জাহান্নাম থেকে মুক্তি দেয়া হয় তাহলে জাহান্নাম ও তার মধ্যে যতো খারাপি আছে তার থেকে মুক্তি দেয়া হবে।[16]
  2. আল্লাহর দরবারে হীনতা-দ্বীনতা ও অপারগতা প্রকাশ করা। সকল ক্ষমতা আল্লাহর হাতে। উপকার ও অনুপোকারের ক্ষমতা একমাত্র আল্লাহর। আল্লাহ যদি কারও কল্যাণ করতে না চান তাহলে সমগ্র পৃথিবীর সকল মানুষ মিলেও তার কোনো উপকার সাধন করতে পারবে না। আর যদি তিনি কারো উপকার করতে চান তাহলে সমগ্র পৃথিবীর মানুষ মিলেও তা ঠেকাতে পারবে না। এ ধরনের বিশ্বাস নিয়ে নিজেকে একেবারে হীন ও দুর্বল ভেবে আল্লাহর কাছে সওয়াল করতে হবে। আল্লাহ হলেন সৃষ্টিকর্তা আর আমি অতি নগণ্য, অনুল্লেখযোগ্য একজন দাস, বান্দা। আল্লাহ হলেন ধনী আমি গরিব, অক্ষম। তিনি পবিত্র ও সকল অসম্পূর্ণতা থেকে মুক্ত। আর আমি আদ্যোপান্ত অসম্পূর্ণ। একমাত্র তিনিই বিধান দাতা আমি বিধান গ্রহীতা। এ ধরনের মন-মানসিকতা নিয়ে দোয়া করতে হবে।
  3. পরিব্যাপ্ত ও নবী (স) থেকে বর্ণিত শব্দ ও বাক্য ব্যবহার করা। কেননা রাসূলুল্লাহ (ﷺ) যে শব্দ ও বাক্য ব্যবহার করেছেন তা পূর্ণাঙ্গ ও পরিব্যাপ্ত, ‘জামে’। এক বর্ণনায় এসেছে, ‘রাসূলুল্লাহ (ﷺ)পরিব্যাপ্ত দোয়া পছন্দ করতেন, ও অন্যগুলো ছেড়ে দিতেন। [17]
  4. পরিত্রাণ পাওয়ার দোয়া অধিক পরিমাণে করা। কেননা দুনিয়া ও আখেরাতে যে ব্যক্তি পরিত্রাণ পেয়ে গেল তার চেয়ে সৌভাগ্যবান আর কেউ হতে পারে না। হাদিসে এসেছে, ‘পরিত্রাণের দোয়া বেশি,বেশি করো’। [18]
  5. দোয়া কবুলের জন্য মাধ্যম হিসেবে কিছু পেশ করা। যেমন আল্লাহর নাম ও সিফাত-গুনাবলীর উসিলায় দোয়া তলব করা। এরশাদ হয়েছে,

وَلِلَّهِ الْأَسْمَاءُ الْحُسْنَى فَادْعُوهُ بِهَا .

  1. -আল্লাহর আছে সুন্দর নাম-সমগ্র, সেগুলো দিয়ে তাঁকে ডাকো।[19] নিজের কৃত কোনো সৎকাজকে উসিলা করে দোয়া চাওয়া। এর উদাহরণ পবিত্র কুরআনে খোঁজে পাওয়া যায়। এরশাদ হয়েছে—

رَبَّنَا إِنَّنَا سَمِعْنَا مُنَادِيًا يُنَادِي لِلْإِيمَانِ أَنْ آمِنُوا بِرَبِّكُمْ فَآمَنَّا رَبَّنَا فَاغْفِرْ لَنَا ذُنُوبَنَا وَكَفِّرْ عَنَّا سَيِّئَاتِنَا وَتَوَفَّنَا مَعَ الْأَبْرَارِا

-হে আমাদের প্রতিপালক! আমরা একজন আহবানকারীকে শুনতে পেয়েছি, তিনি ঈমানের দিকে আহবান করছেন, বলছেন, ঈমান আনো তোমাদের রবের প্রতি। অতঃপর ঈমান এনেছি। তাই, হে আমাদের প্রতিপালক, আমাদের পাপসমূহ ক্ষমা করে দিন, আমাদের মন্দ কর্মসমূহ মার্জনা করুন, ও সৎ ব্যক্তিদের অনুগামী করে আমাদের মৃত্যু নসিব করুন।[20] তবে এ ক্ষেত্রে সতর্ক থাকতে হবে। কোনো ব্যক্তিকে উসিলা বানিয়ে দোয়া করা কখনো উচিৎ নয়। সাহাবায়ে কেরাম রাসূলুল্লাহ (ﷺ)কে তাঁদের জন্য দোয়া করতে বলেছেন। রাসূলুল্লাহ (ﷺ)এর ওফাতের পর আব্বাস (রাঃ) কে দোয়া করতে বলেছেন। এরূপ করাকেই বলা হয় দোয়ার ক্ষেত্রে কাউকে উসিলা বানানো। সৎ ব্যক্তিদেরকে দিয়ে দোয়া করানোর এ পদ্ধতি এখনও অবলম্বন করা যায়।[21] তবে এরূপ বলা কখনো শরিয়তসম্মত নয় যে, হে আল্লাহ অমুক ব্যক্তির উসিলায় আমার দোয়া কবুল করুন।

  1. দোয়া করার সময় বেশি বেশি ‘ইয়া যাল্জালালি ওয়াল ইকরাম’ বলা। হাদিসে এসেছে, ‘(তোমাদের দোয়ায়) বেশি বেশি য়া যালজালালি ওয়াল ইকরাম বলো।[22]
  2. ইসমে আজম দিয়ে দোয়া করা। এক বর্ণনায় এসেছে যে, রাসূলুল্লাহ (ﷺ)এক ব্যক্তিকে এই বলে দোয়া করতে শুনলেন যে, হে আল্লাহ! আমি আপনার কাছে সওয়াল করছি (এই একীন নিয়ে) যে আপনি আল্লাহ, অদ্বিতীয় ও অমুখাপেক্ষী। কাউকে জন্ম দেননি, কারও থেকে জন্ম গ্রহণও করেননি। আর তাঁর কোনো সমকক্ষ নেই। রাসূলুল্লাহ (ﷺ)বললেন, লোকটি আল্লাহর ইসমে আজম দিয়ে সওয়াল করেছে। যার দ্বারা সওয়াল করলে আল্লাহ দান করেন, দোয়া করলে কবুল করেন।[23] এক. হাদিসে এসেছে, ‘ইসমে আজম এ দুটি আয়াতে রয়েছে: এক.

وَإِلَهُكُمْ إِلَهٌ وَاحِدٌ لَا إِلَهَ إِلَّا هُوَ الرَّحْمَنُ الرَّحِيمُ[24]

  1. দু্ই. সূরা আল ইমরানের শুরুর আয়াত।[25]
  2. বেশি বেশি চাওয়া এবং অতিমাত্রায় অনুনয়-বিনয় করা। হাদিসে এসেছে, ‘তোমাদের কেউ যখন সওয়াল করবে সে যেন বেশি মাত্রায় করে। কেননা সে আল্লাহর কাছে সওয়াল করছে।’
  3. কেবলামুখী হয়ে দোয়া করা। কেননা রাসূলুল্লাহ (ﷺ)কেবলামুখী হয়ে দোয়া করতেন।[26] দোয়ার কেবলা আকাশ বলে যে একটি কথা আছে, তা ঠিক নয়।
  4. দোয়া শেষ হলে ‘আমীন’ বলা।
[1] - الدعاء هو العبادة (তিরমিযী : হাদিস নং ৩২৯৪)

[2] - قال النبي صلى الله عليه وسلم : إذا سألتم الله فاسألوه ببطون أكفكم ، ولا تسألوه بظهورها (আবু দাউদ : ১৪৮৬)

[3] - كان إذا دعا جعل باطن كفه إلى وجهه (তাবারানী : ১১/১২২৩৪)

[4] - ما من عبد يرفع يديه حتى يبدو إبطه يسأل الله مسألة إلا أتاها إياه.. (তিরমিযী : ৩৬০৩) মুহাদ্দিস নাসিরুদ্দিন আলবানী এ হাদিসটি সহিহ বলেছেন (দ্রঃ সহিহুত্তিরমিযী :২৮৫৩)

[5] - বোখারি : হাদিস নং ৭৫১০ , মুসলিম : হাদিস নং ১৯৩

[6] - كل دعاء محجوب حتى يصلى على النبي (দায়লামী : ৩/৪৭৯১, সহিহুল জামে’ : ৪৫২৩)

[7] - সূরা নূহ : ২৮

[8] - সূরা আল আ’রাফ : ১৫১

[9] - সূরা আল হাশর : ১০

[10] - আবু দাউদ : হাদিস নং ৩৯৮৪

[11] - দ্র ঃ বোখারি : হাদিস নং ৬৩৩৯

[12] - أدعو الله تعالى و أنتم موقنون بالإجابة ، واعلموا أن الله لا يستجيب دعاء من قلب غافل لاه (তিরমিযী : ৩৪৭৯ ; সহিহুত্তিরমিযী : ২৭৬৬)

[13] - সূরা আল বাকারা : ১৮৬

[14]- তিরমিযী : ৩৪৭৯ ; সহিহুত্তিরমিযী : ২৭৬৬

[15] - سيكون قوم يعتدون في الدعاء (আহমদ : ১/১৭২)

[16] - আহমদ : ১/১৭২

[17] - كان يستحب جوامع من الدعاء ، ويدع ما سوى ذلك (আবু দাউদ : হাদিস নং ১৪৮২; সহীহু আবি দাউদ: ১৩১৫)

[18] - সহীহুল জামে’: হাদিস নং ১১৯৮

[19] - সূরা আল আরাফ : ১৮০

[20] - সূরা আল ইমরান: ১৯৩

[21] - দ্রঃ আব্দুল আযীয বিন ফাতহি আস্সাইয়িদ নাদা : মাওসুয়াতুল আদাব আল ইসলামিয়া, পৃ : ৩৬৪

[22] - সহিহুত্তিরমিযী : ২৭৯৭

[23] - سمع النبي صلى الله عليه وسلم رجلا يقول : اللهم إني أسألك بأنك أنت الله الأحد الصمد ، الذي لم يلد ولم يولد ، ولم يكن له كفوا أحد .فقال رسول الله : لقد سأل الله باسمه الأعظم ، الذي إذا سئل به أعطى ، وإذا دعى به أجاب (আবু দাউদ : হাদিস নং ১৪৯৩; সহীহু আবি দাউদ : ১৩২৪)

[24] - সূরা আল বাকারা : ১৬১

[25] - আবু দাউদ : ১৪৯৬ ; ইবনে মাযাহ : ৩৮৫৫; সহিহু ইবনে মাযাহ :৩১০৯

[26] - মুসলিম : হাদিস নং ২১৩৭