ইসলাম-পূর্ব যুগ দ্বারা উদ্দেশ্য জাহেলী যুগ, যা বিশেষভাবে আরববাসী এবং সাধারণভাবে পুরো জগতবাসী যাপন করছিল, কারণ সেটা ছিল রাসূলদের বিরতি ও পূর্বের হিদায়াত বিস্মৃতির যুগ। হাদীসের ভাষা মতে “আল্লাহ তাদের দিকে দৃষ্টি দিলেন এবং আরব ও অনারব সবার ওপর তিনি গোস্বা করলেন, তবে অবশিষ্ট কতক আহলে কিতাব ব্যতীত”।[1] এ সময় নারীরা বেশির ভাগ ক্ষেত্রে ও সাধারণভাবে খুব কঠিন অবস্থার সম্মুখীন ছিল। বিশেষত আরব সমাজে। আরবরা কন্যা সন্তানের জন্মকে অপছন্দ করত। তাদের কেউ মেয়েকে জ্যান্ত দাফন করত যেন মাটির নিচে তার মৃত্যু ঘটে। আবার কেউ অসম্মান ও লাঞ্ছনার জীবন-যাপনে মেয়েকে বাধ্য করত। আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
﴿وَإِذَا بُشِّرَ أَحَدُهُم بِٱلۡأُنثَىٰ ظَلَّ وَجۡهُهُۥ مُسۡوَدّٗا وَهُوَ كَظِيمٞ ٥٨ يَتَوَٰرَىٰ مِنَ ٱلۡقَوۡمِ مِن سُوٓءِ مَا بُشِّرَ بِهِۦٓۚ أَيُمۡسِكُهُۥ عَلَىٰ هُونٍ أَمۡ يَدُسُّهُۥ فِي ٱلتُّرَابِۗ أَلَا سَآءَ مَا يَحۡكُمُونَ ٥٩﴾ [النحل: ٥٨، ٥٩]
“আর যখন তাদের কাউকে কন্যা সন্তানের সুসংবাদ দেওয়া হত, তখন তার চেহারা কালো হয়ে যায়, আর সে থাকে দুঃখ ভারাক্রান্ত। তাকে যে সংবাদ দেওয়া হয়েছে সে দুঃখে সে কওম থেকে আত্মগোপন করে। অপমান সত্ত্বেও কি একে রেখে দেবে, না মাটিতে পুঁতে ফেলবে? জেনে রাখ, তারা যা ফয়সালা করে তা কতই না মন্দ”! [সূরা আন-নাহল, আয়াত: (৫৮-৫৯]
অন্যত্র তিনি বলেন:
﴿وَإِذَا ٱلۡمَوۡءُۥدَةُ سُئِلَتۡ ٨ بِأَيِّ ذَنۢبٖ قُتِلَتۡ ٩﴾ [التكوير: ٨، ٩]
“আর যখন জীবন্ত কবরস্থ কন্যাকে জিজ্ঞাসা করা হবে, কী অপরাধে তাকে হত্যা করা হয়েছে”? [সূরা আত-তাকওয়ীর, আয়াত: ৮-৯]
‘মাওউদাতু’ সে মেয়েকে বলা হয়, যাকে জীবিত দাফন করা হয় যেন মাটির নীচে মারা যায়। কোনো কন্যা যদিও জ্যান্ত দাফন থেকে নিষ্কৃতি পেত, কিন্তু লাঞ্ছনার জীবন থেকে মুক্তি পেত না। নারীর ঘনিষ্ঠ আত্মীয়ের সম্পদ যদিও প্রচুর হত, কিন্তু তার মৃত্যুর পর নারী কখনো মিরাসের অধিকারী হত না, যদিও সে হত অভাবী ও খুব সংকটাপন্ন! কারণ তাদের নিকট পুরুষদের জন্য মিরাস খাস ছিল, নারীদের তাতে কোনো অংশ ছিল না, বরং নারীরা মৃত স্বামীর সম্পদের ন্যায় মিরাসে পরিণত হত। ফলশ্রুতিতে এক পুরুষের অধীন অনেক নারী আবদ্ধ হত, যার নির্ধারিত কোনো সংখ্যা ছিল না। একাধিক সপত্নী বা সতীন থাকার কারণে নারীরা যে সংকীর্ণতা, যুলম ও কোণঠাসা অবস্থার সম্মুখীন হত -সেটাও তাদের অনেকের নিকট বিবেচ্য ছিল না।
ইসলাম এসে নারীর ওপর থেকে এসব যুলম দূরীভূত করেছে, তাকে ফিরিয়ে দিয়েছে পুরুষদের ন্যায় মনুষ্য অধিকার। আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
﴿يَٰٓأَيُّهَا ٱلنَّاسُ إِنَّا خَلَقۡنَٰكُم مِّن ذَكَرٖ وَأُنثَىٰ﴾ [الحجرات: ١٣]
“হে মানব জাতি, নিশ্চয় আমরা তোমাদেরকে সৃষ্টি করেছি পুরুষ ও নারী থেকে”। [সূরা আল-হুজুরাত, আয়াত: ১৩]
এখানে আল্লাহ বলেছেন যে, মানব সৃষ্টির শুরু থেকে নারী পুরুষের সঙ্গী, যেমন সে পুরুষের সঙ্গী নেকি প্রাপ্তি ও শাস্তির ক্ষেত্রে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
﴿مَنۡ عَمِلَ صَٰلِحٗا مِّن ذَكَرٍ أَوۡ أُنثَىٰ وَهُوَ مُؤۡمِنٞ فَلَنُحۡيِيَنَّهُۥ حَيَوٰةٗ طَيِّبَةٗۖ وَلَنَجۡزِيَنَّهُمۡ أَجۡرَهُم بِأَحۡسَنِ مَا كَانُواْ يَعۡمَلُونَ ٩٧﴾ [النحل: ٩٧]
“যে মুমিন অবস্থায় নেক আমল করবে, পুরুষ হোক বা নারী, আমরা তাকে পবিত্র জীবন দান করব এবং তারা যা করত তার তুলনায় অবশ্যই আমরা তাদেরকে উত্তম প্রতিদান দেব”। [সূরা আন-নাহাল, আয়াত: ৯৭]
অপর আয়াতে তিনি বলেন:
﴿لِّيُعَذِّبَ ٱللَّهُ ٱلۡمُنَٰفِقِينَ وَٱلۡمُنَٰفِقَٰتِ وَٱلۡمُشۡرِكِينَ وَٱلۡمُشۡرِكَٰتِ﴾ [الاحزاب: ٧٣]
“যাতে আল্লাহ মুনাফিক পুরুষ ও মুনাফিক নারী এবং মুশরিক পুরুষ ও মুশরিক নারীদের ‘আযাব দেন। আর মুমিন পুরুষ ও মুমিন নারীদের ক্ষমা করে দেন। আল্লাহ অত্যন্ত ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু”। [সূরা আল-আহযাব, আয়াত: ৭৩]
আল্লাহ তা‘আলা মৃত ব্যক্তির সম্পদের ন্যায় নারীকে পরিত্যক্ত মিরাস গণ্য করা হারাম করেন। যেমন তিনি বলেন:
﴿يَٰٓأَيُّهَا ٱلَّذِينَ ءَامَنُواْ لَا يَحِلُّ لَكُمۡ أَن تَرِثُواْ ٱلنِّسَآءَ كَرۡهٗاۖ ﴾ [النساء: ١٩]
“হে মুমিনগণ, তোমাদের জন্য হালাল নয় যে, তোমরা জোর করে নারীদের ওয়ারিশ হবে”। [সূরা আন-নিসা, আয়াত: ১৯]
এভাবে ইসলাম নারীর ব্যক্তি স্বাধীনতা পুনরুদ্ধার করে তাকে ওয়ারিশ ঘোষণা দেয়। কারণ, সে পরিত্যক্ত সম্পদ নয়। মৃত নিকট আত্মীয়ের পরিত্যক্ত সম্পদ থেকে মিরাসের হক প্রদান করে তাকে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
﴿لِّلرِّجَالِ نَصِيبٞ مِّمَّا تَرَكَ ٱلۡوَٰلِدَانِ وَٱلۡأَقۡرَبُونَ وَلِلنِّسَآءِ نَصِيبٞ مِّمَّا تَرَكَ ٱلۡوَٰلِدَانِ وَٱلۡأَقۡرَبُونَ مِمَّا قَلَّ مِنۡهُ أَوۡ كَثُرَۚ نَصِيبٗا مَّفۡرُوضٗا ٧﴾ [النساء: ٧]
“পুরুষদের জন্য মাতা পিতা ও নিকট আত্মীয়রা যা রেখে গিয়েছে তা থেকে একটি অংশ রয়েছে। আর নারীদের জন্য রয়েছে মাতা পিতা ও নিকট আত্মীয়রা যা রেখে গিয়েছে তা থেকে একটি অংশ, তা কম হোক বা বেশি হোক, নির্ধারিত হারে”। [সূরা আন-নিসা, আয়াত: ৭]
অপর আয়াতে তিনি বলেন:
﴿يُوصِيكُمُ ٱللَّهُ فِيٓ أَوۡلَٰدِكُمۡۖ لِلذَّكَرِ مِثۡلُ حَظِّ ٱلۡأُنثَيَيۡنِۚ فَإِن كُنَّ نِسَآءٗ فَوۡقَ ٱثۡنَتَيۡنِ فَلَهُنَّ ثُلُثَا مَا تَرَكَۖ وَإِن كَانَتۡ وَٰحِدَةٗ فَلَهَا ٱلنِّصۡفُۚ ﴾ [النساء: ١١]
“আল্লাহ তোমাদেরকে তোমাদের সন্তানদেরকে ক্ষেত্রে নির্দেশ দিচ্ছেন, এক ছেলের জন্য দুই মেয়ের অংশের সমপরিমাণ। তবে যদি তারা দুইয়ের অধিক মেয়ে হয়, তাহলে তাদের জন্য হবে, যা সে রেখে গছে তার তিন ভাগের দুই ভাগ, আর যদি একজন মেয়ে হয় তখন তার জন্য অর্ধেক ...”। [সূরা আন-নিসা, আয়াত: ১১]
এভাবে আল্লাহ একজন নারীকে মা, মেয়ে, বোন ও স্ত্রী হিসেবে মিরাস দান করেন।
আর বিবাহের ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ চারজন স্ত্রী রাখার অনুমতি প্রদান করেন, শর্ত হচ্ছে নারীদের মাঝে ইনসাফ প্রতিষ্ঠা ও তাদের সাথে প্রচলিত রেওয়াজ মোতাবেক আচরণ করতে হবে। তিনি বলেন:
﴿وَعَاشِرُوهُنَّ بِٱلۡمَعۡرُوفِۚ﴾ [النساء: ١٩]
“আর তাদের সাথে সদ্ভাবে আচরণ কর”। [সূরা আন-নিসা, আয়াত: ১৯]
অধিকন্তু নারীর জন্য পুরুষের ওপর দেন-মোহর অবধারিত করে তাকে তা পরিপূর্ণ প্রদান করার নির্দেশ দেন, তবে নারী যদি স্বেচ্ছায় ও পূর্ণ সন্তুষ্টিতে কিছু হক ত্যাগ করে সেটা পুরুষের জন্য বৈধ। তিনি বলেন:
﴿وَءَاتُواْ ٱلنِّسَآءَ صَدُقَٰتِهِنَّ نِحۡلَةٗۚ فَإِن طِبۡنَ لَكُمۡ عَن شَيۡءٖ مِّنۡهُ نَفۡسٗا فَكُلُوهُ هَنِيٓٔٗا مَّرِيٓٔٗا ٤ ﴾ [النساء: ٤]
“আর তোমরা নারীদেরকে সন্তুষ্টচিত্তে তাদের মোহর দিয়ে দাও, অতঃপর যদি তারা তোমাদের জন্য তা থেকে খুশি হয়ে কিছু ছাড় দেয়, তাহলে তোমরা তা সানন্দে তৃপ্তিসহ খাও”। [সূরা আন-নিসা, আয়াত: ৪]
ইসলাম নারীকে তার স্বামীর ঘরে আদেশ ও নিষেধকারী জিম্মাদার এবং স্বীয় সন্তানের ওপর কর্তৃত্বকারী অভিভাবক বানিয়েছে। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন:
«وَالْمَرْأَةُ رَاعِيَةٌ فِي بَيْتِ زَوْجِهَا وَمَسْئُولَةٌ عَنْ رَعِيَّتِهَا»
“নারী তার স্বামীর ঘরে জিম্মাদার এবং তার জিম্মাদারি সম্পর্কে তাকে জিজ্ঞাসা করা হবে”।[1]
রেওয়াজ মোতাবেক নারীর খরচ ও পোশাক-পরিচ্ছদ প্রদান করা স্বামীর ওপর ওয়াজিব করেছেন।
সন্দেহ নেই, ইসলামের শত্রু বরং মানব জাতির শত্রু কাফির, মুনাফিক ও যাদের অন্তরে ব্যাধি রয়েছে, ইসলাম কর্তৃক প্রদত্ত নারীর ইজ্জত, সম্মান ও নিরাপত্তা তাদেরকে ক্ষেপিয়ে তুলেছে। কারণ এসব কাফির ও মুনাফিকরা চায় নারীরা দুর্বল ঈমান ও প্রবৃত্তির অনুসারীদের শিকার করা বস্তু ও ধ্বংসের হাতিয়ার হোক। আর তাদের সমাজের নারীদের থেকে তারা নিজেরা প্রবৃত্তি পূর্ণ করে নিয়েছে সন্দেহ নেই। আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
﴿وَيُرِيدُ ٱلَّذِينَ يَتَّبِعُونَ ٱلشَّهَوَٰتِ أَن تَمِيلُواْ مَيۡلًا عَظِيمٗا﴾ [النساء: ٢٧]
“আর যারা প্রবৃত্তির অনুসরণ করে তারা চায় যে, তোমরা প্রবলভাবে (সত্য থেকে) বিচ্যুত হও”। [সূরা আন-নিসা, আয়াত: ২৭]
বস্তুত যেসব মুসলিমদের অন্তরে রোগ ও ব্যাধি রয়েছে, তারা চায় নারীরা তাদের প্রবৃত্তি পূরণ ও শয়তানি কর্ম-কাণ্ডে সস্তাপণ্য হোক। তাদের সামনে উন্মুক্ত পণ্য হয়ে থাক, যেন তার সৌন্দর্য দেখে তারা মুগ্ধ হয় অথবা তার থেকে আরো ঘৃণিত উদ্দেশ্য হাসিল করতে সক্ষম হয়। এ জন্য তারা প্রলুব্ধ করে যেন কাজের জন্য নারী ঘর থেকে বের হয় ও তাদের পাশা-পাশি কাজ করে অথবা নার্স সেজে পুরুষদের সেবা দেয় অথবা বিমান বালা হয় অথবা সহশিক্ষায় ছাত্রী কিংবা শিক্ষিকা হয়। অথবা সিনেমায় অভিনেত্রী ও গায়িকা হয় অথবা বিভিন্ন মিডিয়ার বিজ্ঞাপনে মডেল হয়। উন্মুক্ত ঘোরাফেরা এবং কণ্ঠ ও সৌন্দর্য প্রদর্শন করে ফেতনার জন্ম দেয়। ম্যাগাজিনগুলো অধিক প্রচার ও বাজার হাসিল করার উদ্দেশ্যে উলঙ্গ-আবেদনময়ী নারীদের অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করে। কতক অসাধু ব্যবসায়ী তাদের পণ্য প্রচারের জন্য এসব ছবিকে হাতিয়ার হিসেবে নিয়েছে, তাদের উৎপাদিত পণ্য ও শো-রোমসমূহে এসব ছবি তারা সাঁটিয়ে দেয়। এ জাতীয় পদক্ষেপ ও কর্মকাণ্ডের কারণে অধিকাংশ নারী তাদের ঘরের প্রকৃত দায়িত্ব ত্যাগ করেছে, যে কারণে তাদের স্বামীরা ঘর গুছানো ও সন্তান লালন-পালন করার জন্য বাধ্য হয়ে বাহির থেকে খাদ্দামাহ ও সেবিকা ভাড়া করছে, যা অনেক ফিতনা ও অনিষ্টের জন্ম দিচ্ছে দিন দিন।
১. নারী যদি কাজের মুখাপেক্ষী হয় অথবা সমাজ তার সেবার প্রয়োজন বোধ করে এবং তার সেবা দানকারী বিকল্প কোনো পুরুষ না পাওয়া যায়।
২. নারীর মূল দায়িত্ব বাড়ির কাজ শেষে অন্য কাজ করা।
৩. নারীদের পরিবেশে কাজ করা, যেমন পুরুষ থেকে পৃথক পরিবেশে নারীদের শিক্ষা দান করা অথবা নারীদের সেবা ও চিকিৎসা প্রদান করা। এ তিনটি শর্তে নারীর পক্ষে ঘরের বাইরে কাজ করা বৈধ।
৪. অনুরূপ নারীর পক্ষে দীনি ইলম শিখা ও শিখানো দোষ নয় বরং জরুরি, তবে নারীদের পরিবেশে হতে হবে। অনুরূপ মসজিদ ও মসজিদের মতো পরিবেশে ধর্মীয় মজলিসে অংশ গ্রহণ করা তার পক্ষে দোষণীয় নয়। অবশ্যই পুরুষ থেকে পৃথক ও পর্দানশীন থাকা জরুরি, যেভাবে ইসলামের শুরু যুগে নারীরা কাজ আঞ্জাম দিত, দীন শিক্ষা করত ও মসজিদে হাজির হত।