জুমআর নামায প্রত্যেক সাবালক জ্ঞান-সম্পন্ন পুরুষের জন্য জামাআত সহকারে ফরয।
মহান আল্লাহ বলেন,
(يَا أَيُّهَا الَّذِيْنَ آمَنُوْا إِذَا نُوْدِيَ لِلصَّلاَةِ مِنْ يَّوْمِ الْجُمُعَةِ فَاسْعَوْا إِلَى ذِكْرِ اللهِ وَذَرُوا الْبَيْعَ، ذَلِكُمْ خَيْرٌ لَّكُمْ إِنْ كُنْتُمْ تَعْلَمُوْنَ)
অর্থাৎ, হে ঈমানদারগণ! যখন জুমআর দিন নামাযের জন্য আহবান করা হবে, তখন তোমরা সত্বর আল্লাহর স্মরণের জন্য উপস্থিত হও এবং ক্রয়-বিক্রয় বর্জন কর। এটিই তোমাদের জন্য কল্যাণকর, যদি তোমরা উপলব্ধি কর। (কুরআন মাজীদ ৬২/৯)
মহানবী (ﷺ) বলেন, “দুনিয়াতে আমাদের আসার সময় সকল জাতির পরে। কিন্তু কিয়ামতের দিন আমরা সকলের অগ্রবর্তী। (সকলের আগে আমাদের হিসাব-নিকাশ হবে।) অবশ্য আমাদের পূর্বে ওদেরকে (ইয়াহুদী ও নাসারাকে) কিতাব দেওয়া হয়েছে। আমরা কিতাব পেয়েছি ওদের পরে। এই (জুমআর) দিনের তা’যীম ওদের উপর ফরয করা হয়েছিল। কিন্তু ওরা তাতে মতভেদ করে বসল। পক্ষান্তরে আল্লাহ আমাদেরকে তাতে একমত হওয়ার তওফীক দান করেছেন। সুতরাং সকল মানুষ আমাদের থেকে পশ্চাতে। ইয়াহুদী আগামী দিন (শনিবার)কে তা’যীম করে (জুমআর দিন বলে মানে) এবং নাসারা করে তার পরের দিন (রবিবার)কে।” (বুখারী, মুসলিম, মিশকাত)
মহানবী (ﷺ) বলেন, “প্রত্যেক সাবালক পুরুষের জন্য জুমআয় উপস্থিত হওয়া ওয়াজেব।” (নাসাঈ, সুনান ১৩৭১নং)
হযরত ইবনে মসউদ (রাঃ) কর্তৃক বর্ণিত, নবী (ﷺ) বলেন, “আমি ইচ্ছা করেছি যে, এক ব্যক্তিকে লোকেদের ইমামতি করতে আদেশ করে ঐ শ্রেণীর লোকেদের ঘর-বাড়ি পুড়িয়ে দিই, যারা জুমআতে অনুপস্থিত থাকে।” (মুসলিম ৬৫২নং,হাকেম)
হযরত আবূ হুরাইরা (রাঃ) ও ইবনে উমার (রাঃ) কর্তৃক বর্ণিত, তাঁরা শুনেছেন, আল্লাহর রসূল (ﷺ) তাঁর মিম্বরের কাঠের উপর বলেছেন যে, “কতক সম্প্রদায় তাদের জুমুআহ ত্যাগ করা হতে অতি অবশ্যই বিরত হোক, নতুবা আল্লাহ তাদের অন্তরে অবশ্যই মোহ্র মেরে দেবেন। অতঃপর তারা অবশ্যই অবহেলাকারীদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যাবে।” (মুসলিম, সহীহ ৮৬৫ নং, ইবনে মাজাহ্, সুনান)
হযরত আবুল জা’দ যামরী (রাঃ) হতে বর্ণিত, নবী (ﷺ) বলেন, “যে ব্যক্তি বিনা ওজরে তিনটি জুমুআহ ত্যাগ করবে সে ব্যক্তি মুনাফিক।” (ইবনে খুযাইমাহ্, সহীহ, ইবনে হিব্বান, সহীহ, সহিহ তারগিব ৭২৬নং)
হযরত জাবের বিন আব্দুল্লাহ্ (রাঃ) কর্তৃক বর্ণিত, তিনি বলেন, একদা নবী (ﷺ) জুমআর দিন খাড়া হয়ে খুতবা দানকালে বললেন, “সম্ভবত: এমনও লোক আছে, যার নিকট জুমুআহ উপস্থিত হয়; অথচ সে মদ্বীনা থেকে মাত্র এক মাইল দূরে থাকে এবং জুমআয় হাযির হয় না।” দ্বিতীয় বারে তিনি বললেন, “সম্ভবত: এমন লোকও আছে যার নিকট জুমুআহ উপস্থিত হয়; অথচ সে মদ্বীনা থেকে মাত্র দুই মাইল দূরে থাকে এবং জুমআয় হাজির হয় না।” অতঃপর তৃতীয়বারে তিনি বললেন, “সম্ভবত: এমন লোকও আছে যে মদ্বীনা থেকে মাত্র তিন মাইল দূরে থাকে এবং জুমআয় হাজির হয় না তার হৃদয়ে আল্লাহ মোহ্র মেরে দেন।” (আবূ য়্যা’লা, সহিহ তারগিব ৭৩১নং)
হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) বলেন, “যে ব্যক্তি পরপর ৩ টি জুমুআহ ত্যাগ করল, সে অবশ্যই ইসলামকে নিজের পিছনে ফেলে দিল।” (ঐ, সহিহ তারগিব৭৩২নং)
১-২-৩। মহিলা, শিশু ও অসুস্থ ব্যক্তি।
নবী মুবাশ্শির (ﷺ) বলেন, “প্রত্যেক মুসলিমের জন্য জামাআত সহকারে জুমুআহ ফরয। অবশ্য ৪ ব্যক্তির জন্য ফরয নয়; ক্রীতদাস, মহিলা, শিশু ও অসুস্থ।” (আবূদাঊদ, সুনান ১০৬৭নং)
৪। যে ব্যক্তি (শত্রু, সম্পদ বিনষ্ট, সফরের সঙ্গী ছুটে যাওয়ার) ভয়ে, অথবা বৃষ্টি, কাদা বা অত্যন্ত শীত বা গ্রীষ্মের কারণে মসজিদে উপস্থিত হতে অক্ষম।
মহানবী (ﷺ) বলেন, “যে ব্যক্তি মুআযযিনের (আযান) শোনে এবং কোন ওজর (ভয় অথবা অসুখ) তাকে জামাআতে উপস্থিত হতে বাধা না দেয়, তাহলে যে নামায সে পড়ে, তার সে নামায কবুল হয় না।” (আবূদাঊদ, সুনান ৫৫১নং)
একদা ইবনে আব্বাস (রাঃ) এক বৃষ্টিময় জুমআর দিনে তাঁর মুআযযিনকে বললেন, ‘তুমি যখন আশহাদু আন্না মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ্’ বলবে তখন বল, ‘তোমরা তোমাদের ঘরে নামায পড়ে নাও।’ এ কথা শুনে লোকেরা যেন আপত্তিকর মনোভাব ব্যক্ত করল। কিন্তু তিনি বললেন, ‘এরুপ তিনি করেছেন যিনি আমার থেকে শ্রেষ্ঠ। অর্থাৎ, আল্লাহর রসূল (ﷺ) এরুপ করেছেন। আর আমিও তোমাদেরকে এই কাদা ও পিছল জায়গার মাঝে বের হওয়াকে অপছন্দ করলাম।’ (বুখারী ৯০১, মুসলিম, সহীহ ৬৯৯নং)
প্রকাশ থাকে যে, যারা দূরের মাঠে অথবা জঙ্গলে অথবা সমুদ্রে কাজ করে এবং আযান শুনতে পায় না, তাছাড়া কাজ ছেড়ে শহর বা গ্রামে আসাও সম্ভব নয়, তাদের জন্য জুমুআহ ফরয নয়। (ফাতাওয়া ইসলামিয়্যাহ্, সঊদী উলামা-কমিটি ১/৪১৪, ফাতাওয়া ইবনে উষাইমীন ১/৩৯৯)
৫। মুসাফির :
মহানবী (ﷺ) জুমআর দিন সফরে থাকলে, জুমআর নামায না পড়ে যোহরের নামায পড়তেন। বিদায়ী হজ্জের সময় তিনি আরাফাতে অবস্থানকালে জুমআর নামায পড়েননি। বরং যোহ্র ও আসরের নামাযকে অগ্রিম জমা করে পড়েছিলেন। অনুরুপ আমল ছিল খুলাফায়ে রাশেদ্বীন (রাঃ) দেরও।
উপর্যুক্ত ব্যক্তিবর্গের জন্য জুমআর নামায ফরয নয়। কিন্তু যোহরের নামায অবশ্যই ফরয। পরন্তু যদি তারাও জুমআর মসজিদে উপস্থিত হয়ে জামাআতে জুমুআহ পড়ে নেয়, তাহলে তা বৈধ। এ ক্ষেত্রে তাদের জুমুআহ হয়ে যাবে এবং যোহরের নামায মাফ হয়ে যাবে।
একাধিক হাদীস এ কথা প্রমাণ করে যে, মহানবী (ﷺ) এবং খুলাফায়ে রাশেদ্বীন (রাঃ) দের যুগে মহিলারা জুমুআহ ও জামাআতে উপস্থিত হয়ে নামায আদায় করত।
উল্লেখ্য যে, কোন মুসাফির জুমুআহ খুতবা দিলে ও ইমামতি করলে তা শুদ্ধ হয়ে যাবে। (আলমুমতে’, শারহে ফিক্হ, ইবনে উষাইমীন ৫/২৩)
জুমআর জামাআতে কোন মুসাফির যোহরের কসর আদায় করার নিয়ত করতে পারে না। কারণ, যোহ্র অপেক্ষা জুমআর ফযীলত অনেক বেশী। (আলমুমতে’, শারহে ফিক্হ, ইবনে উষাইমীন ৪/৫৭৪)
অধিকাংশ সাহাবা, তাবেঈন ও ইমামগণের নিকট জুমআর সময় যোহরের সময় একই। অর্থাৎ, সূর্য ঢলার পর থেকে নিয়ে প্রত্যেক বস্তুর ছায়া তার সমপরিমাণ হওয়া (আসরের আগে) পর্যন্ত।
হযরত আনাস (রাঃ) বলেন, ‘নবী (ﷺ) জুমুআহ তখন পড়তেন, যখন সূর্য পশ্চিম আকাশেঢলে যেত।’ (আহমাদ, মুসনাদ, বুখারী, আবূদাঊদ, সুনান, তিরমিযী, সুনান, বায়হাকী)
ইমাম বুখারী বলেন, ‘জুমআর সময় সূর্য ঢলার পরই শুরু হয়। হযরত উমার, আলী, নু’মান বিন বাশীর এবং আম্র বিন হুয়াইরিষ কর্তৃক এ ব্যাপারে বর্ণনা পাওয়া যায়।’ (বুখারী)
হযরত সালামাহ্ বিন আকওয়া’ (রাঃ) বলেন, ‘আমরা যখন নবী (ﷺ)-এর সাথে জুমআর নামায পড়ে ঘরে ফিরতাম, তখন দেওয়ালের কোন ছায়া থাকত না।’ (বুখারী, মুসলিম, আবূদাঊদ, সুনান)
হযরত আনাস (রাঃ) বলেন, ‘ঠান্ডা খুব বেশী হলে নবী (ﷺ) জুমআর নামায সকাল সকাল পড়তেন এবং গরম খুব বেশী হলে দেরী করে পড়তেন।’ (বুখারী)
অবশ্য সূর্য ঢলার পূর্বেও জুমুআহ পড়া বৈধ। (বিস্তারিত দ্রষ্টব্য আল-আজবিবাতুন নাফেআহ্, আন আসইলাতি লাজনাতি মাসজিদিল জামেআহ্, মুহাদ্দিস আলবানী ২২-২৫পৃ:) তবে সূর্য ঢলার পরই জুমুআহর (খুতবার) আযান হওয়া উত্তম। কারণ, প্রথমত: এতে অধিকাংশ উলামার সাথে সহ্মত প্রকাশ হয়। দ্বিতীয়ত: যারা জুমআয়হাজির হয় না এবং সময়ের খবর না রেখে আযান শুনে নামায পড়তে অভ্যাসী (ওযরগ্রস্ত ও মহিলারা) সময় হওয়ার পূর্বেই নামায পড়ে ফেলে না। (লিকাউবাবিল মাফতূহ্, ইবনে উষাইমীন ৫/৩৪)
প্রকাশ থাকে যে, সকাল সকাল মসজিদে গিয়ে তাহিয়্যাতুল মসজিদ সহ্ অন্যান্য নফল পড়া সূর্য ঠিক মাথার উপরে থাকার সময়ে হলেও তা নিষেধের আওতাভুক্ত নয়। (ঐ)
জুমআর নামায যেহেতু জামাআত সহকারে ফরয, সেহেতু যে কয় জন লোক নিয়ে জামাআত হবে, সে কয় জন লোক নিয়ে জুমআহও প্রতিষ্ঠিত হবে। কিন্তু তার জন্য নির্দিষ্ট লোক সংখ্যা হাদীস থেকে প্রমাণিত নয়।
জুমুআহ যেমন শহরবাসীর জন্য ফরয, তেমনি ফরয গ্রামবাসীর জন্যও। এর জন্য খলীফা হওয়া, শহর হওয়া, জামে মসজিদ হওয়া বা ৪০ জন নামাযী হওয়া শর্ত নয়। বরং যেখানেই স্থানীয় স্থায়ী বসবাসকারী জামাআত পাওয়া যাবে, সেখানেই জুমুআহ ফরয। (মাজাল্লাতুল বুহূসিল ইসলামিয়্যাহ্ ২২/৭৫, ফাতাওয়া ইসলামিয়্যাহ্, সঊদী উলামা-কমিটি ১/৪২৪)
হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) বলেন, ‘নবী (ﷺ)-এর মসজিদে জুমুআহ প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর ইসলামে সর্বপ্রথম যে জুমুআহ প্রতিষ্ঠিত হয়, তা হল বাহ্রাইনের জুয়াষা নামক এক গ্রামে।’ (বুখারী ৮৯২, ৪৩৭১, আবূদাঊদ, সুনান ১০৬৮নং)
হযরত ইবনে উমার (রাঃ) মক্কা মুকার্রামা ও মদ্বীনা নববিয়ার মধ্যবর্তী পথে অবস্থিত ছোট ছোট জনপদে জুমুআহ প্রতিষ্ঠিত হতে লক্ষ্য করতেন। তিনি তাতে কোন আপত্তি জানাতেন না। (আব্দুর রাযযাক, মুসান্নাফ)
হযরত উমার (রাঃ) বলেন, ‘তোমরা যেখানেই থাক, সেখানেই জুমুআহ পড়।’ (আব্দুর রাযযাক, মুসান্নাফ, তামামুল মিন্নাহ্, আলবানী ৩৩২পৃ:)
পক্ষান্তরে পাড়া-গ্রামে জুমুআহ হবে না বলে হযরত আলী কর্তৃক যে হাদীস বর্ণনা করা হয়, তা সহীহ নয়। (মাজাল্লাতুল বুহূসিল ইসলামিয়্যাহ্ ১৬/৩৫২-৩৫৪, ২২/৭৫)
কোন অমুসলিম দেশে পড়াশোনা বা চাকরী করতে গিয়ে সেখানে মসজিদ না থাকলে বা যথেষ্ট সংখ্যক মুসলিম না থাকলেও ৩ জনেই যে কোন রুমে জুমুআহ কায়েম হবে। (মাজাল্লাতুল বুহূসিল ইসলামিয়্যাহ্ ১৫/৮৫)
একই বড় গ্রাম বা শহরে বিচ্ছন্নতা সৃষ্টির উদ্দেশ্যে নয়, বরং মসজিদ সংকীর্ণ হওয়ার কারণে, অথবা দূর হওয়ার কারণে, অথবা ফিতনা সৃষ্টি হওয়ার আশঙ্কায় প্রয়োজনে একাধিক মসজিদে জুমুআহ কায়েম করা যায়। (মাজাল্লাতুল বুহূসিল ইসলামিয়্যাহ্ ১৮/১১১, ১৯/১৬৫-১৬৬)
কোন মসজিদে জুমুআহ পড়ার জন্য নির্মাণের সময় ঐ নিয়ত শর্ত নয়। অক্তিয়ারুপে নির্মাণের পর প্রয়োজনে সেখানে জুমুআহ পড়া যায়। (মাজাল্লাতুল বুহূসিল ইসলামিয়্যাহ্ ১৮/১১০)
মহানবী (ﷺ), হযরত আবূ বাকর ও হযরত উমার (রাঃ)-এর যামানায় জুমআর মাত্র ১টি আযানই প্রচলিত ছিল। আর এ আযান দেওয়া হত, যখন ইমাম খুতবাহ্ দেওয়ার জন্য মিম্বরে চড়ে বসতেন তখন মসজিদের দরজার সামনে উঁচু জায়গায় দাঁড়িয়ে। এইরুপ আযান চালু ছিল হযরত আবূ বাকর, উমারের খেলাফত কাল পর্যন্ত। অতঃপর হযরত উসমান (রাঃ) মদ্বীনার বাড়ি-ঘর দূরে দূরে এবং জনসংখ্যা বেশী দেখে উক্ত আযানের পূর্বে আরো একটি অতিরিক্ত আযান চালু করলেন। যাতে লোকেরা পূর্ব থেকেই প্রস্তুতি নিয়ে জুমআর খুতবাহ্ শুনতে প্রথম থেকেই উপস্থিত হয়। আর এই আযান দেওয়া হত বাজারে যাওরা নামক একটি উঁচু ঘরের ছাদে। এ আযান শুনে লোকেরা জুমুআহর সময় উপস্থিত হয়েছে বলে জানতে পারত। এইভাবে ঐ আযান প্রচলিত থাকল। এতে কেউ তাঁর প্রতিবাদ বা সমালোচনা করল না। অথচ মিনায় (২ রাকআতের জায়গায়) ৪ রাকআত নামায পড়ার কারণে লোকেরা তাঁর সমালোচনা করেছিল। (বুখারী, সুনানু আরবাআহ (আবূ দাঊদ, তিরমিযী, নাসাঈ ও ইবনে মাজাহ্), আল-আজবিবাতুন নাফেআহ্, আন আসইলাতি লাজনাতি মাসজিদিল জামেআহ্, মুহাদ্দিস আলবানী ৮-৯পৃ:)
বলাই বাহুল্য যে, যে কাজ একজন খলীফায়ে রাশেদ করেছেন তা বিদআত হতে পারে না। বিশেষ করে মহানবী (ﷺ)-এর বিরোধিতা নেই যেখানে সেখানে সাহাবীর ইজতিহাদ ও আমল আমাদের জন্যও সুন্নত। কেননা, মহানবী (ﷺ) বলেন, “তোমাদের মধ্যে যে আমার পরে জীবিত থাকবে, সে বহু মতভেদ দেখতে পাবে। অতএব তোমরা আমার সুন্নাহ্ (পথ ও আদর্শ) এবং আমার পরবর্তী সুপথপ্রাপ্ত খুলাফায়ে রাশেদ্বীনের সুন্নাহ্ অবলম্বন করো। তা দৃঢ়ভাবে ধারণ করো, দাঁতে কামড়ে ধরো। আর দ্বীনে নবরচিত কর্ম থেকে সাবধান থেকো। কারণ প্রত্যেক নবরচিত (দ্বীনী) কর্মই হল ‘বিদআত’। আর প্রত্যেক বিদআতই হল ভ্রষ্টতা।” (আহমাদ, মুসনাদ, আবূদাঊদ, সুনান ৪৬০৭, তিরমিযী, সুনান ২৮১৫ নং, ইবনে মাজাহ্, সুনান, মিশকাত ১৬৫নং) (মাজাল্লাতুল বুহূসিল ইসলামিয়্যাহ্ ১৫/৭৫)
অতএব যদি অনুরুপ প্রয়োজন বোধ করে মাঠে-ঘাটে ও অফিসে-বাজারে সর্বসাধারণকে জুমআর জন্য প্রস্তুত হওয়ার কথা জানানো একান্ত জরুরী হয়েই থাকে, তাহলে তৃতীয় খলীফার সে সুন্নত ব্যবহার করতে আমাদের বাধা কোথায়?
পক্ষান্তরে বিদআত ও বাধা হল, একই উদ্দেশ্যে এর পরিবর্তে অন্য কিছু ব্যবহার করা। যেমন, মাইকে জুমআর সময় বলে দেওয়া, ওযূ-গোসল সেরে মসজিদে আসতে অনুরোধ করা, সূরা জুমআর শেষ ৩টি আয়াত পাঠ করা, গজল পড়া, বেল বা ঘন্টা বাজানো ইত্যাদি। (ফাতাওয়া ইসলামিয়্যাহ্, সঊদী উলামা-কমিটি ১/৪১১, ৪২১)
অবশ্য এই আযান দিতে হবে খুতবার আযানের সময়ের যথেষ্ট পূর্বে। নচেৎ, আযানের প্রধান উদ্দেশ্যই বাতিল হয়ে যাবে। যেমন ৫ বা ১০ মিনিট আগে হলে তাতে তেমন কিছু লাভ পরিলক্ষিত হবে না। অন্ততঃপক্ষে আধা থেকে এক ঘন্টা আগে হলে তবেই উদ্দেশ্য সফল হবে।
উল্লেখ্য যে, জুমআর দিন (খুতবার আগে দ্বিতীয়) আযান হওয়ার পর বেচা-কেনা (অনুরুপ সফর করা) হারাম হয়ে যায়। কারণ, মহান আল্লাহর আদেশ হল, “হে ঈমানদারগণ! যখন জুমআর দিন নামাযের জন্য আহবান করা হবে, তখন তোমরা সত্বর আল্লাহর স্মরণের জন্য উপস্থিত হও এবং ক্রয়-বিক্রয় বর্জন কর। এটিই তোমাদের জন্য কল্যাণকর, যদি তোমরা উপলব্ধি কর।” (কুরআন মাজীদ ৬২/৯)
দ্বিতীয় আযান (মাইকে হলেও) দেওয়া উচিৎ মসজিদের সামনে কোন উঁচু জায়গায়। এ আযান মসজিদের ভিতরে মিম্বরের সামনে দেওয়া বিদআত। (আল-আজবিবাতুন নাফেআহ্, আন আসইলাতি লাজনাতি মাসজিদিল জামেআহ্, মুহাদ্দিস আলবানী ১৪-১৯পৃ:)
জুমআর খুতবার দুটি অংশ। প্রথম অংশটি প্রথম খুতবা এবং শেষ অংশটি দ্বিতীয় খুতবা নামে প্রসিদ্ধ। খুতবাহ্ মানে হল ভাষণ বা বক্তৃতা। এই ভাষণ দেওয়া ও শোনার বহু নিয়ম-নীতি আছে। যার কিছু নিম্নরুপ :-
খুতবার জন্য ওযূ হওয়া শর্ত নয়। তবে খুতবার পরেই যেহেতু নামায, তাই ওযু থাকা বাঞ্ছনীয়। খুতবা চলাকালে খতীবের ওযূ নষ্ট হলে খুতবার পর তিনি ওযূ করবেন এবং সে পর্যন্ত লোকেরা অপেক্ষা করবে। (ফাতাওয়া নূরুন আলাদ দার্ব, ইবনে উষাইমীন ১/২০৮)
খুতবা পরিবেশিত হবে দন্ডায়মান অবস্থায়। বিনা ওজরে বসে জুমআর খুতবা সহীহ নয়।
মহানবী (ﷺ) খুতবায় দাঁড়াবার সময় লাঠি অথবা ধনুকের উপর ভর দিয়ে দাঁড়াতেন। (আবূদাঊদ, সুনান ১০৯৬নং) অবশ্য অনেকে বলেন, এ ছিল মিম্বর বানানোর পূর্বে। অল্লাহু আ’লাম।
মহানবী (ﷺ)-এর অধিকাংশ সময়ে মাথায় পাগড়ী ব্যবহার করতেন। সুতরাং যারা পাগড়ী ব্যবহার করে না তাদের বিশেষ করে জুমুআহ বা খুতবার জন্য পাগড়ী ব্যবহার করা বিদআত। (আল-আজবিবাতুন নাফেআহ্, আন আসইলাতি লাজনাতি মাসজিদিল জামেআহ্, মুহাদ্দিস আলবানী ৬৭পৃ:)
জুমআর খুতবা হবে কোন উঁচু জায়গায় দাঁড়িয়ে। যাতে সকল নামাযীকে খতীব দেখতে পান এবং তাঁকে সকলে দেখতে পায়। এ ক্ষেত্রে ২ থাকি বা ৩ থাকি অথবা তার চেয়ে বেশী থাকির কোন প্রশ্ন নেই। আসল উদ্দেশ্য হল উঁচু জায়গা। অতঃপর সেই উঁচু জায়গায় পৌঁছনোর জন্য যতটা সিড়ির দরকার ততটা করা যাবে। এতে বাধ্যতামূলক কোন নীতি নেই। শুরুতে মহানবী (ﷺ) একটি খেজুর গাছের উপর খুতবা দিতেন। তারপর এক ছুতোর সাহাবী তাঁকে একটি মিম্বর বানিয়ে দিয়েছিলেন; যার সিড়ি ছিল ২টি। (আবূদাঊদ, সুনান ১০৮১নং) এই দুই সিড়ি চড়ে তৃতীয় (শেষ) ধাপে মহানবী (ﷺ) বসতেন। বলা বাহুল্য, তাঁর মিম্বর ছিল তিন ধাপ বিশিষ্ট। আর এটাই হল সুন্নত। (ফাতহুল বারী, ইবনে হাজার ২/৩৩১) (এবং করতে হয় মনে করে) তার বেশী ধাপ করা বিদআত। (আল-আজবিবাতুন নাফেআহ্, আন আসইলাতি লাজনাতি মাসজিদিল জামেআহ্, মুহাদ্দিস আলবানী ৬৭পৃ:)
বিশেষ করে জুমআর জন্য জুমআর দিন মিম্বরের উপর কার্পেট বিছানো বিদআত। (আল-আজবিবাতুন নাফেআহ্, আন আসইলাতি লাজনাতি মাসজিদিল জামেআহ্, মুহাদ্দিস আলবানী ৬৬পৃ:)
মিম্বরে চড়ে মহানবী (ﷺ) মুসল্লীদের উদ্দেশ্যে সালাম দিতেন। (ইবনে মাজাহ্, সুনান ১১০৯, সিলসিলাহ সহীহাহ, আলবানী ২০৭৬নং) এরপর বসে যেতেন। মুআযযিন আযান শেষ করলে উঠে দাঁড়াতেন।
আল্লাহর রসূল (ﷺ) দাঁড়িয়ে খুতবা দিতেন। তিনি খুতবায় কুরআনের আয়াত পাঠ করে লোকেদেরকে নসীহত করতেন। (মুসলিম, আবূদাঊদ, সুনান, নাসাঈ, সুনান, ইবনে মাজাহ্, সুনান)
খুতবাহ্ হবে মহান আল্লাহর প্রশংসা, মহানবীর নবুওয়াতের সাক্ষ্য, আল্লাহর তাওহীদের গুরুত্ব, ঈমান ও ইসলামের শাখা-প্রশাখার আলোচনা, হালাল ও হারামের বিভিন্ন আহ্কাম, কুরআন মাজীদের কিছু সূরা বা আয়াত পাঠ, লোকেদের জন্য উপদেশ, আদেশ-নিষেধ বা ওয়ায-নসীহত এবং মুসলিম সর্বসাধারণের জন্য দুআ সম্বলিত।
মহানবী (ﷺ) বলেন, “যে খুতবায় তাশাহহুদ, শাহাদত বা আল্লাহর তাওহীদের ও রসূলের রিসালাতের সাক্ষ্য থাকে না, তা কাটা হাতের মত (ঠুঁটো)।” (আবূদাঊদ, সুনান ৪৮৪১, জামে ৪৫২০নং)
তাঁর খুতবার ভূমিকায় মহানবী (ﷺ) যা পাঠ করতেন তা বক্ষ্যমাণ পুস্তকের (প্রথম খন্ডের) ভূমিকায় উল্লেখ করা হয়েছে। ঐ খুতবা পাঠ করার পর তিনি ‘আম্মা বা’দ’ (অতঃপর) বলতেন।
কখনো কখনো মহানবী ঐ খুতবায় উল্লেখিত আয়াত ৩টি পাঠ করতেন না। কখনো কখনো আম্মা বা’দের পর বলতেন,
فإن خير الحديث كتاب الله، وخير الهدي هدي محمد (ﷺ)، وشر الأمور محدثاتها،
وكل محدثة بدعة، وكل بدعة ضلالة، وكل ضلالة في النار।
অর্থাৎ, অতঃপর নিশ্চয়ই সর্বশ্রেষ্ঠ বাণী আল্লাহর গ্রন্থ। সর্বশ্রেষ্ঠ হেদায়াত মুহাম্মাদ (ﷺ)-এর হেদায়াত। আর সর্বনিকৃষ্ট কর্ম হল নব রচিত কর্ম। প্রত্যেক নব রচিত কর্মই বিদআত। প্রত্যেক বিদআতই ভ্রষ্টতা এবং প্রত্যেক ভ্রষ্টতা দোযখে। (তামামুল মিন্নাহ্, আলবানী ৩৩৪-৩৩৫পৃ:)
তিনি খুতবায় সূরা ক্বাফ এত বেশী পাঠ করতেন যে, উম্মে হিশাম (রাঃ) প্রায় জুমআতে আল্লাহর রসূল (ﷺ)-কে মিম্বরের উপরে পাঠ করতে শুনে তা মুখস্থ করে ফেলেছিলেন। (আহমাদ, মুসনাদ, মুসলিম, সহীহ ৮৭২-৮৭৩নং, আবূদাঊদ, সুনান, নাসাঈ, সুনান)
তারপর একটি খুতবা দিয়ে একটু বসতেন।
এ বৈঠকে পঠনীয় কোন দুআ বা যিক্র নেই। খতীব বা মুক্তাদী সকলের জন্যই এ সময়ে সূরা ইখলাস পাঠ করা বিদআত। (মু’জামুল বিদা’ ১২২পৃ:) মহানবী (ﷺ) বসে কোন কথা বলতেন না। অতঃপর উঠে দ্বিতীয় খুতবা দিতেন। (বুখারী, মুসলিম, আবূদাঊদ, সুনান ১০৯২, ১০৯৫নং)
এই সময় (দুই খুতবার মাঝে) কারো দুআ করা এবং তার জন্য হাত তোলা বিধেয় নয়। (আল-আজবিবাতুন নাফেআহ্, আন আসইলাতি লাজনাতি মাসজিদিল জামেআহ্, মুহাদ্দিস আলবানী ৭০পৃ:)
তাঁর উভয় খুতবাতেই নসীহত হত। সুতরাং একটি খুতবাতে কেবল ক্বিরাআত এবং অপর খুতবাতে কেবল নসীহত, অথবা একটি খুতবাতে নসীহত এবং অপরটিতে কেবল দুআ করা সঠিক নয়। (আল-আজবিবাতুন নাফেআহ্, আন আসইলাতি লাজনাতি মাসজিদিল জামেআহ্, মুহাদ্দিস আলবানী ৭১পৃ:)
খুতবা হবে সংক্ষেপ অথচ ব্যাপক বিষয়ভিত্তিক। মহানবী (ﷺ)-এর খুতবা এবং নামায মাঝামাঝি ধরনের হত। (মুসলিম, সহীহ ৮৬৬, আহমাদ, মুসনাদ ১১০১, তিরমিযী, সুনান, নাসাঈ, সুনান, ইবনে মাজাহ্, সুনান) তিনি বলতেন, “(খতীব) মানুষের নামায লম্বা এবং খুতবা সংক্ষিপ্ত হওয়া তার দ্বীনী জ্ঞান থাকার পরিচয়। সুতরাং তোমরা নামাযকে লম্বা এবং খুতবাকে সংক্ষেপ কর।” (আহমাদ, মুসনাদ, মুসলিম, সহীহ ৮৬৯নং) হযরত আম্মার বিন ইয়াসির (রাঃ) বলেন, ‘আল্লাহর রসূল (ﷺ) আমাদেরকে খুতবা ছোট করতে আদেশ দিয়েছেন।’ (আবূদাঊদ, সুনান ১১০৬নং)
জুমআর খুতবার জন্য বিশেষ প্রস্তুতি নেওয়া এবং উচ্চস্বরে প্রভাবশালী ও হৃদয় গ্রাহী ভাষা ব্যবহার করে পরিবেশের বর্তমান প্রেক্ষাপট ও পরিস্থিতি সামনে রেখে ভাষণ দান করা খতীবের কর্তব্য। মহানবী (ﷺ) যখন খুতবা দিতেন, তখন তাঁর চোখ লাল হয়ে যেত, তাঁর কণ্ঠস্বর উঁচু হত এবং তাঁর ক্রোধ বেড়ে যেত; যেন তিনি লোকেদেরকে এমন এক সেনাবাহিনী সম্পর্কে সতর্ক করছেন, যা আজই সন্ধ্যা অথবা সকালে তাদেরকে এসে আক্রমণ করবে। (মুসলিম, ইবনে মাজাহ্, সুনান)
গান গাওয়ার মত সুর করে খুতবা দেওয়া বিধেয় নয়, বরং তা বিদআত। (আল-আজবিবাতুন নাফেআহ্, আন আসইলাতি লাজনাতি মাসজিদিল জামেআহ্, মুহাদ্দিস আলবানী ৭২পৃ:)
খতীবের উচিৎ, খুতবায় দুর্বল ও জাল হাদীস ব্যবহার না করা। প্রত্যেক খুতবা প্রস্তুত করার সময় ছাঁকা ও গবেষণালব্ধ কথা বেছে নেওয়া উচিৎ।
জুমুআহবারীয় খুতবার মধ্যে খতীব মুসলিম জনসাধারণকে সহীহ আকীদাহ্ শিক্ষা দেবেন, কুসংস্কার নির্মূল করবেন, বিদআত অনুপ্রবেশ করার ব্যাপারে ও তা বর্জন করতে আহবান জানাবেন। সচ্চরিত্রতা ও শিষ্টাচারিতা শিক্ষা দেবেন। ইসলামের বিরুদ্ধে সকল প্রকার সন্দেহের নিরসন ঘটাবেন। মার্জিত ভাষায় ও ভঙ্গিমায় বাতিল মতবাদ ও বক্তৃতা-লেখনীর খন্ডন করবেন। ইসলামী ভ্রাতৃত্ববোধের ও ঐক্যের উপর বিশেষ জোর দিয়ে তার গুরুত্ব ফুটিয়ে তুলবেন ভাষণের মাধ্যমে। উদ্বুদ্ধ করবেন মযহাব, ভাষা, বর্ণ ও বংশ ভিত্তিক সকল প্রকার অন্ধ পক্ষপাতিত্ব ও তরফদারী বর্জন করতে।
মিম্বর মুসলিম জনসাধারণের। এ মিম্বরকে বিশেষ কোন রাজনৈতিক দলের জন্য ব্যবহার করা যাবে না। কোন দলেরই প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে তরফদারী করা যাবে না এতে চড়ে। খতীব সাহেব সাধারণভাবে সকলকে নসীহত করবেন। তিনি হবেন সকলের কাছে শ্রদ্ধার পাত্র। অবশ্য ইসলাম-বিরোধী কোন কথা বা কাজে তিনি কারো তোষামোদ করবেন না।
বলা বাহুল্য, মসজিদ আল্লাহর ঘর। এটা কোন মানবরচিত রাজনীতির আখড়া নয়। এখানে দ্বীন উঁচু করার কথা ছাড়া অন্য দল বা ব্যক্তিগত স্বার্থের কথা আলোচিত হবে না। মহান আল্লাহ বলেন,
وأَنَّ الْمَسَاجِدَ للهِ فَلاَ تَدْعُوْا مَعَ اللهِ أَحَداً
অর্থাৎ, আর অবশ্যই মসজিদসমূহ আল্লাহর। সুতরাং আল্লাহর সঙ্গে আর কাউকে আহবান করো না। (কুরআন মাজীদ ৭২/১৮)
খুতবা দানে বিভিন্ন উপলক্ষ্য সামনে রাখবেন খতীব। মৌসম অনুপাতে খুতবার বিষয়বস্তু পরিবর্তন করবেন। বারো চাঁদের খুতবার মত বাঁধা-ধরা খুতবা পাঠ করেই দায় সারা করে কর্তব্য পালন করবেন না।
সপ্তাহান্তে একবার এই বক্তৃতা একটি সুবর্ণ সুযোগ দ্বীনের আহ্বায়কের জন্য। যেহেতু এই দিনে নামাযী-বেনামাযী, আমীর-গরীব, মুমিন-মুনাফিক এবং অনেক সময় মুসলিম নামধারী নাস্তিকও কোন স্বার্থের খাতিরে উপস্থিত হয়ে থাকে। সুতরাং এই সুযোগের সদ্ব্যবহার করে সকলের কাছে আল্লাহর বিধান পৌঁছে দেওয়া খতীবের কর্তব্য।
খুতবায় হাত তুলে দুআ বিধেয় নয়। (আল-আজবিবাতুন নাফেআহ্, আন আসইলাতি লাজনাতি মাসজিদিল জামেআহ্, মুহাদ্দিস আলবানী ৭২পৃ:) বরং এই সময় কেবল তর্জনীর ইশারায় দুআ করা বিধেয়। খতীবকে হাত তুলে দুআ করতে দেখে বহু সলফ বদ-দু’আ করতেন।
বিশর বিন মারওয়ানকে খুতবায় হাত তুলে দুআ করতে দেখে উমারাহ্ বিন রুয়াইবাহ্ বললেন, ‘ঐ হাত দুটিকে আল্লাহ বিকৃত করুন।’ (মুসলিম, সহীহ ৮৭৪, আবূদাঊদ, সুনান ১১০৪নং)
মাসরুক বলেন, ‘(জুমআর দিন ইমাম-মুক্তাদী মিলে যারা হাত তুলে দুআ করে) আল্লাহ তাদের হাত কেটে নিন।’ (ইবনে আবী শাইবা ৫৪৯১ ও ৫৪৯৩ নং)
বিধেয় নয় মুক্তাদীদের হাত তুলে দুআ। (আল-আজবিবাতুন নাফেআহ্, আন আসইলাতি লাজনাতি মাসজিদিল জামেআহ্, মুহাদ্দিস আলবানী ৭৩পৃ:) বরং ইমাম খুতবায় (হাত না তুলে) দুআ করলে, মুক্তাদীহাত না তুলেই একাকী নিম্নস্বরে বা চুপে-চুপে ‘আমীন’ বলবে। (ফাতাওয়া ইসলামিয়্যাহ্, সঊদী উলামা-কমিটি ১/৪২৭, ৪২৮)
হ্যাঁ, খুতবায় বৃষ্টি প্রার্থনা বা বৃষ্টি বন্ধ করার জন্য দুআ করার সময় ইমাম-মুক্তাদী সকলে হাত তুলে ইমাম দুআ করবেন এবং মুক্তাদীরা ‘আমীন-আমীন’ বলবে। (বুখারী ৯৩২, ৯৩৩, ১০১৩, ১০২৯, মুসলিম, সহীহ ৮৯৭নং)
কোন জরুরী কারণে খুতবা ত্যাগ করে প্রয়োজন সেরে পুনরায় খুতবা পূর্ণ করা খতীবের জন্য বৈধ। একদা মহানবী (ﷺ) খুতবা দিচ্ছিলেন। এমন সময় হযরত হাসান ও হুসাইন (রাঃ) পড়ে-উঠে তাঁর সামনে আসতে লাগলে তিনি মিম্বর থেকে নিচে নেমে তাঁদেরকে উপরে তুলে নিলেন। অতঃপর তিনি বললেন, “আল্লাহ তাআলা সত্যই বলেছেন,
(إنَّمَا أَمْوَالُكُمْ وَأَوْلاَدُكُمْ فِتْنَةٌ)
(অর্থাৎ, তোমাদের ধন-সম্পদ ও সন্তান-সন্ততি তোমাদের জন্য ফিতনাই তো।) আমি এদেরকে পড়ে-উঠে চলে আসতে দেখে ধৈর্য রাখতে পারলাম না। বরং খুতবা বন্ধ করে এদেরকে তুলে নিলাম।” (আহমাদ, মুসনাদ, সুনানু আরবাআহ (আবূ দাঊদ, তিরমিযী, নাসাঈ ও ইবনে মাজাহ্)
হযরত আবূ রিফাআহ্ আদাবী (রাঃ) বলেন, একদা আমি মসজিদে এসে দেখলাম নবী (ﷺ) খুতবা দিচ্ছেন। আমি বললাম, ‘হে আল্লাহর রসূল! একজন অপরিচিত বিদেশী মানুষ; যার দ্বীন সম্পর্কে কোন জ্ঞানই নেই। এক্ষণে সে জ্ঞান লাভ করতে চায়।’ তিনি খুতবা ছেড়ে দিয়ে আমার প্রতি অভিমুখ করলেন। এমনকি তিনি আমার নিকট এসে একটি কাঠের চেয়ার আনতে বললেন যার পায়া ছিল লোহার। তিনি তারই উপর বসে আমাকে দ্বীনের কথা বললেন। অতঃপর মিম্বরে এসে খুতবা পূর্ণ করলেন। (মুসলিম, সহীহ ৮৭৬নং, নাসাঈ, সুনান)
প্রকাশ থাকে যে, জরুরী মনে করে নিয়মিতভাবে إن الله وملائكته।।। এবং
اذكروا الله يذكركم।।। আয়াত পাঠ করে খুতবা শেষ করা বিদআত। (আল-আজবিবাতুন নাফেআহ্, আন আসইলাতি লাজনাতি মাসজিদিল জামেআহ্, মুহাদ্দিস আলবানী ৭৩পৃ:)
নামাযীর জন্য যথাসম্ভব ইমামের নিকটবর্তী হওয়ার চেষ্টা করা কর্তব্য। মহানবী (ﷺ) বলেন, “তোমরা আল্লাহর যিকরে উপস্থিত হও এবং ইমামের নিকটবর্তী হও। আর লোকে দূর হতে থাকলে বেহেশত প্রবেশেও দেরী হবে তার; যদিও সে বেহেশ্তে প্রবেশ করবে।” (আবূদাঊদ, সুনান ১১০৮নং)
জুমআর দিন নামাযী মসজিদে এসে যেখানে জায়গা পাবে সেখানে বসে যাবে। দেরী করে এসে (সামনের কাতারে ফাঁক থাকলেও) কাতার চিরে সামনে যাওয়া এবং তাতে অন্যান্য নামাযীদেরকে কষ্ট দেওয়া বৈধ নয়।
হযরত আব্দুল্লাহ বিন বুসর (রাঃ) কর্তৃক বর্ণিত, তিনি বলেন, কোন এক জুমআর দিনে এক ব্যক্তি লোকেদের কাতার চিরে (মসজিদের ভিতর) এল। সে সময় নবী (ﷺ) খুতবা দিচ্ছিলেন। তাকে দেখে নবী (ﷺ) বললেন, “বসে যাও, তুমি বেশ কষ্ট দিয়েছ এবং দেরী করেও এসেছ।” (আহমাদ, মুসনাদ, আবূদাঊদ, সুনান, ইবনে খুযাইমাহ্, সহীহ, ইবনে হিব্বান, সহীহ, সহিহ তারগিব ৭১৩ নং)
খুতবা চলাকালে মসজিদে উপস্থিত ব্যক্তির জন্য নামায নিষিদ্ধ। কিন্তু এই সময়ে কেউ মসজিদে প্রবেশ করলে তার জন্য হাল্কা করে ২ রাকআত নামায পড়া বিধেয়। যেমন কাউকে নামায না পড়ে বসতে দেখলে খতীবের উচিৎ তাকে ঐ নামায পড়তে আদেশ করা। খুতবা শোনা ওয়াজেব হলেও এ নামাযের গুরুত্ব দিয়েছেন খোদ মহানবী (ﷺ)। একদা খুতবা চলাকালে এক ব্যক্তি মসজিদে প্রবেশ করে বসে পড়লে তিনি তাকে বললেন, “তুমি নামায পড়েছ কি?” লোকটা বলল, না। তিনি বললেন, “ওঠ এবংহাল্কা করে ২ রাকআত পড়ে নাও।” (বুখারী ৯৩০, মুসলিম, আবূদাঊদ, সুনান ১১১৫-১১১৬, তিরমিযী, সুনান ৫১০নং) অতঃপর তিনি সকলের জন্য চিরস্থায়ী একটি বিধান দেওয়ার উদ্দেশ্যে লোকেদেরকে সম্বোধন করে বললেন, “তোমাদের কেউযখন ইমামের খুতবা দেওয়া কালীন সময়ে উপস্থিত হয়, সে যেন (সংক্ষেপে) ২ রাকআত নামায পড়ে নেয়।” (বুখারী, ১১৭০, মুসলিম, সহীহ ৮৭৫, আবূদাঊদ, সুনান ১১১৭নং)
একদা হযরত আবূ সাঈদ খুদরী (রাঃ) মসজিদ প্রবেশ করলেন। তখন মারওয়ান খুতবা দিচ্ছিলেন। তিনি নামায পড়তে শুরু করলে প্রহ্রীরা তাঁকে বসতে আদেশ করল। কিন্তু তিনি তাদের কথা না শুনেই নামায শেষ করলেন। নামায শেষে লোকেরা তাকে বলল, আল্লাহ আপনাকে রহ্ম করুন। এক্ষনি ওরা যে আপনার অপমান করত। উত্তরে তিনি বললেন, আমি সে নামায ছাড়ব কেন, যে নামায পড়তে নবী (ﷺ)-কে আদেশ করতে দেখেছি। (তিরমিযী, সুনান ৫১১নং)
বলা বাহুল্য, খুতবা শুরু হলে লাল বাতি জ্বেলে দেওয়া, অথবা কাউকে ঐ ২ রাকআত নামায পড়তে দেখে চোখ লাল করা, অথবা তার জামা ধরে টান দেওয়া, অথবা খোদ খতীব সাহেবের মানা করা সুন্নাহ্-বিরোধী তথা বিদআত কাজ।
জুমআর আযানের সময় মসজিদে এলে দাঁড়িয়ে থেকে আযানের উত্তর না দিয়ে, তাহিয়্যাতুল মাসজিদ পড়ে খুতবা শোনার জন্য বসে যাওয়া বাঞ্ছনীয়। (ফাতাওয়া ইসলামিয়্যাহ্, সঊদী উলামা-কমিটি ১/৩৩৫, ৩৪৯)
প্রকাশ থাকে যে, আযানের উত্তর দেওয়া মুস্তাহাব। (তামামুল মিন্নাহ্, আলবানী ৩৪০পৃ:) আর খুতবা শোনা ওয়াজেব। সুতরাং আযানের সময় পার করে খুতবা শুরু হলে নামায পড়া বৈধ নয়। পক্ষান্তরে তাহিয়্যাতুল মাসজিদ ওয়াজেব না হলেও ঐ সময় মহানবী (ﷺ)-এর মহা আদেশ পালন করা জরুরী।
ইমামের দিকে চেহারা করে বসা মুস্তাহাব। হযরত আব্দুল্লাহ বিন মাসঊদ (রাঃ) বলেন, ‘আল্লাহর রসূল (ﷺ) যখন মিম্বরে চড়তেন, তখন আমরা আমাদের চেহারা তাঁর দিকে ফিরিয়ে বসতাম।’ (তিরমিযী, সুনান ৫০৯নং)
পরিধানে লুঙ্গি বা লুঙ্গি জাতীয় এক কাপড় পরে খুতবা চলাকালে বসার সময় উভয় হাঁটুকে খাড়া করে রানের সাথে লাগিয়ে উভয় পা-কে দুইহাত দ্বারা জড়িয়ে ধরে অথবা কাপড় দ্বারা বেঁধে বসা বৈধ নয়। (আবূদাঊদ, সুনান ১১১০, তিরমিযী, সুনান ৫১৪নং) কারণ, এতে শরমগাহ্ প্রকাশ পাওয়ার, চট করে ঘুম চলে আসার এবং তাতে পড়ে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে তাই।
খুতবা শোনা ওয়াজেব। আর এ সময় সকল প্রকার কথাবার্তা, সালাম ও সালামের উত্তর, হাঁচির হামদের জবাব, এমনকি আপত্তিকর কাজে বাধা দেওয়াও নিষিদ্ধ।
হযরত আবূ হুরাইরা (রাঃ) হতে বর্ণিত, নবী (ﷺ) বলেন, “জুমআর দিন ইমামের খুতবা দানকালে কথা বললে তুমি অনর্থ কর্ম করলে এবং (জুমুআহ) বাতিল করলে।” (ইবনে খুযাইমাহ্, সহীহ, সহিহ তারগিব ৭১৬ নং)
উক্ত হযরত আবূ হুরাইরা (রাঃ) কর্তৃক বর্ণিত, নবী (ﷺ) বলেন, “জুমআর দিন ইমামের খুতবা দেওয়ার সময় যদি তুমি তোমার (কথা বলছে এমন) সঙ্গীকে ‘চুপ কর’ বল তাহলে তুমিও অসার কর্ম করবে।” (বুখারী ৯৩৪, মুসলিম, সহীহ ৮৫১নং, সুনানু আরবাআহ (আবূ দাঊদ, তিরমিযী, নাসাঈ ও ইবনে মাজাহ্), ইবনে খুযাইমাহ্, সহীহ)
‘অসার বা অনর্থক কর্ম করবে’ এর একাধিক ব্যাখ্যা করা হয়েছে; যেমন, তুমি জুমআর সওয়াব থেকে বঞ্চিত হবে। অথবা তোমারও কথা বলা হবে। অথবা তুমিও ভুল করবে। অথবা তোমার জুমুআহ বাতিল হয়ে যাবে। অথবা তোমার জুমুআহ যোহরে পরিণত হয়ে যাবে -ইত্যাদি। তবে বিশেষজ্ঞ উলামাদের নিকট শেষোক্ত ব্যাখ্যাই নির্ভরযোগ্য। কারণ, এরুপ ব্যাখ্যা নিম্নোক্ত হাদীসে বর্ণিত হয়েছে।
আব্দুল্লাহ বিন আম্র বিন আস (রাঃ) কর্তৃক বর্ণিত, আল্লাহর রসূল (ﷺ) বলেন, “যে ব্যক্তি জুমআর দিন গোসল করল, তার স্ত্রীর সুগন্ধি (আতর) থাকলে তা ব্যবহার করল, উত্তম লেবাস পরিধান করল, অতঃপর (মসজিদে এসে) লোকেদের কাতার চিরে (আগে অতিক্রম) করল না এবং ইমামের উপদেশ দানকালে কোন বাজে কর্ম করল না, সে ব্যক্তির জন্য তা উভয় জুমআর মধ্যবর্তী কৃত পাপের কাফফারা হয়ে যাবে। আর যে ব্যক্তি অনর্থক কর্ম করল এবং লোকেদের কাতার চিরে সামনে অতিক্রম করল সে ব্যক্তির জুমুআহ যোহরে পরিণত হয়ে যাবে।” (আবূদাঊদ, সুনান, ইবনে খুযাইমাহ্, সহীহ, সহিহ তারগিব ৭২০নং)
মহানবী (ﷺ) বলেন, “জুমআর দিন ৩ শ্রেণীর মানুষ (মসজিদে) উপস্থিত হয়। প্রথম শ্রেণীর মানুষ উপস্থিত হয়ে বাজে কথা বলে; তার সেটাই হল প্রাপ্য। দ্বিতীয় শ্রেণীর মানুষ উপস্থিত হয়ে দুআ করে; আর সে এমন লোক, যে আল্লাহর কাছে দুআ করে, আল্লাহ তার দুআ কবুল করেন অথবা না করেন। আর তৃতীয় শ্রেণীর মানুষ উপস্থিত হয়ে চুপ ও নির্বাক থাকে, কোন মুসলিমের কাঁধ ডিঙিয়ে (কাতার চিরে) আগে যায় না এবং কাউকে কোন প্রকার কষ্ট দেয় না। এই শ্রেণীর মানুষের জন্য তার ঐ কাজের ফলে তার ঐ জুমুআহ থেকে আগামী জুমুআহ পর্যন্ত বরং অতিরিক্ত ৩ দিনে (অর্থাৎ, ১০ দিনে) কৃত গুনাহর কাফফারা হবে। কেননা আল্লাহ আয্যা অজাল্ল্ বলেন, (من جاء بالحسنة فله عشر أمثالها) (অর্থাৎ, যে ব্যক্তি একটি সওয়াবের কাজ করবে, সে তার ১০ গুণ সওয়াব লাভ করবে।)” (আহমাদ, মুসনাদ, আবূদাঊদ, সুনান ১১১৩নং)
আলকামাহ্ বিন আব্দুল্লাহর সাথে তাঁর এক সাথী খুতবা চলাকালে কথা বলছিল। তিনি তাকে চুপ করতে বললেন। নামাযের পর ইবনে উমার (রাঃ)-এর কাছে এ কথা উল্লেখ করা হলে তিনি বললেন, ‘তোমার তো জুমুআহই হয়নি। আর তোমার সাথী হল একটা গাধা।’ (ইবনে আবী শাইবা ৫৩০৩নং)
প্রকাশ থাকে যে, ইমাম মিম্বরের উপর বসে থাকা অবস্থায়, অর্থাৎ খুতবা বন্ধ থাকা অবস্থায় কথা বলা অবৈধ নয়। (ফিকহুস সুন্নাহ্ উর্দু১৭৩পৃ:) যেমন ইমামের খুতবা শুরু না করা পর্যন্ত (প্রয়োজনীয়) কথাবার্তা (এমনকি আযানের সময়ও) বলা বৈধ। ষা’লাবাহ্ বিন আবী মালেক কুরাযী বলেন, হযরত উমার ও উসমানের যুগে ইমাম বের হলে আমরা নামায ত্যাগ করতাম এবং ইমাম খুতবা শুরু করলে আমরা কথা বলা ত্যাগ করতাম। (ইবনে আবী শাইবা, তামামুল মিন্নাহ্, আলবানী ৩৪০পৃ:)
খুতবা চলা অবস্থায় কেউ মসজিদ এলে মসজিদে প্রবেশ করার আগে রাস্তায় খুতবা শুনতে পেলে রাস্তাতেও কারো সঙ্গে কথা বলাও বৈধ নয়।
বৈধ নয় খুতবা চলা অবস্থায় হাতে কোন কিছু নিয়ে ফালতু খেলা করা। যেমন মিসওয়াক করা, তাসবীহ-মালা (?) নিয়ে খেলা করা, মসজিদের মেঝে, কাঁকর বা কুটো স্পর্শ করে খেলা করা ইত্যাদি। মহানবী (ﷺ) বলেন, “যে ব্যক্তি সুন্দরভাবে ওযু করে জুমআর উদ্দেশ্যে (মসজিদে) উপস্থিত হয়। অতঃপর মনোযোগ সহকারে (খুতবাহ্) শ্রবণ করে ও নীরব থাকে সেই ব্যক্তির ঐ জুমুআহ থেকে দ্বিতীয় জুমুআহর মধ্যবর্তীকালে সংঘটিত এবং অতিরিক্ত তিন দিনের পাপ মাফ করে দেওয়া হয়। আর যে ব্যক্তি (খুতবা চলাকালে) কাঁকর স্পর্শ করে সে অসার (ভুল) কাজ করে।” (মুসলিম, সহীহ ৮৫৭ নং, আবূদাঊদ, সুনান ১০৫০, তিরমিযী, সুনান, ইবনে মাজাহ্, সুনান)
খুতবা চলাকালে তন্দ্রা (ঢুল) এলে জায়গা পরিবর্তন করে বসা বিধেয়। এতে তন্দ্রা দূরীভূত হয়ে যায়। মহানবী (ﷺ) বলেন, “তোমাদের কেউমসজিদে বসে ঢুললে সে যেন তার বসার জায়গা পরিবর্তন করে অন্য জায়গায় বসে।” (আবূদাঊদ, সুনান ১১১৯ নং, তিরমিযী, সুনান, জামে ৮০৯নং)
কাউকে তার জায়গা থেকে উঠিয়ে সেখানে বসা, কেউ কোন কারণে জায়গা ছেড়ে উঠে গেলে এবং সে ফিরে আসবে ধারণা হওয়া সত্ত্বেও তার সেই জায়গায় বসা বৈধ নয়। মহানবী (ﷺ) বলেন, “যখন তোমাদের কেউ নিজ জায়গা ছেড়ে উঠে যায় এবং পরক্ষণে সে ফিরে আসে, তাহলে সেই ঐ জায়গার অধিক হ্কদার।” (আহমাদ, মুসনাদ, মুসলিম, সহীহ)
হযরত ইবনে উমার (রাঃ) কেউ তার জায়গা ছেড়ে উঠে গেলে সে জায়গায় বসতেন না। (আহমাদ, মুসনাদ, মুসলিম, সহীহ)
কিন্তু খুতবা শুনতে শুনতে ঘুম এলে (কথা না বলে) ইঙ্গিতে পাশের সাথীর সাথে জায়গা বদল করা উত্তম। যেহেতু মহানবী (ﷺ) বলেন, “যখন তোমাদের কেউ জুমআর দিন ঢুলতে শুরু করে, তখন তার উচিৎ তার সঙ্গীর জায়গায় গিয়ে বসা এবং তার সঙ্গীর উচিৎ তার ঐ জায়গায় বসা।” (বায়হাকী, জামে ৮১২নং)
জ্ঞাতব্য যে, ইমামের কলেমা অথবা দরুদ পড়ার সাথে সাথে মুসল্লীদের সমস্বরে সশব্দে তা পড়া বিদআত। (মুখালাফাত ফিত্বাহারাতি অসস্বালাহ্ ২৬৫পৃ:)
প্রকাশ থাকে যে, বিশেষ করে জুমুআহ বা ঈদের নামাযে অত্যন্ত ভিঁড়ের ফলে যদি সিজদাহ করার জায়গা না পাওয়া যায়, তাহলেও জামাআতে নামায পড়তে হবে। আর এই অবস্থায় সামনের নামাযীর পিঠে সিজদা করতে হবে। ইবনে উমার (রাঃ) বলেন, ‘নবী (ﷺ) আমাদের কাছে সিজদার সূরা পড়তেন। অতঃপর সিজদায় জায়গায় তিনি সিজদাহ করতেন এবং আমরাও সিজদাহ করতাম। এমনকি ভিঁড়ের ফলে আমাদের কেউ সিজদাহ করার মত জায়গা না পেলে অপরের (পিঠের) উপরে সিজদাহ করতাম।’ (বুখারী ১০৭৬নং)
হযরত উমার বলেন, পিঠের উপর উপর সিজদাহ করতে হবে। এই মত গ্রহণ করেছেন কুফাবাসীগণ, ইমাম আহমাদ এবং ইসহাক। পক্ষান্তরে আত্বা ও যুহ্রী বলেন, সামনের লোকের উঠা পর্যন্ত অপেক্ষা করে সে উঠে গেলে তারপর সিজদাহ করবে। আর এমত গ্রহণ করেছেন ইমাম মালেক ও অধিকাংশ উলামাগণ। (কিন্তু এর ফলে ইমামের বিরোধিতা হবে।) ইমাম বুখারীর লিখার ভঙ্গিতে বুঝা যায় যে, তিনি মনে করেন, এই অবস্থায় নামাযী নিজ সামথ্য অনুযায়ী সিজদাহ করবে। এমনকি নিজ ভায়ের পিঠে সিজদাহ করতে হলে তাও করবে। (ফাতহুল বারী, ইবনে হাজার ২/৬৫২)
অবশ্য (মাসজিদুলহারামাইনে) সামনে মহিলা পড়লে সিজদাহ না করে একটু ঝুঁকে বা ইশারায় নামায আদায় করবে।
জুমআর জমায়েত মুসলিমদের একটি প্রশিক্ষণ ক্ষেত্র। সাপ্তাহিক এই প্রশিক্ষণে মুসলিমের বিস্মৃত কথা স্মরণ হয়, চলার পথে অন্ধকারে আলোর দিশা পায়, সুন্দর চরিত্র ও ব্যবহার গড়তে সহায়তা পায়, ঈমান নবায়ন হয়, হৃদয় নরম হয়, মৃত্যু ও পরকালের স্মরণ হয়, তওবা করতে অনুপ্রাণিত হয়, ভালো কাজ করতে এবং খারাপ কাজ বর্জন করতে উৎসাহ্ পায়, ইত্যাদি।
তাই খুতবার ভূমিকা আরবীতে হওয়ার পর স্থানীয় ভাষায় বাকী খুতবা পাঠ বৈধ। যেহেতু খুতবার আসল উদ্দেশ্য হল জনসাধারণকে শরীয়তের শিক্ষা ও উপদেশ দান করা। আর তা আরবীতে হলে উদ্দেশ্য বিফল হয়। সুতরাং যে খুতবা আরবীতে হত তারই ভাবার্থ স্থানীয় ভাষায় হলে মুসলিমদেরকে সপ্তাহান্তে একবার উপদেশ ও পথ নির্দেশনা দান করার মত মহান উদ্দেশ্য সাধিত হয়। পক্ষান্তরে খুতবা নামাযের মত নয়। নামাযে অন্য ভাষা বললে নামায বাতিল। কিন্তু খুতবা তা নয়। যেমন খুতবা ছেড়ে অন্য কথা বলা যায়, নামাযে তা যায় না। ইত্যাদি। (দ্র: ফাতাওয়া ইসলামিয়্যাহ্, সঊদী উলামা-কমিটি ১/৪২২-৪২৩, মাজাল্লাতুল বুহূসিল ইসলামিয়্যাহ্ ১৫/৮৪)
পক্ষান্তরে খুতবার আগে স্থানীয় ভাষায় খুতবা দেওয়া বিধেয় নয়। কারণ, উপায় থাকতেও ডবল খুতবা হয়ে যায় তাতে। ডিষ্টার্ব হয় নামায, তেলাওয়াত ও যিক্ররত মুসল্লীদের। (মাজাল্লাতুল বুহূসিল ইসলামিয়্যাহ্ ১৭/৭১-৭২)
উল্লেখ্য যে, কোন স্থানের জামাআতে খুতবা দেওয়ার মত কোন লোক না থাকার ফলে যদি খুতবা দেওয়া না হয়, তাহলে সেই জামাআতের লোক জুমুআহ না পড়ে যোহ্র পড়বে। (ইবনে আবী শাইবা ৫২৬৯-৫২৭৬নং দ্র:)
জ্ঞাতব্য যে, যিনি খুতবা দেবেন তাঁরই নামায পড়া জরুরী নয়। যদিও সুন্নত হল খতীবেরই ইমামতি করা। (ফাতাওয়া ইসলামিয়্যাহ্, সঊদী উলামা-কমিটি ১/৪১০, ৪১৩)
জুমআর নামায ফরয ২ রাকআত। এতে ক্বিরাআত হবে জেহরী। এ নামাযে সূরা ফাতিহার পর যে কোন সূরা বা আয়াত যথানিয়মে পড়া যায়। তবুও সুন্নত হল, প্রথম রাকআতে সূরা জুমুআহ (সম্পূর্ণ) এবং দ্বিতীয় রাকআতে সূরা মুনাফিকূন (সম্পূর্ণ) পাঠ করা। (আহমাদ, মুসনাদ, মুসলিম, আবূদাঊদ, সুনান, তিরমিযী, সুনান, ইবনে মাজাহ্, সুনান) অথবা প্রথম রাকআতে সূরা জুমুআহ (সম্পূর্ণ) এবং দ্বিতীয় রাকআতে সূরা গাশিয়াহ্ পাঠ করা। (আহমাদ, মুসনাদ, মুসলিম, আবূদাঊদ, সুনান, তিরমিযী, সুনান, ইবনে মাজাহ্, সুনান) অথবা প্রথম রাকআতে সূরা আ’লা এবং দ্বিতীয় রাকআতে সূরা গাশিয়াহ্ পাঠ করা। (আহমাদ, মুসনাদ, মুসলিম, আবূদাঊদ, সুনান, তিরমিযী, সুনান, ইবনে মাজাহ্, সুনান)