নিম্নে আপনার দুটি প্রশ্নের উত্তর দেওয়া হলো:
১. আপনার স্বামীর উক্ত কথাটি পরিপূর্ণ সঠিক নয়। অর্থাৎ স্বামীকে দ্বিতীয় বিয়ে করতে না দেওয়াই সংসার ভাঙ্গার একমাত্র কারণ নয়। তবে অনেকগুলো কারণের মধ্যে এটিও একটি কারণ।
নিম্নে সংসার ভঙ্গের কিছু উল্লেখযোগ্য কারণ উল্লেখ করা হলো:
মূলত সংসার ভঙ্গের পেছনে বিভিন্ন কারণ থাকে। কখনো স্বামীর কারণে, কখনো স্ত্রীর কারণে আবার কখনো উভয়ের কারণে দাম্পত্য জীবনের পরিসমাপ্তি ঘটতে পারে।
ক. স্বামীর পক্ষ থেকে যে সব কারণে সংসার ভাঙ্গতে পারে:
অনেক সময় স্বামীর পক্ষ থেকে স্ত্রী বা স্ত্রীর পরিবারের প্রতি খারাপ ব্যবহার, স্ত্রীকে অবজ্ঞা ও তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করা, তার প্রতি শারীরিক বা মানসিক জুলুম-নির্যাতন করা, তার প্রাপ্য হক আদায় না করা, তার সাথে প্রতারণা ও বিশ্বাসঘাতকতা করা, পরকীয়ায় লিপ্ত থাকা, শারীরিক অক্ষমতা, মাদকাসক্তি ও নেশা গ্রহণ, এমন কোনও বদ অভ্যাস বা শারীরিক সমস্যা থাকা যা স্ত্রী কোনোভাবেই মেনে নিতে পারে না। ইত্যাদি নানা কারণে সংসার ভেঙ্গে যেতে পারে।
খ. স্ত্রীর পক্ষ থেকে যে সব কারণে সংসার ভাঙ্গতে পারে:
অনেক সময় স্ত্রীর পক্ষ থেকে স্বামী বা তার পরিবারের প্রতি খারাপ ব্যবহার, স্বামীর আনুগত্যহীনতা, বিলাসিতা ও উচ্চমাত্রায় ভোগের মনোভাব, অসহিষ্ণু আচরণ, ঝগড়া-ঝাটি করা, পরকীয়ার সম্পর্ক থাকা ইত্যাদি কারণে সংসার ভাঙ্গে।
আবার অনেক মেয়ে বিয়ের আগে মনের মধ্যে স্বামী সম্পর্কে আকাশ-কুসুম কল্পনা করে কিন্তু বাস্তবে তেমন না পেলে স্বপ্ন ভঙ্গ হয়। এতেও অনেক সময় সংসার ভেঙ্গে যেতে পারে। তার মধ্যে জটিল কোন রোগ-ব্যাধিও সংসার ভাঙ্গার কারণ হয়। আবার স্বামীর প্রয়োজন থাকা সত্ত্বেও তাকে দ্বিতীয় বিয়ে করতে বাধা দেওয়াও সংসার ভাঙ্গার অন্যতম কারণ হতে পারে।
গ. উভয়ের পক্ষ থেকে যে সব কারণে সংসার ভাঙ্গতে পারে:
স্বামী-স্ত্রী উভয়ের পক্ষ থেকেও কিছু কারণে সংসার ভাঙ্গতে পারে। যেমন: বিয়ের পর সঙ্গীর প্রতি ভালোবাসা কমে যাওয়া বা একে অপরের প্রতি আকর্ষণ বোধ না থাকা, (অবশ্য এর পেছনেও উপরোক্ত কিছু কারণ দায়ী) কোনোভাবেই মন-মানসিকতার দিক থেকে তাদের মাঝে মিলমিশ না হওয়া, ধৈর্যহীনতা, অতিরিক্ত রাগ, দাম্পত্য জীবনের ব্যক্তিগত বিষয়ে তৃতীয় পক্ষকে হস্তক্ষেপ করার সুযোগ দেওয়া, রূপ-সৌন্দর্য, স্মার্টনেস, শিক্ষাগত যোগ্যতা ইত্যাদি কারণে অহংকার করা ইত্যাদি।
এ ছাড়াও স্বামী কিংবা স্ত্রী যদি এমন সব পাপাচারে লিপ্ত হয় যাতে তাদের উপর থেকে আল্লাহর রহমত ও বরকত উঠে যায়, তাদের মাঝে শয়তান অনুপ্রবেশ করে এবং আল্লাহ তাদের উপর ক্রোধান্বিত হন। ফলে তাদের দাম্পত্য জীবনে নেমে আসে অশান্তি এবং বিশৃঙ্খলা। যা শেষ পর্যন্ত সংসার ভাঙ্গা পর্যন্ত গড়ায়। আল্লাহ ক্ষমা করুন। আমিন।
২. স্বামী দ্বিতীয় বিয়ে করতে চাইলে শরিয়তের দৃষ্টিতে স্ত্রীর করণীয় কী?
কোন স্বামী যদি একাধিক বিয়ের ইচ্ছে করে বা তার একাধিক বিয়ে করা তার জন্য প্রয়োজনীয় হয় তাহলে কোন স্ত্রীর জন্য তাতে বাধা দেওয়া বা এ ক্ষেত্রে তাকে হুমকি-ধমকি দেওয়া বা শারীরিক-মানসিক ইত্যাদি কোনোভাবে কষ্ট দেওয়া শরিয়ত সম্মত নয়। কারণ এই অধিকার স্বয়ং আল্লাহ তায়ালা তাকে দিয়েছেন। মহান আল্লাহ বলেন,
وَإِنۡ خِفۡتُمۡ أَلَّا تُقۡسِطُواْ فِي ٱلۡيَتَٰمَىٰ فَٱنكِحُواْ مَا طَابَ لَكُم مِّنَ ٱلنِّسَآءِ مَثۡنَىٰ وَثُلَٰثَ وَرُبَٰعَۖ فَإِنۡ خِفۡتُمۡ أَلَّا تَعۡدِلُواْ فَوَٰحِدَةً أَوۡ مَا مَلَكَتۡ أَيۡمَٰنُكُمۡۚ ذَٰلِكَ أَدۡنَىٰٓ أَلَّا تَعُولُواْ
"তাহলে তোমরা নারীদের মধ্যে যাকে তোমাদের ভালো লাগে, দুই, তিন বা চার বিয়ে করো। আর যদি আশংকা কর যে সুবিচার করতে পারবে না তবে একজনকেই বা তোমাদের অধিকারভুক্ত দাসীকেই গ্রহণ কর। এতে পক্ষপাতিত্ব না করার সম্ভাবনা বেশি।" [সূরা নিসা: ৩]
সুতরাং এ ক্ষেত্রে বাধা দেওয়া আল্লাহ প্রদত্ত অধিকারে হস্তক্ষেপের শামিল-যা মারাত্মক অন্যায়।
তবে হ্যাঁ, একাধিক বিয়ের জন্য পুরুষের শারীরিক ও আর্থিক সক্ষমতা থাকা এবং স্ত্রীদের মধ্যে সমতা রক্ষা করার শর্তারোপ করা হয়েছে। কোনও ব্যক্তি যদি এই শর্ত পালন করতে সক্ষম হবে না বলে মনে করে তাহলে তার জন্য একাধিক বিয়ে করা হারাম।
স্বামী যদি দ্বিতীয় বিয়ে করে তাহলে স্ত্রী এ ক্ষেত্রে আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য ধৈর্য ধারণ করবে। কোনভাবেই ধৈর্যধারণ সম্ভব না হলে সে খোলা তালাকের মাধ্যমে সংসার ত্যাগ করবে। কিন্তু কোন অবস্থাতেই এই কারণে স্বামীর সাথে খারাপ ব্যবহার করা বা তাকে কোনভাবেই কষ্ট দেওয়া জায়েজ নেই। কারণ ইসলামে কোন মুসলিমকে কষ্ট দেওয়া গালাগালি করা হারাম ও কাবিরা গুনাহ। আর তা যদি হয় স্বামীর সাথে তাহলে তা আরও বেশি গর্হিত কাজ। কারণ মহান আল্লাহ স্বামীকে অনেক বেশি মর্যাদা দিয়েছেন। যেমন আল্লাহ বলেন,
ٱلرِّجَالُ قَوَّٰمُونَ عَلَى ٱلنِّسَآءِ بِمَا فَضَّلَ ٱللَّهُ بَعۡضَهُمۡ عَلَىٰ بَعۡضٖ وَبِمَآ أَنفَقُواْ مِنۡ أَمۡوَٰلِهِمۡۚ فَٱلصَّٰلِحَٰتُ قَٰنِتَٰتٌ حَٰفِظَٰتٞ لِّلۡغَيۡبِ بِمَا حَفِظَ ٱللَّهُۚ وَٱلَّٰتِي تَخَافُونَ نُشُوزَهُنَّ فَعِظُوهُنَّ وَٱهۡجُرُوهُنَّ فِي ٱلۡمَضَاجِعِ وَٱضۡرِبُوهُنَّۖ فَإِنۡ أَطَعۡنَكُمۡ فَلَا تَبۡغُواْ عَلَيۡهِنَّ سَبِيلًاۗ إِنَّ ٱللَّهَ كَانَ عَلِيّٗا كَبِيرٗا
"পুরুষরা নারীদের কর্তা। কারণ আল্লাহ তাদের এককে অপরের উপর শ্রেষ্ঠত্ব দিয়েছেন এবং এজন্যে যে, পুরুষ তাদের ধন-সম্পদ ব্যয় করে। কাজেই পূণ্যশীলা স্ত্রীরা অনুগতা এবং লোকচক্ষুর আড়ালে আল্লাহর হেফাজতে তারা হেফাজত করে।
আর স্ত্রীদের মধ্যে যাদের অবাধ্যতার আশংকা কর তাদেরকে সদুপদেশ দাও, তারপর তাদের শয্যা বর্জন কর এবং তাদেরকে প্রহার কর । যদি তারা তোমাদের অনুগত হয় তবে তাদের বিরুদ্ধে কোনো পথ অন্বেষণ করো না । নিশ্চয় আল্লাহ শ্রেষ্ঠ, মহান।" [সূরা নিসা: ৩৪]
হাদিস সে বলা হয়েছে যে, পৃথিবীতে যদি আল্লাহ ছাড়া অন্য কাউকে সেজদার অনুমতি দেওয়া হত তাহলে স্ত্রীদেরকে আদেশ করা হতো তারা যেন তাদের স্বামীদেরকে সেজদা করে। এ বিষয়ে আরও একাধিক হাদিস রয়েছে।
মোটকথা, একজন স্বামীর জন্য তার স্ত্রীর সাথে সুন্দর আচরণ করার পাশাপাশি তার প্রতি কতিপয় দায়িত্ব ও কর্তব্য রয়েছে। অনুরূপভাবে একজন স্ত্রীর জন্য (বৈধ বিষয়ে এবং সামর্থ্যের মধ্যে) তার স্বামীর আনুগত্যের পাশাপাশি তার প্রতিও কতিপয় দায়িত্ব ও কর্তব্য রয়েছে। প্রত্যেক স্বামী-স্ত্রী যদি তার সঙ্গীর সাথে সদাচারণের পাশাপাশি একে অপরের প্রতি আল্লাহ ও তাঁর রাসুল নির্দেশিত দায়িত্ব-কর্তব্য ও হকগুলো সঠিক আদায় করে তাহলে সংসার ভাঙ্গার পরিমাণ খুবই কমে যাবে ইনশাআল্লাহ। এতে কোন সন্দেহ নেই।
আল্লাহ আমাদের দাম্পত্যগুলোকে মধুময় করে দিন এবং স্বামী-স্ত্রীকে সব ধরনের অপ্রত্যাশিত পরিস্থিতি থেকে হেফাজত করুন। আমিন।