প্রটেস্ট্যান্ট বাইবেলের ২৭ নং, ক্যাথলিক বাইবেলের ৩৪ নং ও ইহুদি বাইবেলের ৩৫ নং পুস্তক দানিয়েল। এ পুস্তকে দানিয়েল নবীর অনেক রূপক ও অস্পষ্ট ভবিষ্যদ্বাণী বিদ্যমান, যেগুলোকে বিভিন্নভাবে ব্যাখ্যা করা হয়। এ পুস্তকের কিছু ভবিষ্যদ্বাণীকে মুসলিম গবেষকরা মুহাম্মাদ (ﷺ) বিষয়ক বলে দাবি করেছেন, বিশেষত দানিয়েল পুস্তকের ৭ম অধ্যায়ের কয়েকটা ভবিষ্যদ্বাণী। ভবিষ্যদ্বাণীগুলো বিস্তারিত উল্লেখ করতে অনেক পরিসরের প্রয়োজন। এজন্য এখানে সংক্ষেপে কয়েকটা বিষয় উল্লেখ করছি।
দানিয়েল পুস্তকের সপ্তম অধ্যায়ে দানিয়েল চারটা জন্তু দেখেন (দানিয়েল ৭/৩) এবং এ চারটা জন্তু চারজন বিরাট বাদশাহ, রাজত্ব বা সাম্রাজ্য বলে ব্যাখ্যা দেন (দানিয়েল ৭/১৭)। দানিয়েল চতুর্থ জন্তুটার দশটা শিং দেখেন (দানিয়েল ৭/৭)। এরপর একাদশ শিং উঠতে দেখেন, যেটা তিনটা শিং বিনষ্ট করে (দানিয়েল ৭/৮)।
এরপর তিনি সাদা চুলের একজন বৃদ্ধকে দেখলেন যার সিংহাসনটা ছিল আগুনের শিখার মত: ‘‘আমি দেখতে না দেখতে কয়েকটি সিংহাসন স্থাপিত হল এবং অনেক দিনের বৃদ্ধ উপবিষ্ট হলেন, তাঁর পরিচ্ছদ হিমানীর মত শুক্লবর্ণ এবং তাঁর মাথার চুল বিশুদ্ধ ভেড়ার লোমের মত; তাঁর সিংহাসন আগুনের শিখার মত, তার চাকাগুলো যেন জ্বলন্ত আগুন।’’ (দানিয়েল ৭/৯, মো.-১৩)
এরপর তিনি মানব-সন্তানের মত একজনকে দেখেন: ‘‘আমি রাতের বেলায় দর্শনে দৃষ্টিপাত করলাম, আর দেখ, আসমানের মেঘ সহকারে ইবনুল-ইনসানের (ইংরেজি: the Son of man কেরি: মনুষ্যপুত্রের, মো.-০৬: ইবনে আদমের) মত এক পুরুষ আসলেন, তিনি সেই বৃদ্ধের কাছে উপস্থিত হলেন, তাঁর সম্মুখে তাঁকে আনা হল। আর তাঁকে কর্তৃত্ব, মহিমা ও রাজত্ব দেওয়া হল; লোকবৃন্দ, জাতি ও ভাষাবাদীকে তাঁর সেবা করতে হবে; তাঁর কর্তৃত্ব অনন্তকালীন কর্তৃত্ব, তা লোপ পাবে না এবং তাঁর রাজ্য বিনষ্ট হবে না।’’ (দানিয়েল ৭/১৩-১৪, মো.-১৩)
চতুর্থ জন্তু ও শিংগুলোর ব্যাখ্যায় দানিয়েল লেখেছেন: ‘‘তিনি এরকম কথা বললেন, ঐ চতুর্থ জন্তু দুনিয়ার চতুর্থ রাজ্য; সেই রাজ্য অন্য সকল রাজ্য থেকে ভিন্ন হবে এবং সমস্ত দুনিয়াকে গ্রাস, মাড়াই ও চূর্ণ করবে। আর তার দশটি শিংএর তাৎপর্য; ঐ রাজ্য থেকে দশজন বাদশাহ উৎপন্ন হবে। তাদের পরে আর একজন উঠবে, সে পূর্ববর্তী বাদশাহদের থেকে ভিন্ন হবে এবং তিন বাদশাহকে নিপাত করবে। সে সর্বশক্তিমানের বিপরীতে কথা বলবে, সর্বশক্তিমানের পবিত্রগণের উপর জুলুম করবে এবং নিরূপিত কাল ও শরীয়তের পরিবর্তন করতে মনস্থ করবে এবং এক কাল, দুই কাল ও অর্ধেক কাল পর্যন্ত তাদের তার হাতে তুলে দেওয়া হবে। পরে বিচার বসবে, তার কর্তৃত্ব তার কাছ থেকে নিয়ে নেওয়া হবে, শেষ পর্যন্ত তার ক্ষয় ও বিনাশ করা যাবে। আর রাজত্ব, কর্তৃত্ব ও সমস্ত আসমানের অধঃস্থিত রাজ্যের মহিমা সর্বশক্তিমানের পবিত্র লোকদের দেওয়া হবে; তার রাজ্য অনন্তকাল স্থায়ী রাজ্য এবং সমস্ত কর্তৃত্ব তাঁর সেবা করবে ও তাঁর বাধ্য হবে।’’ (দানিয়েল ৭/২৩-২৭, মো.-১৩)
মুসলিম গবেষকরা চতুর্থ সাম্রাজ্য হিসেবে রোমান সাম্রাজ্যকে চিহ্নিত করেছেন। তার দশটা শিং দশজন রোমান সম্রাট যারা যীশু খ্রিষ্টের অনুসারীদের নির্যাতনের জন্য ঐতিহাসিকদের নিকট প্রসিদ্ধ। তারা হলেন: নিরো (Nero), ডোমিটিয়ান (Domitian), ট্রাজন (Trajan), মারকাস অরেলিয়াস (Marcus Aurelius), সেপ্টিমিয়াস সিভেরাস (Septimius Severus), ম্যাক্সিমিনাস (Maximinus), ডেসিয়াস (Decius), ভ্যালেরিয়ান (Valerian), অরেলিয়ান (Aurelian) ও ডায়োক্লেটিয়ান (Diocletian)।
একাদশ শিং হলো রোমান সম্রাট প্রথম কন্সটান্টাইন (Constantine I)। একাদশ শিং যে তিনটা শিং বিনষ্ট করে তারা হলেন কন্সটান্টাইন কর্তৃক পরাভূত তিন রোমান সম্রাট: লিসিনিয়াস (Licinius), ম্যাক্সেনটিয়াস (Maxentius) ও ম্যাক্সিমিয়ান (Maximian)। কন্সটান্টাইন এদেরকে পরাজিত করেন।
সম্রাট কন্সটান্টাইনের সময়ে ৩২৫ খ্রিষ্টাব্দে নাইসীন ধর্মবিশ্বাস (Nicene Creed) উদ্ভাবন করা হয় এবং মূসার শরীয়ত ও একত্ববাদী বিশ্বাস পরিবর্তনের ব্যবস্থা করা হয়। পরবর্তী প্রায় সাড়ে তিন শত বছর নাইসীন খ্রিষ্টানরা রোমান সম্রাটদের ছত্রছায়ায় আরিয়ান (Arians) ও অন্যান্য একত্ববাদী খ্রিষ্টানদের উপর নীপিড়ন চালাতে থাকেন। এরপর মুহাম্মাদ (ﷺ)-এর আগমন হয় এবং ইসলামের রাজত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়।
‘মানব সন্তান, ইবনুল ইনসান বা ইবনে আদমের মত’ যাকে দানিয়েল দেখলেন তিনি মুহাম্মাদ (ﷺ)। মুসলিমরা এটাকে মুহাম্মাদ (ﷺ)-এর মিরাজ বিষয়ক ভবিষ্যদ্বাণী বলে গণ্য করেছেন।[1]