উপসংহার: বাইবেল বনাম বাইবেলীয় ধর্মবিশ্বাস

সুপ্রিয় পাঠক, পবিত্র বাইবেলের ধর্মবিশ্বাস নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করার সুযোগ পাচ্ছি না। তবে সংক্ষেপে এটুকু বলা যায় যে, পবিত্র বাইবেল ইহুদি ও খ্রিষ্টান দু’টা বৃহৎ ধর্মের গ্রন্থ। উভয় ধর্মের বিশ্বাসই বাইবেল থেকে গৃহীত, কিন্তু সাংঘর্ষিক। বাইবেল দিয়ে খ্রিষ্টানরা যে বিশ্বাস প্রমাণ করেন ইহুদিরা বাইবেল দ্বারাই তা কুফরী বলে প্রমাণ করেন। পাঠক এ বিষয়ে ইহুদি পণ্ডিত রাবিব স্টুয়ার্ট ফেডেরো (Rabbi Stuart Federow) পরিচালিত  ‘ইহুদিরা কী বিশ্বাস করেন?’ (what jews believe) নামক ওয়েবসাইট (http://whatjewsbelieve.org/index.html) থেকে বিস্তারিত জানতে পারবেন।

মানুষের পাপের জন্য যীশুর রক্তপাত, আদিপাপ, ঈশ্বরের ত্রিত্ব, যীশুর ঈশ্বরত্ব ইত্যাদি বিষয়গুলোকে বাইবেলের আলোকে ভুল প্রমাণ করে রাবিব ফেডেরো বলেন:

“Jews Believe That: One person cannot die for the sins of another... Jesus was not the messiah, G-d hates human sacrifices, People are born pure and without original sin. Gd is one and indivisible... Gd does not become human and humans do not become Gd...” ‘‘ইহুদিরা বিশ্বাস করে যে, এক ব্যক্তি অন্যের পাপের জন্য মৃত্যুবরণ করতে পারে না। ... যীশু মসীহ ছিলেন না, ঈশ্বর নরবলি ঘৃণা করেন, মানুষ আদিপাপ-মুক্ত হয়ে জন্মগ্রহণ করে। ... ঈশ্বর এক এবং অবিভাজ্য। ... ঈশ্বর মানবীয় রূপ নেন না এবং মানুষ ঈশ্বর হতে পারে না।’’

তার বিস্তারিত আলোচনার কয়েকটা বিষয়ের সার সংক্ষেপ নিম্নরূপ:

(১) এক ব্যক্তি অন্যের পাপের জন্য মৃত্যুবরণ করতে পারে না

খ্রিষ্টানরা যীশুকে মসীহ বলে বিশ্বাস করেন এবং বিশ্বাস করেন যে, তিনি সকল মানুষের পাপের জন্য মৃত্যুবরণ করেন। মসীহ সম্পর্কে এরূপ ধারণা আমাদের বাইবেলের মধ্যে পাওয়া যায় না। বরং বাইবেল আমাদেরকে অত্যন্ত সুস্পষ্টভাবে এবং অবিরতভাবে শিক্ষা দিচ্ছে যে, একজন মানুষ অন্যের পাপের জন্য মৃত্যু বরণ করতে পারেন না। বনি-ইসরাইলরা যখন বাছুর পুজা করে তখন মূসা তাদের পাপের জন্য নিজেকে কাফ্ফারা হিসেবে পেশ করার চেষ্টা করেন, কিন্তু ঈশ্বর তা অগ্রাহ্য করেন:

‘‘পরদিন মূসা লোকদের বললেন, তোমরা মহাগুনাহ্ করলে, এখন আমি মাবুদের কাছে উঠে যাচ্ছি; যদি সম্ভব হয়, তোমাদের গুনাহ্র কাফ্ফারা দেবো। পরে মূসা মাবুদের কাছে ফিরে গিয়ে বললেন, হায় হায়, এই লোকেরা মহাগুনাহ্ করেছে, নিজেদের জন্য সোনার দেবমূর্তি তৈরি করেছে। আহা! এখন যদি এদের গুনাহ মাফ করতে চাও তবে মাফ কর। আর যদি না কর তবে আমি বিনয় করছি, তোমার লেখা কিতাব থেকে আমার নাম কেটে ফেল। তখন মাবুদ মূসাকে বললেন, যে ব্যক্তি আমার বিরুদ্ধে গুনাহ্ করেছে, তারই নাম আমি আমার কিতাব থেকে কেটে ফেলব। ... মাবুদ লোকদের আঘাত করলেন, কেননা লোকেরা হারুনের কৃত সেই বাছুর তৈরি করেছিল।’’ (হিজরত ৩২/৩০-৩৫, মো.-১৩)

বাইবেলের এ বক্তব্য দ্ব্যর্থহীনভাবে নিশ্চিত করছে যে, যে পাপ করবে সেই শুধু মরবে, অন্য কেউ শাস্তি গ্রহণ বা ঈশ্বরের জীবন-কিতাব থেকে নাম কেটে মৃত্যু গ্রহণ করে তার পাপ মোচন করতে পারে না। বাইবেল অন্যত্রও এ বিষয় নিশ্চিত করেছে: ‘‘সন্তানের জন্য পিতার, কিংবা পিতার জন্য সন্তানের প্রাণদ- করা যাবে না; প্রত্যেক জন নিজ নিজ গুনাহ্র জন্যই প্রাণদ- ভোগ করবে।’’ (দ্বিতীয় বিবরণ ২৪/১৬, মো.-১৩)

যিহিষ্কেল ১৮ অধ্যায় পুরোটাই এ মূলনীতি ব্যাখ্যা করেছে। এ অধ্যায় নিশ্চিত করেছে যে, গুনাহর মাফ পেতে আমাদের দায়িত্ব অন্যায় কর্ম থেকে বিরত হওয়া এবং ভাল কর্ম করতে শুরু করা। কোথাও বলা হয়নি যে, গুনাহর মাফ পেতে রক্তপাত করতে হবে। (বিশেষত দেখুন যিহিষ্কেল ১৮/১-৪, ২০-২৪, ২৬-২৭)

ঈশ্বর আরো বলেছেন যে, একের পাপে অন্যের মৃত্যু অথবা একের মৃত্যুতে অন্যের পাপমোচন হওয়ার কথা যে উদ্ভট ও বিভ্রান্তি তা এক সময় মানুষ বুঝবে এবং এরূপ মত পরিত্যাগ করবে: ‘‘সেই সময় লোকে আর বলবে না, পিতারা আঙ্গুর ফল খেয়েছিলেন, তাই সন্তানের দাঁত টকেছে। কিন্তু প্রত্যেকে নিজ নিজ অপরাধের দরুন মরবে; যে ব্যক্তি আঙ্গুর ফল খাবে তারই দাঁত টকে যাবে।’’ (ইয়ারমিয়া ৩১/২৯-৩০)

বাইবেলের নিদের্শনা অনুসারে ইহুদিরা বিশ্বাস করে যে, অন্যের পাপের কাফফরা হিসেবে কেউ মরতে পারেন না। যীশুর মৃত্যুর মধ্যে কোনো পাপমোচনের ক্ষমতা আছে বলে ইহুদিরা বিশ্বাস করেন না। এরূপ বিশ্বাস বাইবেল-বিরোধী (unbiblical)। বাহ্যত যীশুর ক্রুশে মৃত্যু হওয়ার পরে এ মৃত্যুকে অর্থবহ বলে পেশ করার জন্যই ‘মানুষের পাপ মোচনের জন্য যীশুর মৃত্যু’ বিশ্বাসটার উদ্ভাবন করা হয়।

খ্রিষ্টানরা বাইবেলের অন্য কিছু বক্তব্যকে উপরের বাইবেলীয় বক্তব্যের বিপরীতে পেশ করে প্রমাণ করতে চান যে, একের পাপের জন্য অন্যের মৃত্যু হওয়া সম্ভব। তাদের বক্তব্য সঠিক হলে স্বীকার করতে হবে যে, ঈশ্বর তাঁর মন পরিবর্তন করেন। কিন্তু বাইবেল নিশ্চিত করেছে যে, ঈশ্বরের পরিবর্তন হয় না (মালাখি ৩/৬)।[1]

(২) ইহুদিরা বিশ্বাস করেন যে, যীশু মসীহ ছিলেন না

খ্রিষ্টানরা বিশ্বাস করেন যে, যীশু ছিলেন মসীহ (Messiah)। মসীহ বিষয়ক খ্রিষ্টীয় বিশ্বাসকে ইহুদিরা বাইবেলে বিরোধী মনে করেন। মসীহ বিষয়ক খ্রিষ্টীয় বিশ্বাস বাইবেলীয় নয়, বরং পৌত্তলিক। পৌত্তলিকরা মসীহ বা অভিষিক্ত ত্রাণকর্তা বলতে যা বুঝেন খ্রিষ্টানরা মসীহ বলতে ঠিক তাই বুঝেন, তা হলো তাদের মৃত্যুবরণকারী ত্রাণকর্তা মানুষ-ঈশ্বর ও বীরেরা। প্রাচীন যুগে এমন অনেক উদাহরণ পাওয়া যায়। পারস্যের মিত্রা বা মিহির (Mithra/ mihr/ mher), গ্রীক-রোমান এডোনিস (Adonis), ডায়োনিসিস (Dionysis/ Dionysus/ Dionysos), অটিস (Attis), মিসরীয় রা (Ra) এবং আরো অনেক প্রাচীন এরূপ ত্রাণকর্তার কথা জানা যায় তারা সকলেই শীতকালে জন্মগ্রহণ করেন, বসন্তকালে মৃত্যুবরণ করেন এবং মৃত্যুর পরে পুনরুজ্জীবিত হন।

এ সকল ত্রাণকর্তা দেবতার অনুসারীরা বিশ্বাস করতেন যে, তাদের দেবতা তাদের পাপের জন্য জীবন দান করেছেন, এজন্য তাঁর অনুসারীরা অনন্ত জীবন লাভ করবেন। পৌত্তলিক জগতে এমন অনেক দেবতা রয়েছেন যারা মানুষ মাতা ও দেবতা পিতার সন্তান। গ্রীক-রোমান দেবতা হেরাক্লিস (Heracles)-এর পিতা দেবরাজ জিউস (Zeus) এবং মাতা আলকমিনি (Alcmene) নামক মানবী। দেবতা ডায়োনিসিসের মাতা সেমেলি (Semele) এবং পিতা দেবরাজ জিউস (Zeus)। ডায়োনিসিসকে একজন ত্রাণকর্তা দেবতা বলে বিশ্বাস করা হতো। খ্রিষ্টধর্মীয় বিশ্বাসের সাথে এ সকল পৌত্তলিক বিশ্বাসের মিল খুবই সুস্পষ্ট। প্রাচীন যুগ থেকেই ইহুদিরা খ্রিষ্টান ধর্মকে পৌত্তলিক ধর্ম হিসেবে গণ্য করেছেন এবং তাদেরকে সিনাগগ থেকে তাড়িয়ে দিয়েছেন।

আমরা ইহুদিরা মসীহ বলতে বাইবেল থেকে আমরা নিম্নের বিষয়গুলো বুঝি:

(১) মসীহ হবেন মানুষ পিতা ও মাতার সন্তান। ইহুদি বিশ্বাসে তিনি ঈশ্বরের পুত্র হবেন না। ঈশ্বরের পুত্র হওয়ার বিষয়টা একেবারেই পৌত্তলিক বিশ্বাস।

(২) মানবীয় পিতার ঔরসজাত সন্তান হিসেবে তিনি রাজা দাউদের বংশধর হবেন। (যিশাইয় ১১/১, ১০, যিরমিয় ২৩/৫; যিহিষ্কেল ৩৪/২৩-২৪, ৩৭/২১-২৮; যিরমিয় ৩০/৭-১০, ৩৩/১৪-১৬; হোশেয় ৩/৪-৫)। খ্রিষ্টান ধর্মবিশ্বাস অনুসারে যীশুর পিতা ঈশ্বর। এজন্য তিনি তাঁর মানুষ পিতা যোষেফের  ঔরসে দাউদের বংশধর নন।

(৩) মসীহ শলোমনের বংশধর হবেন (২ শমূয়েল ৭/১২-১৭; ১ বংশাবলি ২২/৯-১০)। কিন্তু লূক ৩/৩১ অনুসারে যীশু শলোমনের বংশধর নন; বরং তাঁর বৈমাত্রেয় ভাই নাথনের বংশধর। এদিক থেকেও তিনি মসীহ হওয়ার অযোগ্য।

(৪) মসীহ যিহোয়াকীম, যিকনিয় বা শল্টীয়েলের বংশধর হবেন না। কারণ এ বংশধারা অভিশপ্ত (১ বংশাবলি ৩/১৫-১৭; যিরমিয় ২২/১৮, ৩০)। কিন্তু মথি ১/১১-১২ এবং লূক ৩/২৭ অনুসারে যীশু শল্টীয়েলের বংশধর।

(৫) মসীহের আগমনের পূর্বে ইলিয়াস আসবেন এবং তাঁরা দুজনে সকল পরিবার একত্রিত করবেন (মালাখি ৪/৫-৬)। যীশু নিজেই এর বিপরীত কথা বলেছেন (মথি ১০/৩৪-৩৭)

(৬) বাইবেলের বক্তব্যের ভিত্তিতে ইহুদিরা বিশ্বাস করেন যে, বাস্তব দুনিয়ায় মসীহ ব্যাপক পরিবর্তন সাধন করবেন, যেগুলোর মধ্যে কয়েকটা নিম্নরূপ:

(ক) নিজ বংশধরদের মাধ্যমে মসীহ বাদশাহ দাউদের রাজত্ব পুনরায় প্রতিষ্ঠা করবেন (দানিয়েল ৭/১৩-১৪)। কিন্তু যীশুর কোনো সন্তান ছিল না।

(খ) মসীহ সকল জাতির ও সকল মানুষের মধ্যে চিরস্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠা করবেন (যিশাইয় ২/২-৪; মীখা ৪/১-৪; যিহিষ্কেল ৩৯/৯)। যীশুর মাধ্যমে কোনো শান্তি প্রতিষ্ঠা হয়নি। উপরন্তু যীশু নিজেই বলেছেন যে, তিনি শান্তি দিতে আসেননি, বরং তরবারী দিতে এসেছেন (মথি ১০/৩৪)।

(গ) মসীহ বিশ্বের সকল মানুষকে নৈতিক একেশ্বরবাদের (Ethical Monotheism) মধ্যে নিয়ে আসবেন (যিরমিয় ৩১/৩১-৩৪; সখরিয় ৮/২৩, ১৪/৯, ১৬; যিশাইয় ১১/৯)। মসীহ প্রতিমা পূজার অবসান ঘটাবেন (সখরিয় ১৩/২)। ঈশ্বরই ঈশ্বর- ইহুদিদের এ বিশ্বাসকে মসীহ বিশ্বময় প্রতিষ্ঠা করবেন (যিশাইয় ১১/৯)। মসীহের মাধ্যমে পৃথিবী নিরামিষ ভোজী হবে (যিশাইয় ১১/৬-৯)।

(ঘ) বনি-ইসরাইলের বার গোত্রের সকল মানুষকে মসীহ ইসরাইল রাজ্যে একত্রিত করবেন (যিহিষ্কেল ৩৬/২৪)। মসীহ শলোমনের মন্দির বা ধর্মধাম (বাইতুল মোকাদ্দস) পুনর্নিমাণ করবেন (যিশাইয় ২/২; যিহিষ্কেল ৩৭/২৬-২৮)।

(ঙ) মসীহের আগমনের পরে আর কখনো দুর্ভিক্ষ হবে না (যিহিষ্কেল ৩৬/২৯-৩০)। মসীহের আগমনের পরে মৃত্যু থেমে যাবে (যিশাইয় ২৫/৮)। অবশেষে মৃতরা পুনরুত্থিত হবে (যিশাইয় ২৬/১৯; দানিয়েল ১২/২; যিহিষ্কেল ৩৭/১২-১৩; যিশাইয় ৪৩/৫-৬)। পৃথিবীর জাতিগুলো জাগতিকভাবে ইহুদিদেরকে সাহায্য করবে (যিশাইয় ৬০/৫-৬, ৬০/১০-১২)। আত্মিক নেতৃত্বের জন্য ইহুদিদেরকে খোঁজা হবে (জাকারিয়া ৮/২৩)। সকল অস্ত্র ধ্বংস করা হবে (যিহিষ্কেল ৩৯/৯, ১২)।

(চ) নীল নদ শুকিয়ে যাবে (যিশাইয় ১১/১৫)। ইসরাইল দেশের গাছগুলো মাসে মাসে ফল দেবে (যিহিষ্কেল ৪৭/১২) বনি-ইসরাইলের প্রত্যেক বংশ ফিলিস্তিন দেশে বাইবেল নির্ধারিত তাদের দেশগুলো দখলে পেয়ে যাবে (যিহিষ্কেল ৪৭/১৩-২৩)

(ছ) পৃথিবীর সকল জাতি স্বীকার করবে যে, তারা ভুলের মধ্যে ছিল এবং শুধু ইহুদিরাই সর্বদা সঠিক কর্মে ছিল। তারা স্বীকার করে নেবে যে, পরজাতিদের পাপ, তাদের অত্যাচার ও হত্যাকাণ্ডসমূহ ইহুদিরা বহন করেছে (যিশাইয় ৫৩ অধ্যায়)।

বাইবেল অনুসারে এ সকল পরিবর্তন হবে বাস্তব ও দৃশ্যমান। আর খ্রিষ্টানরা যীশুর মাধ্যমে যে পরিবর্তনের দাবি করেন তা দৃশ্যমান নয়; বরং বিশ্বাস নির্ভর। বিশ্বাস ছাড়া আর কোনোভাবেই তা প্রমাণ করা যায় না। যীশু মানুষদের পাপের জন্য জীবন দিয়েছেন, এ দাবিটা একমাত্র বিশ্বাস করা ছাড়া কিভাবে প্রমাণ করা যায়? ইহুদি বিশ্বাসে মসীহ যে সকল পরিবর্তন আনবেন তা প্রমাণযোগ্য। কিন্তু খ্রিষ্টীয় বিশ্বাসে মসীহ যে সকল পরিবর্তন এনেছেন তা বিশ্বাস করা যায়, কিন্তু প্রমাণ করা যায় না।

সর্বোপরি খ্রিষ্টানরাও স্বীকার করেন যে, বাইবেল ও ইহুদি বিশ্বাস অনুসারে মসীহ যে পরিবর্তনগুলো করবেন তা এখনো সাধিত হয়নি। আর  এ সমস্যার সমাধানের জন্যই খ্রিষ্টানরা যীশুর দ্বিতীয় আগমনের তত্ত্ব আবিষ্কার করেছেন। প্রকৃত মসীহকে এ সকল পরিবর্তন সাধন করতে দ্বিতীয়বার আগমন করতে হবে না। মসীহ হতে হলে তাকে অবশ্যই প্রথমবারে এসেই বাস্তব বিশ্বে প্রকৃতভাবে এ সকল পরিবর্তন সাধন করতে হবে। তাহলেই শুধু তিনি প্রকৃত মসীহ বলে গণ্য হবেন।[2]

(৩) ঈশ্বর নরবলি ঘৃণা করেন

মসীহ বিষয়ে খ্রিষ্টীয় বিশ্বাস যে, সকল মানুষকে তাদের পাপ থেকে রক্ষা করার জন্য যে রক্তপাত প্রয়োজনীয় ছিল যীশুই ছিলেন সেই রক্তবলি। কিন্তু ক্রুশের উপরে প্রকৃতপক্ষে কে মরলেন? যদি ঈশ্বর যীশু (Jesus-the-god) ক্রুশে মরেন তবে প্রমাণ হয় যে, ঈশ্বর মরণশীল! কিন্তু ঈশ্বর কিভাবে মরবেন? আর যদি মানুষ-যীশু (Jesus-the-human)  ক্রুশের উপরে মরেন তবে খ্রিষ্টানদেরকে স্বীকার করতে হবে যে, এখানে একজন মানুষকে কোরবানি দেওয়া হলো গুনাহর কাফফারা হিসেবে।

কিন্তু বাইবেলে ঈশ্বর আমাদের বলছেন, নরবলি ঘৃণিত ও নিষিদ্ধ। পৌত্তলিক জাতিগুলো নরবলি করে, কাজেই এক ঈশ্বরে বিশ্বাসীরা তা করবে না  (দ্বিতীয় বিবরণ ১২/৩০-৩১; যিরমিয় ১৯/৪-৬; গীতসংহিতা ১০৬/৩৭-৩৮; যিহিষ্কেল ১৬/২০)।

ইহুদিরা কখনোই বিশ্বাস করে না যে, ঈশ্বর নিজে নরবলি নিষিদ্ধ করার পরে নিজেই তাঁর মন পরিবর্তন করে নিজেই তা করার সিদ্ধান্ত নেবেন এবং তাঁর নিজের মানুষ পুত্রকে কোরবানি করবেন এবং বলবেন, ঠিক আছে, পৌত্তলিকরা যেভাবে নরবলিতে বিশ্বাস করে, ঠিক তেমনি এখন থেকে তোমরা মানুষ কোরবানিতে বিশ্বাস কর। এরূপ হতে পারে না; কারণ ঈশ্বর অপরিবর্তনীয় (মালাখি ৩/৬)।[3]

(৪) ইহুদিরা আদিপাপে বিশ্বাস করেন না

খ্রিষ্টধর্মে ‘আদিপাপ’ (Original Sin) বিশ্বাসটা নিম্নরূপ: এদেনের বাগানে আদম ও হাওয়া পাপ করেন, এজন্য মানব সন্তান শুধু পাপের প্রবণতা নিয়েই জন্মগ্রহণ করে তা নয়, বরং প্রত্যেক মানব সন্তান আদম ও হাওয়ার পাপের অপরাধ নিয়ে জন্মগ্রহণ করে। আদম ও হাওয়া তাদের পাপের কারণে পৃথিবীতে মৃত্যু আনয়ন করেন এবং এ পাপের কারণেই সকল মানুষকে মরতে হয়। (দেখুন ১ করিন্থীয় ১৫/২১-২২)।

খ্রিষ্টধর্মের এ বিশ্বাসটা পুরোপুরিভাবেই বাইবেলবিরোধী (unbiblical)। বাইবেলের বক্তব্য এ কথা বলে না যে, পাপের কারণে আদম ও হাওয়াকে এদেনের বাগান থেকে বের করা হয়। লক্ষণীয় যে,আদম-হাওয়ার ফল ভক্ষণকে বাইবেল ‘পাপ’ (sin) বলে আখ্যায়িত করেনি। বাইবেল পাপ বা গুনাহ (sin) শব্দটা প্রথম ব্যবহার করেছে হাবিলের প্রতি কাবিলের ঈর্ষার আলোচনায়। (আদিপুস্তক ৪/৭)। পাপের কারণে নয়, বরং ‘জীবন-গাছ’ (Tree of Life) নামক অন্য গাছের ফল খাওয়া থেকে বিরত রাখতেই আদম ও হাওয়াকে এদেনের বাগান থেকে বের করা হয়। আদম ও হাওয়াকে তো মরণশীল করেই সৃষ্টি করা হয়েছে। সৃষ্টির মুহূর্ত থেকেই মৃত্যু তাদের অস্থিত্বের অবিচ্ছেদ্য অংশ। তারা যেন মরণশীলই থাকেন, জীবন-বৃক্ষর ফল খেয়ে অমর না হয়ে যান সেজন্যই তাদেরকে এদেনের বাগান থেকে বের করা হয়। আদিপুস্তক ৩/২২-২৪ শ্লোকের বক্তব্য এ বিষয়ে সুস্পষ্ট। মানুষ পাপের কারণে মরে না; বরং মানুষ মরে কারণ স্রষ্টা তাকে মরণশীল করে সৃষ্টি করেছেন।[4]

(৫) ঈশ্বর মানুষ হন না এবং মানুষ ঈশ্বর হতে পারে না

ইহুদিরা বিশ্বাস করেন যে, ঈশ্বর ঈশ্বরই এবং মানুষ মানুষই। ঈশ্বর মানুষ হন না বা মানুষ রূপ গ্রহণ করেন না এবং মানুষ ঈশ্বর বা দেবতা হতে পারে না।

সকল পৌত্তলিক-প্রতিমাপূজারী বিশ্বাসের ভিত্তি হল ঈশ্বরের সাথে মানুষকে গুলিয়ে ফেলা: ঈশ্বর মানুষ রূপে প্রকাশিত অথবা মানুষ ঈশ্বরত্ব বা দেবত্ব লাভ করতে পারে বলে মনে করা। পৌত্তলিক বিশ্বাসের বিপরীতে বাইবেল আমাদের শিক্ষা দেয় যে, ঈশ্বর ও মানুষ কখনো সংমিশ্রিত হতে পারে না। ঈশ্বর সুস্পষ্ট ও দ্ব্যর্থহীনভাবে বলছেন: ‘‘আমি আল্লাহ, মানুষ নই।’’ (হোশেয় ১১/৯)।

ঈশ্বর মানুষ হলে বা কোনো মানুষ ঈশ্বরত্ব পেলে তাকে মানবীয় প্রকৃতির কারণে মিথ্যা বলতে হত বা অনুশোচনা করতে হত। ঈশ্বর মানুষ নন বলেই তিনি মিথ্যা বলেন না এবং অনুশোচনা করেন না: ‘‘আল্লাহ মানুষ নন যে মিথ্যা বলবেন, তিনি মানুষের-সন্তান (the Son of Man মনুষ্যপুত্র/ ইবনে আদম/ ইবনুল ইনসান)  নন যে অনুশোচনা করবেন।’’ (শুমারী ২৩/১৯, মো.-১৩)

ইবরাহিম, ইসহাক, যাকোব, সারা রেবেকা, রাহেল, ইউসুফ, মূসা, দাউদ  ও ইহুদি বাইবেলের অন্যান্য সকল মহান ইহুদি ব্যক্তিত্বকে পরিপূর্ণ মানুষ হিসেবেই চিত্রিত করা হয়েছে, ঐশ্বরিক বা দেবতা হিসেবে দেখান হয়নি। বাইবেল এবং ইহুদি জাতির মূল বিশ্বাস হল মানুষ ও ঈশ্বরের মধ্যে পার্থক্যে বিশ্বাস করা। আর মূলধারার খ্রিষ্টানরা বিশ্বাস করেন যে, যীশু ঈশ্বরের ‘আক্ষরিক’ পুত্র, উপরন্তু তিনিই ঈশ্বর। এ বিশ্বাস বাইবেলের সাথে সাংঘর্ষিক।[5]

[1] http://www.whatjewsbelieve.org/explanation1.html
[2] http://www.whatjewsbelieve.org/explanation3.html
[3] http://whatjewsbelieve.org/explanation4.html
[4] http://whatjewsbelieve.org/explanation5.html
[5] http://whatjewsbelieve.org/explanation8.html