রমযান মাসের সিয়াম প্রত্যেক মুসলিম নারী ও পুরুষের ওপর ফরয। সিয়াম ইসলামের একটি রুকন ও মহান এক স্তম্ভ। আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
﴿يَٰٓأَيُّهَا ٱلَّذِينَ ءَامَنُواْ كُتِبَ عَلَيۡكُمُ ٱلصِّيَامُ كَمَا كُتِبَ عَلَى ٱلَّذِينَ مِن قَبۡلِكُمۡ لَعَلَّكُمۡ تَتَّقُونَ ١٨٣﴾ [البقرة: ١٨٣]
“হে মুমিনগণ, তোমাদের ওপর সিয়াম ফরয করা হয়েছে, যেভাবে ফরয করা হয়েছিল তোমাদের পূর্ববর্তীদের ওপর, যাতে তোমরা তাকওয়া অবলম্বন কর”। [সূরা আল-বাকারা, আয়াত: ১৮৩]
এখানেكُتِبَঅর্থ ফরয করা হয়েছে। কিশোরীর মাঝে সালাবক হওয়ার কোনো একটি নিদর্শন স্পষ্ট হলে ফরয বিধান পালন করার বয়সে উপনীত হয়, তখন থেকে সে ফরয সিয়াম রাখা শুরু করবে। সাবালক হওয়ার একটি নিদর্শন ঋতু বা হায়েয। ঋতু কখনো নয় বছরে শুরু হয়; কিন্তু কতক কিশোরী বিধান না জানার কারণে সিয়াম রাখে না, তার ধারণা সে ছোট। পরিবারও তাকে সিয়াম রাখার নির্দেশ করে না, ইসলামের একটি রুকনের ক্ষেত্রে এটি বড় ধরণের গাফলতি। এরূপ যার ক্ষেত্রে ঘটেছে তাকে অবশ্যই ঋতু তথা হায়েযের শুরু থেকে সিয়াম কাযা করতে হবে, যদিও অনেক দীর্ঘ হয়, কারণ তার জিম্মায় সিয়াম বাকি রয়েছে।[1]
কার ওপর রমযান ওয়াজিব?
রমযান মাস প্রবেশ করলে সালাবক, সুস্থ ও নিবাসস্থলে অবস্থানকারী প্রত্যেক মুসলিম নারী ও পুরুষের ওপর সিয়াম রাখা ওয়াজিব হয়। কেউ যদি রমযানের মাঝে অসুস্থ হয় অথবা মুসাফির হয়, সে পানাহার করবে এবং তার সংখ্যা মোতাবেক অন্য সময় কাযা করবে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
﴿فَمَن شَهِدَ مِنكُمُ ٱلشَّهۡرَ فَلۡيَصُمۡهُۖ وَمَن كَانَ مَرِيضًا أَوۡ عَلَىٰ سَفَرٖ فَعِدَّةٞ مِّنۡ أَيَّامٍ أُخَرَۗ﴾ [البقرة: ١٨٥]
“সুতরাং তোমাদের মাঝে যে মাসটিতে উপস্থিত হবে সে যেন তাতে সিয়াম পালন করে। আর যে অসুস্থ হবে অথবা সফরে থাকবে তবে অন্যান্য দিবসে সংখ্যা পূরণ করবে”। [সূরা আল-বাকারা, আয়াত: ১৮৫]
অনুরূপ যার নিকট রমযান উপস্থিত হয় এমন অবস্থায় যে, সে জরাগ্রস্ত, সিয়াম রাখতে সক্ষম নয় অথবা স্থায়ীভাবে অসুস্থ যা কোনো সময় সেরে উঠার কোনো সম্ভাবনা নেই, হোক সে নারী কিংবা পুরুষ পানাহার করবে এবং প্রত্যেক দিনের পরিবর্তে একজন মিসকীনকে আধা সা[2] দেশীয় খাবার দিবে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
﴿وَعَلَى ٱلَّذِينَ يُطِيقُونَهُۥ فِدۡيَةٞ طَعَامُ مِسۡكِينٖۖ﴾ [البقرة: ١٨٤]
“আর যাদের জন্য তা কষ্টকর হবে, তাদের কর্তব্য ফিদিয়া -একজন দরিদ্রকে খাবার প্রদান করা”। [সূরা আল-বাকারা, আয়াত: ১৮৪]
আব্দুল্লাহ ইবন আব্বাস বলেন, এ বিধান এমন বুড়োর জন্য যার সুস্থ হয়ে উঠার সম্ভাবনা নেই। এ কথা ইমাম বুখারী বর্ণনা করেছেন। অনুরূপ যার রোগ থেকে সেরে উঠার সম্ভাবনা নেই সেও বুড়োর মত, তাদের ওপর কাযা নেই যেহেতু তাদের পক্ষে কাযা সম্ভবও নয়।
[2] এক সা‘ এর সঠিক পরিমাণ হচ্ছে, দুই মুদ্দ। এক মুদ্দ হচ্ছে, স্বাভাবিক মানুষের দু’ হাতের ক্রোশ পরিমান। সাধারণত গম হলে তা ২ কেজি ৪০ গ্রাম হয়। সে হিসেবে আধা সা‘ হচ্ছে, এক কেজি বিশ গ্রাম।
নারীর কিছু অপারগতা রয়েছে, যে কারণে রমযানে পানাহার করা তার পক্ষে বৈধ, তবে ছেড়ে দেওয়া সিয়ামগুলো পরে কাযা করবে অবশ্যই।
নারীর অপারগতাগুলো নিম্নরূপ:
১. হায়েয ও নিফাস: হায়েয ও নিফাসের সময় সিয়াম রাখা হারাম, পরে তা কাযা করা ওয়াজিব। কারণ, আয়েশা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহা থেকে বুখারী ও মুসলিম বর্ণনা করেন:
»كنا نؤمر بقضاء الصوم، ولا نؤمر بقضاء الصلاة«
“আমাদেরকে সিয়ামের কাযা করার নির্দেশ দেওয়া হত, কিন্তু সালাতের কাযা করার নির্দেশ দেওয়া হত না”।[1]
এর কারণ, একদা জনৈক নারী আয়েশাকে প্রশ্ন করেন: ঋতুমতী নারীরা সিয়াম কাযা করবে, কিন্তু সালাত কাযা করবে না কারণ কী?
উত্তরে তিনি বলেন: এসব বিষয় অহী নির্ভর, এতে অহীর অনুসরণ করাই মূল কথা।
ঋতু অবস্থায় সিয়াম ত্যাগ করার হিকমত:
শাইখুল ইসলাম ইবন তাইমিয়্যাহ রহ. ‘মাজমুউল ফতোয়ায়’: (২৫/২৫১) বলেন: “ঋতুতে যে রক্ত নির্গত হয় সেটা এক প্রকার রক্তক্ষরণ, যা তার স্বাভাবিক সুস্থতার বিপরীত। ঋতুমতী নারী স্বাভাবিক অবস্থায় সিয়াম রাখতে সক্ষম যখন তার রক্ত নির্গত হয় না। অতএব, ঋতুমতী নারী যদি স্বাভাবিক অবস্থায় সিয়াম রাখে যখন তার শরীর থেকে শক্তিশালী উপাদান (রক্ত) বের হওয়া বন্ধ থাকে তার সিয়ামটা স্বাভাবিক হয়। পক্ষান্তরে যদি ঋতু অবস্থায় সিয়াম রাখে যখন তার থেকে শরীরের নির্যাস রক্ত বের হয়, যা শরীরকে ক্ষয় ও দুর্বল করে, তখন তার সিয়ামও হবে অস্বাভাবিক (দুর্বল)। এ জন্য নারীদের ঋতু শেষে সিয়াম কাযা করার নির্দেশ প্রদান করা হয়েছে। সমাপ্ত।
২. গর্ভ ও দুগ্ধপান: গর্ভ ও দুগ্ধপান করানো অবস্থায় সিয়াম দ্বারা যদি নারী অথবা সন্তান অথবা তারা উভয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়, তাহলে গর্ভ ও দুগ্ধপান করানো অবস্থায় পানাহার করবে। অতঃপর যে ক্ষতির আশঙ্কায় পানাহার করেছে সেটা যদি বাচ্চা সংশ্লিষ্ট হয়, মায়ের সাথে সম্পৃক্ত না হয়, তাহলে পানাহার করা দিনের কাযা করবে এবং প্রত্যেক দিনের মোকাবিলায় একজন মিসকিনকে খাবার দিবে। আর যদি ক্ষতি নারীর সাথে সংশ্লিষ্ট হয়, তাহলে শুধু তার কাযা করলে যথেষ্ট হবে। কারণ, গর্ভবতী ও দুগ্ধদানকারী উভয় আল্লাহর বাণীর অন্তর্ভুক্ত। আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
﴿وَعَلَى ٱلَّذِينَ يُطِيقُونَهُۥ فِدۡيَةٞ طَعَامُ مِسۡكِينٖۖ﴾ [البقرة: ١٨٤]
“আর যাদের জন্য তা কষ্টকর হবে, তাদের কর্তব্য ফিদিয়া -একজন দরিদ্রকে খাবার প্রদান করা”। [সূরা আল-বাকারা, আয়াত: ১৮৪]
হাফেয ইবন কাসির রহ. স্বীয় তাফসীর: (১/৩৭৯) গ্রন্থে বলেন: “আয়াতের অর্থে গর্ভবতী ও দুগ্ধদানকারী অন্তর্ভুক্ত হয়, যদি তারা তাদের নিজের নফসের অথবা সন্তানের ওপর আশঙ্কা করে”। সমাপ্ত।
শাইখুল ইসলাম ইবন তাইমিয়্যাহ রহ. বলেন: যদি গর্ভবতী তার বাচ্চার ওপর আশঙ্কা করে, তাহলে পানাহার করবে ও প্রত্যেক দিনের কাযা করবে এবং প্রত্যেক দিনের মোকাবেলায় মিসকীনকে এক রতল[2] রুটি দিবে”।[3] সমাপ্ত।
কয়েকটি জ্ঞাতব্য:
১. মুস্তাহাযাহ নারী: যে নারীর হায়েয ব্যতীত কোনো কারণে রক্ত নির্গত হয়, যার আলোচনা আমরা পূর্বে করেছি, তার উপর সিয়াম রাখা জরুরি। ইস্তেহাযার কারণে পানাহার করা তার পক্ষে বৈধ নয়।
শাইখুল ইসলাম ইবন তাইমিয়্যাহ রহ. ঋতুমতী নারীর পানাহার করার আলোচনা শেষে বলেন: ইস্তেহাযা এর বিপরীত, কারণ ইস্তেহাযা দীর্ঘ সময়কে ঘিরে থাকে, তার এমন কোনো সময় নেই যেখানে তাকে সিয়ামের নির্দেশ দেওয়া হবে। আবার ইস্তেহাযাহ থেকে তার বাচারও উপায় নেই। ইস্তেহাযার রক্ত হচ্ছে সামান্য বমি, আঘাতের কারণে বা পায়খানার রাস্তা দিয়ে রক্ত বের হওয়া ও স্বপ্ন দোষ ইত্যাদির মত, যার কোনো নির্দিষ্ট সময় নেই, যার থেকে নিরাপদ থাকা অসম্ভব। অতএব, এগুলো হায়েযের রক্তের ন্যায় সিয়ামের পথে বাঁধা নয়”।[4] সমাপ্ত।
২. ঋতুমতী, গর্ভবতী ও দুগ্ধদানকারী নারী যদি পানাহার করে, তাহলে তাদের ওপর ফরয হচ্ছে, যে রমযানে পানাহার করেছে তার পর থেকে আগামী রমযানের আগে কাযা করা, তবে দ্রুত কাযা করা মুস্তাহাব। যদি যে পরিমাণ তার ওপর কাযা ফরয, পরবর্তী রমযান আসার সে ক’টি দিন বাকি থাকে, তাহলে এ দিনগুলোতে তার কাযা করা ফরয, যেন পিছনের রমযানের কাযা থাকাবস্থায় তার ওপর নতুন রমযান আগমন না করে। যদি পেছনের রমযানের কাযা না করে, এভাবেই পরবর্তী রমযান এসে যায়, বিলম্ব করার কোনো কারণও নেই, তাহলে তার ওপর কাযা করা ও প্রত্যেক দিনের বিনিময়ে মিসকীনকে খাবার দেওয়া ফরয, আর যদি তার পশ্চাতে সঙ্গত কারণ থাকে তাহলে শুধু কাযা করা ওয়াজিব। অনুরূপভাবে যার ওপর কাযা ছিল রোগ অথবা সফরের কারণে, তার হুকুমও ঋতুমতী নারীর মতো উপরোক্ত ব্যাখ্যাসহ।
৩. স্বামীর উপস্থিত থাকাবস্থায় নারীর নফল সিয়াম রাখা জায়েয নয়। কারণ, ইমাম বুখারী ও মুসলিম প্রমুখগণ আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণনা করেন, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন:
»لا يحل لامرأة أن تصوم وزوجها شاهد إلا بإذنه«
“কোনো নারীর পক্ষে জায়েয নয় স্বামীর উপস্থিতিতে সিয়াম রাখা তার অনুমতি ব্যতীত”।[5] আহমদ ও আবু দাউদের কতক বর্ণনায় আছে, তবে রমযান ব্যতীত।
অবশ্য যদি স্বামী নফল সিয়াম রাখার অনুমতি দেয় অথবা তার স্বামী উপস্থিত না থাকে অথবা তার স্বামীই নেই, তার পক্ষে নফল সিয়াম রাখা মুস্তাহাব। বিশেষভাবে যে দিনগুলোকে সিয়াম রাখা মুস্তাহাব, যেমন সোমবার, বৃহস্পতিবার ও প্রত্যেক মাসে তিনটি সিয়াম, শাওয়াল মাসের ছয় সিয়াম, জিল হজ মাসের দশ দিনের সিয়াম, আরাফার সিয়াম এবং আশুরার দিন সিয়াম রাখা আগে বা পরে একদিন মিলিয়ে। হ্যাঁ, রমযানের কাযা যিম্মাদারিতে থাকাবস্থায় যতক্ষণ না ফরয সাওম পালন শেষ করছে ততক্ষণ নফল সিয়াম রাখা যথাযথ নয়। আল্লাহ ভালো জানেন।
৪. ঋতুমতী নারী যদি রমযান মাসে দিনের মধ্যবর্তী সময় পাক হয়, তাহলে সে অবশিষ্ট দিন বিরত থাকবে এবং পরবর্তীতে কাযা করবে। সময়ের প্রতি সম্মান জানিয়ে অবশিষ্ট দিন তার বিরত থাকা আবশ্যক।
[2] এখানে রতল বলে সম্ভবত: অর্ধ সা বুঝানো হয়েছে। যা পূর্বে বর্ণিত হয়েছে। [সম্পাদক]
[3] আল-মাজমু: (২৫/৩১৮)
[4] মাজমুউল ফাতোয়া: (২৫/২৫১)
[5] সহীহ বুখারী, হাদীস নং ৪৮৯৯; সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ১০২৬; আহমদ (২/৩১৬)