ইদ্দত পালনকারী নারীর জন্য যা হারাম:

১. ইদ্দত পালনকারী নারীকে বিয়ের প্রস্তাব দেওয়ার হুকুম:

ক. রজ‘ঈ ইদ্দত পালনকারী। এ জাতীয় নারীকে স্পষ্ট বা ইঙ্গিতে বিয়ের প্রস্তাব দেওয়া হারাম। কারণ, সে এখনো সাবেক স্বামীর স্ত্রীর হুকুমে, তাই তাকে প্রস্তাব দেওয়া কারো জন্য বৈধ নয়, এখনো সে স্বামীর নিরাপত্তায় রয়েছে।

খ. রজ‘ঈ ব্যতীত অন্য কোনো ইদ্দত পালনকারী। এ জাতীয় নারীকে স্পষ্টভাবে বিয়ের প্রস্তাব দেওয়া হারাম, তবে ইশারা ইঙ্গিতে প্রস্তাব দেওয়া হারাম নয়। আল্লাহ তা‘আলা বলেন:

﴿وَلَا جُنَاحَ عَلَيۡكُمۡ فِيمَا عَرَّضۡتُم بِهِۦ مِنۡ خِطۡبَةِ ٱلنِّسَآءِ﴾ [البقرة: ٢٣٥]

“আর এতে তোমাদের কোনো পাপ নেই যে, তোমরা নারীদেরকে ইশারায় যে প্রস্তাব করবে”। [সূরা আল-বাকারা, আয়াত: ২৩৫]

স্পষ্ট প্রস্তাব অর্থ তাকে বিয়ে করার আগ্রহ প্রকাশ করা, যেমন বলা: আমি তোমাকে বিয়ে করতে চাই। কারণ, এমন হলে হয়তো বিয়ের আগ্রহ থেকে নারী ইদ্দত শেষ হওয়ার আগে বলবে আমার ইদ্দত শেষ, যদিও বাস্তবে ইদ্দত শেষ হয় নি। ইশারা-ইঙ্গিতের প্রস্তাব এরূপ নয়, কারণ তার দ্বারা বিয়ে করার স্পষ্ট বার্তা প্রদান করা হয় না, তাই তাতে ক্ষতির সম্ভাবনা নেই। দ্বিতীয়ত আয়াত যেহেতু তার অনুমতি প্রদান করেছে তাই তা বৈধ।

ইশারা-ইঙ্গিতের উদাহরণ: তোমার মতো নারীর আমি খুব প্রয়োজন বোধ করি। রাজ‘ঈ ইদ্দত ব্যতীত অন্য কোনো ইদ্দত পালনকারী নারীর পক্ষে ইঙ্গিত দাতার প্রস্তাবের উত্তর ইঙ্গিতের মাধ্যমে প্রদান করা বৈধ, তবে স্পষ্টভাবে সাড়া দেওয়া বৈধ নয়। রাজ‘ঈ ইদ্দত পালনকারী নারীর পক্ষে ইশারা বা স্পষ্ট কোনো ভাবেই বিয়ের প্রস্তাবে সাড়া দেওয়া বৈধ নয়।

২. অপরের ইদ্দত পালনকারী নারীকে বিয়ে করা হারাম:

আল্লাহ তা‘আলা বলেন:

﴿وَلَا تَعۡزِمُواْ عُقۡدَةَ ٱلنِّكَاحِ حَتَّىٰ يَبۡلُغَ ٱلۡكِتَٰبُ أَجَلَهُۥۚ﴾ [البقرة: ٢٣٥]

“আর আল্লাহর নির্দেশ (ইদ্দত) তার সময় পূর্ণ করার পূর্বে বিবাহ বন্ধনের সংকল্প করো না”।  [সূরা আল-বাকারা, আয়াত: ২৩৫]

ইবন কাসির রহ. তার ‘তাফসীর’: (১/৫০৯) গ্রন্থে বলেন: “অর্থাৎ বিয়ের আকদ কর না যতক্ষণ না ইদ্দত শেষ হয়। আলেমগণ একমত যে, ইদ্দতের সময় বিয়ের আকদ দুরস্ত নয়।” সমাপ্ত।

দু’টি জ্ঞাতব্য:

এক. যে নারীকে বিয়ের পর সহবাসের পূর্বে তালাক দেওয়া হয় তার ওপর কোনো ইদ্দত নেই। আল্লাহ তা‘আলা বলেন:

﴿يَٰٓأَيُّهَا ٱلَّذِينَ ءَامَنُوٓاْ إِذَا نَكَحۡتُمُ ٱلۡمُؤۡمِنَٰتِ ثُمَّ طَلَّقۡتُمُوهُنَّ مِن قَبۡلِ أَن تَمَسُّوهُنَّ فَمَا لَكُمۡ عَلَيۡهِنَّ مِنۡ عِدَّةٖ تَعۡتَدُّونَهَاۖ﴾ [الاحزاب: ٤٩]

“হে মুমিনগণ, যখন তোমরা মুমিন নারীদেরকে বিবাহ করবে অতঃপর তাদেরকে স্পর্শ করার পূর্বেই তালাক দিয়ে দেবে, তাহলে তোমাদের জন্য তাদের কোনো ইদ্দত নেই যা তোমরা গণনা করবে”। [সূরা আল-আহযাব, আয়াত: ৪৯]

ইবন কাসির রহ. তার তাফসীর: (৫/৪৭৯) গ্রন্থে বলেন: এ মাস’আলার ক্ষেত্রে সকল আলেম একমত, অর্থাৎ নারীকে যদি সহবাসের পূর্বে তালাক দেওয়া হয়, তাহলে তার ওপর কোনো ইদ্দত নেই, সে তালাকের পর তৎক্ষণাৎ যার সাথে ইচ্ছা বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হতে পারবে।

দুই. বিয়ের পর সহবাসের পূর্বে তালাক প্রাপ্তা নারীর জন্য যদি মাহর নির্ধারণ করা হয়, তাহলে তাকে অর্ধেক মাহর দিবে, আর যার মাহর নির্ধারণ করা হয় নি তাকে মুত‘আহ অর্থাৎ স্বামীর সাধ্য মোতাবেক পোশাক ইত্যাদি প্রদান করবে।

সহবাসের পর যাকে তালাক দেওয়া হয়, সে অবশ্যই মাহরের হকদার। আল্লাহ তা‘আলা বলেন:

﴿لَّا جُنَاحَ عَلَيۡكُمۡ إِن طَلَّقۡتُمُ ٱلنِّسَآءَ مَا لَمۡ تَمَسُّوهُنَّ أَوۡ تَفۡرِضُواْ لَهُنَّ فَرِيضَةٗۚ وَمَتِّعُوهُنَّ عَلَى ٱلۡمُوسِعِ قَدَرُهُۥ وَعَلَى ٱلۡمُقۡتِرِ قَدَرُهُۥ مَتَٰعَۢا بِٱلۡمَعۡرُوفِۖ حَقًّا عَلَى ٱلۡمُحۡسِنِينَ ٢٣٦ وَإِن طَلَّقۡتُمُوهُنَّ مِن قَبۡلِ أَن تَمَسُّوهُنَّ وَقَدۡ فَرَضۡتُمۡ لَهُنَّ فَرِيضَةٗ فَنِصۡفُ مَا فَرَضۡتُمۡ ﴾ [البقرة: ٢٣٦،  ٢٣٧]

“তোমাদের কোনো অপরাধ নেই যদি তোমরা স্ত্রীদেরকে তালাক দাও এমন অবস্থায় যে, তোমরা তাদেরকে স্পর্শ কর নি কিংবা তাদের জন্য কোনো মাহর নির্ধারণ কর নি। আর উত্তমভাবে তাদেরকে ভোগ-উপকরণ দিয়ে দাও, ধনীর ওপর তার সাধ্যানুসারে এবং সংকটাপন্নের ওপর তার সাধ্যানুসারে। সু-কর্মশীলদের ওপর এটি আবশ্যক। আর যদি তোমরা তাদেরকে তালাক দাও, তাদেরকে স্পর্শ করার পূর্বে এবং তাদের জন্য কিছু মাহর নির্ধারণ করে থাক, তাহলে যা নির্ধারণ করেছে, তার অর্ধেক (দিয়ে দাও)”। [সূরা আল-বাকারা, আয়াত: ২৩৬-২৩৭]

অর্থাৎ স্বামীদের স্পর্শ ও মাহর নির্ধারণ করার পূর্বে তালাক দেওয়া কোনো সমস্যা নয়, এতে যদিও নারী মনক্ষুণ্য হয়, মুত‘আহ তার মনক্ষুণ্যতা লাঘব করবে। প্রত্যেক স্বামী স্বীয় স্বচ্ছলতা ও অস্বচ্ছলতার ভিত্তিতে সাধ্য ও সমাজে প্রচলন মোতাবেক মুত‘আহ দিবে। অতঃপর যার মাহর নির্ধারিত, তাকে অর্ধেক দেওয়ার নির্দেশ প্রদান করা হয়েছে।

হাফেয ইবন কাসির রহ. স্বীয় ‘তাফসীর’: (১/৫১২) গ্রন্থে বলেন: “এ জাতীয় নারীকে অর্ধেক মাহর প্রদান করা সর্বসম্মত মত। এতে কোনো আলেম দ্বিমত পোষণ করেন নি”। সমাপ্ত।

৩. বিধবা নারীর ইদ্দতে পাঁচটি বস্তু হারাম, যার আরবি নাম হিদাদ:

এক. সকল প্রকার সুগন্ধি: বিধবা নারী নিজের শরীরে কিংবা কাপড়ে সুগন্ধি ব্যবহার করবে না, অনুরূপ সুগন্ধি যুক্ত বস্তুও ব্যবহার করবে না। কারণ, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন:

»ولا تمس طيبا«

“কোনো সুগন্ধি স্পর্শ করবে না”।[1]

দুই. শারীরিক সাজসজ্জা গ্রহণ করা: বিধবা নারীর সাজসজ্জা গ্রহণ করা, যেমন খিযাব ও অন্যান্য রূপচর্চার বস্তু সুরমা, শরীরের তক রঙ্গিনকারী বিভিন্ন প্রকার রঙ ব্যবহার করা হারাম। ওষুধ হিসেবে সুরমা ব্যবহার করা বৈধ, যদি প্রয়োজন হয়, সৌন্দর্যের অংশ হিসেবে নয়, সুরমা শুধু রাতে ব্যবহার করবে, দিনে মুছে ফেলবে। সুরমা ব্যতীত অন্যান্য বস্তু দ্বারা চোখের চিকিৎসা করাও বৈধ, যাতে সৌন্দর্য নেই।

তিন. সাজসজ্জার কাপড় পরিধান করা: বিধবা নারীর জন্য সাজসজ্জার কাপড় পরিধান করা হারাম। সাধারণ কাপড় পড়বে, এ সময় নির্দিষ্ট রঙের কাপড় পরিধান করার কোনো ভিত্তি নেই, সমাজে যার প্রচলন রয়েছে।

চার. অলঙ্কার: বিধবা নারীর জন্য সকল প্রকার অলঙ্কার পরিধান করা হারাম, এমন কি আঙ্কটি পর্যন্ত।

পাঁচ. স্ত্রী যে ঘরে থাকাবস্থায় স্বামী মারা যায় সে ঘর ব্যতীত কোথাও রাত-যাপন করা: শর‘ঈ কোনো কারণ ব্যতীত বিধবা নারীর জন্য ঘর পরিবর্তন করা জায়েয নয়। সে কোনো রোগী কিংবা কোনো বন্ধু কিংবা কোনো নিকট আত্মীয়কে দেখতে যাবে না, একান্ত প্রয়োজনে দিনে বের হওয়া বৈধ। এ পাঁচটি বস্তু ব্যতীত কোনো জিনিস থেকে তাকে বারণ করা যাবে না, আল্লাহ তার জন্য যা হালাল করেছেন।

ইমাম ইবনুল কাইয়্যিম রহ. ‘আল-হাদইউন নববী’: (৫/৫০৭) গ্রন্থে বলেন: “বিধবা নারীকে নখ কাঁটা, বগলের পশম উপড়ে ফেলা, যে চুল ফেলে দেওয়া মুস্তাহাব তা ফেলে দেওয়া, বড়ই পাতা দিয়ে গোসল করা ও চুল আঁচড়ানো থেকে বারণ করা যাবে না।” সমাপ্ত।

শাইখুল ইসলাম ইবন তাইমিয়্যাহ ‘মাজমুউল ফতোয়ায়’: (২৪/২৭ ও ২৮) বলেন: “বিধবা নারীর জন্য সব কিছু খাওয়া বৈধ, যা আল্লাহ তার জন্য হালাল করেছেন। যেমন, ফল ও মাংস ইত্যাদি। অনুরূপ বৈধ সকল পানীয় পান করা... অতঃপর তিনি বলেন: বৈধ কোনো কাজে ব্যস্ত থাকা তার জন্য হারাম নয়। যেমন, নকশা, সেলাই ও কাপড় বুনা ইত্যাদি, যা নারীদের স্বভাব সূলভ কাজ। অনুরূপ ইদ্দতের বাইরে সেসব কাজ করা তার জন্য বৈধ ইদ্দতের ভেতরও তা বৈধ। যেমন, প্রয়োজনে পুরুষদের সাথে কথা বলা, তবে পর্দার আড়াল থেকে অবশ্যই। আমি যা উল্লেখ করলাম তা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সুন্নত, যা সাহাবীগণের নারীগণ সম্পাদন করতেন তাদের স্বামীদের মৃত্যুর পর।” সমাপ্ত।

সাধারণ মানুষ যা বলে, চাঁদ থেকে বিধবা নারী চেহারা ঢেকে রাখবে, ঘরের ছাদে উঠবে না, পুরুষের সাথে কথা বলবে না, মাহরামদের থেকেও চেহারা ঢেকে রাখবে, আরো অনেক কিছু তার কোনো ভিত্তি নেই। আল্লাহ তা‘আলা ভালো জানেন।

[1] সহীহ বুখারী, হাদীস নং ৫০২৮; সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ৯৩৮; নাসাঈ, হাদীস নং ৩৫৩৪; আবু দাউদ, হাদীস নং ২৩০২; ইবন মাজাহ, হাদীস নং ২০৮৭; আহমদ (৫/৮৫); দারেমী, হাদীস নং ২২৮৬