আল্লাহ তা‘আলা প্রত্যেক নফসের জন্যই মৃত্যুকে অবধারিত করে দিয়েছেন। স্থায়িত্ব একমাত্র তার নিজের জন্যই সংরক্ষিত। তিনি বলেন:
﴿وَيَبۡقَىٰ وَجۡهُ رَبِّكَ ذُو ٱلۡجَلَٰلِ وَٱلۡإِكۡرَامِ ٢٧﴾ [الرحمن: ٢٧]
“আর থেকে যাবে শুধু মহামহিম ও মহানুভব তোমার রবের চেহারা”। [সূরা আর-রহমান, আয়াত: ২৭]
বনু আদমের জানাযার সাথে কিছু বিধান রয়েছে, যা বাস্তবায়ন করা জীবিতদের ওপর জরুরি। তন্মধ্যে এখানে আমরা শুধু নারীদের সাথে খাস জরুরি কতক বিধান উল্লেখ করব।
১. মৃত নারীকে গোসল দেওয়ার দায়িত্ব কোনো নারীর গ্রহণ করা ওয়াজিব:
মৃত নারীকে গোসল নারীই দিবে, পুরুষের পক্ষে তাকে গোসল দেওয়া বৈধ নয় স্বামী ব্যতীত, স্বামীর পক্ষে স্ত্রীকে গোসল দেওয়া বৈধ। অনুরূপ পুরুষকে গোসল করানোর দায়িত্ব পুরুষ গ্রহণ করবে, নারীর পক্ষে তাকে গোসল দেওয়া বৈধ নয় স্ত্রী ব্যতীত, স্ত্রীর পক্ষে নিজ স্বামীকে গোসল দেওয়া বৈধ। কারণ, আলী রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু নিজ স্ত্রী ফাতিমা বিনতে মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে গোসল দিয়েছেন, অনুরূপ আসমা বিনতে উমাইস নিজ স্বামী আবু বকর রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুকে গোসল দিয়েছেন।
ইযার, যা দিয়ে তার নিম্নাংশ আবৃত করা হয়। উড়না হবে মাথার উপর। জামা হবে তার শরীরের উপর। আর দু’টি লেফাফা দিয়ে তার পূর্ণ শরীরকে ঢেকে দেওয়া হবে। কারণ, লায়লা সাকাফিয়্যাহ বর্ণনা করেন:
»كنت فيمن غسل أم كلثوم بنت رسول الله صلى الله عليه وسلم عند وفاتها، وكان أول ما أعطانا رسول الله الحقى، ثم الدرع، ثم الخمار، ثم الملحفة، ثم أدرجت بعد ذلك في الثوب الآخر«
“উম্মে কুলসুম বিনতে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মারা গেলে যারা তাকে গোসল দেয়, আমি তাদের একজন ছিলাম। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদেরকে প্রথম যা দিয়ে ছিলেন, তা ছিল ইযার, অতঃপর জামা, অতঃপর উড়না, অতঃপর লেফাফা, অতঃপর এগুলোকে আরেকটি কাপড় দিয়ে আচ্ছাদিত করে দেই”।[1]
ইমাম শাওকানী রহ. বলেন: হাদীস প্রমাণ করে যে, নারীর কাফনের জন্য বিধান হচ্ছে ইযার, জামা, উড়না, চাদর ও লেফাফা”।[2] সমাপ্ত।
[2] নাইলুল আওতার: (৪/৪২)
উম্মে ‘আতিয়্যাহ রাদিয়াল্লাহু ‘আনহা থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন:
»نهينا عن اتباع الجنائز، ولم يعزم علينا«
“আমাদেরকে জানাযার অনুসরণ করতে নিষেধ করা হয়েছে তবে কঠোরভাবে নিষেধ করা হয়নি”।[1]
হাদীসের বাহ্যিক ভাষা নারীদের জন্য জানাযার পিছনে চলা হারাম বুঝায়। আর উম্মে ‘আতিয়্যাহ-এর কথা “আমাদেরকে কঠোরভাবে নিষেধ করা হয়নি” সম্পর্কে শাইখুল ইসলাম ইবন তাইমিয়্যাহ বলেন: “মনে হয় তার উদ্দেশ্য, নিষেধ করার বিষয়টিতে তাকীদ দেওয়া হয়নি”। এ কথা জানাযার অনুসরণ করা হারাম হওয়ার পরিপন্থী নয়। হয়তো তিনি ধারণা করেছে এ নিষেধাজ্ঞা হারাম নয়। এটা তার বুঝ, দলীল তার বুঝ নয়, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কথাই দলীল”।[2]
[2] মাজমুউল ফতোয়া: (২৪/৩৫৫)
আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত:
»أن رسول الله صلى الله عليه وسلم لعن زوارات القبور«
“রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কবর যিয়ারতকারীদের ওপর লা‘নত করেছেন”।[1]
শাইখুল ইসলাম ইবন তাইমিয়্যাহ রহ. বলেন: “যদি নারীকে যিয়ারত করার সুযোগ দেওয়া হয়, সে অস্থিরতা, বিলাপ ও মাতম শুরু করবে, কারণ তার মধ্যে রয়েছে দুর্বলতা, অধিক অস্থিরতা ও কম ধৈর্য। দ্বিতীয়ত তার এসব কর্ম মৃত ব্যক্তির জন্য কষ্টের কারণ। তৃতীয়ত তার চেহারা ও আওয়াজ দ্বারা পুরুষদের ফিতনা হওয়ার সমূহ সম্ভাবনা রয়েছে। অপর এক হাদীসে এসেছে:
»فإنكن تفتن الحي وتؤذين الميت«
“কারণ তোমরা জীবিতদের ফিতনায় ফেল এবং মৃতদের কষ্ট দাও”।
অতএব নারীদের কবর যিয়ারত ফেতনার কারণ, যা তাদের ও পুরুষদের মাঝে কিছু হারাম বিষয়কে জন্ম দেয়। এতে যিয়ারত করার হিকমতও সুনিশ্চিত নয়, কারণ যিয়ারতের এমন কোনো সীমা নির্ধারণ করা সম্ভব নয় যা এসব অপরাধ জন্ম দিবে না। আবার এক যিয়ারতকে অপর যিয়ারত থেকে পৃথক করাও সম্ভব নয় যে, একটি জায়েয বলব। শরী‘আতের একটি নীতি হচ্ছে যদি কোনো বিধানের হিকমত গোপন হয় অথবা সচরাচর না হয়, তাহলে তার সম্ভাব্য হিকমতের সাথে হুকুম সম্পৃক্ত হয়। অতএব, হারাম কর্মের পথ বন্ধ করার স্বার্থে যিয়ারত নিষিদ্ধ করাই শ্রেয়। যেমন, গোপন সৌন্দর্যের দিকে দৃষ্টি দেওয়া হারাম। কারণ, সেটা ফিতনার কারণ। অনুরূপ অপরিচিত নারীর সাথে একান্ত মিলন ও তার দিকে দৃষ্টি ইত্যাদি হারাম। নারীর যিয়ারতে এমন কিছু নেই যা এসব ফ্যাসাদ মোকাবেলায় সক্ষম। কারণ, যিয়ারতে মৃত ব্যক্তির জন্য দো‘আ ব্যতীত কিছু নেই যা ঘরে বসেই সম্ভব”।[2] সমাপ্ত।
[2] মাজমুউল ফতোয়া: (২৪/৩৫৫, ৩৫৬)
মাতম হচ্ছে মৃত ব্যক্তির ওপর অস্থিরতা প্রকাশ করে উচ্চস্বরে বিলাপ করা, কাপড় ছিঁড়ে ফেলা, গাল থাপড়ানো, চুল উঠিয়ে ফেলা, চেহারা কালো করা ও খামচানো, ধ্বংসকে আহ্বান করা ইত্যাদি, যা আল্লাহর সিদ্ধান্ত ও তাকদীরের ওপর অসন্তুষ্টি ও অধৈর্যতা প্রমাণ করে। এসব আচরণ হারাম ও কবিরা গুনাহ। সহীহ বুখারী ও মুসলিমে এসেছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন:
»ليس منا من لطم الخدود، وشق الجيوب، ودعا بدعوى الجاهلية«
“যে গালে আঘাত করে, কাপড় ছিঁড়ে ফেলে ও জাহেলী পরিভাষায় চিল্লাফাল্লা করে সে আমাদের অন্তর্ভুক্ত নয়”।[1] সহীহ বুখারী ও মুসলিমে আরো রয়েছে:
»أنه صلى الله عليه وسلم بريء من الصالقة والحالقة والشاقة«
“নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সালিকাহ, হালিকাহ ও শাক্কাহ থেকে বিমুক্ত”।
সালিকাহ: সে নারী, যে মুসীবতের সময় উচ্চস্বরে আওয়াজ করে। হালিকাহ: সে নারী, যে মুসীবতের সময় চুল ছিঁড়ে ফেলে। শাক্কাহ: সে নারী, যে মুসীবতের সময় কাপড় ছিড়ে ফেলে। সহীহ মুসলিমে বর্ণিত,
»أنه صلى الله عليه وسلم لعن النائحة والمستمعة«
“নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মাতমকারী ও মাতম শ্রবণকারীকে লা‘নত করেছেন”।[2] অর্থাৎ যে স্বেচ্ছায় মাতম শুনে ও তা পছন্দ করে।
হে মুসলিম বোন, মুসীবতের সময় এসব হারাম কাজ থেকে বিরত থাকা একান্ত জরুরি, তুমি ধৈর্য ধারণ কর ও সাওয়াবের আশা রাখ, যেন মুসীবত তোমার পাপের কাফফারা ও নেকি বৃদ্ধির কারণ হয়। আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
﴿وَلَنَبۡلُوَنَّكُم بِشَيۡءٖ مِّنَ ٱلۡخَوۡفِ وَٱلۡجُوعِ وَنَقۡصٖ مِّنَ ٱلۡأَمۡوَٰلِ وَٱلۡأَنفُسِ وَٱلثَّمَرَٰتِۗ وَبَشِّرِ ٱلصَّٰبِرِينَ ١٥٥ ٱلَّذِينَ إِذَآ أَصَٰبَتۡهُم مُّصِيبَةٞ قَالُوٓاْ إِنَّا لِلَّهِ وَإِنَّآ إِلَيۡهِ رَٰجِعُونَ ١٥٦ أُوْلَٰٓئِكَ عَلَيۡهِمۡ صَلَوَٰتٞ مِّن رَّبِّهِمۡ وَرَحۡمَةٞۖ وَأُوْلَٰٓئِكَ هُمُ ٱلۡمُهۡتَدُونَ ١٥٧﴾ [البقرة: ١٥٥، ١٥٧]
“আর আমরা অবশ্যই তোমাদেরকে পরীক্ষা করব কিছু ভয়, ক্ষুধা এবং জান-মাল ও ফল-ফলাদির স্বল্পতার মাধ্যমে। আর তুমি ধৈর্যশীলদের সুসংবাদ দাও। যারা, তাদেরকে যখন বিপদ আক্রান্ত করে তখন বলে, নিশ্চয় আমরা আল্লাহর জন্য এবং নিশ্চয় আমরা তার দিকে প্রত্যাবর্তনকারী। তাদের ওপরই রয়েছে তাদের রবের পক্ষ থেকে মাগফিরাত ও রহমত এবং তারাই হিদায়াত প্রাপ্ত”। [সূরা আল-বাকারা, আয়াত: ১৫৫-১৫৭]
হ্যাঁ, তোমার জন্য কাঁদা বৈধ যদি মাতম, হারাম কর্ম এবং আল্লাহর ফয়সালা ও কুদরতের ওপর অসন্তুষ্টি প্রকাশ না হয়। কারণ, ক্রন্দন মৃত ব্যক্তির প্রতি রহমত ও অন্তরে নম্রতার আলামত। দ্বিতীয়ত এটাকে প্রতিহত করাও সম্ভব নয়, তাই ক্রন্দন করা বৈধ, বরং মুস্তাহাব। আল্লাহই সাহায্যকারী।
[2] আবু দাউদ, হাদীস নং ৩১২৮; আহমদ: (৩/৬৫)