এই নামাযের কথা উল্লেখ করত: মহান আল্লাহ তাঁর রসূল মুহাম্মাদ (ﷺ)-কে সম্বোধন করে বলেন,
(وَمِنَ اللَّيْلِ فَتَهَجَّدْ بِهِ نَافِلَةً لَّكَ، عَسَى أَنْ يَّبْعَثَكَ رَبُّكَ مَقَاماً مَّحْمُوْداً)
অর্থাৎ, রাতের কিছু অংশে তাহাজ্জুদ নামায পড়; এ তোমার জন্য একটি অতিরিক্ত কর্তব্য। আশা করা যায় তোমার প্রতিপালক তোমাকে মাকামে মাহ্মূদে (প্রশংসিত স্থানে) প্রতিষ্ঠিত করবেন। (কুরআন মাজীদ ১৭/৭৯)
“হে বস্ত্র আচ্ছাদনকারী (নবী)! উপাসনার জন্য রাত্রিতে উঠ (জাগরণ কর); রাত্রির কিছু অংশ বাদ দিয়ে; অর্ধরাত্রি অথবা তদপেক্ষা অল্প। অথবা তদপেক্ষা বেশী। কুরআন তেলাওয়াত কর ধীরে ধীরে স্পষ্ট ও সুন্দরভাবে। আমি তোমার উপর অবতীর্ণ করেছি গুরুত্বপূর্ণ বাণী। ইবাদতের জন্য রাত্রি জাগরণ গভীর অভিনিবেশ ও হৃদয়ঙ্গম করার পক্ষে অতিশয় অনুকূল।” (কুরআন মাজীদ ৭৩/১-৫)
“রাত্রিতে তাঁর প্রতি সিজদাবনত হও এবং রাত্রির দীর্ঘ সময় তাঁর পবিত্রতা ও মহিমা ঘোষণা কর।” (কুরআন মাজীদ ৭৬/২৬)
এ সম্বোধন মহানবীর জন্য হলেও তাঁর অনুসরণ করতে মুসলিম উম্মাহ্ অনুপ্রাণিত হয়েছে। যাঁরা তাহাজ্জুদ পড়েন, তাঁরা অবশ্যই সৎলোক, মহান আল্লাহর কৃপা ও অনুগ্রহের অধিকারী। মহান আল্লাহ বলেন,
(إِنَّ الْمُتَّقِيْنَ فِيْ جَنَّاتٍ وَّعُيُوْنٍ آخِذِيْنَ مَا آتَاهُمْ رَبُّهُمْ إِنَّهُمْ كَانُوْا قَبْلَ ذَلِكَ مُحْسِنِيْنَ، كَانُوْا قَلِيْلاً مِّنَ اللَّيْلِ مَا يَهْجَعُوْنَ، وَبِالأَسْحَارِ هُمْ يَسْتَغْفِرُوْنَ)
অর্থাৎ, নিশ্চয়ই পরহেযগারগণ বেহেশত ও প্রসবণে অবস্থান করবে। তাদের প্রতিপালক তাদেরকে যা দেবেন তা উপভোগ করবে। কারণ, পার্থিব জীবনে তারা ছিল সৎকর্মপরায়ণ। তারা রাত্রির সামান্য অংশই নিদ্রায় অতিবাহিত করত। রাত্রির শেষ প্রহ্রে তারা ক্ষমা প্রার্থনা করত। (কুরআন মাজীদ ৫১/১৫-১৮)
রাত্রি জাগরণ করে ইবাদত করা রহ্মানের বান্দাগণের গুণ। তিনি বলেন,
(وَعِبَادُ الرَّحْمنِ الَّذِيْنَ يَمْشُوْنَ عَلَى الأَرْضِ هَوْناً، وَإِذَا خَاطَبَهُمُ الْجَاهِلُوْنَ قَالُوْا سَلاَماً، وَالَّذِيْنَ يَبِيْتُوْنَ لِرَبِّهِمْ سُجَّداً وَّقِيَاماً)
অর্থাৎ, রহ্মানের বান্দা তারা, যারা ভূপৃষ্ঠে নম্রভাবে চলাফেরা করে এবং তাদেরকে যখন অজ্ঞ ব্যক্তিরা সম্বোধন করে তখন তারা প্রশান্তভাবে জবাব দেয়। আর তারা তাদের প্রতিপালকের উদ্দেশ্যে সিজদাবনত হয়ে ও দন্ডায়মান থেকে রাত্রি অতিবাহিত করে। (কুরআন মাজীদ ২৫/৬৩-৬৪)
এই শ্রেণীর মানুষদের জন্য আল্লাহ ঈমানের সাক্ষ্য দিয়েছেন। তিনি বলেন,
(إِنَّمَا يُؤْمِنُ بِآيَاتِنَا الَّذِيْنَ إِذَا ذُكِّرُوْا بِهَا خَرُّوْا سُجَّداً وَّسَبَّحُوْا بِحَمْدِ رَبِّهِمْ وَهُمْ لاَ يَسْتَكْبِرُوْنَ، تَتَجَافَى جُنُوْبُهُمْ عَنِ الْمَضَاجِعِ يَدْعُوْنَ رَبَّهُمْ خَوْفاً وَّطَمَعاً وَّمِمَّا رَزَقْنَاهُمْ يُنْفِقُوْنَ، فَلاَ تَعْلَمُ نَفْسٌ مَّا أُخْفِيَ لَهُمْ مِّنْ قُرِّةِ أَعْيُنٍ، جَزَاءً بِمَا كَانُوْا يَعْمَلُوْنَ)
অর্থাৎ, কেবল তারাই আমার আয়াতসমূহের প্রতি ঈমান রাখে, যারা ওর দ্বারা উপদিষ্ট হলে সিজদায় লুটিয়ে পড়ে এবং তাদের প্রতিপালকের সপ্রশংস পবিত্রতা ও মহিমা ঘোষণা করে এবং অহংকার করে না। তারা শয্যা ত্যাগ করে আশায় ও আশংকায় তাদের প্রতিপালককে ডাকে এবং আমি তাদেরকে যে রুযী দান করেছি তা হতে তারা ব্যয় করে। কেউই জানে না তাদের জন্য তাদের কৃতকর্মের নয়ন-প্রDতিকর কি পুরস্কার রক্ষিত আছে। এ হল তাদের কৃতকর্মের প্রতিদান। (সূরা সিজদাহ ১৫-১৬ আয়াত)
তারা অবশ্যই তাঁদের মত নয়, যারা তাঁদের মত রাত্রি জাগরণ করে মহান আল্লাহর ইবাদত করে না। তিনি বলেন,
(أَمَّنْ هُوَ قَانِتٌ آنَاءَ اللَّيْلِ سَاجِداً وَّقَائِماً يَّحْذَرُ الآخِرَةَ وَيَرْجُوْ رَحْمَةَ رَبِّهِ، قُلْ هَلْ يَسْتَوِي الَّذِيْنَ يَعْلَمْوْنَ وَالَّذِيْنَ لاَ يَعْلَمُوْنَ، إِنَّمَا يَتَذَّكَّرُ أُولُو الأَلْبَابِ)
অর্থাৎ, যে ব্যক্তি রাত্রিকালে সিজদাবনত হয়ে এবং দন্ডায়মান থেকে ইবাদত করে, পরকালকে ভয় করে এবং তার প্রতিপালকের অনুগ্রহ প্রত্যাশা করে (সে কি তার সমান, যে তা করে না?) বল, যারা জানে এবং যারা জানে না তারা উভয়ে কি এক সমান? বোধশক্তিসম্পন্ন লোকেরাই কেবল উপদেশ গ্রহণ করে থাকে। (কুরআন মাজীদ ৩৯/৯)
হযরত আবু হুরাইরা (রাঃ) হতে বর্ণিত, আল্লাহর রসূল (ﷺ) বলেন, “তোমাদের মধ্যে কেউ যখন ঘুমিয়ে থাকে তখন শয়তান তার মাথার শেষাংশে (ঘাড়ে) তিনটি গাঁট মেরে দেয়। প্রত্যেক গাঁটের সময় এই মন্ত্র পড়ে অভিভূত করে দেয়, ‘তোমার এখনো লম্বা রাত বাকী। সুতরাং এখনও ঘুমাও।’ অতঃপর সে যদি জেগে আল্লাহর যিক্র করে, তবে একটি বাঁধন খুলে যায়, অতঃপর ওযু করলে আর একটি বাঁধন খুলে যায়, অতঃপর নামায পড়লে সকল বাঁধনগুলোই খুলে যায়। ফলে ফজরের সময় সে উদ্যম ও ফুর্তিভরা মন নিয়ে ওঠে। নতুবা (তাহাজ্জুদ না পড়লে) আলস্যভরা ভারী মন নিয়ে সে ফজরে উঠে।” (মালেক, মুঅত্তা, বুখারী১১৪২নং, মুসলিম, সহীহ ৭৭৬নং, আবূদাঊদ, সুনান, নাসাঈ, সুনান, ইবনে মাজাহ্, সুনান)
আবু হুরাইরা (রাঃ) হতে বর্ণিত তিনি বলেন, আল্লাহর রসূল (ﷺ) বলেছেন, “রমযানের পর সর্বশ্রেষ্ঠ রোযা হল আল্লাহর মাস মুহার্রামের রোযা। আর ফরয নামাযের পর সর্বশ্রেষ্ঠ নামায হল রাতের (তাহাজ্জুদের) নামায।” (মুসলিম, সহীহ ১১৬৩নং, আবূদাঊদ, সুনান, তিরমিযী, সুনান, নাসাঈ, সুনান, ইবনে খুযাইমাহ্, সহীহ)
হযরত আব্দুল্লাহ বিন সালাম (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি নবী (ﷺ) এর বাণী হতে সর্বপ্রথম যা শুনেছি তা হল, “হে মানুষ! তোমরা সালাম প্রচার কর, অন্নদান কর, জ্ঞাতি-বন্ধন অক্ষুন্ন রাখ এবং লোকেরা যখন ঘুমিয়ে থাকে তখন তোমরা নামায পড়। এতে তোমরা নিবিঘ্নে জান্নাতে প্রবেশ করতে পারবে।” (তিরমিযী, সুনান, ইবনে মাজাহ্, সুনান,হাকেম, মুস্তাদরাক,সহিহ তারগিব ৬১০নং)
হযরত আব্দুল্লাহ বিন আম্র (রাঃ) হতে বর্ণিত, নবী (ﷺ) বলেন, “জান্নাতের মধ্যে এমন একটি কক্ষ আছে যার বাহিরের অংশ ভিতর থেকে এবং ভিতরের অংশ বাহির থেকে দেখা যাবে।” তা শুনে আবু মালেক আশআরী (রাঃ) বললেন, ‘সে কক্ষ কার জন্য হবে, হে আল্লাহর রসূল?’ তিনি বললেন, “যে ব্যক্তি উত্তম কথা বলে, অন্নদান করে ও লোকেরা যখন ঘুমিয়ে থাকে তখন নামাযে রত হয়; তার জন্য।” (ত্বাবারানী,হাকেম, সহীহ তারগীব ৬১১নং)
হযরত জাবের (রাঃ) প্রমুখাৎ বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি আল্লাহর রসূল (ﷺ) কে বলতে শুনেছি, তিনি বলেছেন, “রাত্রিকালে এমন এক মুহূর্ত রয়েছে যখনই তা লাভ করে মুসলিম ব্যক্তি ইহ্-পরকালের কোন কল্যাণ আল্লাহর নিকট প্রার্থনা করে তখনই তিনি তাকে তা প্রদান করে থাকেন। অনুরুপ প্রত্যেক রাত্রিতেই ঐ মুহূর্ত আবির্ভূত হয়ে থাকে।” (মুসলিম, সহীহ ৭৫৭নং)
হযরত আবু উমামাহ্ বাহে লী (রাঃ) হতে বর্ণিত, আল্লাহর রসূল (ﷺ) বলেন, তোমরা তাহাজ্জুদের নামাযে অভ্যাসী হও। কারণ, তা তোমাদের পূর্বতন নেক বান্দাদের অভ্যাস; তোমাদের প্রভুর নৈকট্যদানকারী ও পাপক্ষালনকারী এবং গুনাহ হতে বিরতকারী আমল।” (তিরমিযী, ইবনে আবি নয়্যা, ইবনে খুযাইমাহ্,হাকেম, সহীহ তারগীব ৬১৮ নং)
হযরত আবু হুরাইরা (রাঃ) ও আবু সাঈদ খুদরী (রাঃ) হতে বর্ণিত, তাঁরা বলেন, আল্লাহর রসূল (ﷺ) বলেছেন, “কোন ব্যক্তি যখন তার স্ত্রীকে রাত্রে ঘুম থেকে জাগিয়ে উভয়ে তাহাজ্জুদের নামায পড়ে অথবা দুই রাকাআত নামায পড়ে তখন তাদের প্রত্যেকের নাম (আল্লাহর) যিক্রকারী ও যিক্রকারিণীদের তালিকাভুক্ত হয়।” (আবূদাঊদ, সুনান, নাসাঈ, সুনান, ইবনে মাজাহ্, সুনান, ইবনে হিব্বান, সহীহ,হাকেম, মুস্তাদরাক সহিহ তারগিব ৬২০ নং)
হযরত আবু দারদা (রাঃ) কর্তৃক বর্ণিত, নবী (ﷺ) বলেন, “তিন ব্যক্তিকে আল্লাহ ভালোবাসেন, তাদের প্রতি (সন্তুষ্ট হয়ে) হাসেন এবং তাদের কারণে খুশী হন; (প্রথম) সেই ব্যক্তি যার নিকট স্বদলের পরাজয় প্রকাশ পেলে নিজের জান দিয়ে আল্লাহ আয্যা অজাল্লার ওয়াস্তে যুদ্ধ করে। এতে সে হয় শহীদ হয়ে যায় নতুবা আল্লাহ তাকে সাহায্য (বিজয়ী) করেন ও তিনিই তার জন্য যথেষ্ট হন। তখন আল্লাহ বলেন, ‘আমার এই বান্দাকে তোমরা লক্ষ্য কর, আমার জন্য নিজের প্রাণ দিয়ে কেমন ধৈর্য ধরেছে?’
(দ্বিতীয়) সেই ব্যক্তি যার আছে সুন্দরী স্ত্রী এবং নরম ও সুন্দর বিছানা। কিন্তু সে (এসব ত্যাগ করে) রাত্রে উঠে নামায পড়ে। এর জন্য আল্লাহ বলেন, ‘সে নিজের প্রবৃত্তিকে দমন করে আমাকে স্মরণ করছে, অথচ ইচ্ছা করলে সে নিদ্রা উপভোগ করতে পারত।’
আর (তৃতীয়) সেই ব্যক্তি যে সফরে থাকে। তার সঙ্গে থাকে কাফেলা। কিছু রাত্রি জাগরণ করে সকলে ঘুমেঢলে পড়ে। কিন্তু সে শেষরাত্রে উঠে কষ্ট ও আরামের সময় নামায পড়ে।” (ত্বাবারানী কাবীর, সহীহ তারগীব ৬২৩ নং)
হযরত আব্দুল্লাহ বিন আম্র বিন আস (রাঃ) কর্তৃক বর্ণিত, তিনি বলেন, আল্লাহর রসূল (ﷺ) বলেছেন, “যে ব্যক্তি ১০টি আয়াত নামাযে পড়ে সে উদাসীনদের তালিকাভুক্ত হয় না, যে ১০০টি আয়াত নামাযে পড়ে সে আবেদদের তালিকাভুক্ত হয়। আর যে ১০০০টি আয়াত নামাযে পড়ে সে অজস্র সওয়াব অর্জনকারীদের তালিকাভুক্ত হয়।” (আবু দাঊদ, ইবনে খুযাইমাহ্, সহীহ তারগীব ৬৩৩ নং)
মহানবী (ﷺ) বলেন, “আমার কাছে জিবরীল এসে বললেন, হে মুহাম্মাদ! যত ইচ্ছা বেঁচে থাকুন, আপনি মারা যাবেনই। যাকে ইচ্ছা ভালো বাসুন, আপনি তার কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন হবেন। যা ইচ্ছা তাই আমল করুন, আপনি তার বদলা পাবেন। আর জেনে রাখুন, মুমিনের মর্যাদা হল তাহাজ্জুদের নামাযে এবং তার ইজ্জত হল লোকেদের অমুখাপেক্ষী থাকায়।” (ত্বাবরানী, হাকেম, মুস্তাদরাক, বায়হাকী, সিলসিলাহ সহীহাহ, আলবানী ৮৩১নং)
হযরত আবূ হুরাইরা (রাঃ) বলেন, এক ব্যক্তি নবী (ﷺ)-এর কাছে বলল, ‘অমুক রাত্রে (তাহাজ্জুদের) নামায পড়ে। কিন্তু সকাল হলে (দিনে) চুরি করে!?’ এ কথা শুনে তিনি বললেন, “ঐ নামায তাকে তুমি যা বলছ তাতে (চুরিতে) বাধা দেবে।” (আহমাদ, মুসনাদ, বায়হাকী শুআবুল ঈমান, মিশকাত ১২৩৭নং, সহীহ, সিলসিলাহ যায়ীফাহ, আলবানী ১/৫৭-৫৮ দ্র:)