আমল ও ইবাদত শুদ্ধ-অশুদ্ধ এবং তাতে সওয়াব পাওয়া-না পাওয়ার কথা নিয়তের উপর নির্ভরশীল। নিয়ত শুদ্ধ হলে আমল শুদ্ধ; নচেৎ না। প্রিয় নবী (ﷺ) বলেন, “যাবতীয় আমল নিয়তের উপর নির্ভরশীল। সুতরাং প্রত্যেক ব্যক্তির তা-ই প্রাপ্য হয়, যার সে নিয়ত করে থাকে। যে ব্যক্তির হিজরত পার্থিব কোন বিষয় লাভের উদ্দেশ্যে হয়, সে ব্যক্তির তা-ই প্রাপ্য হয়। যার হিজরত কোন মহিলাকে বিবাহ্ করার উদ্দেশ্যে হয়, তার প্রাপ্যও তাই। যে যে নিয়তে হিজরত করবে সে তাই পেয়ে থাকবে।” (বুখারী, মুসলিম, মিশকাত ১নং)
নাম নেওয়া লোক দেখানো, কোন পার্থিব স্বার্থলাভ ইত্যাদির উদ্দেশ্যে কোন আমল করা এক ফিতনা; যা কানা দাজ্জালের ফিতনা অপেক্ষা বড় ও অধিকতর ভয়ঙ্কর । একদা সাহাবীগণ কানা দাজ্জালের কথা আলোচনা করছিলেন। ইত্যবসরে আল্লাহর রসূল (ﷺ) বের হয়ে তাঁদের উদ্দেশ্যে বললেন, “ আমি কি তোমাদেরকে এমন (ফিতনার) কথা বলে দেব না, যা আমার নিকট কানা দাজ্জালের ফিতনার চেয়ে অধিকতর ভয়ানক?” সকলে বললেন, ‘অবশ্যই হে আল্লাহর রসূল!’ তিনি বললেন, “ তা হল গুপ্ত শির্ক; লোকে নামায পড়তে দাঁড়ালে তার প্রতি অন্য লোকের দৃষ্টি খেয়াল করে তার নামাযকে আরো সুন্দর বা বেশী করে পড়তে শুরু করে।” (ইবনে মাজাহ্, সুনান, বায়হাকী, সহিহ তারগিব ২৭নং)
বলাবাহুল্য, আল্লাহর সন্তুষ্টিলাভ ছাড়া অন্য কোন স্বার্থলাভের উদ্দেশ্যে কোনও আমল করলে গুপ্ত শির্ক করা হয়।
আল্লাহ তাআলা বলেন, “সুতরাং দুর্ভোগ সেই সকল নামাযীদের, যারা তাদের নামায সম্বন্ধে উদাসীন। যারা লোক দেখানোর উদ্দেশ্যে নামায পড়ে এবং গৃহ্স্থালির প্রয়োজনীয় ছোটখাটো সাহায্য দানে বিরত থাকে।” (কুরআন মাজীদ ১০৭/৪-৭)
জ্ঞাতব্য যে, প্রত্যেক ইবাদাত কবুল হওয়ার মূল বুনিয়াদ হল তাওহীদ।
অতএব মুশরিকের কোন ইবাদাত গ্রহণযোগ্য নয়। যেমন প্রত্যেক ইবাদত মঞ্জুর হওয়ার জন্য মৌলিক শর্ত হল দু’টি; নিয়তের ইখলাস বা বিশুদ্ধচিত্ততা এবং মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ (ﷺ) এর তরীকা, যা সহীহ হাদীসে বর্ণিত।
যে কোনও আমলের জন্য নিয়ত জরুরী। নিয়ত ছাড়া কোন ইবাদত বা আমল শুদ্ধ হয় না। মহানবী (ﷺ) বলেন, “আমলসমূহ তো নিয়তের উপরেই নির্ভরশীল।” (বুখারী, মুসলিম, মিশকাত ১নং)
ইমাম নওবী (রহঃ) বলেন, নিয়ত বলে মনের সংকল্পকে। (যার স্থল হল হৃদয় ও মস্তিষ্ক।) সুতরাং নামাযী নির্দিষ্ট নামাযকে তার মন-মস্তিষ্কে উপস্থিত করবে। যেমন যোহ্র, ফরয ইত্যাদি নামাযের প্রকার ও গুণ মনে মনে স্থির করবে। অতঃপর প্রথম তকবীরের সাথে সাথে (মন-মস্তিষ্কে উপস্থিতকৃত কর্ম করার) সংকল্প করবে। (রওযাতুত ত্বালেবীন ১/২২৪, সিফাতু স্বালাতিন নাবী (ﷺ), আলবানী ৮৫পৃ:)
এই সংকল্প করার জন্য নির্দিষ্ট কোন শব্দ শরীয়তে বর্ণিত হয় নি। আরবীতে বাঁধা মনগড়া নিয়ত বা নিজ ভাষায় কোন নির্দিষ্ট শব্দাবলী দ্বারা রচিত নিয়ত মুখে উচ্চারণ করা বা আওড়ানো বিদআত। (ফাতাওয়া ইসলামিয়্যাহ্, সঊদী উলামা-কমিটি ১/৩১৪, ৩১৫) সুতরাং নিয়ত করা জরুরী, কিন্তু পড়া বিদআত।
ইবনুল কাইয়েম (রহঃ) বলেন, নবী (ﷺ) যখন নামাযে দাঁড়াতেন তখন ‘আল্লাহু আকবার’ বলতেন। এর পূর্বে তিনি কিছু বলতেন না এবং মোটেই নিয়ত মুখে উচ্চারণ করতেন না। তিনি এ কথাও বলতেন না যে, (নাওয়াইতু আন) ‘উসাল্লী লিল্লাহি সালাতান---, আল্লাহর উদ্দেশ্যে অমুক নামায, কেবলাহ্ মুখে, চার রাকআত, ইমাম বা মুক্তাদী হয়ে পড়ছি।’ আর না তিনি আদায়, কাযা বা বর্তমান ফরযের কথা উল্লেখ করতেন। উক্ত ১০ প্রকার বিদআতগুলির কোন একটি শব্দও তাঁর নিকট হতে কেউই বর্ণনা করেন নি; না সহীহ সনদ দ্বারা, না যয়ীফ দ্বারা, না মুসনাদ রুপে, আর না-ই মুরসাল রুপে। বরং তাঁর কোন সাহাবী হতেও ঐ নিয়তের কথা বর্ণিত হয়নি। কোন তাবেয়ীও তা বলা উত্তম মনে করেন নি, আর না-ই চার ইমামের কেউ---। (যাদুল মাআদ ১/২০১)
তিনি অন্যত্র বলেন, নিয়ত কোন বিষয়ের উপর মনের ইচ্ছা ও সংকল্পকে বলে; যার স্থান হল অন্তর। মুখের সাথে এর আদৌ কোন সম্পর্ক নেই। এ জন্যই নবী (ﷺ) হতে, আর না তাঁর কোন সাহাবী হতে কোন প্রকার (নিয়তের) একটিও শব্দ বর্ণিত হয়নি এবং আমরা তাঁদের নিকট হতে এর কোন উল্লেখও শুনিনি। পরন্তু ঐ সমস্ত শব্দাবলী যা পবিত্রতা (ওযু-গোসল) ও নামায শুরু করার সময় (নিয়ত করার জন্য) রচনা করা হয়েছে, তা শয়তান খুঁতে লোকদের জন্য প্রতিযোগিতার ময়দানরুপে সৃষ্টি করেছে। যেখানে সে তাদেরকে আবদ্ধ করে রাখে, তাতে তাদেরকে কষ্টও দিয়ে থাকে এবং তা সহীহ-করণের পশ্চাতে তাদেরকে আপতিত করে রাখে। আপনি তাদের কাউকে দেখবেন, সে ঐ নিয়তকে মুখে বারবার আওড়াচ্ছে এবং তা উচ্চারণ করার জন্য নিজে কত কষ্ট স্বীকার করছে, অথচ তা নামাযের কোন কিছুই নয়। পক্ষান্তরে নিয়ত হল কোন কাজ করার জন্য সংকল্প করার নাম মাত্র---। (ইগাসাতুল লাহ্ফান ১/১৫৮)
আবার বাস্তব এই যে, নিয়তের এত এত শব্দ-সম্ভার দেখে অনেকে নামায শিখতেও ভয় পায়। মুখস্থ করলেও অনেকের ঐ অনর্থক বিষয়ে সময় ব্যয় করা হয় মাত্র। পক্ষান্তরে সূরা মুখস্থ করে ৩টি কি ৪টি! তাছাড়া বহু সাধারণ মানুষের নিকটেই নিয়তের শব্দাবলীতে তালগোল খেয়ে যায়। অনেকে তার অর্থই বোঝে না। অথচ অর্থ না বুঝলে নিয়ত অর্থহীন। সুতরাং যা আল্লাহ ও তাঁর রসূলের নির্দেশ নয় তার পিছনে আমরা খামাখা ছুটব কেন?
নামায পড়তে পড়তে যদি নিয়ত পরিবর্তনের দরকার হয়, তাহলে সীমাবদ্ধ কয়েকটি নামাযে তা করা যাবে। যেমন;
ফরয পড়তে পড়তে কারো প্রয়োজন হল তা নফল গণ্য করবে। এরুপ বড়র নিয়ত করে ছোটতে পরিবর্তন করতে পারে। তবে এর জন্য শর্ত এই যে, পরে যেন ঐ ফরয পড়ার মত সময় অবশিষ্ট থাকে।
অনুরুপ নির্দিষ্ট সুন্নত (মুআক্কাদাহ) পড়তে পড়তে যদি কেউ তা সাধারণ নফল গণ্য করতে চায় তাও শুদ্ধ হবে।
পক্ষান্তরে এক ফরয পড়তে পড়তে অন্য ফরযের নিয়ত করা (যেমন, আসর পড়তে পড়তে মনে পড়ল যোহ্র কাযা আছে, সুতরাং তখনই যোহরের নিয়ত করে ঐ নামাযটাকে যোহরের ধরে নেওয়া) শুদ্ধ হবে না। উভয় নামাযই বাতিল গণ্য হবে।
তদনুরুপ সাধারণ নফল পড়তে পড়তে কোন নির্দিষ্ট সুন্নত বা নফল গণ্য করাও শুদ্ধ হবে না। যেমন কোন নির্দিষ্ট সুন্নত পড়তে পড়তে অন্য কোন নির্দিষ্ট সুন্নতের (যেমন এশার সুন্নত পড়তে পড়তে বিতরের) নিয়ত করা শুদ্ধ নয়। কারণ, শুরু থেকে নির্দিষ্ট নামাযের নিয়ত না হলে পূর্ণ নামায শুদ্ধ হয় না। (আলমুমতে’, শারহে ফিক্হ, ইবনে উষাইমীন ২/২৯৫-২৯৮, ফাতাওয়া ইবনে উষাইমীন ১/৪১৬)
তদ্রুপ ২ রাকআত সুন্নত পড়তে পড়তে ৪ বা ৪ রাকআত পড়তে পড়তে ২ রাকআত সুন্নতের নিয়ত শুদ্ধ নয়।
বলা বাহুল্য, তারাবীহ্র নামাযে ভুলে তৃতীয় রাকআতে উঠে গেলে মনে পড়ার সাথে সাথে বসে গিয়ে নামায পূর্ণ করে সহু সিজদাহ করতে হবে। নচেৎ ৪ রাকআতের নিয়ত করে নামায পড়লে তা বাতিল গণ্য হবে। (আলমুমতে’, শারহে ফিক্হ, ইবনে উষাইমীন ৪/১০৯-১১০)