মহান আল্লাহ বান্দার প্রতি বড় দয়াবান, বড় অনুগ্রহশীল। তিনি বান্দার কষ্ট চান না। তাই অনুগ্রহ করেই বিধান দিয়েছেন দুই সময়ের নামাযকে প্রয়োজনে এক সময়ে একত্রিত করে পড়ার। অনুমতি দিয়েছেন আগের নামাযকে পরের সাথে (বিলম্ব করে) অথবা পরের নামাযকে আগের সাথে (ত্বরান্বিত করে) পড়ার।
অবশ্য এ কেবল সীমাবদ্ধ নামাযের মাঝেই সম্ভব। যেমন, যোহ্র ও আসর এক সাথে এবং মাগরেব ও এশা এক সাথে দুটির মধ্যে একটির সময়ে জমা করে পড়া যাবে। পক্ষান্তরে ফজরের নামাযকে আগে-পরের কোন নামাযের সাথে জমা করে পড়া যাবে না। যেমন পড়া যাবে না আসর ও মাগরেবের নামাযকে এক সাথে জমা করে। অনুরুপ জুমআর নামায যোহ্র থেকে পৃথক। অতএব জুমআর সাথে আসরের নামাযকে জমা করে পড়া যাবে না। (আলমুমতে’, শারহে ফিক্হ, ইবনে উষাইমীন ৪/৫৭২-৫৭৩)
যথা সময়ে নামায পড়াই প্রত্যেক মুসলিম নরনারীর জন্য ফরয। কিন্তু দলীলের ভিত্তিতেই নিম্নোক্ত সময় ও অবস্থায় এক সময়ের নামাযকে অন্য সময়ের নামাযের সাথে জমা করে পড়া বৈধ :-
আরাফাত ও মুযদালিফায় :
বিদায়ী হ্জ্জে মহানবী (ﷺ) আরাফাতে যোহ্র ও আসরের নামাযকে যোহরের সময় এবং মুযদালিফায় মাগরেব ও এশার নামাযকে এশার সময় জমা করে পড়েছিলেন।
সফরে মুসাফির অবস্থায় :
সফরে পথে অথবা কোন অবস্থান ক্ষেত্রে বা বাসায় জমা (ও কসর) করে নামায পড়া যায়। হযরত আব্দুল্লাহ বিন আব্বাস (রাঃ) বলেন, ‘আমি কি তোমাদেরকে নবী (ﷺ)-এর নামায সম্পর্কে বর্ণনা দেব না?’ লোকেরা বলল, ‘অবশ্যই।’ তিনি বললেন, ‘সফর করার সময় অবস্থান ক্ষেত্রে থাকতে থাকতেই যদি সূর্য ঢলে যেত, তাহলে সওয়ার হওয়ার আগেই যোহ্র ও আসরকে জমা করে পড়ে নিতেন। আর সূর্য না ঢললে তিনি বের হয়ে যেতেন। অতঃপর আসরের সময় হলে সওয়ারী থেকে নেমে যোহ্র ও আসরকে এক সঙ্গে জমা করে পড়ে নিতেন। অনুরুপ যদি অবস্থান ক্ষেত্রে থাকতে থাকতেই সূর্য ডুবে যেত, তাহলে মাগরেব ও এশার নামাযকে এক সঙ্গে জমা করে নিতেন। আর সূর্য না ডুবলে তিনি বের হয়ে যেতেন। অতঃপর এশার সময় হলে তিনি সওয়ারী থেকে নেমে মাগরেব ও এশার নামাযকে এক সঙ্গে জমা করে পড়ে নিতেন।’ (আহমাদ, মুসনাদ, শাফেয়ী, দ্র: বুখারী ১১১১-১১১২নং)
হযরত মুআয (রাঃ) বলেন, তবুক অভিযানে গিয়ে আল্লাহর রসূল (ﷺ) একদা দেরী করে নামায পড়লেন। তিনি বাইরে এসে যোহ্র ও আসরকে এক সাথে জমা করে পড়লেন। তারপর তিনি ভিতরে চলে গেলেন। অতঃপর বাইরে এসে তিনি মাগরেব ও এশাকে এক সাথে জমা করে পড়লেন। (মুসলিম, মালেক, মুঅত্তা)
দুই নামাযকে একত্রে জমা করে পড়ার সময় সুন্নত হল নামাযের পূর্বে একটি আযান হবে এবং প্রত্যেক নামায শুরু করার আগে ইকামত হবে। আর উভয় নামাযের মাঝে কোন সুন্নত পড়া যাবে না। মহানবী (ﷺ) আরাফাত ও মুযদালিফায় অনুরুপই করেছিলেন। (আহমাদ, মুসনাদ, বুখারী, মুসলিম, নাসাঈ, সুনান)
দুই নামায জমা করার সময় উভয়ের মাঝে সামান্য ক্ষণ দেরী হয়ে যাওয়া দোষাবহ্ নয়। কারণ, মুযদালিফায় পৌঁছে মহানবী (ﷺ) মাগরেবের নামায পড়েন। অতঃপর প্রত্যেকে নিজ নিজ উট নিজ নিজ অবতরণ স্থলে বসিয়ে দিল। তারপর এশার নামায পড়লেন এবং মাঝে কোন নামায পড়েননি। (বুখারী ১৬৭২, মুসলিম, সহীহ)
বৃষ্টি-বাদলের দিনে কাদায় পা পিছলে পড়ে যাওয়া বা পানিতে ভিজে যাওয়ার আশঙ্কায় বারবার মসজিদ আসতে মুসল্লীদের কষ্ট হবে বলেই সরল শরীয়তে সে সময়ও দুই নামাযকে এক সাথে জমা করে পড়ে নেওয়ার অনুমতি দান করেছে।
হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) বলেন, ‘মহানবী (ﷺ) মদ্বীনায় যোহ্র ও আসর এবং মাগরেব ও এশাকে জমা করে পড়েছেন।’ (এক বর্ণনাকারী) আইয়ুব (আবুশ শা’ষা জাবেরকে) জিজ্ঞাসা করলেন, ‘সম্ভবত: বৃষ্টির সময়?’ উত্তরে (জাবের) বললেন, ‘সম্ভবত:।’ (বুখারী ৫৪৩নং, তামামুল মিন্নাহ্, আলবানী ৩২১পৃ:)
হযরত আবূ সালামাহ্ (রাঃ) বলেন, ‘বৃষ্টির দিনে মাগরেব ও এশাকে জমা করে পড়া সুন্নত।’ (আষরাম, নাইলুল আউতার, শাওকানী ৩/২১৮)
হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) বলেন, ‘একদা নবী (ﷺ) মদ্বীনায় যোহ্র ও আসর এবং মাগরেব ও এশার নামাযকে জমা করে পড়েছেন। সেদিন না কোন ভয় ছিল আর না বৃষ্টি।’ লোকেরা জিজ্ঞাসা করল, ‘তিনি এমন কেন করলেন?’ উত্তরে ইবনে আব্বাস (রাঃ) বললেন, ‘তিনি তাঁর উম্মতকে অসুবিধায় না ফেলার উদ্দেশ্যে এমনটি করলেন।’ (মুসলিম, সহীহ ৭০৫নং)
উক্ত বর্ণনায় ‘বৃষ্টি ছিল না তাও জমা করে নামায পড়েছেন’ এই কথার দলীল যে, বৃষ্টি হলে জমা করে পড়া এমনিতেই বৈধ। আর এ জমা হবে হাক্বীক্বী (প্রকৃত) জমা (তাকদীম), সূরী (আপাত) জমা নয়। কারণ, তাতেই উম্মতকে অসুবিধায় পড়তে হবে। (দ্র: সিলসিলাহ সহীহাহ, আলবানী ২৮৩৭নং)
বৃষ্টির জন্য জমা কেবল তারাই করতে পারে, যারা জামাআতের লোক। যারা জামাআতে বা মসজিদে হাযির হয় না তাদের জন্য জমা বৈধ নয়। যেমন, রোগী (কষ্ট না হলে) বা মহিলা বাড়িতে জমা করতে পারে না।
পক্ষান্তরে যে ব্যক্তি মসজিদেই বা মসজিদের শামিল বা পাশাপাশি বাসায় বাস করে তার জন্যও জমা বৈধ। আসল কথা হল জামাআত। আর জামাআতের ফযীলত বেশী। অতএব জামাআত ছেড়ে তাদের যথাসময়ে নামায পড়া উচিৎ নয়। (আলমুমতে’, শারহে ফিক্হ, ইবনে উষাইমীন ৪/৫৬০)
ভয় বা বৃষ্টি ছাড়াও অন্য কোন বড় অসুবিধার কারণেও দুই নামাযকে জমা করে পড়া বৈধ। উপর্যুক্ত ইবনে আব্বাস (রাঃ)-এর হাদীস সে কথাই ইঙ্গিত করে।এ ছাড়া বুখারী ও মুসলিম শরীফের একটি যৌথ বর্ণনায় পাওয়া যায় যে, মহানবী (ﷺ) মদ্বীনায় যোহ্র ও আসর এবং মাগরেব ও এশাকে জমা করে পড়েছেন। (বুখারী ৫৪৩, মুসলিম, সহীহ)
আব্দুল্লাহ বিন শাকীক বলেন, একদা হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) আসরের পর আমাদের মাঝে বক্তব্য রাখলেন। এই অবস্থায় সূর্য ডুবে গেল এবং আকাশে তারা ফুটে উঠল। আর লোকেরা বলতে লাগল, ‘নামাযের সময় হয়ে গেছে, নামাযের সময় হয়ে গেছে।’
বনী তামীমের এক ব্যক্তি ‘নামায, নামায’ করতে করতে সোজা ইবনে আব্বাসের কাছে এল। তিনি লোকটাকে বললেন, ‘তুমি কি আমাকে আল্লাহর রসূল (ﷺ)-এর সুন্নত শিখাতে এসেছ? আমি নবী (ﷺ)-কে যোহ্র ও আসর এবং মাগরেব ও এশার নামাযকে একত্রে জমা করে পড়তে দেখেছি।’
আব্দুল্লাহ বিন শাকীক বলেন, ‘তাঁর এ কথায় আমার সন্দেহ্ হলে আমি আবূ হুরাইরা (রাঃ)-এর কাছে উপস্থিত হয়ে তাঁকে এ ব্যাপারে জিজ্ঞাসা করি। তিনি তাঁর এ কথার সমর্থন করেন।’ (মুসলিম, সহীহ ৭০৫নং)
প্রয়োজনে অসুস্থ অবস্থায়ও বারবার ওযূ করতে বা লেবাস পাল্টে পবিত্রতা অর্জন করতে কষ্ট হলে দুই নামাযকে এক সাথে জমা করে পড়া বৈধ। যেমন মহানবী (ﷺ) ইস্তিহাযাগ্রস্ত (সর্বদা মাসিক আসে এমন) মহিলাকে এক গোসলে দুই নামাযকে এক সাথে জমা করে পড়ার নির্দেশ দিয়েছেন। (আহমাদ, মুসনাদ, আবূদাঊদ, সুনান, তিরমিযী, সুনান, মিশকাত ৫৬১-৫৬৩নং) অনুরুপ যার সব সময় প্রস্রাব ঝরার রোগ আছে সেও ২ নামাযকে জমা করে পড়তে পারে।
জ্ঞাতব্য যে, ত্বরান্বিত জমা (তাক্বদীম) অপেক্ষা (কষ্ট না হলে) বিলম্বিত (তা’খীর) জমাই উত্তম। এ ছাড়া যখন যার জন্য যেমন সুবিধা তার জন্য সেই জমাই উত্তম। (আলমুমতে’, শারহে ফিক্হ, ইবনে উষাইমীন ৪/৪৬১-৫৬৪) অবশ্য প্রথম অক্তে জমা না করলে সে সময়ে জমার নিয়ত জরুরী। নচেৎ, জমার নিয়ত ছাড়া বিনা ওযরে কোন নামাযকে যথাসময় থেকে পার করে দেওয়া হারাম। (আলমুমতে’, শারহে ফিক্হ, ইবনে উষাইমীন ৪/৫৭৪)
বলা বাহুল্য, প্রথম অক্তে জমার নিয়ত না রেখে সময় পার হওয়ার পর পরের ওয়াক্তের সাথে জমার নিয়ত সহীহ নয়। বরং এই সময় প্রথম নামায কাযা ও দ্বিতীয় নামায আদায়ের নিয়তে পড়া জরুরী। (ঐ ৪/৫৭৫)
প্রকাশ থাকে যে, কোন ওযরে প্রথম অক্তে দুই নামায জমা করে নেওয়ার পর দ্বিতীয় ওয়াক্ত আসার আগেই যদি সে ওযর দূর হয়ে যায়; যেমন রোগ ভাল হয়ে যায়, মুসাফির ঘরে ফিরে আসে অথবা বৃষ্টি থেমে যায়, তবুও জমা নামায বাতিল হবে না এবং দ্বিতীয় অক্তে ঐ পড়া নামায আর ফিরিয়ে পড়তে হবে না। এমন কি দ্বিতীয় নামায শেষ হওয়ার আগেই যদি ওযর দূর হয়ে যায় তবুও জমা বাতিল নয়। (ঐ ৪/৫৭৪, মাজাল্লাতুল বুহূসিল ইসলামিয়্যাহ্ ১৭/৫৫, ফাতাওয়া ইসলামিয়্যাহ্, সঊদী উলামা-কমিটি ১/২৬১-২৬২)
মুসাফিরের জন্য জমা ও কসর একই সাথে করা জরুরী নয়। সুতরাং সে জমা না করে কেবল কসর এবং কসর না করে জমাও করতে পারে। (মাজাল্লাতুল বুহূসিল ইসলামিয়্যাহ্ ১২/৮৮)