অনেক মানুষ এমন রয়েছে যারা নিজেদেরকে ফিক্বহী মাযহাবের দলভুক্ত বলে সম্বোধন করে। বিশেষ করে বর্তমান যুগে এটা বেশি পরিলক্ষিত হয়। মূলতঃ এরা এমন অস্বীকারকারী যারা স্ব-স্ব মাযহাবকে ধরে রাখতে চায় এবং তা থেকে সরে যেতে চায় না। তারা মনে করে যে, এ সব মাযহাবের যে কোন একটি গ্রহণ করা দরকার। ফলে তারা ঐ সব পছন্দনীয় বিষয়কে বৈধ করে যা তাদের মুগ্ধ করে এবং যা তাদের প্রবৃত্তির অনুযায়ী হয়। আর তারা এ সব মাযহাবের মাধ্যমে তাদের উদ্দেশ্য বাস্তবায়ন করতে চায়, যদিও এ দাবীগুলো দলীলের বিপক্ষে যায়। তারা তাদের দাবীর পক্ষে এ দলীল উপস্থাপন করে যে, ‘‘এ ব্যাপারে কোন একজন বিদ্বান বলেছেন। আর ( اختلاف أمتي رحمة ) ‘‘আমার উম্মতের মতভেদ রহমত স্বরূপ’’-এ হাদীস দ্বারা যুক্তি পেশ করে বলে যে, উম্মতের মধ্যে প্রশস্ততা রয়েছে।
এ সংশয়টির জবাব দিয়ে আল্লামা আলবানী (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন:[1] এর উত্তর, দু’ভাবে হবে:
প্রথম উত্তর:
হাদীসটি বিশুদ্ধ নয়, বরং তা বাত্বিল, তার কোন ভিত্তি নেই। আল্লামা সুবকী বলেন: আমিও এ হাদীসের সূত্র পাই নি । না সহীহ, না যঈফ, না জাল হাদীস।
আমার মতে: বরং এ শব্দে বর্ণনা করা হয়েছে: ( . . . اختلاف أصحابي لكم رحمة ) অর্থ: ......... আমার সাহাবাদের মতভেদ তোমাদের জন্যে রহমত। ( أصحابي كالنجوم فبأيهم اقتديتم اهتديتم ) অর্থ: ‘‘আমার সাহাবাগণ তারকারাজির ন্যায়, তাদের যাকেই তোমরা অনুসরণ করবে হিদায়াত পেয়ে যাবে।’’
এ উভয় বাক্যই বিশুদ্ধ নয়, প্রথমটি মারাত্মক দুর্বল, আর দ্বিতীয়টি জাল। আমি সবক’টিকে
( سلسلة الأحاديث الضعيفة والموضوعة ) গ্রন্থের ৫৮-৫৯, ৬১ নম্বরে যাচাই করে দেখেছি।
দ্বিতীয় উত্তর: হাদীসটি যঈফ হওয়ার সাথে সাথে তা কুরআন বিরোধীও বটে। কেননা মতবিরোধ থেকে বিরত ও ঐকমত্য থাকার ব্যাপারে আদেশ সংক্রান্ত আয়াত এত বেশি প্রসিদ্ধ যে, তা উলেস্নখের অপেক্ষা রাখে না। তবে দৃষ্টান্ত স্বরূপ কিছু উল্লেখ করা যায়।
আল্লাহ্ তা’আলা বলেন:
﴾ وَلَا تَنَازَعُوا فَتَفْشَلُوا وَتَذْهَبَ رِيحُكُمْ ﴿ আর তোমরা পরস্পরে বিবাদ কর না, তাহলে অকর্মণ্য হয়ে পড়বে এবং তোমাদের শক্তি হারিয়ে যাবে (সূরা: আনফাল-৪৬)।
তিনি আরও বলেন:
﴿وَلَا تَكُونُوا مِنَ الْمُشْرِكِينَ * مِنَ الَّذِينَ فَرَّقُوا دِينَهُمْ وَكَانُوا شِيَعًا كُلُّ حِزْبٍ بِمَا لَدَيْهِمْ فَرِحُونَ﴾
আর মুশরিকদের অন্তর্ভুক্ত হয়ো না। যারা তাদের দ্বীনে বিভেদ সৃষ্টি করেছে আর নিজেরা দলে দলে বিভক্ত হয়ে পড়েছে, প্রত্যেক দলই নিজ নিজ মতবাদ নিয়ে আনন্দিত (সূরা: রূম-৩১,৩২)।
তিনি আরও বলেন:
﴾ وَلَا يَزَالُونَ مُخْتَلِفِينَ * إِلَّا مَنْ رَحِمَ رَبُّكَ ﴿
তোমার পালনকর্তা যাদেরকে অনুগ্রহ করেন তারা ব্যতীত অন্যান্যরা সর্বদা মতভেদ করতেই থাকবে (সূরা: হুদ-১১৮,১১৯)।
তোমার প্রতিপালক তাদেরকে অনুগ্রহ করেন যারা মতভেদ করে না, সুতরাং বুঝা গেল যারা বাত্বিলপন্থি তারাই মতভেদ করে। তবে কোন বিবেক বলবে যে, মতভেদ করা রহমত?
অতএব, সাব্যাস্ত হলো যে, এ হাদীস বিশুদ্ধ নয়, না সনদের (সূত্রের) দিক দিয়ে আর না মতনের (শব্দের) দিক দিয়ে। এখনি পরিষ্কার হয়ে গেল যে, কুরআন হাদীসের উপর আমল বন্ধ রাখার জন্য এ হাদীসকে সংশয়ের উৎস বানানো বৈধ নয়, যে ব্যাপারে ইমামগণও আদেশ দিয়েছেন।
যখন দ্বীনের ব্যাপারে মতভেদ নিষিদ্ধ হলো তবে সাহাবা ও তাদের পরবর্তী ইমামগণের মতভেদ সম্পর্কে আপনাদের অভিমত কী? আর তাদের মতবিরোধ ও পরবর্তীদের মতপার্থক্যের মধ্যে কি কোন তফাৎ রয়েছে?
উত্তর: হ্যাঁ, উভয় মতানৈক্যের মধ্যে বড় ধরনের পার্থক্য রয়েছে যা দু’টি বিষয়ের ভিতর দিয়ে প্রকাশ পায়।
এক- মত পার্থক্যের কারণ।
দুই- তার প্রতিক্রিয়া।
সাহাবাদের মধ্যকার মতভেদ ছিল অনিবার্য কারণ সাপেক্ষ, যা তাদের বুঝের বেলায় স্বভাবগতভাবেই সংঘটিত হয়েছিল, ইচ্ছাকৃতভাবে মতপার্থক্য তৈরির জন্য নয়। এর সাথে আরও কিছু বিষয় যোগ হবে যা তাদের যুগে মতবিরোধকে অপরিহার্য করেছে যা তৎপরর্তীকালে দূর হয়ে যায়। আর এটি এমন মতানৈক্য যা থেকে সম্পূর্ণ উদ্ধার পাওয়া অসম্ভব ব্যাপার। উপরোক্ত আয়াত বা তার সমার্থবোধক আয়াতসমূহের নিন্দাও তাদেরকে স্পর্শ করবে না। কেননা এক্ষেত্রে জবাবদিহিতার শর্ত বিদ্যমান নেই। আর তা হচ্ছে ইচ্ছা বা পীড়াপীড়ি করে অটল থাকা।
কিন্তু বর্তমান যুগের অন্ধ অনুসরণকারীদের (মুকাল্লিদদের) মধ্যকার মতভেদ এমন পর্যায়ের যাতে সাধারণত কোন ওযর নেই। কেননা তাদের কারও নিকট কখনও কুরআন হাদীসের এমন দলীল প্রকাশিত হয় যা সাধারণত তিনি যে মাযহাবের অনুসরণ করেন না তার সমর্থন করে, তখন তিনি শুধু এজন্যই তা পরিত্যাগ করেন যে এটি তার মাযহাবের বিপরীত, আর অন্য কোন কারণে নয়। যার পরিণতি এই দাঁড়ায় যে, মাযহাবটাই তার কাছে যেন আসল অথবা এটাই সেই দ্বীন যা নিয়ে মুহাম্মাদ (ﷺ) আগমন করেছেন, আর অন্য মাযহাব হচ্ছে ভিন্ন আরেক দ্বীন যা রহিত হয়ে গেছে।
অপর আরেক দল এদের বিপরীতমুখী দৃষ্টিভঙ্গি পোষণ করে। তারা এই বিসত্মর মতানৈক্যপূর্ণ মাযহাবগুলোকে ভিন্ন ভিন্ন শরীয়াত মনে করেন। যেমন স্পষ্ট ভাষায় তাদের পরবর্তীদের কেউ কেউ একথা বলেছেন:
لا حرج على المسلم أن يأخذ من أيها ما شاء ويدع ما شاء إذ الكل شرع
অর্থ: মুসলিম ব্যক্তির বেলায় এ সব মাযহাব থেকে ইচ্ছা মাফিক গ্রহণ ও বর্জনে কোন আপত্তি নেই যেহেতু এগুলো প্রত্যেকটি (স্বতন্ত্র) শরীয়ত।
আর উভয় প্রকারের লোকজনই কখনও কখনও সেই বাত্বিল হাদীস اختلاف أمتي رحمة ) ) ‘‘আমার উম্মতের মতভেদ রহমত স্বরূপ’’ দ্বারা প্রমাণ পেশ করে থাকে। তাদেরকেও উক্ত হাদীস দ্বারা অনেক ক্ষেত্রে দলীল গ্রহণ করতে শুনেছি। তাদের কেউ কেউ আবার এ হাদীসের কারণও দর্শায় এ বলে যে, মতভেদটা এজন্যই রহমত যে, এতে জাতির উপর উদারতা প্রদর্শন করা হয়। এ ব্যাখ্যাটি পূর্বোক্ত আয়াতসমূহের স্পষ্ট বিরোধী ও ইমামগণের পূর্বোলেস্নখিত বক্তব্যসমূহের মর্মবিরোধী হওয়া ছাড়াও তাদের কারও কারও স্পষ্ট প্রতিবাদও এর বিরুদ্ধে এসেছে।
ইবনু কাসিম বলেন: আমি মালিক এবং লাইসকে বলতে শুনেছি রাসূল (ﷺ) এর সাহাবাদের মতবিরোধ সম্পর্কে লোকজন যে রকম বলে যে, এতে উদারতা রয়েছে তা সঠিক নয় বরং তা হচ্ছে ভুল অথবা শুদ্ধের ব্যাপার মাত্র।
আশহাব বলেন: ইমাম মালিককে জিজ্ঞাসা করা হলো ঐ ব্যক্তি সম্পর্কে, যে রাসূল (ﷺ) এর বিশ্বসত্ম কোন সাহাবীর বর্ণনাকৃত হাদীসের কোন একটি হাদীস অবলম্বন করল আপনি কি তাকে এ ব্যাপারে স্বাধীন মনে করেন? তিনি বললেন: ‘‘আল্লাহ্র শপথ, না, যতক্ষণ হক্ব পর্যন্ত না পৌঁছে, হক্বতো একটাই, বিপরীতমুখী দু’টি কথাকি একই সাথে সঠিক হয়? সত্য ও সঠিক একটাই হয়’’।
ইমাম শাফেঈর সাথী মাযিনী বলেন: রাসূল (ﷺ) এর সাহাবাগণ মতবিরোধ করেছেন, তাদের একজন অপরজনের ভুল ধরেছেন এবং তাদের একজন অপরজনের মতামত বিবেচনা করে দেখেছেন এবং তার উপর মন্তব্য করেছেন। যদি তাদের সব কয়টি কথা সঠিকই হত, তবে তারা এমনটি করতেন না।
আর উমার ইবনুল খাত্তাব (রাঃ) একদা উবাই ইবনু কা’ব (রাঃ) এবং ইবনু মাসউদ (রাঃ) কে একটিমাত্র কাপড় পরিধান করে সালাত (বিশুদ্ধ হওয়া না হওয়া) এর ব্যাপারে মতানৈক্য করতে দেখে তাদের উপর রাগান্বিত হন। যখন উবাই বললেন: একটি কাপড়ে সালাত আদায় করা সুন্দর ও চমৎকার কাজ। আর ইবনু মাসউদ বললেন, এটা তো কেবল ঐ সময়কার কথা যখন কাপড় কম ছিল। তখন উমার (রাঃ) রাগান্বিত হয়ে তাদের নিকট বেরিয়ে আসলেন এবং বললেন রাসূল (ﷺ) এর এমন দু’জন সাহাবী মতভেদ করছেন যাদের অনুকরণ করা হয় এবং যাদের কথা গ্রহণীয়। তবে উবাই সঠিক বলেছেন আর ইবনু মাসউদ চেষ্টায় ত্রুটি করেন নি। কিন্তু আমার আজকের এই বক্তব্য শুনার পর যে কাউকে এ বিষয়ে মতভেদ করতে শুনব তাকেই এ এ (শাস্তি) প্রদান করব।
ইমাম মাযানি আরও বলেন: যে ব্যক্তি মতভেদকে জায়েয রাখে এবং এ ধারণা পোষণ করে যে, কোন একটি বিষয়ে যদি দু’জন আলিম মতবিরোধ করেন এবং একজন বলেন: এটা হালাল আর অপরজন বলেন: এটা হারাম? তবে তাদের উভয়জনই তাদের গবেষণায় হক্বের উপর আছেন, তাকে জিজ্ঞেস করা হবে- তুমি এ কথা দলীল ভিত্তিক বলেছ, নাকি ক্বিয়াস (অনুমান) ভিত্তিক? যদি বলে: দলীল ভিত্তিক, তবে তাকে বলা হবে কিভাবে দলীল ভিত্তিক হয় অথচ কুরআন (এর বিপক্ষে) মতানৈক্যকে নিষেধ করছে? যদি সে বলে যে, আমি কিয়াস দ্বারা করেছি। তাহলে বলা হবে কিভাবে করতে পার? যেখানে আসল (কুরআন ও সুন্নাহ) বলছে মতভেদ করা যাবে না। আর তুমি কিভাবে মতভেদকে বৈধ করার জন্য এর উপর কিয়াস করছ? এটা কোন আলিমতো দূরের কথা কোন বিবেকবান ব্যক্তি বৈধ বলতে পারে না।
যদি কেউ বলেন: আপনি ইমাম মালিক থেকে যা উল্লেখ করলেন যে হক্ব একটাই হয় একাধিক হয় না, তাতো অধ্যাপক যুরক্বা তার আলমাদখালুল ফিক্বহী ( المدخل الفقهي ) গ্রন্থে (১/৮৯) যা লিখেছেন তার বিপরীত হয়ে যাচ্ছে। তিনি লিখেছেন: খলীফা আবূ জা’ফর আল মানসূর এবং তার পরে খলীফা হারুনুর রশীদ স্থির করেন যে, ইমাম মালিক এর মাযহাব ও তার কিতাব ( الموطأ ) কে আব্বাসীয় রাষ্ট্রের বিচার বিভাগের সংবিধান হিসেবে পরিগণিত করবেন তাতে মালিক উভয়কে বাধা দেন এবং বলেন: ‘‘রাসূল (ﷺ) এর সাহাবাগণ (ফিক্বহের) শাখা-প্রশাখার মাসআলায় মতভেদ করেছেন এবং দেশ-বিদেশে ছড়িয়ে পড়েছেন আর তাদের প্রত্যেকেই সঠিক’’।
আমি বলছি: এ ঘটনাটি ইমাম মালিক (রাহিমাহুল্লাহ) থেকে পরিচিত ও প্রসিদ্ধ, কিন্তু শেষের কথাটি ‘‘প্রত্যেকেই সঠিক’’ তার কোন ভিত্তি আমি জানতে পারি নি- ঐ সকল বর্ণনা ও গ্রন্থাদির মাধ্যমে আমি যেগুলো অবগত হয়েছি। তবে আবূ নুআইম তার ‘আল হিলইয়াহ্’ ( الحلية ) গ্রন্থে (পৃ.৬/৩৩২) একটি মাত্র বর্ণনা নিয়ে এসেছেন যাতে মিক্বদাম ইবনু দাউদ রয়েছেন, একে যাহাবী দুর্বলদের অন্তর্ভুক্ত করেছেন। তাছাড়া এর শব্দ হচ্ছে: ( وكل عند نفسه مصيب ) অর্থ: প্রত্যেকেই নিজের বিচারে সঠিক।
তার কথা عند نفسه প্রমাণ বহন করে যে, ( المدخل ) গ্রন্থে আংশিক বর্ণনা ঢুকিয়ে দেয়া হয়েছে। এমনটি কেনই বা হবে না যেখানে এটা ইমাম মালিক থেকে নির্ভরযোগ্য বর্ণনাকারীদের বর্ণনার বিরোধিতা করছে যা হচ্ছে এই যে, হক্ব এক, তা একাধিক হয় না, যেমন এর আলোচনা অতিবাহিত হয়ে গেল। এর উপরে সাহাবা, তাবিঈন এবং মুজতাহিদ ইমাম চতুষ্টয় ও অন্যান্য ইমামগণ প্রতিষ্ঠিত ছিলেন। ইমাম ইবনু আব্দিল বার বলেন: (পৃ.২/৮৮) সংঘাতপূর্ণ দুই পক্ষের উভয় বক্তব্যই যদি সঠিক হত তবে সালাফদের একজন অপরজনের গবেষণা, বিচার এবং ফাৎওয়াতে ভুল ধরতেন না। বিবেকও একথা অস্বীকার করে যে, কোন বস্ত্ত আর তার বিপরীতমুখী বস্ত্ত উভয়টাই সঠিক হবে। কি সুন্দরইনা বলেছেন যিনি এ কবিতা আবৃত্তি করেছেন:
إثبات ضدين معا في حال أقبح ما يأتي من المحال
অর্থ: দু’টি বিপরীত বস্ত্তকে একই অবস্থায় এক সাথে সাব্যাস্ত করা অশোভনীয় এবং অসম্ভবও বটে।
যদি বলা হয়: এই বর্ণনা যদি ইমাম থেকে ভুল সাব্যাস্তই হয়, তবে মানসূর যখন মানুষকে তাঁর কিতাব الموطأ )) এর উপর ঐক্যবদ্ধ করতে চেয়েছিলেন তখন তিনি কেন তা গ্রহণ না করে অস্বীকৃতি জানেই?
আমি বলছি: সর্বাধিক সুন্দরতম যে বর্ণনা সম্পর্কে আমি অবহিত হয়েছি তা হচ্ছে ঐটি যেটি হাফিয ইবনু কাসীর তার শারহ ইখতিসারি উলূমিল হাদীস গ্রন্থে (পৃ.৩১) উল্লেখ করেছেন যে, ইমাম মালিক বলেন: ‘‘লোকজন এমন সব বিষয় একত্রিত করেছে ও জেনেছে যা আমি (হয়ত) জানতে পারি নি’’। একথা তার (ইমাম মালিকের) জ্ঞান ও ইনসাফের পূর্ণতার প্রমাণ। যেমন ইবনু কাসীর (রাহিমাহুল্লাহ) বলেছেন।
সুতরাং সাব্যাস্ত হলো যে, সব মতভেদই মন্দ এবং তা রহমত নয়। তবে কোন কোন মতভেদ এমন রয়েছে যার উপর মানুষকে পাকড়াও করা হবে যেমন গোঁড়া মাযহাবপন্থিদের মতভেদ। আর কোনটি এমন যে, তার উপর পাকড়াও করা হবে না। যেমন সাহাবা ও তাদের অনুসারী ইমামগণের মতভেদ। আল্লাহ্ তাদের দলে আমাদের একত্রিত করুন এবং আমাদেরকে তাদের অনুসরণ করার তাওফীক্ব দান করুন। এখন প্রকাশ পেল যে, সাহাবাগণের মতভেদ ছিল মুকাল্লিদদের মতভেদ থেকে আলাদা।
সারকথা: সাহাবাগণ নিরুপায় অবস্থায় মতভেদ করেছেন। কিন্ত তারা মতভেদের বিরুদ্ধাচরণ করেছেন এবং যতদূর সম্ভব এ থেকে দূরে থাকার চেষ্টা করতেন। পক্ষান্তরে, মুকাল্লিদগণ মতভেদপূর্ণ বিষয়ের বিরাট এক অংশে এ মতবিরোধ থেকে বেঁচে থাকা সম্ভব হওয়া সত্ত্বেও তারা একমত হয় না এবং এর জন্য চেষ্টাও করে না, বরং তারা একে সাব্যাস্ত করে। তাই উভয় মতবিরোধের মধ্যে বিরাট দূরত্ব রয়েছে। এ পার্থক্য ছিল কারণের দিক থেকে।
আর প্রতিক্রিয়ার দিক থেকে উভয় মতভেদের মধ্যে পার্থক্য হচ্ছে আরও স্পষ্ট, আর তা এই যে, সাহাবাগণ অমৌলিক বা খুঁটিনাটি বিষয়ে মতবিরোধ করা সত্ত্বেও- তারা ঐক্যের ভাবমূর্তিকে কঠিনভাবে সংরক্ষণ করতেন। যে সব বিষয় ঐক্যবাক্যের মধ্যে বিক্ষিপ্ততা সৃষ্টি করে তা থেকে তারা সম্পূর্ণ বিরত থাকতেন। যেমন তাদের মধ্যে কেউ সশব্দে বিসমিল্লাহ বলার পক্ষে মত ব্যক্ত করতেন আবার কেউ এটি ঠিক মনে করতেন না। তাদের কেউ রাফউল ইয়াদাইন করা মুস্তাহাব মনে করতেন আবার কেউ তা মনে করতেন না। এমনিভাবে কেউবা মহিলা স্পর্শ করলে ওযূ ভঙ্গ হওয়ার পক্ষে ছিলেন আবার অন্যরা ছিলেন এর বিপক্ষে। তা সত্ত্বেও তারা সবাই এক ইমামের পিছনে সালাত পড়তেন এবং মাযহাবী মতানৈক্যকে কেন্দ্র করে তাদের কেউ ইমামের সাথে সালাত পড়া থেকে বিরত থাকেন নি।
পক্ষান্তরে, মুকাল্লিদগণের (অন্ধ অনুসারীদের) মতবিরোধ হচ্ছে এর সম্পূর্ণ বিপরীত। যার পরিণতি এই দাঁড়িয়েছে যে, মুসলিমগণ দুই সাক্ষ্যবাণী তথা আল্লাহ্ ও রাসূলের সাক্ষ্য প্রদানের পর পরই সর্বপ্রধান ভিত্তি সালাতের ব্যাপারে বিভক্ত হয়ে পড়েছে। তারা সবাই একত্রে এক ইমামের পিছনে সালাত পড়তে অস্বীকৃতি জানায় এই বলে যে, ভিন্ন মাযহাবের ইমামের সালাত বাত্বিল, আর না হয় অন্ততপক্ষে মাকরূহ। আমরা একথা শুনেছি এবং দেখেছি যেমন অন্যরাও দেখেছে। কেনইবা তা হবে না যেখানে আজকের দিনে প্রসিদ্ধ কিছু মাযহাবের কিতাবে স্পষ্টাক্ষরে সালাত মাকরূহ বা বাত্বিল হওয়ার কথা বিদ্যমান রয়েছে? যার পরিণতি হিসেবে আপনি কোন কোন দেশে একই জামে মাসজিদে চারটা মেহরাব দেখতে পাবেন যাতে পর পর চারজন ইমাম সালাত পড়ান। লোকজনকে দেখতে পাবেন তাদের ইমামের জন্য অপেক্ষা করছে অথচ অপর আরেকজন ইমাম দাঁড়িয়ে সালাত পড়ছেন।
বরং মুকালিস্নদদের কারও কারও নিকট মতানৈক্য এ পর্যন্ত গড়িয়েছে যে, তারা হানাফী বর এবং শাফেঈ কন্যার মধ্যে বিয়ে নিষেধ করেছে। পরবর্তীতে হানাফীদের নিকট প্রসিদ্ধ এক লোক যাকে ( مفتي الثقلين ) জ্বিন ইনসান উভয় জাতির মুফতী উপাধিতে ভূষিত করা হয় তিনি হানাফী পুরুষের সাথে শাফেঈ কন্যার বিবাহ বৈধ বলে ঘোষণা দেন এ কারণ দর্শিয়ে যে, সেই মহিলাকে আহলুল কিতাব (ইহুদী ও খৃষ্টানদের) পর্যায়ভুক্ত ধরে নেয়া হবে। যার অর্থ এই যে, এর বিপরীত বৈধ নয় অর্থাৎ শাফেঈ বরের সাথে হানাফী কন্যার বিয়ে বৈধ নয়। যেমন কিতাবী (ইহুদী-খৃষ্টান) বরের সাথে মুসলিম কন্যার বিবাহ বৈধ নয়।
অনেক দৃষ্টান্ত থেকে এ দু’টি দৃষ্টান্ত পেশ করা হলো যা জ্ঞানী ব্যক্তির জন্য ঐ অশুভ পরিণতির কথা পরিষ্কারভাবে তুলে ধরছে যা পরবর্তীদের মতবিরোধ এবং এর উপর জড়বদ্ধ থাকার ফলশ্রুতিতে ঘটেছে। এটা পূর্বসূরীদের মতভেদের চেয়ে ভিন্ন। কেননা তাদের মতপার্থক্যের কোন অশুভ পরিণতি জাতির উপর পতিত হয় নি। এজন্যই তারা দ্বীনের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টির উপর নিষেধাজ্ঞা বহনকারী আয়াতগুলোর আওতার বাইরে। কিন্তু পরবর্তীদের কথা এর চেয়ে ভিন্ন। আল্লাহ্ আমাদের সবাইকে তাঁর সঠিক পথের সন্ধান দিন।